# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ২৮
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- ২৮
________________
দিনটা শনিবার, অফিস ছুটি। বিছানায় কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে আছে সাদাফ। সকাল সকাল আকাশে ভীষণ মেঘ করেছে আজ। বৈশাখের প্রথম দিনেই প্রকৃতির কালবৈশাখী রূপ। সিলিং ফ্যানটা দ্রুত ঘুরছে। চারপাশটায় চাপা ঠান্ডা ভাব। মাঝরাত পর্যন্ত ফোনে কথা বলায় ঘুমের রেশটা এখনও কাটে নি সাদাফের। শরীরটা কেমন ম্যাচম্যাচ করছে। তার সাথে মাথাটাও কেমন ভারি ভারি ঠেকছে। মাথার ভিতর দিকটাই একধরনের নীরব ব্যাথা ধপধপ করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়ে চলেছে সেই ভোররাত থেকে। সাদাফ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে পাশ ফিরে শুলো। প্রায় সাথে সাথেই কোকিলের মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এলো কানে। দু’বারের মাথায় কাঁথা সরিয়ে সচেতন চোখে তাকালো সাদাফ। নিজের অজান্তেই কপালটা খানিক কুঁচকে এলো। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে বসলো সাদাফ। বালিশের পাশে থাকা ফোনটা তুলে নিয়ে সময় দেখলো —- ৭ঃ২০। বিছানা থেকে নেমে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার সময়টুকুতে একটা কথায় মনে করার চেষ্টা করলো সাদাফ, ‘এতো সকালে কারো কি আসার কথা ছিলো আজ?’ কুঞ্চিত কপালে দরজাটা খুলতেই বিস্মিত হলো সাদাফ। কুঁচকানো কপাল সিথিল হয়ে এলো মুহূর্তেই। বিরক্তিটা উবে গিয়ে চোখে-মুখে ফুটে উঠলো নিদারুন ভালো লাগা আর কৌতূহল। সাদাফকে এভাবে অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে লাজুক হাসলো ওপাশের মানুষটি। হাস্যোজ্জল কন্ঠে বললো,
—-” শুভ নববর্ষ।”
শুভ্রতার হালকা কন্ঠে বলা কথায় আরো একদফা মোহগ্রস্ত হলো সাদাফ। শুভ্রতার গায়ের লাল টকটকে শাড়ি, লাল ঠোঁট, মুক্তোর মতো ছোট্ট নাকফুল, হাতভরা চুড়ি সব মিলিয়ে যেন সদ্য বিবাহিত রমনী। শুভ্রতার ওষ্ঠ জোড়া আরো একদফা নড়ে ওঠায় সচেতন হলো সাদাফ। বিমোহিত মানুষের মতো দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো সে। শুভ্রতা নিঃসংকোচ পদযুগলে ভেতরে প্রবেশ করতেই শুভ্রতার পায়ের দিকে নজর গেলো সাদাফের। কাঁচা হলুদ রঙা পায়ে টকটকে লাল আলতা লাগিয়েছে শুভ্রতা।
হাঁটার তালে তালে বাজছে রূপোর ভারি নুপুর। শুভ্রতা কৌতূহলী মনে ঘরের এদিকে ওদিক ঘুরে বেড়ালেও, সাদাফ আগের জায়গাটাতেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। বিস্মিয়টা কিছুতেই কমছে না তার। তারওপর শুভ্রতার এমন নববধূ সাজ! সাদাফ এমন অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকলেও শুভ্রতা দ্বিধাহীন। শুভ্রতার চালচলন দেখে মনে হচ্ছে, এই ঘরটা তার বহুকালের চেনা। দীর্ঘদিন বাপের বাড়িতে থেকে হুট করেই স্বামীর ঘরে আসায় ঘরদোরটা একটু অগোছালো হয়ে আছে মাত্র। বাকিসব তার হাতেই সাজানো…তার মায়াতেই গড়া। শুভ্রতা খাবার টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো। বিজ্ঞ গৃহিণীর মতো বললো,
—-” বাসায় বাজার টাজার কিছু আছে? অনেক বেলা হলো, রাঁধতে হবে তো!”
শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে হালকা হাসলো সাদাফ। শুভ্রতা আজ দু’হাত ভরে মেহেদী পড়েছে। ফর্সা হাতে মেহেদীর রঙটা বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর লাগছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই ছোট্ট করে উত্তর দিলো সাদাফ,
—-” থাকার তো কথা।”
কয়েক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে সাদাফের দিকে তাকালো শুভ্রতা। খোলা চুলগুলো হাত খোপা করতে করতে এদিক ওদিক তাকালো। বড় বড় চোখদুটো মেলে বললো,
—-” রান্নাঘর?”
সাদাফ হাসলো। হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে চোখের ইশারায় রান্নাঘর দেখালো। শুভ্রতা মিষ্টি হেসে সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,
—-” দরজার বাইরে একটা ব্যাগ রেখে এসেছি। নিয়ে আসো না প্লিজ।”
সাদাফ ভ্রু কুঁচকে বললো,
—-” ব্যাগ? ব্যাগ কেন? তুমি কি একেবারে চলে এসেছো শুভ্রা?”
শুভ্রতা উত্তর দিলো না। সাদাফ দ্রুত পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। দরজার সামনেই মাঝারি সাইজের পাটের ব্যাগ। শুভ্রতাকে খেয়াল করতে গিয়ে ব্যাগটার ওপর একদমই নজর পড়ে নি সাদাফের। সাদাফ দ্রুত হাতে ব্যাগটা তুলে নিলো। দরজাটা লাগিয়ে ব্যাগে উঁকি দিতে দিতে বললো,
—-” তুমি আসার পথে বাজার করেছো নাকি শুভ্রা? এসবের কি দরকার ছিলো? আমাকে বলে রাখলেই তো হতো।”
কথাটা শেষ করে রান্না ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সাদাফ। বাজারের ব্যাগটা চুলোর পাশে কেবিনেটের ওপর রাখতেই মুখ ফুলিয়ে বলে উঠলো শুভ্রতা,
—-” বলে রাখলে কি অবাক হতে? তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই এতোকিছু করলাম। কিন্তু তুমি তো দিব্যি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছো। তোমার জায়গায় আমি হলে তো ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাক করে ফেলতাম।”
সাদাফ হেসে ফেললো। অবাক সে যথার্থই হয়েছিলো৷ এমনকি তার বিস্ময়ভাবটা পুরোপুরি কাটে নি এখনও। শুভ্রতাকে এই রূপে দেখে বুকটা ঢুপঢাপ ঢোল পিটিয়ে চলেছে সেই কখন থেকে। হাত-পায়ে মৃদু কম্পনও টের পাচ্ছে সে। কিন্তু সবকিছুই হচ্ছে শুভ্রতার দৃষ্টির বাইরে। সাদাফের বাসায় শুভ্রতার প্রথম আগমনটা যে এমন নাটকীয় হতে পারে তা যেন কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি সাদাফ। কিন্তু সমস্যা হলো, সাদাফের বিস্ময় বা রাগ কোনোকিছুই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশ পায় না। অতিরিক্ত বিস্ময়ে শীতল হয়ে আসে তার দৃষ্টি। একদমই নীরব হয়ে যায় তার আচরণ। যেমনটা হয়েছিলো মুরংদের গ্রামে অর্পনের মেয়ে ঘটিত ব্যাপারটা শোনার পর। সেদিনও বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো সে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়।
শুভ্রতা বাজারের ব্যাগ থেকে এটা ওটা বের করছে। কাজলটানা চোখ দুটোর দু’পাশে পড়ে আছে দুই গাছি স্নিগ্ধ চুল। সাদাফ ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। শুভ্রতার স্নিগ্ধ কোমল গালদুটোকে ছোঁয়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছে জাগছে তার। অভিমানে ফুলিয়ে রাখা ওষ্ঠদ্বয়ও কি ভীষণ টানছে তাকে। নিজেকে হঠাৎ করেই কেমন পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। সামনে দাঁড়ানো নববধূবেশী মেয়েটা সত্যিই তার বিবাহিত স্ত্রী ভাবতেই বুকে অদ্ভুত এক মায়া উপচে পড়ছে। পৃথিবীটাকে, এই জীবনটা এবং এই মেয়েটাকে নিদারুণ সুন্দর এবং প্রশান্তির বলে বোধ হচ্ছে। আপ্লুত গলায় বলতে ইচ্ছে করছে, “শুনো মেয়ে, আমার পৃথিবীটা আমি তোমার নামে লিখে দেবো। আমার সব সুখ আর হাসিগুলোকে তোমার নামেই উড়িয়ে দেবো। তার পরিবর্তে একগুচ্ছ প্রশান্তির অনলে আমায় জ্বালিয়ে দিও প্লিজ।”
—-” কতক্ষণ আছো?”
সাদাফের প্রশ্নে চোখ তুলে তাকালো শুভ্রতা। অভিমানী গলায় বললো,
—-” এটা আমার বরের বাসা। আমি যতক্ষণ ইচ্ছে থাকতে পারি। আপনার কোনো সমস্যা?”
সাদাফ মৃদু হেসে বললো,
—-” জ্বী না। আমার কোনো সমস্যা নেই।”
শুভ্রতা কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
—-” সমস্যা না থাকলে এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো। আজ আমি রান্না করবো।”
সাদাফ আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এখান থেকে একপাও নড়তে ইচ্ছে করছে না তার। এভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই শুভ্রতাকে দেখতে ইচ্ছে করছে ঘন্টার পর ঘন্টা। শুভ্রতার নাক,চোখ,ঠোঁট,গাল সবাই যেন লাজুক ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে চলেছে। ফিসফিস করে জানাতে চাইছে, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়েটি তার স্ত্রী। উহুম, শুধু পৃথিবী নয়। শুধু পৃথিবীর তুলনা দিয়ে মন ভরছে না সাদাফের। তার চোখে শুভ্রতা আরো কয়েকগুণ বেশি সুন্দর। আরো কয়েকগুণ বেশি লাজুক, প্রাণোচ্ছল।
ঝটপট ফ্রেশ হয়ে আবারও রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছে সাদাফ। খুব অদ্ভুত কারণেই রান্না ঘরের মতো জায়গাটাও ভীষণ প্রিয় লাগছে তার। শুভ্রতার ঘেমে নেয়ে যাওয়া মুখ, ল্যাপ্টে যাওয়া কাজল আর শুভ্রতার গন্ধমাখা তাপটাও ভীষণ মিষ্টি লাগছে আজ। শুভ্রতা রান্নায় খুব একটা দক্ষ নয়। বাড়িতে নিজ হাতে এক গ্লাস পানি ঢেলেও খেতে দেখা যায় না তাকে। গরম তেল ছিঁটকে উঠতেই শুভ্রতার চমকে পিছিয়ে যাওয়াটা তার অদক্ষতারই পরিচয়।তার সেই অপটু হাতে মাছ ভাজি করা দেখেই হেসে ফেললো সাদাফ। ধীর পায়ে শুভ্রতার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো সে। শুভ্রতা ভয়মাখা চাহনী নিয়ে মাছ উল্টাতে উল্টাতে বললো,
—-” কি চাই?”
সাদাফ শীতল কন্ঠে বললো,
—-” রান্না দেখি। দূর থেকে ভালো দেখা যাচ্ছিলো না তাই কাছে এসে দাঁড়ালাম। একটু শেখাবে আমায়?”
শুভ্রতা সন্দেহী চোখে তাকালো। তার জানা মতে রান্নাবান্নায় বেশ ভালোই দক্ষ সাদাফ, তবে? শুভ্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বামহাতটা শুভ্রতার কোমরের ওপর রাখলো সাদাফ। ডানহাতটা শুভ্রতার ডানহাতের ওপর দিয়ে খুন্তির ওপর রাখলো। ফিসফিসিয়ে বললো,
—-” আমিও একটু শিখি মহারাণী।”
প্রেমে পাগল প্রেয়সীকে পাগল করার জন্য এতটুকু ছোঁয়ায় যে যথেষ্ট তা হয়তো জানা ছিলো না সাদাফের। যার ফলশ্রুতিতে পুরোটা সময় প্রেয়সীর মুগ্ধদৃষ্টির শিকার হতে হলো তাকে। শুভ্রতা নিজের সম্পূর্ণটা ভর সাদাফের বুকের ওপর ছেড়ে দিয়ে মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়েই ছিলো। শুভ্রতার এমন পাগলামোতে মিটিমিটি হাসলো সাদাফ। কিন্তু তাতেও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া হলো না শুভ্রতার। মাছভাজা শেষ করে সাদাফ যখন কথা বললো তখনই কেবল মোহভঙ্গ ঘটলো শুভ্রতার। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে খানিকটা দূরে সরে গিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। সাদাফ মাথা চুলকে বললো,
—-” আর কিছু রান্না করবেন মহারাণী?”
#চলবে….
[ ছোট হয়েছে না? আমিও বুঝতে পারছি। আসলে, অনেকদিন বাদ পড়ায় সুরকাটা সঙ্গিতের মতো হয়ে গিয়েছিলাম। হাত চলছিলোই না….আশা করছি আবারও নিয়মিত লিখে ঠিক হয়ে যাবে ব্যাপারটা। লিখবো লিখবো করে লেখা হচ্ছিল না। তাই ছোট মোট যা হলো তাতেই সূচনাটা করলাম। ]
# আরশিযুগল প্রেম পর্ব ২৮
# লেখিকাঃ নৌশিন আহমেদ রোদেলা
# পর্ব- এক্সট্রা পার্ট (২৮)
________________
বসার ঘরে বসে আছেন রাদিবা আহমেদ। তারপাশেই বসে আছেন শাহিনুজ্জামান সাহেব ও হাজী আনিমুল হক। দরজার পাশে হাত মুড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শফিক আর শুভ্রব। সামনের সোফায় বসে আছেন দু’জন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। বসার ঘরের পরিবেশটা বেশ থমথমে। গুরুগম্ভীর আলোচনা চলছে। আর সেই গুরুগম্ভীর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলো এ বাড়িরই মেয়ে, শুভ্রতা।
—-” আপনি আমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে এ পর্যন্ত এসেছেন বলে ধন্যবাদ, ওবায়দুল্লাহ সাহেব।”
ওবায়দুল্লাহ সাহেব মৃদু হেসে বললেন,
—-” এভাবে বলবেন না। আপনি আমার বাবার মতো। আপনার পরিবারের মেয়েকে পুত্রবধূ করে পাওয়াটা আমি সৌভাগ্য বলেই মনে করি। তাছাড়া, শুভ্রতাকে আমি দেখেছি। ভীষণ লক্ষ্মী মেয়ে সে। আপনি একদম চিন্তা করবেন না চাচা। আপনি হজ্জ থেকে ফিরে আসুন। তারপর দিনক্ষণ দেখে না’হয় চারহাত এক করা যাবে। মাত্র তো চারটা মাস। শুভ্রতাও যখন চারমাস পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চাইছে তাহলে আমাদের কোনো সমস্যা নেই। চারমাস অপেক্ষা করলে আমার ছেলের বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে না।”
আনিমুল হক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হাসিমুখে বললেন,
—-” নাতনীটা আমার খুব আদরের ওবায়দুল্লাহ সাহেব। আমার বংশে একটা মাত্র জান্নাত সে। সেই জান্নাতের চোখের পানিটা সহ্য হয় না। মেয়েটা যখন কেঁদেকেটে কিছুদিন সময় চাইলো তখন আর মানা করতে পারি নি। আদরের মেয়ে তো…আমাদের সংস্পর্শহারা হওয়ার কথা চিন্তা করতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। আপনারা যে আমাদের সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন তাতেই আমরা কৃতজ্ঞ।”
ওবায়দুল্লাহ সাহেব অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসলেন। বিনীত গলায় বললেন,
—-” বারবার কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমাদের লজ্জায় ফেলবেন না চাচা। হজ্জের মতো একটা পবিত্র কাজের পর বিয়ে হওয়াটাই মঙ্গলময়। আপনি যেহেতু কথা দিয়েছেন বিয়েটা হবে, সেখানে আর কি-ই বা বলার আছে? তাছাড়া, বিয়ের আয়োজন করার জন্য আমাদের দু’পক্ষেরই কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। ফারদিনের কলেজেও নাকি একটু ঝামেলা চলছে। সবদিক থেকে বিবেচনা করলে বিয়ের জন্য ওটাই হবে পার্ফেক্ট সময়।”
রাদিবা আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। শশুড়ের প্রতি শ্রদ্ধাহীন মনোভাবের জন্য খানিকটা গুটিয়ে গেলেন। অপরাধী দৃষ্টিতে শশুড়ের দিকে একপলক তাকিয়েই মাথা নিচু করে বসে রইলেন।
শুভ্রতা বাড়ি ফিরলো সন্ধ্যায়। ততক্ষণে মাগরিবের আযান পড়ে গিয়েছে। চারপাশে ঝাপসা অন্ধকার আর আমের মুকুলের তীব্র গন্ধ। শুভ্রতা বাসায় পৌঁছোতেই বাঁকা চোখ তাকালো শুভ্রব। কান থেকে ফোন নামিয়ে বললো,
—-” কই ছিলি সারাদিন? ফ্রেন্ডদের সাথে তো ছিলি না।”
শুভ্রতা থতমত খেয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। হঠাৎ করে কোনো কথা খুঁজে পেলো না সে। ভাইয়ের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে খানিকটা মিঁইয়ে গেলো সে। তারপর হঠাৎই রাগী সিংহীর মতো বলে উঠলো,
—-” আমি যে বান্ধবীদের সাথে ছিলাম না এটা তুই কিভাবে জানলি ভাইয়া? আমার বান্ধবীদের সাথে তোর কিসের যোগাযোগ? কাহিনি কি বল তো? ছোট বোনের বান্ধবীর সাথে প্রেম করিস আবার কথা?”
শুভ্রতার এমন কথায় বোকা বনে গেলো শুভ্রব। ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা বলবে তার আগেই দ্রুত পায়ে রুমে ঢুকে দরজা দিলো শুভ্রতা। শুভ্রব কিছুক্ষণ বোনের দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে ছাঁদের দিকে পা বাড়ালো। শুভ্রতার চাল-চলন খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না তার। শুভ্রতা কি প্রেম করছে? কোনো বাজে ছেলের সাথে জড়িয়ে পড়ছে না তো মেয়েটা? শুভ্রব নিজে ছেলে। ছেলেরা কতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে, সে সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা আছে তার। তাছাড়া, শুভ্রতার যে বিয়ে ঠিক। শুভ্রব দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছাঁদের ফ্লোরে পা রাখলো। ছাঁদের পাশের আম গাছটায় ফুল মুড়িয়ে গুঁটি ধরেছে। চারপাশের বাতাসটা আমের নব গুটির গন্ধে মউ মউ করছে। কচি আমের মিষ্টি গন্ধটাও আজ সহ্য হচ্ছে না শুভ্রবের। মনের মধ্যে ভয়ানক কিছু চলছে। ভয়ানক কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছে সে। উলোটপালোট ভয়ানক এক ঝড়!
____________________
ফ্রেশ হয়ে, শাড়ি ছেঁড়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে শুভ্রতা। নাকের ছোট্ট নাকফুলটা বাল্বের আলোয় ঝলঝল করছে। এই নাকফুলটা কখনো খুলবে না শুভ্রতা। কখনোই না। শুভ্রতা শহরের আধুনিক মেয়ে। গ্রামের নানি-চাচিদের ‘নাকফুল’ বিষয়ক কুসংস্কারগুলো মানার কথা নয় তার। তবুও কোনো জানি এই নাকফুলের প্রতিই তীব্র এক টান অনুভব করছে আজ। স্বামী সোহাগী মেয়েদের মতো নাকফুলটাকে আগলে রেখে লজ্জা লুকোতে ইচ্ছে করছে। শুভ্রতা আয়নার দিকে দু’চোখ মেলে তাকালো। নিজের চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে চোখ নিচু করলো। মনে পড়ে গেলো সাদাফের বলা কথা…..
বাসায় ফেরার আগমুহূর্তে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিলো শুভ্রতা। ঠিক তখনই তার পেছনে এসে দাঁড়ালো সাদাফ। আয়নার ভেতর দিয়ে শুভ্রতার চোখের দিকে দৃষ্টি রাখলো সে। চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো,
—-” সেদিন তোমার বলা ‘আরশিযুগল প্রেম’ টা ভুল ছিলো শুভ্রতা। এই কাঁচের আরশিতে নয় দুটো মানুষের মনের আরশিতে যখন প্রেম হয় সেটাই আরশিযুগল প্রেম। তোমার মনের আরশিটা শুধুই আমিময় শুভ্রা। সেই আরশি থেকে আমাকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তোমার নেই। সেই আরশি সময়ে অসময়ে তোমায় জ্বালাতন করবে। চোখদুটো বোজার সাথে সাথে আস্ত এই আমিকে তোমার সামনে নিয়ে দাঁড় করাবে। এটাই প্রেম শুভ্রা….এটাই আরশিযুগল প্রেম! তোমার মনের আরশিটা আমার আরশিতে বাঁধা পড়েছে শুভ্রা। ভয়ানক প্রেমে মত্ত হয়েছে দু’জন…. ভয়ানক!!!”
শুভ্রতার ভাবনার মাঝেই টোকা পড়লো দরজায়। শুভ্রতা তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দিতেই গম্ভীর চোখে তাকালেন রাদিবা আহমেদ। মেয়েটাকে আজ বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর লাগছে। হঠাৎ করেই মেয়ের এমন বাড়াবাড়ি সৌন্দর্যটা রাদিবা আহমেদের খুব একটা পছন্দ হচ্ছে না। জীবনের দুটো পর্যায়ে মেয়েদের বাড়াবাড়ি রকম সুন্দর লাগে। প্রথমত, কিশোরী থেকে যৌবনে পদার্পনের সময়। দ্বিতীয়ত, বিয়ের পর। শুভ্রতার বর্তমান অবস্থা এই দুটোর একটির পর্যায়েও পড়ছে না। তাহলে হুট করে তার এই সৌন্দর্যের কারণ কি? রাদিবা আহমেদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরই আবিষ্কার করলেন মেয়েটা আজ নাকফুল পড়েছে। শুধু নাকফুল নয় হাতে মোটা দুটো বালাও পড়েছে। বালা দুটো রাদিবার শাশুড়ির। রাদিবা আহমেদ বিস্ময় নিয়ে বললেন,
—-” হঠাৎ নাকফুল পড়েছিস যে? এর আগে তো জোড় করেও পড়ানো যায় নি তোকে।”
শুভ্রতা মৃদু হাসলো। দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে মাকে ভেতরে আসতে বললো। বিছানায় ছড়িয়ে রাখা শাড়িটা ভাঁজ করতে করতে বললো,
—-” আজ তো নববর্ষ মা। তাই একটু বাঙালি বধূ সাজার শখ হয়েছিলো। দেখো, হাতে মেহেদী আর পায়ে আলতাও পড়েছি। নাকফুলটায় আমায় সুন্দর লাগছে না মা? সেদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে তিনশো টাকা দিয়ে কিনে এনেছি।”
রাদিবা জবাব দিলেন না। মেয়ের হাতের দিকে দৃষ্টি রেখে বললেন,
—-” এতো মোটা বালা পড়েছিস অসুবিধা লাগছে না?”
শুভ্রতা হাসলো। মায়ের পাশে বসে বললো,
—-” লাগছে। ভীষণ অসুবিধা লাগছে।”
—-” তাহলে পড়ে আছিস কেন? খুলে রাখলেই পাড়িস।”
—-” অসুবিধা লাগার সাথে সাথে ভালোও লাগছে। তাই আর খুলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া, এসব পড়ে পড়ে অভ্যাস করতে হবে না? তুমিই তো বিয়ে দেওয়ার জন্য ওঠে পড়ে লেগেছো। আজ বাদে কাল বিয়ে হয়ে গেলে পড়তে হবে না? তাই আগে থেকেই অভ্যাস করছি।”
রাদিবা আহমেদ হঠাৎ করেই কোনো কথা বললেন না। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে মেয়েকে পর্যবক্ষণ করলেন উনি। বিয়ে নিয়ে শুভ্রতার হঠাৎ এমন পজিটিভ চিন্তাটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে রাদিবার। রাদিবা আহমেদ খানিক ভাবলেন। ফারদিনের সাথে তার বিয়ের ব্যাপারটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। আনিমুল সাহেব যেখানে নিজে থেকেই শুভ্রতাকে জানাতে বারণ করেছেন সেখানে কি দরকার কথা বাড়ানোর? রাদিবা হঠাৎ করেই গম্ভীর গলায় প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
—-” সারাদিন কোথায় ছিলে?”
শুভ্রতা চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল। খানিক চুপ থেকে নিজের উত্তরটা গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলো। শুভ্রতাকে চুপ থাকতে দেখে নিজ থেকেই কথা বললেন রাদিবা আহমেদ,
—-” তুমি এখন বাচ্চা নও। এতো বড় মেয়ে হয়ে সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর মানেটা কি? দাদু যে এসব পছন্দ করেন না, জানো না?”
শুভ্রতা মাথা নিচু করে বসে রইলো। রাদিবা আহমেদ উঠে দাঁড়ালেন। মেয়ের দিকে কড়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
—-” ফ্রেশ হয়ে দাদুর রুমে যাও। আর কখনো যেন এমন উড়নচণ্ডী স্বভাব না দেখি। এখন বিয়ের যোগ্য হয়েছো….কেউ যেন বলতে না পারে আমাদের বাড়ির মেয়ে উশৃংখল।”
শুভ্রতা কোনো জবাব দিলো না। মা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে।
#চলবে,
[ অসম্ভব রকম কষ্টে দিন যাচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কিছুই লিখতে পারছি না। মাথাভর্তি বস্তাপচা আইডিয়া আর গল্প নিয়ে বসে আছি। কলম নিয়ে বসলে আর কিছু বের হয় না। কোনো অনুপ্রেরণা পাচ্ছি না। শুনেছিলাম বিখ্যাত লেখকদের ‘রাইটার্স ব্লক’ নামক সমস্যাটা হয়। তাহলে, আমার মতো ক্ষুদ্র বালিকার কাছে তার কি চায়? বিখ্যাত টিখ্যাত হয়ে যাচ্ছি নাকি আবার?
বিঃদ্রঃ রাইটার্স ব্লকটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে আমায়। ]