অরোনী, তোমার জন্য~১৪
লিখা- Sidratul Muntaz
বদ্ধ ঘরে দীপ্তি সশব্দে রুবায়েতের গালে চড় মারল। রুবায়েত হতচকিত দৃষ্টিতে বলল,” আপা তুমিও?”
দীপ্তির ক্রোধানলে পুড়ছে। রাগে খিটমিট করে বলল,” এতোবড় স্পর্ধা তোর কিভাবে হলো? একবারও আমার মান-সম্মানের কথা চিন্তা করলি না? ফাজিল, লাফরাঙ্গা!”
রুবায়েত কোনো উত্তর দিল না৷ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে। দেখলে মনে হবে সে ড্রাগস নিয়ে নেশায় টাল-মাটাল। এই জগতের কোনো ধ্যান-ধারণা তার মাঝে নেই। দীপ্তি ক্রমাগত পায়চারী করতে লাগল। লিভিংরুমে এখন পারিবারিক তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। সেই সুযোগে দীপ্তি রুবায়েতকে নিয়ে নিজের বেডরুমে চলে এসেছে। ওখানে থাকলে আরও মার খেতো সে।
দীপ্তির নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আগে যেখানে দেবর-ননদেরা মুখে হাসি ছাড়া দীপ্তির সঙ্গে কথা বলতো না তারাই আজ কেমন বক্র দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল। রাফাত তো রীতিমতো দীপ্তিকে সবার সামনেই বিনা ডিটারজেন্টে ধুঁয়ে দিয়েছে। কারো সামনে মাথা তুলে তাকানোর উপায়টুকুও নেই৷ এই বাড়িতে আর থাকা সম্ভব না তার পক্ষে। সবার অসম্মানের ব্যাক্তি হয়ে দীপ্তি এখানে থাকতে চায় না। দীপ্তি চেঁচিয়ে বলল,” তোর জন্য রুবায়েত, তোর অসভ্যতামির জন্য আজকে আমার এই শোচনীয় অবস্থা। সবার মাথা হেঁট করে দিলি তুই। তোর কোনোদিন ভালো হবে না দেখিস।”
দীপ্তি কাঁদতে লাগল হাউমাউ করে। আপার কান্না দেখেও রুবায়েতের মধ্যে কোনো হেল-দোল দেখা যাচ্ছে না। সে নিজস্ব ঘোরে আটকে থেকেই বলল,” আপা, আমি অরোনীকে বিয়ে করতে চাই।”
কথাটা শুনে দীপ্তির চোখ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠল। কাছে এসে রুবায়েতকে একাধারে আরও দু-একটা চড় দিয়ে বলল,” তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। টোটালি ইনসেন তুই৷ তোর ট্রিটমেন্ট দরকার। আল্লাহ, এ কেমন বিপদে ফেললে তুমি? তোর মতো কুলাঙ্গার ভাই আর কারো না হোক।”
রাহাত ঘরে ঢুকেই বলল,” অনেক কষ্ট করে মাকে ম্যানেজ করেছি। নাহলে আজকেই আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে হতো।”
দীপ্তি বিস্ফোরিত গলায় বলল,” তোমার কিভাবে মনে হলো যে এতোকিছুর পরেও আমি এই বাড়িতে থাকবো? রাফাত আমাকে কি অপমানটাই না করল সকলের সামনে। সে যদি এসে আমার পায়ে ধরে পড়ে থাকে তাও আমি এখানে থাকবো না।”
” রাফাত জীবনেও তোমার পায়ে ধরবে না। সেই আশা করেও লাভ নেই। কিন্তু এখানে না থাকলে তো সমস্যা হয়ে যাবে। এমনিই বাড়ির সাথে আমার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে।”
” তাহলে তুমি থাকো তোমার বাড়ি নিয়ে। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। আমি তোমাদের সবার সাথে এখানে অবহেলার পাত্রী হয়ে থাকতে পারবো না। আমার এখনি দমবন্ধ লাগছে। আমার এতোদিনের সব মান-সম্মান ধুঁলোয় মিশে গেল।”
রাহাত আঁড়চোখে রুবায়েতের দিকে চেয়ে বিড়বিড় করে বলল,” এমন ভাই যার থাকে, তার মান-সম্মান ধুঁলোয় মিশবে না তো কি?”
দীপ্তি রুবায়েতের কাছে গিয়ে রোষপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” বের হো তুই এখান থেকে। আমার চোখের সামনে আর কোনোদিন আসবি না।”
রুবায়েত নমনীয় গলায় বলল,” আপা অরোনী..”
” চুপ। একদম চুপ। আরেকবার অরোনীর নাম উচ্চারণ করলে আমি তোকে গলা টিপে মারবো।”
বিকট শব্দ হলো। হুট করেই দীপ্তিদের শোবার ঘরে ঢুকে পড়েছে রাফাত। রুবায়েতকে দেখেই মেজাজটা তার সপ্তম আসমানে উঠে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” এই স্কাউন্ড্রেল এখনও যায়নি কেন?”
রাহাত দুইহাতে রাফাতকে আটকাতে চেষ্টা করল। কিন্তু সম্ভব হলো না। রাফাত সর্বোচ্চ হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল রুবায়েতের উপর। তার পরনের ডেনিম জ্যাকেট প্রায় টেনে-টুনে ছিড়ে ফেলল। ধাক্কা মারতে মারতে বলল,” বের হো, আমার বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন তোকে আর না দেখি।”
দীপ্তি কাঁদতে কাঁদতে বলল,” রাফাত প্লিজ, ও এমনিই চলে যাবে। তোমার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
রাফাত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দীপ্তির দিকে তাকালো। দীপ্তি তখনি মাথা নিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করা ছাড়া তার আজ অন্যকোনো উপায় নেই। আজ তার মাথা নিচু করার দিন।
” কেউ যদি অরোনীর কাছেও আসে আমি তার মাথা ফাটিয়ে দিবো।”
তানজিমা আর নিলিমা ভয়ে দৌড়ে পালালো। সন্ধ্যায় তারা গিয়েছিল অরোনীর সাথে সকালের দূর্ঘটনার ব্যাপারে কথা বলতে। কিন্তু রাফাত কাউকেই অরোনীর কাছে ঘেষতে দিচ্ছে না। শীলা চাচীকে পর্যন্ত তাড়িয়ে দিয়েছে। সেখানে তানজিমা আর নিলিমা তো কোন ছাড়! এই মাত্র মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুমকি শুনে তারা দৌড়ে নিচে চলে এলো।
নিচতলায় একটা গেস্টরুমের মতো আছে। এখানে বুকশেল্ফ দিয়ে ভর্তি। তাহসিন বসে বসে বই পড়ে। এখনও সে বই পড়ছে। তানজিমা আর নিলিমার উপস্থিতি লক্ষ্য করে একবার মাথা তুলে তাকাল। তারপর আবার বইয়ে মনোযোগ দিল। চশমা চোখের ছেলে তাহসিন খুবই কিউট। তাকে বাড়ির সবাই ডাকে,” গুড বয়।” কারণ পড়াশুনা ছাড়া অন্যকোনো কাজ তাকে করতে দেখা যায় না। ছেলেটা কোনো দুষ্টুমীতেও থাকে না। তবে মাঝে মাঝে বুদ্ধিমানের মতো বুদ্ধি করে দু-একটা কথা বলে। তার সেই কথাগুলো খুব কাজে লাগে। তানজিমা আর নিলিমা তাহসিনের সামনে বসেই ফিসফিসিয়ে আলাপ করছিল। তাদের আলোচ্য বিষয় অরোনী।
” অরোনীর অবস্থা খুবই খারাপ। সারাদিন একবারও ঘর থেকে বের হয়নি। আর ওই দূর্ঘটনার পর সে পুরো চল্লিশ মিনিট লাগিয়ে গোসল করেছে। খুব অদ্ভুত তাই না?”
তানজিমার কথার উত্তরে নিলিমা বলল,” অদ্ভুত তো বটেই। কিন্তু ছোটভাবীর শুচিবায়ু রোগ আছে। তাই মনে হয় গোসল করেছিল।”
তানজিমা মাথা নেড়ে বলল,” উহুম। আমার মনে হয় যথেষ্ট খারাপ কিছু হয়েছে। নাহলে অরোনী এতোক্ষণ লাগিয়ে গোসল করবে কেন? ওইসময় কারো গোসল করার মতো অবস্থা থাকে?”
নিলিমা একটু ভেবে বলল,” ধূর, কিভাবে যে আসল ঘটনা জানবো! ছোটভাইয়া তো ভাবীর কাছে যেতে কাউকে এলাউ করছে না। আচ্ছা, ছোটভাইয়া এমন করছে কেন?”
তাহসিনের থেকে উত্তর এলো,” এইসময় ছোটভাবী খুবই মানসিক ফ্রাস্ট্রেশনে ভুগছে। সবাই মিলে যদি তাকে এই ব্যাপারে একাধারে প্রশ্ন করে তাহলে সে আরও বেশি ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাবে। ঘটনাটা ভুলতেও তার সময় বেশি লাগবে। তার মানসিক অবস্থা এখন খুবই খারাপ।
শারীরিকভাবে সে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিন্তু মেন্টালি অনেক বেশি ড্যামেজ হয়ে গেছে। এই ব্যাপারটা আমরা কেউ বুঝতে চাইছি না। কিন্তু ছোটভাইয়া খুব ভালো মতো বুঝতে পারছেন। আফটার অল, দে আর সৌলমেইটস। ব্যাসিকেলি ছোটভাবীর মেন্টাল হেলথের কথা চিন্তা করেই ছোটভাইয়া তাকে সবার থেকে আলাদা করে রাখছে। এইসময় একটা মেয়ের জন্য মেন্টাল সাপোর্ট আর স্পেস খুব দরকার।”
তাহসিন বইয়ের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছে। মনে হলো যেন বই পড়েই বলছে। নিলি আর তানজু কিছুক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে রইল। একটু পর তানজু বলল,” ঘোড়ার আন্ডা। এতো ঢং নিয়ে কে বসে আছে? বউয়ের চিন্তায় ছোটভাইয়ের মাথা খারাপ হয়ে গেছে তাই সে এমন করছে।”
তানজু কথা শেষ করে হাসতে লাগল। নিলি বলল,” আচ্ছা তাহসিন, তুই সবসময় এমন জ্ঞানীদের মতো কথা বলিস কেন?”
উর্মি এসে উত্তর দিল,” যে সারাক্ষণ বই পড়ে সে-ই তো জ্ঞানীদের মতো কথা বলবে। এটা খুব স্বাভাবিক। তোমাদের মতো কূটনীরা তো আর জ্ঞানীদের মতো কথা বলবে না তাই না?”
তানজু চোখ পাকিয়ে বলল,” কে কূটনী?”
উর্মি নির্বিকার গলায় বলল,” তুমি, রুমাপু, নিলিপু। তোমাদের কূটনীতির সর্দার হলো রুমাপু। ওহ বাই দ্যা ওয়ে, আজ তোমাদের সর্দারনি কোথায়?”
নিলিমা আক্ষেপ করে বলল,
” সে রুবায়েত ভাইয়ের শোকে কাতর হয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে কাঁদছে।”
” কেন?”
” রুবায়েত ভাইয়ের সাথে তার বিয়ের কথা চলছিল না? এখন এই ঘটনার পর বিয়েটা কি আর হবে?”
উর্মি হাসতে হাসতে বলল,” বুঝলাম। এখনও কি তার বিয়ে করার স্বাদ মেটেনি?”
নিলিমাও খিলখিলিয়ে হেসে বলল,” না। এখনও মেটেনি।”
” ওকে দীপ্তি ভাবীর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া উচিৎ। দু’জনে একসাথে গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদুক।”
” ঠিক বলেছিস। আজ তাদের দু’জনেরই কাঁদার দিন। একজনের ভাই, অন্যজনের হবু বর আর কখনও এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না।”
তানজিমা তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” তোদের কি মনে হয়? সত্যিই আর কখনও রুবায়েত ভাই এই বাড়িতে আসবে না? অবশ্যই আসবে। রুমা কালকেই ফোন করে কেঁদে কেটে ওকে নিয়ে আসবে দেখবি।”
উর্মি সুর টেনে বলল,
” এতো সহজ না! ও আরেকবার এই বাড়িতে ঢুকলে ছোটভাই ওর ঠ্যাঙ ভেঙে দিবে। বলেছে আমাকে।”
তানজু সুযোগসন্ধানীর মতো বলল,
” আর যখন ছোটভাইয়া অফিসে চলে যাবে তখন?”
নিলি কিছু একটা ভেবে বলল,” একটা আইডিয়া পেয়েছি। কাল যখন ছোটভাইয়া অফিসে চলে যাবে তখন আমরা ছোটভাবীর ঘরে উর্মিকে পাঠাবো।”
তানজু বলল,” ভালো বলেছিস। এটা করা যেতে পারে।”
উর্মি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,” আমাকে কেন? হোয়াই মি?”
তানজু মাথা দুলিয়ে বলল,
” আরে তোর সাথেই তো ছোটভাবীর ভালো সম্পর্ক। তুই সবকিছু ডিটেলস জেনে আসবি৷ রুবায়েত ভাই তার সাথে কি কি করেছে, কেন করেছে.. এসব।”
উর্মি মুখ কুচকে বলল,” ছি, তোমরা এসব জানার জন্য বসে আছো? এজন্যই ছোটভাইয়া তোমাদের ঘরে ঢুকতে দেয়নি। একেবারে ঠিক হয়েছে।”
তানজু আর নিলি রাগে চোখাচোখি করল। তানজু বলল,” তোকে মনে হয় খুব ঢুকতে দিয়েছে?”
” আমাকেও দেয়নি অবশ্য। কিন্তু তোমাদের মতো ধমক দেয়নি। আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে।”
তানজু সরু চোখে জিজ্ঞেস করল,” কি বুঝিয়ে বলেছে?
” ছোটভাইয়া বলেছে, এখন তো ছোটভাবীর মন ভালো নেই৷ একটা খারাপ ব্যাপার ঘটে গেছে। বাড়ির সবার মধ্যে কথাটা জানাজানি হয়েছে। তাই সে এখন সবার সামনে আসতে লজ্জা পাচ্ছে। কথা বলতেও তার অস্বস্তি লাগছে। আস্তে আস্তে যখন সে সহজ হয়ে উঠবে তখন নিজেই আমাকে ডেকে দেখা করিয়ে দিবে ভাবীর সাথে। এভাবেই বলেছে ভাইয়া।”
নিলি বলল,” তাহলে তো তাহসিনের কথাগুলোই ঠিক।”
উর্মি মাথা নেড়ে বলল,” হুম। একদম ঠিক।”
অরোনী সারাদিন ধরে কিছু খায়নি। পুতুলের মতো থম মেরে বসে থেকেছে। রাফাত এইমাত্র জোর করে ভাত খাইয়ে দিল। তাও অর্ধেক খাওয়ার পর অরোনী বলল,খাবে না। রাফাত খাবার রেখে দিল। অরোনীকে শুয়ে পড়ার জন্য বিছানা করে দিল। অরোনী রাফাতের হাত ধরে আছে। রাফাত কিছুক্ষণ মায়ার দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল,” চুমু দেই?”
অরোনী মাথা নেড়ে অনুমতি দিল। রাফাত অরোনীর দুইগালে সময় নিয়ে দু’টো আদুরে চুমু দিল। তারপর তাকাতেই দেখল অরোনীর চোখে পানি। রাফাতের গলা জড়িয়ে ধরে শব্দ করে কেঁদে ফেলল অরোনী। রাফাত তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” থাক, কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে গেছে। মনে করো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছো।”
দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। রাফাত গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কে?”
রিতুর কণ্ঠ শোনা গেল,” ছোটভাইয়া আমি।”
রাফাত অরোনীর দিকে চেয়ে বলল,” রিতু এসেছে। দরজা কি খুলবো?”
অরোনী মাথা নেড়ে বোঝালো,” হ্যাঁ।”
রাফাত গিয়ে দরজা খুলল। রিতু একবার অরোনীর দিকে তাকিয়ে বলল,” আজকে ছোটভাবীর সাথে আমি থাকি?”
রাফাত অরোনীর দিকে চাইল। অরোনী মাথা হেলিয়ে রাজি হয়ে গেল। রাফাত রিতুর কাঁধে হাত রেখে বলল,” ঠিকাছে, তোরা দু’জন তাহলে এখানে থাক। আমি ড্রয়িংরুমে শুয়ে পড়ছি।”
রিতু হেসে বলল,” আইচ্ছা।” তারপর সে অরোনীর কাছে বিছানায় গিয়ে বসল। অরোনী কেবল মাত্র রিতুর সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারছে। এছাড়া বাড়ির অন্যকারো সামনেও যেতে চাইছে না। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে অনেকদিন বিষণ্ণতায় ভুগতে হবে মেয়েটাকে। রাফাত এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে! নিজের বাড়িতেও সে অরোনীকে নিরাপত্তা দিতে পারল না। কতবড় বিপদ ঘটে গেল। কাল থেকে তো অফিসে যেতেও ভয় লাগবে।
রাবেয়া দুইতলায় এসে দেখলেন রাফাত সোফায় শুয়ে আছে। রাবেয়া কাছে এসে বললেন,” কিরে, তুই এখানে কেন? বউমা কি ঘরে একা?”
রাফাত উঠে বসতে বসতে বলল, ” একা না। রিতুও আছে ওর সাথে। তুমি কিছু বলবে মা?”
” হ্যাঁ। আমি এসেছিলাম একটু বউমার সাথে কথা বলতে।”
” অরোনী এখন কারো সাথে কথা বলতে পারবে না।”
” কেন? কথা না বলার মতো কি হয়েছে? এইখানে তো তার দোষ নেই। তাহলে কথা বলবে না কেন?”
” ব্যাপারটা দোষের না। তুমি বুঝবে না। কেন এসেছো আমাকে বলো।”
” তোকে কি সব কথা বলা যায় নাকি? এইসব মেয়েলী ব্যাপার।”
” কি এমন মেয়েলী ব্যাপার যা ছেলে হয়ে আমি বুঝবো না?”
” বুঝবি।কিন্তু…”
” বলে ফেলোতো মা।”
” রুবায়েতের সাথে তুই আজকে যা করলি সেটা কি ঠিক হলো? মেরেছিস আবার ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিস। এতো অপমান না করলেও চলতো।”
” তুমি কি এটা বলার জন্য এসেছো?”
” না। আরও কথা আছে। এই ছেলের সাথে তো রুমার বিয়ে ঠিক করেছিলাম।”
রাফাত বিস্মিত হয়ে বলল,” হোয়াট? রুমার বিয়ে? তাও ওই স্কাউন্ড্রেলের সাথে?”
“পাত্র হিসেবে রুবায়েত ভালোই ছিল। বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, ভালো ফ্যামিলি আছে, দেখতেও সুন্দর। আবার দীপ্তির কাজিন। ভেবেছিলাম সবদিক দিয়ে ভালোই হবে। কিন্তু কে জানতো ছেলের চরিত্র যে এতো খারাপ! আমি এই ব্যাপারেই অরোনীর সাথে একটু কথা বলতাম।”
” এই ব্যাপারে অরোনীর সাথে আবার কি কথা?”
রাবেয়া ইতি-উতি করে বললেন,” আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে রুবায়েত আসলেই মজা করেছিল। ভাবী হিসেবে মজা তো করতেই পারে। অরোনীই ভুল-ভাল ভেবে এতোকিছু করে ফেলেছে। ছেলেটার মনে হয় দোষও নেই। অকারণে বেচারা মার খেল। সে কিন্তু একবারও স্বীকার করেনি।”
” চোর কি জীবনে স্বীকার করে যে সে চুরি করেছে? আর তুমি অরোনীর অবস্থা দেখতে পাচ্ছো না মা? মেয়েটার মধ্যে ভয়ংকর পরিবর্তন এসে গেছে। আজকে সারাদিন ও একবারও হাসেনি। কথাও বলছে না ঠিকমতো। একটু পর পর কাঁদছে। সামান্য ঘটনা হলে কি সে এমন করতো?”
রাবেয়া চোখ বড় করে বললেন,” বলিস কি? না জানি কতবড় সর্বনাশ হয়ে গেছে! এটা তো এই বাড়ির মান-সম্মানের প্রশ্ন। আমার এখনি অরোনীর সাথে কথা বলতে হবে।”
” অসম্ভব। তুমি অরোনীর সাথে এই বিষয় নিয়ে একটা কথাও বলবে না।”
” কেন বলবো না? পরিষ্কার করে জানতে হবে না কি হয়েছিল?”
” এটা পরিষ্কার করে জানার মতো বিষয় না মা। জানার থেকেও বেশি ইম্পোর্ট্যান্ট অরোনীর ভুলে থাকা এবং ভালো থাকা। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এটা আর বললেও ফিরে আসবে না। কিন্তু বার-বার এই বাজে বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন তুললে অরোনী আরও হতাশাগ্রস্ত হবে। সে তো এই খারাপ স্মৃতিটা এমনিই ভুলতে পারছে না। তার উপর তোমরা এভাবে উঠে-পরে লাগলে সে কিছুতেই ভুলতে পারবে না।
এরপর যদি উল্টা-পাল্টা কিছু করে ফেলে মেয়েটা? আমি ওকে নিয়ে যতটা ভয়ে আছি সেটা তোমাকে বলে বোঝানো সম্ভব না। প্লিজ মা, অরোনীকে একটু স্পেস দাও। একটু নিজের মতো থাকতে দাও ওকে। প্রশ্ন করার জন্য অনেক সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু অরোনীর কিছু হয়ে গেলে সেটা আর ঠিক করা যাবে না।”
রাবেয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,” ঠিকাছে। আমি আর আসবো না। ওকে কোনো প্রশ্নও করবো না। হয়েছে?”
রাবেয়া এই কথা বলেই চলে গেলেন। কিন্তু রাফাত নিশ্চিন্ত হতে পারল না। সে জানে, কাল সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই আবার সবাই হামলে পড়বে অরোনীর উপর। তাকে হাজারটা প্রশ্ন করে মাথাখারাপ করে ফেলবে। রাফাত এভাবে কতক্ষণ সবাইকে পাহারা দিয়ে আটকে রাখতে পারবে কে জানে?
চলবে
( আচ্ছা, আমি কথাটা শুধু তাদের জন্য বলছি যাদের মনে হচ্ছে এখানে খুব মেলোড্রামা দেখানো হয়েছে। যারা এই ঘটনাগুলো দেখে অবাক হচ্ছে তাদের কাছে প্রশ্ন, বাস্তবে কি তারা কখনও ঝামেলায় পড়েনি? এইরকম ভয়াবহ ঝগড়া আর ড্রামা কি কারো বাড়িতে হয়নি? যদি না হয় তাহলে বলবো আপনি খুব লাকি। এটা তো আমি অন্য পরিবারের গল্প লিখছি। তাও মানুষের মনে হচ্ছে সিরিয়াল। যদি নিজের পরিবারের গল্প লেখা শুরু করি তাহলে মনে হয় সবাই ভাববে আধুনিক রূপকথা। যাইহোক, মানুষের জীবন অনেক বৈচিত্র্যময়। অনেক বড় জীবনের পরিসর। আর এই গল্পটা জীবনের গল্পই। যদিও সবার অনেক নাটকীয় মনে হচ্ছে। এটা হয়তো আমার লেখার দোষ। আমিই সাজিয়ে ঘটনাগুলো লিখতে পারছি না। তাই কারো বাস্তবিক লাগছে না। সেজন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কিন্তু কেউ এটা ভাববেন না যে আমি ইচ্ছে করে ঘটনা লম্বা করছি। বরং এতোবড় ঘটনাকে আমি ছোট বানিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থাপন করছি। যাতে অন্তত পরিস্থিতিগুলো পাঠকদের উপলব্ধি হয়।)