জলিল ঐ মুহুর্তে দৌড়ে মাজারের ভেতরে গিয়ে দেখে শাহেদা তনুকে হাত ধরে টেনে হিঁচড়ে মাজারের দরজার দিকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। তারাহুরোয় সে জুতা খুলতে ভুলে গেছে। জলিল তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে একটু ধমকের সুরে,
: কি করছো শাহেদা! মেয়েটা হাতে ব্যাথা পাবে তো! ছাড়ো, ছাড়ো বলছি।
শাহেদা জলিলের দিকে কান্না ভরা চোখে তাকিয়ে,
: দেখছো না ওকে নাড়ানো যাচ্ছে না? উঠে দাড় করানোর অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কিছুতেই কথা শুনতেছে না।
বলতে বলতে এক পর্যায়ে শাহেদা কান্না করে দিলো। এমনিতে কিন্তু আশেপাশে এতোক্ষণ কোন লোক ছিলো না। বাইরে বালতি নিয়ে পানি আনতে গেলো যে লোকটা? তার চিৎকার চেঁচামেচিতে কোত্থেকে যেন লোকজন এসে জড়ো হওয়া শুরু করেছে। তারাও একপা দুপা করে তনুর চার পাশে গোল হয়ে দাড়িয়ে এখন মজা দেখছে। জোয়ান সেয়ানা মাইয়া। মাজারে কবরের সামনে হিসু করে দিছে। এখন এটা নিয়ে নিশ্চয়ই বিশাল গ্যান্জাম হবে। এসব ঝামেলা লোকজন খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে। বরং ঝামেলার মধ্যে কিভাবে আরো ঘি ঢেলে তাকে উস্কে দেয়া যায়? আশেপাশের লোকজনের ভিড়ে সেই চেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু সমস্যার সমাধান করতে কেউ এগিয়ে আসে না।
এই ভিড়ের মধ্য থেকে মাতুব্বর টাইপের কয়েকজন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নানা রকমের কথা শোনাচ্ছে। তাদের দিকে শাহেদা আতংকিত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এই বুঝি লোকজন মাজার অপবিত্র করার দায়ে তাদের গায়ে হাত তোলে। এই সময় জলিল তনুকে দুহাতে জাপটে ধরে এক ঝাঁকিতে দাড় করিয়ে দিলো। তারপর এক রকম কোলে করেই তাকে বের করে এনে গাড়িতে নিয়ে বসিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো।
ড্রাইভারকে গাড়ির দরজা লক করতে বলে সে আবার মাজারে গিয়ে ঢুকলো। এবার অবশ্য সে জুতা খুলেই প্রবেশ করলো। মাজারের দায়িত্বে কে আছে? তাকে খুঁজে বের করে,
: হুজুর, আমরা তো আসলে বুঝতে পারনি আমার মেয়েটা এ কাজ করে ফেলবে। ও আসলে একটু ভালো রকমেরই অসুস্থ। ও যেন সুস্থ হয়ে উঠে তাই আমরা এখানে নিয়ে এসেছিলাম। আপনাদের মাজার সম্পর্কে অনেক শুনেছি। আপনাদের দোয়ায় অনেকেই নাকি সুস্থ হয়েছে। আমি সত্যিই সব কিছুর জন্য দূঃখিত।
বলেই জলিল লোকটার সামনে মাথা নিচু করে দুহাত জড়ো করে ক্ষমা চাইলেন। লোকটা দ্রুত কয়েক পা এগিয়ে জলিলের দু হাতের উপর নিজের দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে,
: কি বলছেন এসব ভাইজান! এই মাজারটাতে তো অনেক আশা নিয়ে অসুস্থ রুগীরাই বেশি আসে। তাদের মানতের টাকা বা হাদিয়ার উপরই মাজারের সমস্ত খরচ চলে। আমরাও খেয়ে পরে বেঁচে আছি। ঘটনার জন্য আপনি মোটেও মন খারাপ করবেন না। আর হ্যা, আপনার মেয়ের জন্য আমি খাশ দিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করবো। মাজারের কবরে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি তো শুধু মাত্র উছিলা। কিন্তু আসল শেফাদানকারী তো ঐ সবার উপরে যিনি বসে আছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনার মেয়েকে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করবেন।
জলিলের চোখে এবার সত্যি সত্যিই পানি চলে এলো। ঝাপসা চোখে সে হুজুরের দিকে তাকালেন। হুজুরের মুখের দাড়ি আর মাথায় পাগড়ি পরার কারণে কেমন যেন তাকে দরবেশের মতো দেখাচ্ছে। চোখের সুরমার কারণেই নাকি তার ঐ দরবেশ চেহারায় প্রচন্ড মায়া মায়া লাগছে। জলিল আর সেখানে বেশি সময় দাড়ালেন না। হুজুরকে মাজারের জন্য পাঁচ হাজার টাকা সাধলেন। কিন্তু হুজুর কিছুতেই নিলেন না। বললেন,
: আপনার মেয়ে যদি আল্লাহর রহমতে সুস্থ হয় তাহলে খুশি মনে যা দিবেন তখন আমি আপনাকে ফেরাবো না নিশ্চিত।
জলিল বেরিয়ে এসে নিচু হয়ে খুলে রাখা জুতা দ্রুত পায়ে পড়ছে এমন সময় সে তার সামনে লুঙ্গি পড়া একজোড়া পা দেখতে পেলেন। লোকটার মুখের দিকে তাকাতেই হে হে করে বিগলিত হাসি হেসে,
: স্যার, যে কার্পেটের উপর….. মানে আর কি ঐডা আমারই ধুইতে হবো তো। বুঝেনই তো কার্পেট বিরাট ভারি বস্তু। তাছাড়া ঐডা কান্ধে কইরা পুকুর ঘাটত নেয়া বিরাট দিগদারি ব্যাপার।
জলিল লোকটিকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাতে পাঁচশো টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে গাড়িতে উঠেই ড্রাইভারকে মুখে কিছু না বলে হাতের ইশারায় গাড়ি আগাতে বললেন। সেদিনের পর থেকে সে আর কোন পীর, ফকির, মাজারের দিকে যাননি। শুধুমাত্র সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ মেনে চলেছেন। তবে এরপর থেকে তনুকে অসুধ খাওয়ানোর দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিলেন। আর ছুটির দিনগুলিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে না গিয়ে তিনি ঘরে পড়া শুরু করলেন। প্রতি ওয়াক্তের নামাজ পড়ার সময় জলিল শাহেদাকে বলেন,
: তনুকে, অজু করায়ে একটা জায়নামাজ বিছিয়ে দাও তো শাহেদা।
শাহেদা একটু বিরক্ত হয়ে,
: প্রতিদিন তুমি এটা কি শুরু করলে বলতো তো? ও কি নামাজ পড়ার অবস্থায় আছে? নাকি ওর জন্য নামাজটা এখন ফরজ?
: অতো কিছু বুঝি না। আমি শুধু এটুকু বুঝি, আমি যখন তনুর জন্য আল্লাহর দরবারে দাঁড়াব তখন তনুও আমার পাশেই থাকুক। শাহেদা, এ কাজটা আমাকে করতে দাও প্লিজ।
এরপর আর শাহেদা কোন রকম আপত্তি করেনি। দেখা গেলো একটু পর নামাজের সময় সে নিজেও তাদের পাশে আরেকটা জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পড়া শুরু করেছে। তনুকে সামাল দিতে জলিল আর শাহেদার বেশ কষ্টই হচ্ছিলো। তারপরও কোন কাজের লোকের হাতে তনুর কাজ তারা করায়নি। তাদের বয়সও হয়েছে। তনুকে নাড়ানো তাদের পক্ষে একটা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এরপরও তারা দিনের পর দিন তনুর খেয়াল নিজেরাই রেখেছে। তনুর বাবা-মা’র সাথে আর তারা যোগাযোগ করেনি। অবাক কান্ড, তারাও কোন খোঁজ খবর করেননি!
দীর্ঘ দেড় মাস টানা অসুধ খাওয়ানোর পর তনু কয়েকদিন ধরে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। ইদানীং সে ডাইনিং টেবিলে আপা-দুলাভাইয়ের সাথে খেতেও বসছে। খেতে বসে টুকটাক কথাও হচ্ছে। যদিও কথা সে এখনো আগের মতো বলে না। আগেই বা তেমনটা কথা কই বলতো? বলতো না বলে মনে হয় বলতে পারতো বললে সঠিকটা বলা হবে। এর মাঝে শুধু একদিন ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে অসুধের মাত্রা ঠিক করে আনা হয়েছে। আর তনুর অবস্থা আরেকটু স্বাভাবিক হলে কাউন্সিলিং এর জন্য অন্য একজন সাইকোথেরাপিস্টের কাছে রেফার করা হয়েছে।
তনুর কাউন্সিলিং এর আজ তৃতীয় দিন। যে মেয়েটা তনুকে কাউন্সিলিং করছে তার নাম সানজিদা। বয়স একদম কম, তরুনী। বয়সের চাইতেও তাকে দেখতে আরো ছোট মনে হয়। যথেষ্ট সুন্দরীও। কিন্তু কথা যখন বলে তখন মনে হয় তার সৌন্দর্যের মাত্রা আরো দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তনু মাঝে মধ্যেই কথা থামিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের দুজনের কথোপকথোনের সময় তনু যখন বেশ ইমোশনাল হয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়? তখন সানজিদা টেবিলের অপর পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে তনুর দু’হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে ধরে বসে থাকে। তনুর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে,
: আপনি শান্ত হোন। এখন কিছু বলতে হবে না। আপনার ইচ্ছে হলে একটু পর না হয় আমরা আবার কথা বলা শুরু করবো। আর বেশি খারাপ লাগলে গল্পটা না হয় অন্যদিন হবে।
সানজিদার হাতের স্পর্শ এতো নরম, কোমল এবং ঠান্ডা। যখনই তনুর হাতটা সে ধরে সাথে সাথেই তনুর মনটা শান্ত হয়ে যায়। তনুকে আজ পুরোপুরি সুস্থ এবং ঠিক আগের মতো লাগছে। সানজিদা তনুর এতো দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসায় বেশ স্বস্তিবোধ করতে লাগলো। মনে মনে সে তনুকে ধন্যবাদও দিলো। তাছাড়া মেয়েটির সাথে কথা বলেও তার বেশ ভালো লাগছে। মেয়েটা সানজিদার প্রশ্নের উত্তর বেশ গুছিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। ডে বাই ডে তার পরিবর্তন টের পাচ্ছে সানজিদা। সব চাইতে বড় কথা, তনু এখন যুক্তি দিয়ে কথা বলছে। একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ রোগীর জন্য এটা একটা বড় আশার কথা।
: তনু, আপনি খুব দ্রুত রিকোভারি করেছেন। আপনি কি জানেন? এটা আমার দেখা বিগত কেসের মধ্যে খুব রেয়ার?
তনু একটু হেসে,
: জি না আপা।
: তারমানে আগে থেকেই আপনার মানসিক শক্তি অসাধারণ। অনেক শক্ত মনের মানুষ। আপনি খুব চমৎকার ভাবে আপনার কঠিন সময়টাকে মোকাবিলা করেছেন। আমাদের চিকিৎসার প্রতিটা ধাপ সুন্দর ভাবে মেইনটেইন করেছেন।
: এই জন্য অবশ্য আপনি আমাকে নয়। আমার এই সুস্থতার জন্য আপা, দুলাভাইয়ের অবদান অনেক অনেক বেশি।
: আমি তাদের সাথেও নিশ্চয়ই কথা বলবো। তবে আপনার সাথে কথা শেষ হওয়ার পর। গত দুদিন আমি আপনার মোটামুটি সব কথাই শুনেছি। কোন রকম প্রশ্ন করিনি। আজ কি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি?
: জি বলুন।
: আপনার কথার উপর ভিত্তি করেই বলছি, আপনার স্বামী মারা যাওয়াতে আপনি প্রথম দিন বেশ স্বাভাবিক ছিলেন। আপনার কথা শুনে মনে হলো বিধবা হওয়াতে আপনি বেশ স্বস্তিই পেয়েছিলেন। এমনকি আপনি দীর্ঘদিন ধরে এসব কিছু থেকে নিস্তার চাচ্ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে আপনার মধ্যে এমন কি হয়েছিলো? কেন আপনি মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরলেন?
চলবে……..
আফরোজা খানম তন্দ্রা