বিমূর্ত প্রতিশোধ .
তারানা মরিয়ম খান
অনুষ্ঠানের দু’দিন বাকি থাকায় আম্মা ও বোন দু’টারে গাড়ী পাঠিয়ে নিয়ে আসলাম।আজ সারাদিন ওদের সময় দিব আগেই ভেবে রেখেছি। সকাল দশটার মধ্যেই ওরা চলে আসলো।মা,মেয়ে চারজন মিলে কান্নাকাটির পর্ব শুরু হলো।কত্তো বছর পরই না ওদের সাথে দেখা হল।আমাদের কান্না দেখে বড় আপা,সাইম, জুনিয়র সাইম সহ উপস্থিত সবার চোখে পানি চলে এলো। মেয়েটাতো চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়—-পাপ্পা”!মাম্মাল কি হয়েতে??কান্না কলে তেনো??মাম্মাম!!!
মেয়ের কান্না থামাতে সাইম মেয়েকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে নিচে যায়।মা ও পুচকি গুলার সাথে ভালো ভাবে কথাও বলতে পারেনি সাইম।পুচকি গুলান অনেক বড় হয়ে গেলেও আগের মতো ডাকতে একটুও ভুল হয়নি।ওদের বসিয়ে কিচেনে যেতেই বড় আপার ধমক ফিরে আসলাম। বড় আপার কড়াকড়ি
নির্দেশ ওদেরকে বসিয়ে রেখে ওয়াশরুম ব্যাতিত অন্য কোথায় যাওয়া যাবে না।সব কিছুই বড় আপা মেনেজ করবেন।
আম্মা ও বোনদের সাথে কথা কথা বলছি। আম্মা নাতী দের কোথায় রাখবেন ভেবে পাচ্ছন না!!!কতো শতো আদরেই না নাতী দের ভরিয়ে দিতে থাকে ন।নাতীগনও বায়না ধরেছে, এবার সবাইকেই সুইজারল্যান্ড নিয়ে যাবে।কাউকেই বিডি তে রাখবে না।সবার সাথে খেলা করবে, তাহলে আর পড়ার সময় পাবে না।সময় না পেলে পড়বে কি করে?
আম্মা এদের কথা শুনে হেসে কুটি কুটি। ছেলে দুটো সবাই কেই চিনতে পারছে। কারণ দুদিন বাদে বাদে সবার সাথেই ভিডিও কলে কথা হতো বাবা ছাড়া।বাবার কথা মনে হতেই আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম –বাবা এখনো রাগ আমার প্রতি??
—-নাহ!!বরং তোর সাথে কথা বলার জন্য প্রতিদিনই অপেক্ষা করতো। এই বুঝি তুই বাবাকে চাস কথা বলার জন্য!!তুই চাসনি দেখে তোর বাবা বলতো–মেয়েটাকে অনেক কস্ট দিয়ে ফেলেছি বলেই হয়তো সে আর আমাকে দেখতেই পারে না।দেখো না প্রতিদিন সবার সাথে কথা বললেও আমার কথা জিজ্ঞেস ও করে না।
বাবার কথা শুনে আমার কলিজা ফেটে যাচ্ছিলো। অতিরিক্ত শাসন করায় বাবাকে পছন্দই করতাম না।কিন্ত এই মুহূর্তে বাবার জন্য খুব কস্ট হচ্ছে।আম্মাকে বললাম–বাবার নাম্বার দাও!!এক্ষুনি ফোন দিচ্ছি!!
—-ফোন দিবি কেনো??তোর বাবাতো আমাদের সাথেই এসেছে তোকে একনজর দেখার জন্য।গাড়িতে বসে আছে!!তুই যদি বলিস তাহলে আসবে তোকে দেখতে।
—-আম্মা,এসব কি বলছো??বাবা গাড়িতে বসে আছে আর তোমরা আমায় বলছো না!!আরাম করে গল্প করছো!!আমি দ্রুত দরজা খুলে বের হতেই দেখি, সাইম বাবা কে নিয়ে আসছে।বাবার কোলে আমার মেয়েটা,বাবার দাড়ি ধরে খেলছে। আমি বাবা বলে চিৎকার করে কান্না করতেই সাইম আমায় ধমক দিয়ে থামিয়ে দেয়।আমার দিকে চোখ রাংগিয়ে–অনেক কস্টে আম্মোনি কে থামাইছি।আবার কাদলে খবর আছে!!
আমি কিছুটা অভিমানী হয়েই বলে ফেলি–সাইম!! আমার বাবা!কতদিন পর বাবার সাথে দেখা হইছে!!
—-আমার মেয়ে!!!কতটা কস্ট হইছে তার কান্না থামাতে!!!বিশ্বাস না হলে বাবাকে জিজ্ঞেস করো!
—-তাই বলে বাবাকে জড়িয়ে কাদবো না!!
—কাদো!কিন্তু আমার মেয়ের সামনে নয়।এমনিতেই তোমার কান্না দেখে কেদে কেদে চোখের সব পানিই বের করে ফেলেছে আমার আম্মুন টা।
—-থাক,আমার কাদতে হবে না!আমি হন হন করে রুমে চলে আসতেই সাইম চেচিয়ে উঠে—আরেহ!!বাবাকে তো নিয়ে যাও!টুন টুনি পাখি!বাবাকে বলে –যান বাবা,মেয়ের কান্না থামান!
বাবা আমার হাত জোর করে ক্ষমা চাচ্ছেন বিগত কর্মকান্ডের জন্য।আমিও বাবার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।দুজন দু’জনকে জড়িয়ে অনেক কাদলাম।ভেতরের কস্টটা বহুদিন পর হালকা হালকা লাগছে।
সারাদিন প্রিয়জনদের সাথে সময়গুলো ভালোভাবেই কাটালাম।বাবা অনেক খুশি সাইমের মত এমন ভদ্র জামাই পেয়ে।আবারও ক্ষমা চাচ্ছে বাবা আমার কাছে।বাবা পূর্বের কথা তুলতে নিলে সাইম টেকনিকে প্রসংগ পাল্টে ফেলে।সন্ধ্যার পর ওদের আবার গাড়ি করে বাসায় পাঠানোর ব্যাবস্থা করে দিল সাইম। সাথে অনেক গিফট ও দিয়ে দিলাম এবং সাইম বাবাকে কথা দিল আমাদের নিয়ে বাবার বাসায় দুদিন বেড়াবে।
দেখতে দেখতে অনুষ্ঠানের দিন চলে এলো।অনুষ্ঠানে র ভেন্যু ঠিক করা হয় গাজীপুর। সেখানে আমার ভাসুর -সচীব মহোদয়ের ৩৫একর জমি আছে।ওনার জায়গাতেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পুরো অনুষ্ঠান টি সকল খান’স ও তাদের রিলেটিভ দের অর্থায়নে আয়োজিত। ডেফিনেটলি কোন এমাউন্ট ফিক্সড করে নি।যার যার এবিলিটি অনুযায়ী দেয়ার কথা বলা হয়।সাইম দু, লক্ষ টাকা দিয়েছে। সাইম বড় একটি গাড়ি ভাড়া করে আমাদের জন্য।আমরা ও বড় আপারা এক সাথে যাই।
যেহেতু সারাদিনের প্রোগ্রাম, তাই সকাল আটটার মধ্যে সবাইকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।আমরাও ডিউ টাইমে চলে আসি।ভেতরে ঢুকতেই চোখ ছানা ভড়া।অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই।তারা এত্তো সুন্দর করে সাজিয়েছেন স্পটটি বলার মতো না!!অনুষ্ঠানের মুল স্থানে এগোতে এগোতে চিপস, চটপটি, ফুসকা,ঝালমুড়ির দোকান।পাশাপাশি আখের রস,ডাব,ও মিক্সড শরবতের ভ্যান গাড়ি। স্থানে স্থানে বড় করে লিখা'”ঘোরাঘুরির পাশাপাশি কিছু খাওয়া দাওয়া, কিছু কেনাকাটা আর কিছু আড্ডায় মেতে উঠা।””এক ছোট ভাইকে খাবারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, এখানের কোন খাবারই অস্বাস্থ্যকর নয়।সব নিজেদের লোক দিয়ে তৈরী।তাই নিঃসন্দেহে খাওয়া যাবে।কিছুদুর যেতেই আবার চোখে পরলো,হাতে বোনা জামদানী শাড়ি, মাটির জিনিসপত্র, বাশ বেতের জিনিস, আরো হাতে তৈরী নানাবিধ জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসে আছে বিক্রির জন্য।মুল স্পটে যাওয়ার আগে সাইম আবারো আমাদের সতর্ক করে নিলো।মেয়েটিকে আমার কাছে দিয়ে দু’হাতে দু’ছেলেকে ধরে নিলো।অনুষ্টানের মুল স্থানে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় ছ’মিনিটের মত লাগলো।
আমরা সেখানে পৌছাতেই সকালের নাস্তার জন্য তাগিদ দেওয়া শুরু হলো। পাশাপাশি খোচা মেরে কথাও বলতে লাগলো সাইমকে নিয়ে।সাইমের এক ফুপাতো ভাই বলেই ফেললো –এভাবে বউ নিয়ে কেউ লাপাত্তা হয়??হয়েছিস ভালো কথা,আত্মীয় স্বজনের খোজখবর তো রাখবি!!সাইম জবাবে শুধু এক গাল হাসি ছাড়া আর কিছুই বলেনি।
সকালের নাস্তায় ছিলো পরোটা, গরুর কলিজা ভুনা,ভুনাখিচুড়ি, মুরগির মাথা,কলিজা ও অন্যান্য অংশ দিয়ে সব্জি, মাছের মাথা দিয়ে মুড়ি ঘন্ট,খুদের ভাত আর কয়েক প্রকার ভর্তা। যার যার রুচি অনুযায়ী খাওয়ার কথা বলা হয়।সাইম বাচ্চাদের ভুনাখিচুড়ি ও কলিজা ভুনা দিয়ে খাওয়াতে থাকে।আমি খুদের ভাত ও ভর্তা দিয়েই নাস্তা শেষ করি।
আমার সাথে সাথে বড় আপা ও দুলাভাই সেইম খাবার খায়।
সাইম আমাদের নিয়ে ঘুরেফিরে দেখাচ্ছিলো। ঘুরতে ঘুরতে কিছুটা সামনে চলে যায়।কি মনে করে আবার পেছনে এসে আমার কানে কানে বলে মেয়ে ও নিজে যেন সাবধান থাকি।আমি ডানে বামে তাকাতেই দুরে এক জোরা দম্পতি দেখতে পেলাম যারা কিনা আমাদের প্রাক্তন ছিলো।আমি হাসতেই সাইম বলে–হাসা হাসি বাদ দিয়ে যা করতে বলেছি তা-ই করো!!আবারো বলছি মেয়ে এবং নিজে সাবধানে থাকো।আর আমার পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্য এদিক ওদিক কোত্থাও যাবা না।সাইম দুই ছেলে নিয়ে আমাদের ঘেঁষে ঘেঁষেই হাটছে।
সাইম আমাদের অনেক কিছু কিনে দেয় পরিবার মেলা থেকে। আমাকে দুটো জামদানি শাড়ি,এক ডালা রেশমী চুড়ি, বাচ্চাদের বাশের বাশি,মাটির ব্যংক,দুলাভাই কে এস্ট্রে আর বড় আপাকে কাঠের
হামানদিস্তা। শাড়ির কালার পছন্দ না হওয়ায় বড় আপা শাড়ি কেনেন নি।
ঘুরতে ঘুরতে আমরা হালকা স্ট্রিট ফুডসও খেলাম।সাইম সব আইটেমই একটু একটু করে বাচ্চাদের চেখে দেখালো।শেষে বাচ্চাদের নিয়ে ডাবের পানি খাচ্ছিলো আর আমার ও দুলাভাই এর ফুসকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা উপভোগ করছিলো।
দুলাভাই কে হারানোর উদ্দেশ্যে দুই,তিন ফুচকা একসাথেই খেয়ে ফেলি।কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন চরম পর্যায়ের বিষম খাই।কাশতে কাশতে বমি করে দেই,চোখ দিয়ে টপাটপ পানি পরছে।আমার অবস্থা দেখে সাইম চিল্লাপাল্লা শুরু করে দেয়।অস্থির হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে পানির জন্য। সাইমের অস্থিরতা দেখা আত্মীয় স্বজনের অনেকেই ছুটে আসে এবং সহযোগিতা করে।পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে সবাই আমাদের নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দেয়।সাইম কিছুটা রাগ হয় দুলাভাই এর উপর, এ রুপ প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ায়।যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যেতো!!
দুলাভাই হাসতে হাসতে বলে —শালা বাবু,তুমি কি আমার জন্যে চিন্তিত?? নাকি পোলাপাইনদের মা’র জন্য??
সাইম কিছু বলার আগেই বড় আপা ক্যাৎ করে ওঠে –তোমার জন্য কেনো চিন্তা করবে?? বুড়ো মানুষ!! আর যার জন্যই চিন্তা করুক!! চিন্তা করেছে তো না-কি!! তুমি তো চিন্তাও করতে পারো না!! খালি মানুষকে খোচানো ছাড়া!! খোচাখোচি করতে করতে তো বুড়োই হলে, এবার ইকটু আকটু ভালো হওনা!!
বড় আপার কথায় দুলাভাই ফের দাতের পাটি বের করে জোরে জোরে হাসতে থাকেন।
তাদের রোমাঞ্চকর আচরণে আমি আর সাইমও হেসে উঠি।
মধ্যাহ্নের পূর্বের সময় টুকু ভালোভাবেই আমরা উপভোগ করেছি।যদিও কিছুটা সমস্যা হয়েছিল তবু্ও অনেক ভালোই
লেগেছে।ঘোরার ফাকে ফাকে এখনো পরিচয় ও কুশল বিনিময় চলছে। আমার জীবনে এত্তো বড় ও এত্তো প্রতিষ্ঠিত পরিবার কখনও দেখিনি! অনুষ্ঠানে না আসলে জানতেই পারতামনা খানস,দের সে লেভেলের এক্টিভিটিস।সত্যি ই এমেইজিং!!!
চলবে….
.