বেপরোয়া ভালবাসা পর্ব ২০
লিখনীঃ মনা হোসাইন
সকাল গড়িয়ে বিকাল নেমেছে,আদি বাসায় নেই বন্ধুদের সাথে বেড়িয়েছে। এই ফাঁকে আদিবা নিজের প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে।যদিও তার মা কয়েকবার বাঁধা দিয়েছেন, বলেছিলেন আদি যেহেতু বিয়ের ব্যাপারে অমত করেনি তাই এখন আদিবাকে যেতে হবে না কিন্তু আদিবা এক কথার মানুষ । মাঝে মাঝে অদ্ভুত রকমের জেদ চেপে বসে তার মাথায়। নিজে যেটা ঠিক করে সেটাই করে।
আদি বিদেশে চলে যাওয়ার পর তাকে দোষারোপ করে একবার বলা হয়েছিল পড়াশোনা করানো হবে না। সেই যে আদিবা বেঁকে বসেছিল মাধ্যমিক পেরিয়ে আর কলেজের চৌকাঠ মারায় নি।এমন কি বাসার বাইরে যাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিল। আদিবা এতটাই ঘরকোণে হয়ে যায় যে অনেক আত্নীয়রা তাকে চিনে না পর্যন্ত। আদিবা প্রচন্ড রকমের ইন্ট্রোভার্ট। রাগ,মন খারাপ কিংবা আনন্দ কারো সাথে শেয়ার করেনা।সবার কাছ থেকে নিজেকে একেবারে গুটিয়ে নিয়েছে। আজ যখন তাকে বলা হয়েছে গ্রামে যেতে হবে মানে সে যাবেই কেউ আটকাতে পারবে না।
সন্ধ্যায় ট্রেন কিন্তু ততক্ষনে আদি হয়ত বাসায় চলে আসবে আর তখন তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না কারন এই একটা মানুষের সাথে আদিবা জেদ দেখাতে পারে না। দেখাবেই বা কি করে আদি যে আদিবার চেয়েও বড় জেদি। আদিবা রাগ দেখিয়ে গ্রামে যেতে চাচ্ছে শুনলে সে তাকে গ্রামের বদলে একেবারে পরপারে পাঠিয়ে দিতে দুবার ভাব্বে না।তাই আদি ফিরার আগেই বেরিয়ে যেতে হবে যেমন ভাবনা তেমন কাজ, আদিবা বিকেলেই বাসা থেকে বেরিয়ে আসল।নিজের মায়ের প্রতি একরাশ বিরক্তি নিয়ে স্টেশনে পোঁছাল কিন্তু স্টেশনে এসে
বিপত্তি ঘটল বহুবছর ধরে আদিবা বাইরের পরিবেশে সাথে বিছিন্ন । তাই স্টেশনে এত লোকজন দেখে কিছুটা ভরকে গেল তাছাড়া কোথায় টিকিট কাটতে হবে এই ব্যাপারেও তার কোন ধারনা নেই। আদিবা চারদিকে তাকিয়ে একজনের কাছে জিজ্ঞাস করল। লোকটি কাউন্টার দেখিয়ে দিল কিন্তু কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন আদিবা বাধ্য হয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়াল তবে এত লোকজন দেখে তার অস্বস্তি হচ্ছে। তার পিছনে একজন এসে লাইনে দাঁড়াতেই গাঁ ছমছম করে উঠল আদিবার তারউপড় হটাৎ ধাক্কায় লাইনে থাকা একজনের সাথে গাঁ লাগতে শিওরে উঠল সে, গাঁয়ে কাঁটা দিল। না আর যাই হোক এখানে দাঁড়িয়ে থাকা তারপক্ষে সম্ভব নক। আদিবা কোন কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি লাইন থেকে বেরিয়ে এসে নিচে বসে পড়ল। আজ নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে তার সামান্য টিকিটও সে কাটতে পারে না?আদিবা চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে। নিচে বসে নিজের অসহায়ত্বকে বরণ করছিল ঠিক তখনী কেউ একজন বলে উঠল,
-“আমি হেল্প করে দিব?
আদিবা চমকে তাকাল সাথে সাথে ভিমরি খাওয়ার যোগার হল,
-“আ আদি ভাইয়া আপনি এখানে…?
-“অরিন ফোন করে বলল, আমি বাসায় ফিরে আসায় তোর নাকি অসুবিধে হচ্ছে সেকারনে গ্রামে চলে যাচ্ছিস তাই ভাবলাম ভাই হিসেবে তোকে বিদায় জানানো উচিত।তাই আসলাম আরকি…
আদিবা প্রচন্ড রকমের অবাক হয়ে বলল,
-“আ আ আপু এসব বলেছে?
-“মিথ্যে বলেছে নাকি?
-“আপনি আসায় আমার অসুবিধে হবে কেন?
-“সে আমি কী করে বলব? অসুবিধা যে হচ্ছে সেটা তো তোর চলে যাওয়ায় প্রমান করছে। যাইহোক যুক্তি তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। যা গিয়ে বেঞ্চে বস আমি তোর জন্য টিকিট কেটে আনছি।
আদির আচারনে আদিবা অবাক হল। এতবড় কথা শুনেও সে আদিবাকে শাস্তি না দিয়ে সাহায্য করছে? কিন্তু কেন এর পিছনে উদ্দেশ্যটা কী? আদি যে এত শান্ত থাকার ছেলে না সেটা আদিবার চেয়ে ভাল কে জানে? যদিও আদি তাকে খারাপ কিছু বলে নি কিন্তু ভয়ে আদিবার বুক ধুঁকপুক করছে।
আদিবা তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখল আদি লাইনে না দাঁড়িয়ে সোজা কান্টারের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে আর চোখের পলকেই বেরিয়েও আসল। আদিবা ততক্ষনে উঠে বেঞ্চে বসেছে আদিও এসে আদিবার পাশে বসে পড়ল।
-“কিরে মুখটা এমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে কেন?
-“ভ ভ ভাইয়া…
-“ভয় পাচ্ছিস মনে হচ্ছে?
-“আসলে…
-” কোন কাজ করার আগে ভাবতে হয় কী করছি এর ফলাফল কি হতে পারে। কাজটা করে ফেলার পর আর ভেবে লাভ কী..?
-“আমি আপনার ব্যাপারে কিছু বলিনি বিশ্বাস করুন..
-“বললেই বা কী? মনের কথা বলার অধিকার সবার আছে তোর ও আছে ভয় পাচ্ছিস কেন?
-“আ আ আমি আসলে…
-“এক শব্দ বলতে তিনবার আটকে যাচ্ছিস পুরো বাক্য শেষ করতে গিয়ে হয়ত হার্ট অ্যাটাক করে বসবি তারচেয়ে চুপচাপ বসে থাক। ট্রেন এখনী চলে আসবে।দুটো টিকিট কেটে দিয়েছি যাতে অন্য কারো সাথে বসতে নাহয়।
-“আ আমি প প পানি খাব ভাইয়া…
আদিবার দিকে তাকিয়ে আদি বাঁকা হাসল হাসিতে রহস্য লুকিয়ে আছে সন্দেহ নেই কিন্তু মুখে কিছু বলছে না তাই আদিবা কিছু বুঝে উঠতে পারছে না।
-“বস নিয়ে আসছি বলে আদি চলে গেল। আদিবা ভয় পাচ্ছে কিন্তু কেন পাচ্ছে সেটা সে নিজেও জানে না।
আদি এসে পানি দিতেই আদিবা ঢকঢক করে বোতল খালি করল।আদির চোখে মুখে রহস্যের ছাপ। দেখতে দেখতে ট্রেন এসে স্টেশনে থামল আদিবা একবার আদির মুখের দিকে দেখছে আবার ট্রেনের দিকে দেখছে। আদিবার অবস্থা দেখে আদি মুচকি হেসে বলল,
-“ট্রেন তোর জন্য দাঁড়িয়ে থকবে না যা উঠে পড় গিয়ে। চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়ে ট্রেনে কাঁটা পড়লে ব্যাপারটা খারাপ হবে..তুই যে একটা মাথামোটা সেটা এখানে প্রমাণ করার কিছু নেই।
আদিবা এবারেও কিছু বলল না সে যাচ্ছে না দেখে আদি নিজেই আদিবার হাত ধরে ট্রেনে তুলে দিল তারপর ব্যাগ গুছিয়ে দিয়ে বলল,
-“সাবধানে যাস…
বলতে বলতে ট্রেনের হুইসেল বেজে উঠল আদি নেমে গেল। ট্রেন চলতে শুরু করল। আদি আদিবাকে বিদায় দিল, সহজ বিদায়। তার মাঝে আদিবাকে আটকানোর কোন প্রচেষ্টা নেই , নেই প্রিয়জন হারানোর ব্যাকুলতাও। আদিবা জানলার বাইরে মুখ বের করে তাকাল তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে আমি যেতে চাইনি ভাইয়া …কিন্তু বলতে আর পারল কই ট্রেন চলতে চলতে আদির দৃষ্টি সীমা পেরিয়ে আসল আদিবা এখনো বাইরে তাকিয়ে আছে। ভিষন মন খারাপ করছে তার। সবসময় তার সাথেই কেন এমন হয়? আদির সাথে তার ভুল বুঝাবুঝি কি নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে থাকবে সারাজীবন?সে গ্রামে যাওয়ার পর হয়ত সত্যি সত্যি আদির বিয়ে হয়ে যাবে তবে কী কোনদিন আদিকে বলা হয়ে উঠবে না আদিবা তাকে ভালবাসত। ভাবতে ভাবতে চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। মন খারাপের সন্ধ্যা নেমে আসল আদিবার কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।চোখটা একটু লেগেছে হটাৎ ট্রেনের ঝকঝক শব্দ থেমে গেল আদিবা চোখ মেলে তাকাল বুঝতে পারল ট্রেন ইঞ্জিন পরিবর্তন করছে ছাড়তে দেরি হবে যাত্রীরা স্টেশনে নেমে যে যার মত সময় কাটাচ্ছে কেউ জিনিসপত্র কিনছে কেউ খাবার খাচ্ছে। আদিবার নামা উচিত নাকি উচিত না বুঝে উঠতে পারল না তাই নামল না।
প্রায় আধঘন্টা পর ট্রেনে হুইসেল বাজল যাত্রীরা সবাই উঠতে শুরু করেছে তখন কেউ একজন আদিবার হাত ধরে টানতে শুরু করল ভীড়ের মধ্যে আদিবাকে তার মুখ দেখতে পেল না কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে ট্রেনের বাইরে আবিষ্কার করল ট্রেন তাকে রেখেই চলে যাচ্ছে দেখে আদিবা ভয়ে চুপসে গেল। সে ট্রেনের দিকে দেখতে দেখতে বলল
-“কে আপনি?আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন,হাতটা ছাড়ুন বলছি
ছেলেটা অতিদ্রুত বেগে হাঁটছে আদিবার কথাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না।আদিবা তার সাথে তাল সামলাতে পারছে না। আদিবা আবার বল
-“ছাড়ুন আমাকে, আমি কিন্তু চেঁচাব..
ছেলেটা সোজাসাপটা জবাব দিল,
-“স্টেশনে যারা আছে সবাই ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছে আমি একজন কে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছি তাই চেঁচালেও যা না চেঁচালেও তাই। কারো এগিয়ে আসার হলে এমনি আসবে..
-“এসবের মানে কী…?
ছেলেটা থমকে দাঁড়াল আদিবার দিকে ঘুরে বলল
-“আমার পারমিশন ছাড়া তুই গ্রামে যাওয়ার সিধান্ত নিস কোন সাহসে?
আদিকে দেখে আদিবার দেহে যেন প্রাণ ফিরে পেল শান্ত হয়ে বলল
-“ভাইয়া আপনি…??উফ আর একটু হলে ভয়ে আত্মাটা বেরিয়ে যেত..কত ভয় পেয়েছিলাম জানেন?
বলে আদিবা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল।
আদি রাগী চোখে তাকিয়ে আছে দেখে আদিবা ভয় পাওয়ার কথা কিন্তু সে ভয় পাচ্ছে না কারন তার আনন্দ হচ্ছে। আদি তাকে নিতে এসেছে ভেবেই ভাল লাগছে।আদিবার চোখে মুখে খুশির রেখা ফুটে উঠেছে।
-“কিরে এখানে হাসির মত কোন ঘটনা ঘটেছে?ইডিয়েটের মত হাসছিস কেন?
-“আমাকে যেতে দিবেন না এটা স্টেশনে বললেই তো হত এতদূরে আসার কি দরকার ছিল? তখন নিষেধ করলেই তো আসতাম না।
-“সেটা যদি তুই বুঝতি তাহলে তো কাজেই হত।
-“মানে..?
-“সামনে দেখ তাহলেই বুঝতে পারবি।
আদিবা তাকিয়ে দেখল স্টেশন পেরিয়ে তারা রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। আদিবা এদিক ওদিক দেখে বোকা মুখ করে বলল,
-“কি দেখব ভাইয়া?
-“মাইল স্কেল দেখতে বলেছি যাইহোক তোর মত মাথামোটা সেটা বুঝবে না তাই বুঝিয়ে বলছি এখান থেকে গ্রামের বাড়ি ১৮০ কিলোমিটার আর বাসা ৬০ কিমি এখন তুই চিন্তা করে সিধান্ত নে তুই কোথায় যাবি।
-“আপনি না বললেন বাসায় যেতে..
-“হুম তবে তবে যেখানেই যাস না কেন হেঁটে হেঁটে যেতে হবে।
আদির কথায় আদিবা অবাক হল
-“এটা কেমন মজা?
-“মজা? আমি কি জোকার নাকি যে মজা করব?
-“তাহলে এসব কী বলছেন?
-“বাংলা বুঝিস না? তুই যা ইচ্ছে তাই করবি আর আমি বসে বসে দেখব এমনটাই ভেবেছিলি…?নিজেকে কী ভাবিস তুই? আজ যদি তোর জেদ ভাঙতে না পারি আমার নাম আদি না। বাসায় কী যেন বলেছিস আমার জন্য তোর থাকতে অসুবিধে হচ্ছে তাই না? একবার বাসায় চল অসুবিধা কত প্রকার আর কী কী সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাবি।
-“আমি বাসায় যাব না। কি করবেন আপনি জোর করে নিয়ে যাবেন?
-“একদমি না রাস্তা দুদিকেই খোলা তোর যেদিকে খুশি যেতে পারিস তবে রাতের বেলায় একা একা যাওয়াটা কী ঠিক হবে?দেখ,ভাই হিসেবে আমার ত একটা দায়িত্ব আছে তাই না?আমি যেহেতু বাসায় ফিরব তাই এইটুকু উপকার করতেই পারি মানে তুই যদি এদিকে যাস আমি সারা রাস্তা তোকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাব আর ওদিকে গেলে শেওড়া গাছের জ্বিন তোকে পাহারা দিতে দিতে নিয়ে যাবে তার উপড়ে রাস্তার ছেলেরা তো আছেই এবার তোর ইচ্ছা।
-“ভাইয়া…
-“ফ্লার্ট করে কোন লাভ নেই।
বলতে বলতে আদি গিয়ে বাইকে উঠে বসল আদিবা দৌড়ে গিয়ে বলল,
-“ভ ভ ভাইয়া আমার ভুল হয়েছে। আপনাকে না বলে আসা আমার উচিত হয় নি। আমাকে একা রেখে যাবেন না প্লিজ আমাকে নিয়ে যান।
আমি আপনার সাথে যাব…
-“এই তো সাবাস মেয়ে চল হাঁটা শুরু কর তাহলে…
-“হেঁটে যাব..?
-“অবশ্যই।
-“কিন্তু কেন আপনার সাথে তো বাইক আছে।
-“তাতে কী এটা তোর শাস্তি। আমার কথা নড়চড় হয় না। হেঁটে যাবি বলেছি মানে হেঁটেই যাবি।
-“এত দূরে হেঁটে হেঁটে কি করে যাব?এটা কি সম্ভব.
-“মানুষ সাঁতরে মাইলের পর মেইল পাড়ি দিয়ে দেয় আর তুই হেঁটে যেতে পারবি না?
-“ভাইয়া…
-“কথায় আছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে বুক কাঁপল না? আমি জানতে পারলে তোর পা দুটি যে ভেঙে গুড়িয়ে দিব জানতি নাকি ছোটবেলার ইতিহায়া ভুলে গেছিস? আ… দি…বা বহুত উড়াউড়ি করেছো তুমি এবার পাঁখা দুটো ছাঁটার সময় হয়েছে।
বলে আদি বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।
-“ভাইয়া আমায় রেখে যেও না প্লিজ..আমার অন্ধকার ভয় লাগে দাঁড়াও প্লিজ…আর কখনো তোমার অবাধ্য হব না। এবারের মত ক্ষমা করে দাও দয়া করো প্লিজ ভাইয়া।
কে শুনে কার কথা আদিবার কথায় আদি থামল না
।
।
।
চলবে…!!