বড়ো খালা এসেছিল আজকে। তাঁর পরিচিত কোন এক ইঞ্জিনিয়ার সৌরভ নাম, বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছে।
আমি ঐখানে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে কথা গিলছি দেখতে পেয়ে বড়ো খালা আম্মুর হাত ধরে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
আমি উঠে গেলাম শারমিন আপুর সঙ্গে ঘটনা নিয়ে কথা বলতে। আমি যতদূর জানি, শারমিন আপুর পছন্দ আছে। ওরই ক্লাসমেট।
আপু পড়ার টেবিলে বসে গান শুনছিল আর কী কী যেন আঁকি বুকি করছিল খাতায়। সামনে একটা কারেন্ট এফেয়ার্স খুলে রাখা। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি।
পুরো ঘটনা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “আচ্ছা আমি আলাপ করে দেখি!”
“কী আলাপ করবি? “
“রাকিবের সঙ্গে কথা বলে দেখি! ওদের বাসা থেকে প্রপোজাল নিয়ে আসতে বলি!”
“হ্যাঁ, আমার মনে হয় এটাই সেফ হবে! বড়ো খালার বলে ফেলার আগেই রাকিব ভাইকে সিনে এন্ট্রি নিতে বল!”
“বলতেছি তুই যা!”
কিন্তু ঘটনা এতটা সহজ হলো না। সেদিন রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত আমার পাশের বিছানায় শুয়ে শুয়ে গলা নামিয়ে আপুর ঝগড়াঝাটি শুনলাম।
এইজন্যই এই সব এফেয়ার টেফেয়ার আমার পছন্দ না। এফেয়ার মানেই এক্সপেকটেশানস, আর এক্সপেকটেশানস মানেই মন খারাপ। লাভ ম্যারেজের ডিভোর্স রেট বেশি, শুনেছেন নিশ্চয়ই?
বড়ো খালার সঙ্গে আম্মুর কী কথা হলো জানি না, কিন্তু
এর দুএক দিন পরেই চলে এলো সেই পাত্রপক্ষ।
সালাম দিয়ে ওদের সামনে ঘোমটা দিয়ে বসলো বড়ো আপু, টুকটাক কথা বলে ছেলে মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ছাদের নিরিবিলিতে আলাপ পরিচয় করতে।
আজকে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন ভালো ছিল, রাতের খাবার খাওয়ার পরে যখন ওরা চলে গেল, স্প্রাইটের গ্লাস হাতে ঘরে এসে নিজের খাটে বসলাম।
আপু তখন শাড়ির সেফটি পিন খুলছে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে।
“তারপর? কেমন লেগেছে আপু?”
“কীসের? “
“ওই যে! “
“বুঝতেছি না এখনো! বললাম তো আমার অসুবিধা আছে, আমি বিয়ের জন্য রেডি না এখন! বিয়ে ক্যানসেল করে দিতে রিকোয়েস্ট করলাম। রাখে কিনা কে জানে! “
“ও!”
কিন্তু ঘটনা প্যাঁচ খেয়ে গেল। জানা গেল মেয়ে তাদের পছন্দ হয়েছে ঠিকই। তবে বড়ো মেয়ে নয় ছোট মেয়েকে। বোঝা গেল এর পেছনে ছেলের হাত রয়েছে।
এরপর দ্রুতই ঘটে গেল সব ঘটনা। বড়ো বোনকে রেখে ছোট বোনকে বিয়ে দিতে আম্মুর প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হয়ে গেল আমার সাথে, কারণ ছেলে ভালো, পরিচিত।
বিয়ে নিয়ে আমার তেমন কোনো স্বপ্ন কিংবা চাহিদা ছিল না। অকারণ ফ্যান্টাসিও ছিল না বলে কোনো প্রত্যাশা করিনি। কারণ আমার অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি প্রত্যাশা করলেই কষ্ট পেতে হয়।
বিয়ের পরের দিনগুলো কীভাবে যেন উড়ে গেল ঝড়ের বেগে। আসলে ও দেশের বাইরে থাকে, এক মাসের মধ্যেই বিয়ে করে বউকে নিয়ে আবার চলে যাবে এরকম প্ল্যান ছিল। তাই এতো তাড়াতাড়ি হয়ে গেল সবকিছু।
আপুর সঙ্গে কথা বলা কমে গেল আমার। টাইম জোন মেলে না।
এর মধ্যেই অন্য একটা সোর্স থেকে জানলাম, রাকিব ভাইয়ের বিয়ের খবর। রাকিব ভাই মানে আপুর সঙ্গে এফেয়ার ছিল যার।
ভালো চাকরি পেয়েছে রাকিব ভাই, বিয়ে করেছে পারিবারিকভাবে। আপুর সঙ্গে বিয়ের কথা উঠেছিল কিন্তু কথা এগোতে পারেনি। রাকিব ভাইয়ের ফ্যামিলি থেকে নাকি বলেছে, বড়ো বোনকে রেখে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছে, নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা আছে তার।
এসব কথা আমি জেনেছি অন্য একটা সোর্স থেকে। আপু কিংবা বাসায় কেউ বলেনি আমাকে।
বিয়ের পর থেকেই আমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে আম্মু। বোধ হয় আম্মু আশা করেছিল বিয়েতে রাজি হব না।
কিন্তু আমার রাজি না হওয়ার কারণটা কী হতো? বড়ো বোনের বিয়ে হয়নি বলে আমিও বিয়ে করব না?
এ কারণটা কি যথেষ্ট লজিক্যাল ছিল? আমার তো সেরকম মনে হয় না! আমার তো ভালো লেগেছিল সৌরভকে দেখে, ওর সঙ্গে কথা বলে!
আমার বিয়ের সাড়ে পাঁচ বছর পরে আপু একদিন ফোন করল আমাকে।
“নারমিন, কী খবর? “
আপুর স্বরে রাজ্যের ক্লান্তি জমে আছে। যেন কতো দিন ধরে ঘুমায় না আপু!
“এই তো আপু। তোর? “
আমি স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি প্রাণপণে।
“শুনেছিস তো সব?”
“কী শুনবো আপু?”
“রাকিবের কথা! “
“বাদ দে না আপু! আমার কাছে এসে বেড়িয়ে যা কয়দিন! “
“আসবো। “
সত্যি সত্যিই চলে আসলো আপু। সাময়িক বেড়াতে নয় স্কলারশিপ পেয়ে পড়তে চলে এলো।
আমার জন্য ভালোই হলো। আমারও শরীর চলছে না কিছু দিন ধরে।
সাড়ে পাঁচ মাস চলে আমার প্রেগন্যান্সির। বমি করার সময়টা পার হয়ে গেছে কিন্তু তার পরে এসেছে ক্ষুধার সময়।
এ সময় রাক্ষসের মতো খিদে লাগে, শুনে থাকবেন হয়তো। আর আমাকে উদ্ধার করতে এমনই সময় আপু এলো ত্রাণকর্তা হয়ে।
এখন আর মাঝরাতে উঠে চিন্তা করতে হয় না কী খাবো! কোনো দিন পুডিং বানানো থাকে কোনো দিন পাস্তা।
পেট বড়ো হচ্ছে, নিচু হয়ে পায়ের নখ কাটতে পারি না। বসে কাটতেও অসুবিধা হয়।
আপু বিছানায় বসে আমার পা নিজের কোলে তুলে নিয়ে হাসিমুখে কেটে দেয় আমার পায়ের নখ। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি আমার অসাধারণ বোনের দিকে।
নিজের ক্লাস, পার্ট টাইম জব সবকিছুর মধ্যেই ও আগলে রাখে আমাকে।
কিন্তু তার মধ্যেই ঘটে গেল একটা অদ্ভুত ঘটনা।
ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। সারা রাত প্রায় নির্ঘুম কাটিয়ে ভোরের আলো ফুটে উঠতে উঠতেই ঘুমিয়ে পড়ি আমি।
বেলা সাড়ে এগারোটার আগে ভাঙে না সেই ঘুম। আজকে ঘুম ভেঙে উঠে বালিশের তলা থেকে আমার ফোনে সময় দেখি আটটার কিছু বেশি বাজে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে কেমন যেন থমকে গেল ডাইনিং এ বসে দুজনের হাসাহাসি।
কেমন যেন লাগলো। এভাবে কথা বলা থামিয়ে দিলো কেন ওরা আমাকে দেখে?
যেন কিছু অস্বাভাবিক ঘটে চলছে!
আপু কেমন যেন থমথমে গলায় বললো, “কী, পাহারা দিতে আসছিস?”
“পাহারা দিতে আসবো কেন? আমার ঘুম ভেঙে গেছে তাই আসলাম! “
উঠে চলে গেল আপু।
এরপর এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটতে লাগলো। আমার শরীর ভালো নেই বলে আপু একটা স্পেশ্যাল চকোলেট কেক বানানোর জন্য রান্নাঘরে।
রান্নাঘর থেকে আমার কানে ভেসে আসে টুকরো টুকরো কথা আর চাপা হাসির শব্দ।
আমি শুনি। আমি দেখি।
আমি খাই। আপুর বানানো চকোলেট কেক, আরো আরো সব স্পেশ্যাল ডিশ আমার মুখে বিষের মতো লাগে।
দিনে দিনে মুখ ফুলেছে আমার, পানি এসেছে পায়ে। চেক আপ করতে গেলে নার্স ভাইটাল নিতে নিতে উদ্বিগ্ন স্বরে বলে, “ব্লাড প্রেশারটা এতো বাড়লো কিভাবে? বিশ্রাম নিতে পারছ না?”
আমি মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখে চলে আসি। আমার পেটের ভিতর বাচ্চার লাথালাথি অনুভব করতে করতে পেটের ফাটা দাগে ক্রিম ম্যাসেজ করতে থাকি।
ইদানীং খুব বেশি চুল উঠে যাচ্ছে। আপুর কাছে হট অয়েল ম্যাসেজ করতে বসলে আপু চিন্তিত হয়ে বলে, “টাক পড়ে যাবে নাকি তোর, নারমিন?”
আমি মনে মনে হাসি। কিছু বলি না।
চোখের সামনেই আমার সংসার চলে গেল আপুর কাছে। প্রতি দিন মরে যাব ভাবি কিন্তু আমার পেটের ভিতর বাচ্চার জন্য পারি না।
আপুর স্বরে আমার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ পেলেও আমি অনুভব করি ওর কথায় আলগা ফুর্তি, পুরুষের সোহাগ পেলে মেয়েদের যেমন থাকে।
পুরুষের আদরের পরে মেয়েদের গলার স্বরে কেমন আদুরে ভাব আসে, লক্ষ্য করে দেখেছেন কখনো?
আপুর রুচির উন্নতি হয়েছে। তার আণ্ডার গার্মেন্টস ক্লাসি হচ্ছে।
সব দেখি, সব বুঝতে পারছি, কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারছি না কেন?
অবশেষে একদিন সিদ্ধান্ত নিতে পারলাম। আমি নারমিন হার মানবো না।
প্রয়োজন হলে আমার দুই প্রিয়জনকেই নিজের হাতে শেষ করে দেবো। প্রিয়জন হারানোর শোক অনেক কিন্তু প্রতারিত হওয়ার চেয়ে বেশি নয়।
“আপু, আজ রাতে আমি রান্না করি?”
“তুই করবি? আচ্ছা কর! কিন্তু তোর শরীর ভালো? “
“কয়েক দিন পরে তো আরও পারবো না আপু! শেষ বারের মতো খাওয়াতে দে!”
মিষ্টি হেসে বললাম আমি। আসলেই তো শেষবারের মতো!
“আচ্ছা, কী কী লাগবে বল, আমি কেটেকুটে রেডি করে দিই?”
“আচ্ছা! “
কেমিক্যালটা আপুর ল্যাব থেকেই আনা আমার। ছোট বেলায়ই আপুর সিগনেচার নকল করতে শিখেছি।
আপু একটা রেস্টুরেন্টে জব করে, এর মধ্যেই আপুর ডিউটির দিন আপুর ল্যাবে গিয়েছিলাম। ছোট বেলায় যেমন যেতাম!
একই ভার্সিটি হওয়ায় সহজ হয়েছে ব্যাপারটা। এখন তদন্তে বেরিয়ে আসবে আপু নিজেই তার ল্যাব থেকে সুইসাইড করতে বিষাক্ত কেমিক্যাল নিয়ে এসেছিল।
আর দেশে বিদেশের পরিচিত সবাই জানে আমার জন্য আপুই রান্না করে এখন, সুতরাং আমি রান্না করেছি এটা কারো জানার কথা নয়।
খেতে খেতে দুজনেই বললো, “দারুণ হয়েছে! “
হাসিমুখে তাকিয়ে রইলাম আমি।
“তুই বসবি না?”
“বসব! রান্না করতে করতে আমার খুব খিদে পেয়ে গিয়েছিল, একটু আগেই বিস্কুট খেয়েছি!”
আপু লাজুক স্বরে বললো, “নারমিন, তোকে আমি অনেক দিন ধরেই একটা কথা বলব বলে ভাবছি! “
“কী সেটা? “
“তুই আবার অন্যভাবে নিস কিনা..”
“অন্যভাবে নিবো না, বল তুই! “
“একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এখানে এসেই চাকরির জন্য কথা বলতে গিয়ে একজনের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম! ও আবার সৌরভের ফ্রেন্ড! ওর সঙ্গে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে আমার! “
আমি তাকিয়ে আছি। ব্যাপারটা বুঝতে পারছি না।
“আবারও আগের মতো হয় কিনা, তাই আগেই সবাইকে জানাতে চাইনি! ওর বাসার সবাই দেশে থাকে, আজকে ওর বাসার মানুষের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে খুব ভালো লেগেছে আমার। ওরা আমাদের বাসায় খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের জন্য বলবে! “
ও কথা বলতে বলতেই হঠাৎই গলায় হাত দিয়ে মাটিতে পড়ে গেল আমার বর।
প্রবল ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম আমি। হায় হায় একি হলো! আমি এটা কী করে ফেললাম?
কিছু বোঝার আগেই আমি থাবা দিয়ে দুজনের সামনে থেকে খাবারের প্লেট ফেলে দিলাম মাটিতে।
দ্রুত ছুটে গিয়ে কল করে সাহায্য চাইলাম ইমার্জেন্সিতে।
কিন্তু লাভ হলো না।
আমি নারমিন, এই গল্পের ছোট বোন। আমার বরের সঙ্গে বোনের গোপন কথা আর চাপা হাসি কী ব্যাপারে হয়, সেই ধাঁধাটা মেলাতে গিয়ে এতো বড়ো ভুল হয়ে গেল আমার?
©মৌলী আখন্দ
#ছোটগল্প
#ধাঁধা