বিমূর্ত প্রতিশোধ.
তারানা মরিয়ম খান (রিনি)
সপ্তাহ খানেক হলো আমরা সুইজারল্যান্ড পৌছাই।দুদিন কেটে গেলো দুজনের ঘুমাতে ঘুমাতেই।সাইমের বন্ধু শোয়েবই আমাদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করা থেকে শুরু করে বাসায় নিয়ে আসা সহ যাবতীয় কাজে সাহায্য করেন। আমরা প্রায় একমাস ওনার বাসায় ছিলাম।সাইমের কর্মস্থল সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন এ চলে আসি এরপর। আমাদের বাসা থেকে তার কর্মস্থল দেখা যেতো। ইচ্ছে করেই সাইম কাছাকাছি বাসা নিয়েছিল যাতে করে যত্রতত্র খোঁজ খবর নেয়া সম্ভব হয়।আমরা মাস ছ’মাস বার্ন এ ছিলাম।পরে ভালো অফার পাওয়ায় সাইম কর্মস্থল চেঞ্জ করে আমাকে নিয়ে পাড়ি জমায় সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর জুরিখ এ।তখন আমি চার মাসের প্রেগন্যান্ট। প্রেগন্যান্সির সময়টুকুতে সাইম আমার এতটা টেক কেয়ার করে, এতটা!!! ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।আমি মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমার মা-ও বোধহয় অতটা কেয়ার করতে পারতো না!! প্রেগন্যান্সির অনেক বিষয়ই আমাদের জানা ছিলো না।সুইজারল্যান্ডেও আমাদের আপন কেউ ছিলো না। যত্রতত্র কোনো সমস্যার কথা কারো কাছে শেয়ার করার সুযোগ ছিলো না। ডক্টর দেখানোর পাশাপাশি সাইম যেকোনো ব্যাপারে যখন তখনই শোয়েব ভাইয়ের স্ত্রীর কাছ থেকেই বিভিন্ন বিষয়ে জেনে নিতো।সাইম সম্পর্কে যদিও আমার স্বামী। কিন্তু সে কোনো দিন,কোনো ভাবেই আমার সাথে স্বামীদের মতো কর্তৃত্ব দেখাতে আসেনি। যেমনটি আমার বাবাকে দেখেছি মা’র উপর দেখাতে। সে শুধু আমার স্বামীই ছিলো না, একজন ভালো বন্ধুও ছিলো।
খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে মাঝেমধ্যে এমন হয়ে যেতো, প্রায়ই তাকে মা উচ্চারণ করে ফেলতাম।যেমনটি মা’র কাছে থাকতেও সবসময়ই করে ফেলতাম। মাঝেমধ্যে ঠাট্টার ছলে প্রা-ই বলতাম -সাইম,তুমি আমার স্বামী না হয়ে মা হলেই ভালো হতো!!আমার আব্বা নামক বাঘের থাবা থেকে তো বাচাইতে পারতে!!সাইম এক গাল হেসে বলতো–ধুর পাগলি!!!এ-সব কোনো কথা!!! আমি মা হলে তো জামাই কে হইতো!!আর তোমাকে অমন আদরগুলো কে দিতো শুনি!!!আমার মতে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে!! আমি জামাই আর তুমি আমার বউ!!তাতেই আমি খুশি!! অনেক অনেক খুশি!! আল্লাহ পাক যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
সত্যিই সুইজারল্যান্ড সে আমাকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখে। এভাবেই সুখ, দুঃখ, মান-অভিমান ও ভালোবাসায় কেটে যায় আমদের বিবাহিত জীবনের সাত সাতটি বছর।ভালো আছি স্বামী সন্তান নিয়ে। আল্লাহ অনেক অনেক ভালো রেখেছেন!সেজন্য প্রতিনিয়ত আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে যাচ্ছি।
কদিন ধরে ই খান বাড়ির বড় ছেলে,ইকবাল হাসান খান(সাইমের বড় চাচার ছেলে এবং বর্তমান প্রজন্মের সবার বড়জন,ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে কর্মরত)।সাইমকে ফোনের পর ফোন দিয়েই যাচ্ছে।কারণ তিনি চাচ্ছেন খান বংসের সকল খান ও তাদের যত রিলেটিভ আছে সকলকে নিয়ে ঐতিহাসিক পরিবার মেলার আয়োজন করতে। ওনার বহুদিনের স্বপ্ন তিনি এবার বাস্তবায়ন করবেন ই। সকল রিলেটিভস দের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পাশাপাশি সবাই সবাইকে জানবে, চিনবে, এ উদ্দেশ্যে সামনে রেখেই তিনি অনুস্টান টি করতে চাচ্ছেন।আজকাল সকলেরই কর্মব্যস্ততায় কেউ কারোর সাথে তেমন করে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হচ্ছে না।এমতাবস্থায় আপনজন হওয়া সত্বেও চলতে ফিরতে কেউ কাউকে চিনতে পারছে না।
এসব নানা দিক বিবেচনা করেই তিনি এরকম সিদ্ধান্ত নেন।সাইম কোনো অবস্থায় রাজি হচ্ছিলো না।সে রিতীমত ভয় পাচ্ছে।কারণ আমরা এখন আর দু’জন তে নেই।আমরা এখন দুয়ে দুয়ে পাচ জন।সাইম আর তাহিয়া দম্পতির তিন সন্তান।ছ’বছরের টুইনস -তাহরীম মাহমুদ খান ও তামজিদ মাহমুদ খান এবং চার বছরের মেয়ে সারা সাইম খান।আমরা যে পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়েছিলাম সাইম সেই ব্যাপারটি নিয়েই চিন্তিত। আল্লাহ না করুন!বাচ্চাদের না জানি কোন ক্ষতি হয়ে যায়।বাচ্চাগুলো তার আত্মার আত্মা।এইযে এত্তো বিরক্তির পরও সে বাচ্চাদের সাথে উচু আওয়াজে কথা বলে না।আমি প্রায়ই বিরক্ত হয়ে চিল্লাপাল্লা করে মারতে উদ্দত হই।তখন সে এমন কিছু বাক্য ইউজ করে আমাকে বুঝাতে যেগুলো মনে হতেই বুকের ভেতরটায় অন্যরকম অনুভূতির সৃস্টি হয়।সে প্রায়ই বোঝাতে গিয়ে বলে—“ভেবে দেখোতো টুনটুনি পাখি!!(সে আমায় আদর করে এই নামে ডাকে) বাচ্চাগুলোর উৎ স কোথায়??
একবার ভাবো কলিজা গুলোর পৃথিবীতে আগমনের হেতু কি???তোমার আমার ভালোবাসা!!! আমারতো বিষয়টি মনে হতেই আবেগে গায়ের লোম দাড়িয়ে যায়!!আল্লাহ পাক আমাদের তিন তিনটে ধন দান করেছেন। আমাদের সম্পদ,তোমার আমার ভালোবাসা। ওদের রাগ না হয় আমার উপর ঢেলো,আমাকে মেরো!!আমি কিছুই মনে করবো না।তবুও ওদের গায়ে হাত তুইলো না।এ দেশে কে আছে ওদের, আমি আর তুমি ছাড়া!” চেষ্টা তো অনেকই করি না মেরে থাকতে। তারপরও মাঝেমধ্যে আমায় আক্রমণ চালাতে হয়।কি বা করবোই?? রাগ যে কন্ট্রোল করতে পারিনা। তাই মাঝেসাঝে ইকটু আকটু মাইর দিয়েই ফেলি।তবে তা অবশ্যই সাইমের অগোচরে।
সাইমকে বাড়ির বড় খান সাহেবও রাজি করাতে পারেন নি।শেষে সাইমকে বোঝাতে ব্যার্থ হয়ে ভদ্রলোক আমায় ফোন করে বিষয়টি বোঝান।সাইম তার মেঝো চাচার বড় ছেলে।বাড়ির ছেলেদের মধ্যে দ্বিতীয়। তিনি চাচ্ছেন উনার অবর্তমানে সাইম খান পরিবারের নেতৃত্ব দিবে,দিতে হবে।বছর দুএক পর পর দেশে আসবে,দেশের মানুষের খবরাখবর রাখবে।এভাবে সব ছেড়ে দিলেতো হবে না।আমি ভদ্রলোক কে আস্বস্ত করি যে, যেভাবেই হোক সাইম কে রাজি করাবো।
বাচ্চাগুলান রে লেলিয়ে দিলাম সাইমের পিছু। বিচ্ছুগুলাও আমার কথার মান রেখেছে। বিডিতে যাবো,বিডি তে যাবো বলে বলে যেন দম ফেলা ভুলে গিয়েছিল। শেষে বাচ্চাদের আবদার রাখতে সাইম রাজি হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় যে সাইমকে এক মুহুর্তের জন্যও ছাড়তে পারবে না।
অনুস্টানের ছ’দিন আগেই আমরা বাংলাদেশে পৌছাই।বড় আপার বাসাতেই আমরা উঠলাম। বড় আপা বাচ্চাদের পেয়ে হাতে আসমান পেলেন।তিনি যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। বড় আপার খুশিতে আমরাও খুশি হলাম।কারণ বড় আপা নিঃসন্তান। ওনার ননদের ছেলে ওনার কাছে থাকে।সেও বড় হয়ে গেছে।তাইতো বিচ্ছুগুলো রে পেয়ে তিনি এতটা খুশি। দুলাভাই আমাদের তিন সন্তান দেখে সাইমকে ঠাট্টার ছলে বলেন—আরেহ ভাই!দেখোতো কি কান্ড!!আমি ভেবেছিলাম তোমরা দুয়ে দুয়ে চার হয়ে আসবে!!এখন তো দেখছি দুয়ে দুয়ে পাচ হয়ে এলে।!!ব্যাপার কি বলো তো???
—-দুলাভাই কি বলেন এসব?? মাশ,আল্লাহ বলেন!আল্লাহ আমাদের উপর বেশি খুশি বলেই একটা বাড়িয়ে দিয়েছেন!! মেয়েটিকে আদর করতে করতে সাইম কথাগুলো বলে।
চলবে….
.