ঘাড় ঘুরিয়ে শাহেদকে দেখে তনু ভয়ংকর ভাবে চমকে উঠলো! পেছন থেকে শাহেদ তনুকে জাপটে ধরে আছে। শাহেদের দুই হাত তনুর দুই হাতের কবজির উপর ধরা। দুজনের চারটা হাতই তনুর বুকের সাথে লাগানো। আর তনুর পিঠটা শাহেদের বুকে চেপে ধরে রেখেছে। তার বুকে প্রচন্ড চাপ লাগছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তনু অনেক চেষ্টা করছে শাহেদের হাত থেকে নিজেকে ছুটাতে। কিন্তু শক্তিতে কোন ভাবেই পারছে না। সে যতই চেষ্টা করছে শাহেদের হাতের বাঁধন ততই টাইট হচ্ছে। শাহেদের আঙ্গুলগুলো তনুর কবজিতে গেড়ে বসে গেছে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে হাতদুটো অবশ হয়ে আসছে। হঠাৎই অনেক দূর থেকে তনু তার নাম ধরে কাউকে ডাকতে শুনলো। সাথে সাথেই তনু চিৎকার করে তার অবস্থান জানানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছুতেই তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না। সে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে আবারও চিৎকার করতে চাইলো। এবার তনু ডাকটা তার খুব কাছ থেকে শুনতে পেলো,
: তনু, তনু এই তনু……
মাথায় আলতো হাতের স্পর্শ পেয়ে তনু ধরমরিয়ে উঠে বসে। এখনো হাঁপাচ্ছে সে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। চারপাশে আতংকিত চোখে তাকিয়ে সে শাহেদকে খুঁজতে লাগলো। স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি। কিছুক্ষণের জন্য তনুর মুখের কাছে ঝুকে থাকা মুখটাকেও অপরিচিত মনে হয়। আশেপাশে এতো মানুষের ছোট ছোট কথা, আনাগোনা, সেইবা কোথায় আছে, এরা কারা, তার চার পাশে এতো লোকজন কেন? কোন কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সে। এমন কি নিজের ঘরটাও চিনতে পারে না। তনুর দিকে ঝুঁকে আসা মুখটার চোখে নরম চাহনি। সে বুঝতে পারে তনু তাকে চিনতে পারছে না। সে তার মুখটা তনুর প্রায় কানের কাছাকাছি এনে ফিসফিসিয়ে বলে,
: তনু, আমি তোমার বড় ননাস। শাহেদের বড় বোন। আজ সকালেই শাহেদ মারা গেছে।
এ কথা শোনার সাথে সাথেই তনুর দৃষ্টিতে চেনা চাহনি ফিরে আসে। আর সে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সে সদ্য বিধবা! আজই তার স্বামী মারা গেছেন। আর সে কিনা পরে পরে ঘুমাচ্ছে! কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছে? লোকজনই বা কি ভাবছে? তনু মনে মনে বলে উঠলো,
: আল্লাহ রহম করো। আমার ঘুম, ক্ষুধা, পিপাসা এসব দিও না। এগুলা তুমি আজকের জন্য দয়া করে তুলে নাও। আমাকে কাঁদতে দাও। আমার চোখে পানি এনে দাও। শাহেদের জন্য আমাকে দূঃখ করতে দাও।
এবার একটু ধাতস্থ হয়ে সে বড় আপার দিকে তাকালো। বড় আপার মুখটা এতো মায়াবী। তার কাছাকাছি থাকলে তনুর কেন যেন খুব শান্তি লাগে। আর উনিও তনুকে কোন এক অদৃশ্য কারণে খুব পছন্দও করেন। কিন্তু সেই পছন্দটারও কোন বারাবাড়ি নেই এবং প্রকাশটাও কম। বিয়ের পর তনু জানতে পেরেছে শাহেদ ছোটবেলা থেকে এই আপার কাছেই মানুষ। কারণ শাহেদের জন্মের পর পরই তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পরেন। আর বড় আপার সাথে শাহেদের বয়সের পার্থক্যও অনেক। শাহেদের জন্মের প্রায় বছর খানেক পরই আপার বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় নাকি আপা শাহেদকে সাথে করে নিয়ে যান। পরবর্তীতে শাহেদ আপার ছেলেমেয়েদের সাথে একসঙ্গে বেড়ে উঠে। শাহেদ সম্পর্কে যতটুকু তনু জেনেছে এই আপার কাছ থেকেই। শাহেদের প্রতি তার অভিযোগের কথাগুলিও আপার সাথে মাঝে মধ্যে সে শেয়ার করতো। আপা খুব মনোযোগ দিয়ে তনুর কথা শুনতো কিন্তু শাহেদকে কখনো তেমন কিছু বলতো না। শুধু তনুকে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে বলতেন।
: তনু, সবাই তো এখন আস্তে আস্তে বিদায় নিবে। বিদায় নেয়ার আগে সবাই তোমার সাথে দেখা করতে চাইবে। আমি জানি তুমি খুব ক্লান্ত। কিন্তু এখন যে একটু উঠে বসতে হয় বোন।
তার কথাতেও এতো মায়া। আপার কথা শুনে এই প্রথম তনুর চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। ঘুমিয়ে পরার আগে কেউ একজন তনুকে ২/৩ গাল ভাত মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে আবার অন্য দিকে চলে যায়। যেন, তনু তাকে না করেছে, তার ক্ষুধা নাই। সে খাবে না। যেন কারো জামাই মারা গেলে এর বেশি খাওয়া আইনত দণ্ডনীয়! তার পেট ভরে ভাত খাওয়া অপরাধ। ঐটুকু খেয়ে বরং তনুর ক্ষুধার সাথে সাথে পানি পিপাসাও পেলো। কিন্তু কাউকে পানি এনে দেয়ার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আবার উঠে ঐ জনসমুদ্রের কথার মাঝে গিয়ে খেতেও ইচ্ছে করছিলো না। একটু পর আরেকজন একটা তছবী হাতে দিয়ে দুরুদ পড়তে বলে গেলো। তনু দুরুদ পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে গেছে, টের পায়নি।
ধীরে ধীরে বাসাটা খালি হতে লাগলো। সারাদিন তনুর মা তার কাছে আসেননি। তনুর শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনদেরকে সময় দিয়েছেন। এটা তনুর জন্য একটা ভালো কাজ হয়েছে। লোকজনের ভিড় কমাতে তনুকে একলা পেয়ে তনুর মা নিচু গলায় জিগ্যেস করলেন,
: ওরা কি তোকে কোন টাকা দিয়েছে? ওরা তাই আলোচনা করছিলো তখন শুনলাম।
এই পরিস্থিতিতে মার এই প্রশ্ন তনুর ঠিক পছন্দ হয়নি। এটা তনুর মা তার তাকানোর ভঙ্গি দেখেই বুঝতে পারেন। তাই কৈফিয়ত দেয়ার সুরে,
: না মানে বাসায় এতো মানুষ। তোর মাথার ঠিক নেই। তাই জানতে চাচ্ছিলাম টাকাটা কি সাবধানে রেখেছিস কিনা?
বলেই উনি তারাতাড়ি তনুর সমনে থেকে চলে গেলেন। একটু পর বড় আপা আর বড় দুলাভাই তনুর রুমে এসে দরজাটা ভিড়িয়ে দিলেন যেন কেউ এই রুমে চট করে ঢুকতে না পারে। তনুর দু’পাশে দুজন বসলেন। বড় আপা খুব লুকিয়ে যেন দুলাইও দেখতে না পায় এমন ভাবে তনুর হাতে বেশ অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট গুজে দিয়ে,
: শোন তনু, শাহেদকে আমি আমার সন্তানের মতো লালন-পালন করেছি। সেই হিসাবে তোমাকেও আমি সন্তানের চাইতে কোন অংশে কম দেখতাম না। তার উপর তোমার বয়স আমার মেয়ের চাইতেও কম। তোমার ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব হয়তো পুরোপুরি আমারই ছিলো। কিন্তু কি করবো? সন্তান সমতুল্য শাহেদের অনেক অন্যায়ের প্রতিবাদ আমি করতে পারিনি। তোমার জন্য প্রযোজ্য সুখ আমি আদায় করে দিতে পারিনি। তারপরও বলছি, আমার ছেলের মতো ভাইটার উপর কোন রাগ রেখো না। পারলে ওকে তুমি ক্ষমা করে দিও।
আপার এই কথায় কি ছিলো জানে না তনু। তবে চোখের বাঁধ ভেঙ্গে বুকের গভীর থেকে নিংড়ে নিজের অজান্তেই কোত্থেকে যে এতো কান্না এলো! সারাদিন পর এই প্রথম তনু চিৎকার করে কাঁদছে। না, এই কান্না শাহেদের মৃত্যুর জন্য নয়। এই কান্না নিজে একা হয়ে যাওয়ার জন্য নয়। এই কান্না ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার জন্য নয়। এই কান্না এতো বছর শাহেদের অমানুষিক অত্যাচার নিরবে সহ্য করার জন্যও নয়। এ কান্না শুধু মাত্র একটা মায়ার হাতের স্পর্শের জন্য। এই কান্না তনুকে বুঝতে পারার জন্য।
বড় আপা তনুকে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরে থাকলেন। বড় দুলাভাই তনুর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে,
: যদি পারিস আমাদেরকেও মাফ করে দিস মা।
এরপর আপার দিকে তাকিয়ে,
: ওকে একটু একা থাকতে দেয়া উচিৎ। যত পারে কান্না করুক। কান্না করতে দাও ওকে। চোখের পানি মুছে দেয়ার দরকার নাই। কান্নাটা ওর ভিষণ প্রয়োজন।
চলবে……….
আফরোজা খানম তন্দ্রা