বিমূর্ত প্রতিশোধ
পর্ব ৪
তারানা মরিয়ম খান (রিনি)
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দু’জনের ডিভোর্স পেপারই তৈরি হয়ে গেলো।সাইন করে দু’দিন আগে পিছে করে পাঠিয়ে দিলাম দেবর, ভাবীর নিকট। দশ মিনিটের মধ্যেই বাবার কল আসলো।ফোন রিসিভ করতেই বাবা যেন হুংকার দিয়ে উঠলেন। উনি যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই আমাকে বকতে লাগলেন।আমি যে তার সন্তান, সেটা তিনি ভুলে গেলেন।আমি বার বারই বলতে চাচ্ছিলাম বিষয়টি নিয়ে।তিনি আমায় পাত্তা দিলেন না।তিনি আমায় যে কথাগুলো বললেন তাতে আমি থান্ডার হয়ে গেলাম।আমি নাকি পুরনো প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছি। সিয়াম কে নাকি স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছি।জোর করেও নাকি সে আমার কাছাকাছি আসতে পারেনি। আমি তাকে ঠকিয়েছি, ধোকা দিয়েছি। শেষের বাক্যটি শুনে স্থীর থাকতে পারিনি। বাবার মত করে আমিও হুংকার দিয়ে উঠলাম।এই প্রথম বাবার সাথে উঁচু গলায় কথা বললাম। কারণ এই চব্বিশ বছরেও বাবা তার মেয়েকে চিনতে পারেন নি।নিজের মেয়েকে প্রায়োরিটি দেয়ার চেয়ে একজন ধোকাবাজ কি বলল না বলল সেটাই মুখ্য হয়ে গেলো!!!আমিও বাবাকে চেচিয়ে বলতে লাগলাম —তোমার কাজ তুমি করেছো!সুপাত্রে পাত্রস্থ করেছো!কিছু কি বলেছি??বলিনি!! একবার ফোন দিয়ে জেনেছো??জামাই বাবাজি কেমন??আমার প্রতি তার বিহেভ কেমন, আমি কি তাকে নিয়ে সুখী?? জানোনি!!জানাতে চাইলেও শুনতে চাওনি!! এখন আমার কাছে যা ভালো মনে হল,আমি তা-ই করলাম!তুমি বলার কে??বাবা আমায় ত্যাজ্য করবেন বলে ফোন কেটে দিলেন।
আমি একটও মন খারাপ করিনি।আমাদের সমাজ ব্যাবস্থাই এমন!! মেয়ে বড় হল,বিয়ে দিয়ে দাও তাড়াতাড়ি! সে সুখে থাকুক বা না থাকুক সেটা দেখার প্রয়োজন নেই।বিয়েতো দিতে পেরেছি!!পরিবেশ, পরিস্থিতি মেনে নিতে পারলে সুখী, না পারলে দুঃখী!!! বাবার মেন্টালিটিও ঠিক এরকমই। আমি ভালো ভাবেই জানতাম বাবা কোনদিন আমার পাশে থাকবেনা।তাইতো নিজের সমাধান নিজেরই করা লাগছে।
ডিভোর্স কার্যকরের তিন মাশ চব্বিশ দিন পর অত্যন্ত গোপনীয় ভাবেই আমাদের বিয়েটা হয়।বিয়ের পুর্ব মূহুর্তেও সাইম ভাই অমত প্রকাশ করছিলেন। শেষে বড় আপা হাত জোর করে মিনতি করেন।বিয়ে পর্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাইম ভাই মনমরা হয়েই বিয়ের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন।ভাইয়ের অবস্থা দেখে বড় আপা আমার প্রতি কিঞ্চিৎ পরিমাণ রাগ করেন।কারণ ডিভোর্স কার্যকর হওয়ার পুর্ব পর্যন্ত আমি বড় আপার বাসাতেই ছিলাম।তিনি খুব করে চেয়েছিলেন, আমি যেনো এই কদিনে সাইম ভাইকে নিজের প্রতি আসক্ত করে ফেলি।কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে বিশ্রী লাগায় আমি সাথে সাথেই মানা করে দেই।যাক ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হয়ে গেলো আমাদের।বিয়ের পর আমি কথায় কথায় বড় আপার কাছে জানতে চাইলাম —আমাদের বিয়েটায় তিনি এত আগ্রহী কেনো?কেনোই বা এতটা পজিটিভ হলেন।
তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন—জীবনে একবারের জন্যে হলেও সাইম কে জেতাতে চাচ্ছিলাম। ছেলেটি ছোট ভাইকে জেতানোর জন্য সারাজীবন ইচ্চাকৃত ভাবে হেরেই গেলো।
আমিতো সাইম ভাইকে বিয়ে করেছি শুধুমাত্র দেবর,ভাবীর প্রতিশোধ নিতে, সংসার করতে নয়।তাই বিয়ের কিছু দিন যেতে না যেতেই আমি সাইমকে বললাম–আমি ঐ বাড়িতে যাব,এবং এখন থেকে আমরা সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবো। আমি এখন বাড়ির বড় বউ।আমি যেভাবে চাইবো,সবাইকে সেই ভাবেই চলতে হবে।
—-তুমি কি ওদের প্রতিশোধ নিতে আমায় বিয়ে করেছো?? সাইম রাগী দৃস্টি নিয়ে আমার দিকে তাকাতেই আমি ভয়ে কেদে ফেলি।আর হর হর করে আমার ভেতরের পুঞ্জীভূত কষ্টগুলো বলতে থাকি।
সাইমের রাগী চেহারা কিছুটা মলিন হয়ে আসে।সে আমার পাশে এসে বসে।আমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় ভরে বলতে থাকে—দেখো হাত,পা,মুখ ব্যাবহার করে প্রতিশোধ নিলে অল্পতেই তা সেরে উঠে।কিন্তু এবস্ট্রাকট রিভেঞ্জ অর্থাৎ বিমূর্ত প্রতিশোধ খুবই জটিল একটা বিষয়। আমি মনে করি মারামারি , পারাপারি,কাটাকাটি করে প্রতিশোধ নেয়ার চেয়ে বিমূর্ত প্রতিশোধই উত্তম প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে।যা বাহ্যিক ক্ষতির চেয়ে ভেতরের ক্ষতিই করে বেশি।যেটা মানুষের হার্ট ও ব্রেইনের ক্ষরণকারী। আরেকটি ব্যাপার জানো তো -মানসিক ক্ষত অনেক সময় শারীরিক ক্ষতের চেয়েও বেশি ভয়ংকর। আমরা কিন্তু ইচ্ছে করলে এভাবেও প্রতিশোধ নিতে পারি।
সাইম আমাকে বোঝাচ্ছিল আর আমি পলকহীনভাবে তাকিয়ে তাকে দেখছিলাম। এই প্রথম আমি ভালো করে তাকে দেখি।সিয়ামের চেয়ে সাইম কয়েকগুণ বেশিই সুন্দর। কি মায়াবী চোখ! এই চোখে তাকিয়ে অনায়াসে জীবন পাড়ি দেওয়া সম্ভব। সিয়ামের মত ততটা ওভার স্মার্ট না হলেও যে কেউ-ই পাগল হতে বাধ্য তার নম্র,ভদ্র আচরণের জন্য।তার আচরনের জন্যই অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি আকৃস্ট হয়ে পরছি দিন কি দিন।
মাসের উপরে হতে চলল আমাদের বিবাহিত জীবন। বিয়েটা গোপনীয় ভাবে হলেও বেশিদিন গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। বাবা ফোন দিয়ে ছি ছি ছি করার পাশাপাশি অভিশাপ ও দিয়ে দিলেন।আত্নীয় স্বজনের মধ্যেও মৃদু গুঞ্জন শুরু হল।সিয়াম নিয়ম করে প্রতিদিনই আসতে লাগলো বড় আপার বাসায়।বিশ্রী ভাবে গালি গালাজ,হই চই করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। ডেইলি রুটিনে পরিণত হয়ে গেলো সিয়ামের আগমন। সাইম বড় আপার সাথে রাগা রাগী করতে লাগলো। বড় আপাকে চুপ থাকতে দেখে আমার সহ্য হচ্ছিলো না।আমি বলেই ফেললাম –ওরা দিনের পর দিন ব্যভিচার করে যাচ্ছিলো সেটা অপরাধ না আর আমরা শরীয়ত
মোতাবেক বিয়ে করেছি সেটা অপরাধ হয়ে গেলো!!নিচে সিয়াম বিশ্রী গালিগালাজ করেই যাচ্ছে।আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না।একেতো চুরি তার উপর শিনাজুরি!!আমি দরজা খুলে দ্রুত নিচে নেমে এলাম।পেছন পেছন সাইম ও বড় আপা নেমে এলো। আমাকে দেখেই বে.., নস্টা বলে গালি দিতে লাগলো। ক্ষোভে আমার মাথা ঠিক ছিলো না।আমিও বলতে লাগলাম –আমি যদি বেশ..ও নস্টা হই তাহলে হয় তোর দ্বারা নয়তো তোর ভাইয়ের দ্বারা হয়েছি।আর তোদের দুজনের সাথেই আমার সম্পর্কের বৈধতা ছিল।কিন্তু তুই কি করলি!!!তুইতো জানোয়ার!! জানোয়ারদের মতই তোদের লাইসেন্স বিহীন মিলন।তাইতো বড় ভাইয়ের স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করতেও তোর বুক কাপেনি!! আমাকে উত্তেজিত হতে দেখে সাইম এসে আমাকে শান্ত করার চেস্টা করে। আমি কোন মতে যখন শান্ত হচ্ছিলাম না তখন এক পর্যায়ে সাইম আমায় জরিয়ে ধরে।আমাকে জরিয়ে ধরতেই সিয়াম সাইমকে মারার জন্য তেড়ে আসে।হেচকা টানে আমার কাছ থেকে সাইমকে সরিয়ে কলার চেপে ধরে।কলার ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে —আসল ক্রিমিনাল তো তুই!!নিজের বউকে আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছিলি।আর এখন আমার বউকে ভাগিয়ে নিয়েছিস!!আমি তোদের দুজনকেই মেরে ফেলবো!!একদমই মেরে ফেলবো!! আমার জিনিস আমি না পেলে কাউকেই পেতে দিবোনা।
সে সাইমকে মারার জন্য হাত ওঠাতেই আমি সজোরে সিয়ামকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিই।সিয়ামের কথাগুলো শোনার পর আমার রাগ কয়েকশো গুন বেড়ে যায়।দিনের পর দিন ইগনোর করে এখন আসছে কাহিনী শোনাতে।আমি পর পর কয়েকবার ধাক্কা মেরে চিতকার করে সিয়ামের উদ্দেশ্যে বলি —সাইম আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ!!আমার জীবনের সর্বোচ্চ চাওয়া,এবং পাওয়া। সো বুঝতেই পারছিস ব্যাপারটা!! তাই বলে রাখি সাইমের উপর যদি বিন্দুমাত্র আঘাত আসে, সেই আঘাতের প্রতিঘাত নিতে আমাকে!হ্যাঁ আমাকে যতটুকু নিচে নামতে হয়, আমি নামবো!!এক ইঞ্চি পরিমাণও ছাড় দিবো না।ক্রোধের চোটে আমি জোরে জোরে কাদতে লাগলাম। আমার সে কান্না সাইমের জন্য নয়,সিয়ামের জন্য।সিয়ামকে আমি ভালোবেসে ছিলাম!!নিজের সবটুকু স্বত্তায় শুধুমাত্র সিয়ামের স্থান ছিলো।অ-নে-ক ভালোবেসেছিলাম সিয়ামকে!অনেক!!!!কিন্তু সে আমার ফিলিংসের কোন মুল্য দেয়নি।বরঞ্চ ধোকা দিয়েছে। ধোকা!!!
আমার কথা শুনে সিয়াম আংগুল উঠিয়ে আমাকে শাসাতে লাগলো —তোকে তো আমি!!!খুন করবো!!খুন করে জেলের ভাত খাবো!!তবু্ও তোকে ক্রিমিনাল কে নিয়ে সুখে থাকতে দি-বো-না!!!ছারবো না আমি কাউকেই!! আমার উদ্দ্যেশ আমি হাসিল করেই ছাড়বো!!
কিছু কিছু পুরুষ মানুষের অন্যতম বৈশিষ্ঠের মধ্যে অন্যতম ৈবশিষ্ঠ হলো সে শত নারীর সাথে কুকাজ করে বেড়াবে।কিন্তু নিজের বউকে কারো পাশে সহ্য করবে না।সিয়াম তার অন্যতম উদাহরণ।
চলবে…
(ভুল হতেই পারে।তাই ক্ষমাও চেয়ে নিচ্ছি)।
.