বিমূর্ত প্রতিশোধ
পর্ব ৫
তারানা মরিয়ম খান (রিনি)
বাসার পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হলে,বড় আপা আমাদের নিয়ে বসলেন জরুরি কথা বলার জন্য।তিনি আমাদের বাসা ছেড়ে চলে যেতে বললেন। শুধু বাসা থেকেই নয়,বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতেও বলেন।আমি ও সাইম ভ্রু কুচকে বড় আপার দিকে তাকাতেই তিনি আমাদের বোঝাতে লাগলেন—-দেখ ভাই!এখানে তুই,তাহিয়া কেউ নিরাপদ না!সিয়ামকে তো তুই ভালো ভাবেই জানিস!আমাদের সবার ছোট হওয়ায় বাবা,মা দুজনেই তারে আদর
একটু বেশিই করতো।আমরাও যথেষ্ঠ ছাড় দিয়ে এসেছি।আর এই সুজোগে সে চরম স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠে।আমার থেকে তোর ভালো জানা এ ব্যাপারে। যা শুরু করেছে সে,তোদের সুখে থাকা তো দুর, স্বাভাবিকভাবেই বাচতে পারবি না!যে কোন সময় বড় ধরনের ক্ষতি করে দিতে পারে!
সাইম কিছু ক্ষন মাথা নিচু করে বসে থাকে।সাইমকে এভাবে মাথা নুইয়ে বসে থাকতে দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। আমার জন্য এখন তার জীবনটা বিপন্ন হতে চলছে। আমিও চুপচাপ অপরাধীর মত বসে আছি।
—–বড় আপা আমি রাজি!তুই যেভাবে বলবি সেভাবেই সব করবো! আমি চলে যাব তাহিয়া কে নিয়ে!অনেক তাড়াতাড়ি ই চলে যাব।তবে কিছু ফর্মালিটিতো পুরণ করতে হবে। এই যেমন –এপ্লিকেশন, এপ্লিকেশন এক্সেপ্ট,পাসপোর্ট, ভিসা। অনেক সময়ের ব্যাপার! আমি যতদ্রুত সম্ভব সব ব্যাবস্থা করার চেস্টা করবো। সে কদিন না হয় তাহিয়া তোর বাসায় থাকুক!আমাকে তো দৌড়া দৌড়িতেই ব্যাস্ত থাকতে হবে!!
—নাহ!!তোরা কেহই এখানে থাকবি না!দেখিস সিয়াম আবারো আসবে!!আমি বলি তোরা ছোট্টো একটা ফ্ল্যাট ভাড়া কর,যেখানে পর্যাপ্ত সিকুরিটির ব্যাবস্থা আছে।আছে না এমন বাসা!!আছে তো!!!বাইরের যাওয়ার আগ পর্যন্ত তোরা সেখানেই থাকবি।
বড় আপার কথা মত আমরা চলে এলাম বহুতল ভবনের একটি ফ্ল্যাটে। আমাদের ফ্ল্যাট টি এগারো তালায়।আমরা বেশি জিনিস উঠাইনি।ছোটো একটা বেড,ছোট একটি ফ্রিজ,আর নিতান্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র। আর আমাদের বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম তোড়জোড় ভাবেই।শুনেছি সিয়াম প্রতিদিনই আসে আর আমাদের অকথ্যভাষায় গালি গালাজ করে যায়।বড় আপা আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছেন। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে আমি যেন বাসার বাইরে না বের হই।
এই কদিনে আমাদের সম্পর্কের দুরত্ব কিছুটা কমে এসেছে। সাইম আমার কাজে অনেক সসহযোগীতা করে। আমরা দুজন মিলেই ঘরের সব কাজ করি।সাইমকে বিয়ে করেছিলাম সিয়ামের প্রতিশোধ নিতে।কিন্ত সাইমের আচার-আচরণ দেখে আমি ধীরে ধীরে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছি। ভালোবাসতে শুরু করেছি।আমার কেন জানি মনে হয় সেও আমায় ভালোবাসে।কারণ প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সাবধানে থাকতে বলে যায়।তার বাইরে থাকা সময়টুকুতে বার বার খোঁজ নেয়।চুলার কাছে সাবধানে যেতে,সিনথেটিক কাপড় পরে চুলার ধারে না যেতে,যে কেই আসুক দরজা না খুলতে এরকম আরো অনেক উপদেশ দিতেই থাকে। উপদেশ বাণীগুলা শুনতে শুনতে আমার মুখস্থ হয়ে গেছে।এখন সে ফোনে খোঁজ নিতেই আমি একে একে সবগুলো উপদেশই বলতে থাকি।সেও জোরে জোরে হেসে বলে–যাহ,পাগলী কোথাকার!!!
সাইম বেশ কয়েকটি দেশের জন্য ট্রাই করলেও তিনটি দেশে কনফার্ম হয়।এর মধ্যে সাইমের পছন্দের দেশটিও সে তালিকায় রয়েছে।কাগজ পত্র গোছ গাছ করতে আরো দুমাস সময় লেগে গেলো।দেখতে দেখতে সেই কাংখিত দিন চলে এলো।আগামী কাল বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটায় আমাদের ফ্লাইট। এক দিকে মনটা খুশি হলেও অন্যদিকে খারাপ লাগছে।মা,বোন,বড় আপা, আত্নীয় স্বজন ফেলে চলে যেতে হবে অজানা দেশে।
ইচ্ছে ছিলো মা ও ছোটো বোন দু’টারে শেষমেশ দেখে যাব।সাইমও দেখা করাতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবার কাছে কসম খাওয়ায় মা রাজি হয়নি। মাকে যদিও জানানো হয়নি।কেমন যেন বুকটা ভার ভার লাগছে।সত্যি ই অন্যরকম কস্ট লাগছে।প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়া যে কতটা কস্টের তা আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।কিছু দুস্ট লোকের জন্য আজ সবাইকেই ছেড়ে যেতে হচ্ছে।
সবকিছুই গোছানো শেষ। বড় আপার সাথেও কথা হয়েছে। তিনি আর দুলা ভাই এয়ারপোর্টে চলে যাবেন।বাসার জিনিসপত্র গুলো নিয়েও কথা হয়েছে। মা’র সাথেও ফোনে কথা বলে নিলাম।মা অনেক কান্নাকাটি করছিলো আর বার বার শুধু একটি প্রশ্নই করছিলো –এমন ডিসিশন কেন নেওয়া হলো??? জবাবে শুধুই বলেছিলাম –জানার বেশি প্রয়োজন হলে বড় আপার কাছ থেকে জেনে নিও।
বাংলাদেশে আজই আমাদের শেষ রাত।পাশাপাশি চুপচাপ শুয়ে আছি দুজন। অনেকক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে সাইম আমাকে জিজ্ঞেস করে—আপনজন ছেড়ে আমার সাথে ভীন দেশে যেতে কস্ট হচ্ছে না?
—হচ্ছে!তবে তারচেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে!কারণ আমিতো আমার সবচেয়ে আপনজনের সাথেই যাচ্ছি!
—মানে???
—মানে!!এই ক’মাসের দাম্পত্য জীবনে আমি অন্তত এতটুকু বুঝতে পেরেছি, আপনি আর যা-ই করুন আমাকে ধোকা দিবেন না!!
—-বাপরে!!এত বিশ্বাস???
—-আপনার কার্যকলাপই আমায় বাধ্য করেছে!
ফের নিরবতা। সাইম কপালে হাত দিয়ে সটানভাবে শুয়ে আছে।আমি সাইমের দিকেই মুখ করে কাত হয়ে শুয়ে আছি।আনমনেই বলে ফেললাম –বাংলাদেশে তো আজকের রাতই শেষ রাত!
—হুম!!!দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার জিজ্ঞেস করলাম–
—আপনি কি এখনো আমার উপর রাগ?
—নাহ!
—-তাহলে একদিনও যে আমায় আদর করেন নি??
—-করবো।
—-আজকে আমায় একটু আদর করবেন?
আমি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। সাইমের কোন ভাবান্তর নেই দেখে অন্যপাশ ফিরে শুয়ে রইলাম।
চোখটা মাত্রই লেগে এসেছিলো। হঠাৎ কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই——-???
চলবে….
.