###আত্মা ৫ম ও শেষ পর্ব
###লাকি রশীদ
বেলা সাড়ে তিনটায় লাঞ্চ করতে গিয়ে দেখি টেবিল জোড়া খাবার। লাল শাক ভাজি,উচ্ছে ভাজি,মোরগ ভুনা,ঘন মুশুর ডাল ও কচি লাউপাতা দিয়ে শুঁটকি তরকারি। এত তাড়াতাড়ি
৫টা আইটেম হলো কিভাবে বলতেই হুমায়রা বলছে রান্নাঘরের ২টা চুলা ছাড়াও বাইরে একটা চুলা আছে ভাবী। বাবার জন্য আবার নরম করে খিচুড়িও করেছে। চাচা, মামুন, আমার শাশুড়ি, মাহির, ইভান এবং চাচীকে ৬টি চেয়ারে আমি বসিয়ে দিলাম। তারপর, বাবা ও সিমিনের খিচুড়ি প্লেটে করে বিছানায় নিয়ে খাওয়াতে এলাম। ইভান এর অনেক প্রিয় আইটেম হলো লালশাক ও ডাল। বাসায় যখন খায় তখন বারবার তার লাল হয়ে যাওয়া জিহ্বা বের করে দেখায়। এবার সে দৌড়ে এসে দুইবার দেখিয়ে গেল।
কষা মোরগ ভুনা মাহির আর বাবার ভীষণ প্রিয় আইটেম। ওর অভ্যাস হলো,এক টুকরো নিয়ে আগে টেষ্ট বুঝবে। তারপর ভালো লাগলে নিবে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে সবাই কে পরিবেশন করছে। মাহির এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো, এতো মজার তরকারি আমি খুব কম খেয়েছি। পারফেক্ট মশলা,ঝোল,তেল সবকিছু। নওশীন তোমার রান্নাও তো অনেক মজার। কিন্তু এটাতে ভিন্নধর্মী একটা ফ্লেভার আছে। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। তুমি খেয়ে দেখো, ধরতে পারো কিনা। আমি হেসে বলি, আমি না খেয়েও বলতে পারবো সেই ফ্লেভারটা কি? সাথে সাথে অনেক জোড়া চোখ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
হেসে বলি, সেটা হলো ভাইয়ের জন্য বোনের মিষ্টি
হাতের জাদু। পৃথিবীর সেরা ফ্লেভার সেটাই। পাঁচ তারা হোটেলের অনেক অভিজ্ঞ শেফও শত চেষ্টা করে করেও এই ফ্লেভার আনতে পারবে না। ভাই
এবার বোনকে বলছে, কিরে তোর ভাবীর কথাই সত্যি না মনে মনে অনেক বকা দিয়ে দিয়ে মোরগ রেঁধেছিস? হুমায়রা হেসে বললো, সুন্দর মানুষের সুন্দর কথা। জিহ্বা দিয়েই আপনার বৌ সবাইকে ঘায়েল করে ফেলে। কি সব হাড় নিচ্ছেন, আমার কাছে বাটি দেন ভালো টুকরো দিচ্ছি। আমি মনে মনে হাসি, একবার তারেক জামিল সাহেবের এক স্পীচ শুনেছিলাম। তিনি বলছেন, পৃথিবীর যতো মধু আছে তার চেয়েও বেশি মধু মানুষের জবানে
আছে। ঠিক তেমনি পৃথিবীর সব সমুদ্রে যতো লবণ আছে তার চেয়েও বেশি লবণ মানুষের জবানে আছে। আল্লাহ মিষ্টভাষী কে ভালবাসেন।
এক জিহ্বা দিয়েই আমরা আত্মীয়তা ছিন্ন করতে পারি, আবার এই জিহ্বা দিয়েই ভাঙ্গাচুড়ো সম্পর্ক
জোড়া লাগাতে পারি। জাষ্ট কার কি পছন্দ সেটাই হলো কথা।
ওদের খাওয়া শেষ হলে আমি মাহির কে বলি,
শোনো ড্রাইভারকে ডাক দাও। ও খেয়ে যাক্,পরে
আমরা ননদ ভাবী আয়েশ করে শান্তিতে খাবো।
ও ড্রাইভারকে ডাকতে যেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললো, শান্তি ভাবে আয়েশ করে খাওয়ার খুব একটা সময় কিন্তু আমাদের হাতে নেই নওশীন। সোয়া চারটা বাজে, পাঁচটায় বের না
হলে সমস্যা আছে,রাস্তাও খুব খারাপ। আমি বলি
ঠিক আছে বের হবো। ওকে আগে ডাক তো দাও।অবসর বসে আছি, হুমায়রা ও ছমিরনের সাথে আমিও টেবিল লাগাতে সাহায্য করলাম। খেতে বসতেই চাচী পাশে এসে তরকারি প্লেটে তুলে দিয়ে বলছেন, নতুন বৌ আসছো। কি খাওয়াবো রে মা। উচিত তো ছিল, পোলাও,রোষ্ট, কাবাব করে খাওয়ানো। আমি হেসে বলি, নতুন বৌ কি করে হলাম বলেন? ৭ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। চাচী এসবে পাত্তা না দিয়ে বললেন,ওই হলো আর
কি। হঠাৎ তার সোনার নথ দুলিয়ে দুলিয়ে বলেন,
নাকের ফুল,নথ এসব নাই কেন গো মা? কোনো কিছু কি কম আছে আমাদের ছেলের তবে? এসব
শুনলে আমি সাধারণত কিছু বলি। এখানে চাচীর সাথে তর্ক করতেই ইচ্ছে করছে না। বলি,পরবো।
চাচী সরে যেতেই হুমায়রা বলছে,প্লীজ ভাবী কিছু মনে করবেন না। মা মাঝে মাঝেই ভুলে যায়,কতো টুকু পর্যন্ত বলা যাবে। আমি হেসে বলি, আমার তো খারাপ লাগেনি। এতো ফরমাল না হলেও চলবে। খেয়ে উঠলে হুমায়রা বাটিতে সব পদ নিয়ে মহব্বত আলী ও ছমিরনকে খাবার জন্য দিলো। আমরা দুজন এইরুমে এসে দেখি চাচা, চাচী ও মামুন কে সামনে বসিয়ে মাহির বলছে,
আমাদের অফিসে একটা পদের জন্য মানুষ নেয়া হবে।স্যালারি হচ্ছে ফর্টি প্লাস। আমি চাই মামুন কে কাজটা দিতে। কারো কোনো আপত্তি নেই তো? এবার একদম আনপ্রেডিক্টেবল ভাবে ছোট চাচা বলে উঠলেন, আমি খুব খুশি হলাম। কিন্তু বাবা এটা নেয়া ঠিক হবে না। তাই নিচ্ছি না।
অনেক আগে তোমাদের বাসা থেকে এসে একটা ওয়াদা করেছিলাম যে,আর কখনো তোমাদের থেকে কোনো ধরনের সাহায্য নিবো না। ওয়াদার
বরখেলাপ হয়ে যাবে। মাহির এখন কি বলবে মনে হয় ভেবে পাচ্ছেনা।
পুরো একটা নাটকীয় অবস্থার মাঝে হঠাৎ আমার শাশুড়ি বলে উঠলেন,ছোটন ভাই আমি জানি কি জন্য তুমি বলছো আমাদের সাহায্য নিবে না। আমার বলা ঐদিনের কড়া কথার জন্যই। শোনো আজ প্রায় বছর তিনেক ধরে আমি কতো বার যে ভেবেছি তোমার কাছে মাফ চাইবো। কিন্তু লজ্জায়
অনুশোচনায় আমি আসতে পারিনি। আমি আজ তোমার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। নিশ্চয়ই
জানো,যে মাফ করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন ও
মাফ করে দেন। তুমি দয়া করে আগের সবকিছু ভুলে যাও এবং ছেলেটাকে চাকরিটা করতে দাও।
চাচা এবার হুমায়রার দিকে তাকাচ্ছেন। ও মাথা
নেড়ে হ্যা বুঝাতেই চাচা বললেন, ঠিক আছে। তাই হবে। এবার সরলতার প্রতিমুর্তি চাচী মাহির কে বলছেন, সবই তো বুঝলাম। শুধু জিজ্ঞেস করছি, তার বেতন কতো বাপ? মাহির হেসে বলল আপাতত চল্লিশ এর সামান্য বেশি। চাচী এবার হাউমাউ করে কেঁদে বলছেন,ও আল্লাহ তোমার কোটি কোটি শুকরিয়া। ও বাজান, শহরে গিয়েই
তুমি আবার এই সব কথা ভুলে যাবে না তো?
মাহির হেসে বললো, এতো বছরের ভুল শুদ্ধ করতে এসে আবার ভুল করবো কিভাবে চাচী?
তবুও নানা আশঙ্কায় জর্জরিত বৃদ্ধা এবার বলেন,
যদি তোমার ভাইয়েরা না করে দেয়? মাহির বলে,
একটা পোষ্টে মানুষ নেয়ার ক্ষমতা আমার আছে চাচী। আপনি শুধু দোয়া করবেন, এই মাসের ৭ দিন যেন আমি বেঁচে থাকি। চাচী হাত তুলে দোয়া করছেন, মাহির কে তুমি দেখো মাবুদ। ২টা মাস যদি আমার ছেলে এই বেতন পায় তবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তালুকদার এর ছেলেটাকে কিছু বলতে বা এগোতে পারছি না টাকার জন্য। এবার মাহির বলছে, কাউকে কথা দিবেন না এখন। আমাকে একজন এরকম ১টা মেয়ের কথা বলেছিল। অনেক দিন দেখা নেই,
বিয়ে করে ফেলেছে কিনা তাও জানি না। আমি বাসায় গিয়ে খবর করবো। এখন সেটা বলতে চাচ্ছিলাম না,কারণ ভাবতে পারেন সামনে এসেছে
তাই গাই ও বাছুর সবকিছু দিয়ে দিচ্ছে। এবার যদি অনুমতি দেন আমরা উঠে পড়ি।
এতোক্ষণ আমার শশুড় বসে বসে সবার কথা শুনছিলেন। এবার সটান করে শুয়ে পড়লেন। মাহির বলছে,চলো বাবা বাসায় যাবো। বিছানায় রাখা একটা কাঁথা নিয়ে চটপট খুলে তার গায়ে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বলছেন,তোমরা চলে যাও। আমি এদের সাথেই থাকবো। মাহির এবার বলছে, তোমার এতো এতো ঔষধ নিয়ে আসেনি তো নওশীন। কিছুদিন পর আবার না হয় আসবে।
বাবা অবুঝের মতো বলছেন, না আমি আমার ভাইয়ের সাথে থাকবো। মাহির আর ধৈর্য রাখতে পারেনি, ধমকে উঠেছে যন্ত্রণা করো নাতো বাবা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,ড্রাইভার এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় পরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে মারবে। বাবা এখন কথা না বলে,কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মামুন বলছে, উনি যদি থাকতে চান থাকুন, আমি না হয় কালকে গিয়ে ঔষধ নিয়ে আসবো।
মাহির বলছে, না রে ভাই। অনেক অসুবিধা আছে। এভাবে রেখে যাওয়া যাবে না। দেখিস্ না
দুজন দুদিকে ধরে ধরে নিতে হয়। পায়ের জোর কমে গেছে। চলো বাবা,উঠো চটপট। এরকম যদি
করো, তাহলে তো তোমাকে আর নিয়ে আসা যাবে না। বাবা বাচ্চাদের মতো একই কথা বলছেন
না আমি আমার বাড়ি থেকে কোথাও যাবো না।
তুই কারো সাথে আমার সব জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিস্। আমি বুঝতে পারি,মাহিরের রাগ এবার চড়ে যাচ্ছে। আমার শশুড় এর কাছে গিয়ে বলি, বাবা কাঁথা সরান তো। শুনেন আমি কি বলছি। মুখ থেকে কাঁথা সরাতেই বললাম, আপনি যদি এখন না যান, আপনার ছেলে ঠিকই জোর করে নিয়ে যাবে। মধ্যে থেকে আমিই শুধু বকা খাবো, নিয়ে আসার জন্য তাকে জোর করাতে। আপনি কি চান, আমি বকা খাই? যদি চান তবে তো কিছু বলার নেই আর যদি না চান উঠে পড়ুন প্লিজ।
এবার বসে বলছেন, হারামজাদা তোমাকে বকা দেয় বৌমা? এদের কক্ষনো ভালো হবে না দেখো।
মাহির বলছে, ঠিক আছে ভালো না হোক। এখন দয়া করে নামো। ওর দিকে তাকিয়ে অসহায় এক
টা দৃষ্টি দিয়ে বলছেন, আবার কবে এখানে নিয়ে আসবি বল্? মাহির জবাব দেয়,আসবো আসবো।
খুব শীঘ্রই আসবো। এবার পা মেঝেতে ফেলে বলছেন, বুঝলি ছোটন শক্তিহীনতার অভিশাপ বড় কঠিন। এই দুনিয়ায় শক্তি না থাকলে, তোমায় কেউ গণনাতেও ধরবে না। এই কথা শুনে আমার মনে হলো, বাবা এখন হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ সত্যি কথা বলে ফেলেন। বিয়ের পর এই বাবার প্রতাপ কি ছিল আমি দেখেছি। ছেলেরা কিছু বলতে হলে আগে মাকে মাধ্যম হিসেবে ধরতো। সরাসরি কিছু বলার সাহস ছিল না। গত দুই বছরে সেই বাবার আমূল পরিবর্তন। পৃথিবীতে কখন কার জীবন কোন পথে বাঁক নিবে……… একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ কখনও বলতে পারবে না।
বাবা বসে থাকতে থাকতেই মাহির হঠাৎ বললো,
চাচী একটু শোনে যান প্লিজ। আমি বুঝতে পারি,
টাকা দিতে গেছে মনে হয়। একটু পর মাহির এসে বাবাকে ধরে ধরে বের করলে চাচীও আসলেন। হাজার টাকার কয়েকটি নোট হাতের মুঠোয় দিয়ে বললেন, নতুন বৌ তোমার মুখ সোনা দিয়ে দেখা উচিত ছিল মা। চাচীর সাধ্য নেই, এই টাকা কয়টা রাখো। তোমার পছন্দ মতো ভালো দেখে একটা শাড়ি কিনে নিও। আমি না না করতেই বললেন,
রাখো তো। বেশি মুরুব্বিয়ানা (পাকানো) করতে হবে না। একটা অনুরোধ মা, কখনো বদলে যেও না। গরীবদের প্রতি সবসময় অন্তরে ভালবাসা রেখো।
মামুন ও মাহির দুদিকে ধরে ধরে বাবাকে গাড়িতে তুলছে। আমার শাশুড়ি চাচীকে ধরে বললেন,
বাসায় অনেক জায়গা আছে আঙ্গুর। একদিন তুমি সবাইকে নিয়ে চলে এসো। তোমার ভাইজান খুব খুশি হবেন তাহলে। চাচী বললেন, মেয়ের তো স্কুল গো ভাবী। নাহলে তো যেতে পারতাম। বাবা এবার চাচাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন,এরা আমায় না নিয়ে এলে তুই আমাকে আনতে যাস্। ড্রাইভার মাহিরকে এবার বলছে,স্যার আপনার চাচা ২টা বস্তা দিয়েছেন। গাড়িতে তুলেছি আমি। মাহির বলছে, ঠিক আছে। চাচা বললেন বস্তাতে সব্জি আছে গো মা। গিয়েই খুলে বাতাসে রেখো নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মাথা নেড়ে হুমায়রা ও মামুন
এর সাথে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মাহির দেখি, ৫০০ টাকার ২টা নোট মহব্বত আলী ও তার বৌকে দিল। লাখ টাকা পেলেও কেউ মনে হয় এতো খুশি হয় না,যা তারা হয়েছে।
গ্ৰামের এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় আমাদের চলা শুরু হয়েছে। মাহির বাবার বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার বাবা আমরা কি তোমাকে আদর যত্ন করি না নাকি,যেখানে যাও সেখানে থেকে যেতে চাও? আমাদের কথা বাদ দাও, তোমার এতো আদরের বৌমা কেও তো তুমি ভুলে যাও। বাবা এবার রেগে বললেন, আমাকে
আমার ভাইয়ের সাথে থাকতে দিলি না। দেখিস কি হয় তোর আর তোর মায়ের। আমি বুঝি বাবা অসহায় রাগে, দুঃখে,ক্ষোভে এমনটা করছেন। ইশারা দিয়ে মাহির কে চুপ করে থাকতে বলি। পাঁচ মিনিটও যায়নি বাবা মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলছেন, আবার কবে নিয়ে আসবি এখানে? সে এবার হো হো করে হেসে উঠলো, তুমি তো একদম আমার ইভানের মতো হয়ে গেছো বাবা। আসবে, খুব শীঘ্রই আসবে তো বললাম।
কিন্তু বাবা তুমি খুব বড় একটা ভুল করেছো। সারা জীবন দুই হাতে রোজগার করেছো, কিচেন বাথরুম সহ দুই রুমের একটা বাসা বানাতে পারতে। চাচারা মানুষ ৪ জন,২ রুমে থাকে। তুমি এখন সেখানে কিভাবে থাকবে? তাছাড়া,২ জন মানুষের সাহায্য ছাড়া তুমি হাঁটতে পারো না। সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,তাই না? বাবা কি বুঝলেন উনিই জানেন। এবার নাছোড়বান্দা হয়ে বলছেন, ছোটবেলার মতো আমি ও ছোটন এক খাটে শুবো। আমাদের মা কর্ণারে থাকে তো,তাই আমরা পড়ে যাই না খাট থেকে। মাহির এবার মার
দিকে তাকাতেই মা বললেন,প্রতি রাতেই তোর বাবা তোর দাদী কে পাশে নিয়ে ঘুমায়, কথা বলে।
মাহির এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট করো। এতো দেখি অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।
বাসায় পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার উপরে বাজে। পাড়া থেকে কিছু দূরে থাকতেই ফোন দিয়ে সেলিমাকে বলেছিলাম চা নাস্তা বানিয়ে রাখার জন্য। এসে সবাই ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে চা খেলেও বাবা খাননি। ছোট বাচ্চা যেমন তার পছন্দের জায়গা থেকে তাকে নিয়ে এলে রাগ করে খায় না, তেমনি অনেক রাগ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন। মাহির ২/৩ বার বলেও যখন নাস্তা করাতে নিয়ে আসতে পারেনি,
তখন রেগে গেছে। আমি বলি, এতো বছরের এতো এতো ধাক্কা একদিনে হজম করা অনেক কষ্ট মাহির। সময় দাও একটু, ঠিক হয়ে যাবে। এখন বাবাকে বিরক্ত করো না। পরে খাবেন না হয়। এবার সে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মনে আছে তো কিছু কথা বলবো। খুব মন দিয়ে শুনবে। বললাম,ভয় লাগিয়ে দিচ্ছো যে।
কি এমন কথা, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
চাচা বস্তাতে দুনিয়ার সব্জি দিয়েছেন। এগুলো খুলতেই সেলিমা বলছে ছাদে রাখলে সব্জিগুলো ভালো থাকতো। বললাম, দাঁড়া পুরনো শাড়ি আছে,আনি। তাহলে লম্বা করে বিছিয়ে সব এক সাথে দিয়ে দিবি। উঠে দেখি সারা ছাদ জোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু ফকফকা,লাইট জ্বালাতে হয়নি। কিসের আমি সেলিমাকে সব্জি বিছোতে সাহায্য করবো, আমি তো রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছি। ভাবছি, এতো সুন্দর তোমার চাঁদের আলো তাহলে তুমি কতো সুন্দর মাবুদ !!! চর্মচক্ষে তা অবলোকন করা কি আদৌ সম্ভব হবে? বলো।
খাওয়াদাওয়া এখনো শুরু ই হয়নি। সবাই খুব আস্তেধীরে চলছে,কারণ কালকে অফডে। রাত সাড়ে দশটায় হঠাৎ রমু এসে উপস্থিত। তাঁর বাস না কি কোথায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল……… সেজন্য পৌঁছুতে দেরী হয়েছে। তাকে দেখে বাবা ভীষণ খুশি। রমু এতো দিন বাড়িতে কিকি করেছে তা সে সবিস্তারে বলছে, বাবা অবাক হয়ে শুনছেন আর আমি ঝটপট মুখে খাবার দিচ্ছি। তাও আজকে অন্যদিনের তুলনায় খুব কম সময়ে এই পর্ব শেষ হয়েছে। চাপা গলায় বলি,রমু তোর সব গল্প একদিনে শেষ করিস্ না বাপ। আমার তো মনে হয়,এটা কালকে আবার খুব কাজে আসবে। সে এবার হাসছে। তুই বাবার কাছে থাক্, আমরা খেয়ে আসি। ঠিক আছে? ও মাথা নাড়তেই আমার শাশুড়ি কে নিয়ে খেতে আসি। রমু চলে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় মায়ের। সবসময় বাবার সাথে থাকতে হয়।
ইচ্ছে করেই এসে গা ধুইনি। ঘুমানোর সময় গোসল করলে আরামের ঘুম হয় বলে। সব কর্তব্য
শেষ করে রুমে ঢূকেছি। মাহির টিভি দেখছে। সারা দিনের হুটোপুটি শেষে ক্লান্ত সিমিন অনেক আগেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। গোসল করে এসে বিছানায় গা লাগাতেই মাহির বলছে, খাওয়ার পর গোসল করার বদভ্যাস করো না। আমি হেসে বলি, একদিন নিয়ম ভাঙ্গলে কিছু হয় না। বলো তুমি কি বলবে? এবার টিভি অফ করে বললো,কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে আশা করি।
হেসে বলি,খুব মন দিয়ে শুনবো। বলো তো। কেশে
বলছে, তুমি যে সবাইকে এতো যত্ন আত্তি করো,
সবার মন ভালো রাখতে চেষ্টা করো……….. কিন্তু আসল জায়গাতেই তুমি লবডঙ্কা। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করে বিয়ে করেছিলাম? এই যে গত বছর কয়েক ধরে তুমি কথা বলা কমিয়ে দিয়েছো। আমি খেয়াল করে দেখেছি,সবার সাথে ভালো থাকলেও আমার সাথে তুমি ভালো থাকো না আর আমাকেও ভালো রাখো না……… এগুলো
অন্যায় নয় বলো? আমার যদি নিয়্যত খারাপ থাকতো, তবে তো বিয়ের আগে স্পষ্টভাষী হয়ে এসব বলে আনতাম না। তাহলে, এখানে আমার দোষটা ঠিক কোন জায়গায়? বুঝতে পারছি না। একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ। আমি ভেবে দেখি, সে যা
বলছে তা তো একবিন্দুও ভুল নয়। এবার বলছে,
বাবা জন্মস্থান দেখে খুশি হবে বলে আমার এতো বকা খেয়েও তুমি তাকে সেটা দেখাতে নিয়ে যাও।
মা হ্যান্ডলুমের শাড়ি আরাম পায় বলে, সেটা তুমি খুঁজে খুঁজে আনো।
তোমার পছন্দ তো অনেক ভালো। তা আমাকে এই সাত বছরে একবার বলে দেখেছো, এই পাঞ্জাবি তোমার জন্য অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা? আমার টা অর্ডার দিবে কি, তুমি তো তোমার নিজের জন্য ই কিছু কেনাকাটা করো না। ভাবসাব দেখে মনে হয়, কিডন্যাপ করে এনে বন্দী করে রেখেছি। রহিমাকে যতটুকু অন্তর থেকে ভালোবাসো এর ওয়ান থার্ড কি আমাকে ভালবাসো? সঠিক উত্তর হবে, না। কি হলো তুমি একদম চুপ মেরে গেলে যে? আমার বলার যা ছিল বলে ফেলেছি। আজকে এক্ষুনি কিছু বলতে হবে না। ভেবে কাল পরশু জানিও। তবে কি জানো, আমার মনে হয় সবসময় মেয়েরা কিন্তু শোষিত হয় না, অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও হয়। আমি এসব বললাম কারণ সাতটা বছর আমার ভালবাসাহীন কেটেছে, একটু বিবেক বুদ্ধি দিয়ে যদি ভাবো তবে বাকি জীবন দুজনের হয়তো বা ভালবাসায় গড়াগড়ি দিয়ে কাটবে। এখন ঘুমাবো।
অনেক টায়ার্ড তুমিও, ঘুমিয়ে পড়ো তাহলে।ও হ্যা
হুমায়রার জন্য আমার যে কলিগের ভাইয়ের কথা বলেছিলাম, ফোন করে জেনেছি এখনো বিয়ে হয়নি উনার। দেখা যাক, ভবিষ্যতে কি হয়।
মাহির হচ্ছে পৃথিবীর সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে
একজন,মে শোয়ার সাথে সাথে ই ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি ঘুমাবো কি, কি সব মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে, সেটা নিয়ে ই ভাবছি। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে, বিরক্ত হয়ে উঠে পড়েছি। খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এতো রাতে সেখানে যাবার সাহস আমার নেই। ব্যালকনির গ্ৰীল ধরে দাঁড়াতেই চাঁদের আলো সর্বশরীর যেন ধুইয়ে দিল।
অদৃশ্য অন্ধকারে তাকিয়ে জ্ঞানহীন নওশীন ভাবছে, কি রহস্যময় এক জিনিস সবাইকে দিয়ে পাঠিয়েছেন আল্লাহ, সেটা হলো আত্মা। এই মুহূর্তে আমার শশুড়ের আত্মা চাইছে একটা, শাশুড়ির আত্মা চাইছে আরেকটা। ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র নওশীন এতো দিন ভেবেছিলো, তার আত্মা বেঁধে রাখা হয়েছে। আজকে এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে,সেই কারো আত্মা নির্মমভাবে নওশীনের হাতেই নিস্পেষিত হয়েছে। বাবা মায়ের উপর অভিমান অন্যায়ভাবে অন্যজনের উপর করেছি। কোথায় যেন কোন পাখি না কি পেঁচা ডেকে উঠলো। আমি অন্ধকারে তাকিয়ে ভাবছি,এ
অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি হয়তো বা আলোর দিশা
চেনাতে খুব সাহায্যকারী হবে আমার জন্য। সেটা
নিয়ে ভাবাই হয়তো বা নওশীনের জন্য উপকারী হবে। আত্মার মতো বিশাল জিনিস নিয়ে ভেবে ভেবে কোনো কূল হয়তোবা নওশীন পাবে না।
(সমাপ্ত)