বিমূর্ত প্রতিশোধ.
তারানা মরিয়ম খান (রিনি)
দুপুরে খেতে বসে আমি মেয়েটাকে খাওয়াচ্ছি আর নিজেও খাচ্ছি।সাইমের হচ্ছে যত জ্বালা! খাবার মেখে বাদড়দুটার পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে সাইম অনেকটা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের প্রতি এক বারের জন্য বিরক্ত প্রকাশ করছে না।সাইমের ঢং দেখে আমারই বিরক্ত লাগছে।আমি দ্রুত খাওয়া শেষ করে সাইমের হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিলাম।সাইমকে খেতে বলে আমি দুটারে খাওয়াতে লাগলাম।সাইম খেতে বসলো ঠিকই কিন্তু চেয়ে রইলো আমার দিকে,ছেলেদের বকা ঝকা করি কিনা।আমি সেদিকে নজর না দিয়ে খাওয়াতে লাগলাম। আবার বিরক্ত করতেই জোরে ধমক দিলাম।ধমক শুনে দুস্টগুলা দ্রুত খেতে লাগলো। সাইম খাওয়া ছেড়ে উঠে এসে আমার কানে কানে বলল–সবার সামনে এভাবে ধমক দিওনা!প্লিজ! বাচ্চা গুলা লজ্জা পাবে!!এতে মানষিক ক্ষতি হতে পারে!!
আমি রাগী চেহারা নিয়ে সাইমের দিকে তাকাতেই
সাইম আস্তে করে বলে–প্লিজ!!!
—–তুমি খেতে বস!!সবার খাওয়া শেষের পথে আর তুমি প্লেটই নাওনি!!!
—–নিচ্ছি,আমার খেতে বেশিক্ষণ লাগবে না!
আমি দু’মিনিট এর মধ্যেই ওদেরকে খাইয়ে দিলাম।সাইম এখনো খাচ্ছে। সাইমের অনুমতি নিয়ে কাছাকাছিই এ যাওয়ার কথা বলতেই সাইম বড় আপাকে ডাকতে লাগলো। আমি সাইমকে বুঝিয়ে বলি,বড় আপা কিছুক্ষণ অন্তত নিজের মতো করে চলুক।আমরা বেশি দুরে যাবো না।
সাইম খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে এসে তার ফুফাতো বোন ও বোনের হাসব্যান্ড এর সাথে কথা জুড়ে দিলো।আমরাও বেশি দুর যেতে পারিনি। অমনি আমাদের প্রাক্তন লীনা ও সিয়াম কোত্থেকে এসে
সামনে দাড়ায়।ওদের দাড়ানো দেখে মনে হচ্ছে ওরা যেনো সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলো। ওরা এসে আমাকে যা ইচ্ছা তা-ই বলে গালি গালিগালাজ করতে লাগলো।আমার সন্তানকে নিয়েও নোংরা মন্তব্য করতে লাগলো। শুধু তা-ই নয়, আমার ছেলেদের কানে অনবরত মোচড় দিচ্ছে,গালে ঠোকর দিচ্ছে।আমার ছেলেগুলোও বার ওদের হাত সরিয়ে দিচ্ছে।সিয়াম লীনাকে দেখিয়ে বলে–দেখো লীনা,মা’র মতোই বেয়াদব হয়েছে! দেখো দেখো,কিভাবে হাত সরিয়ে দেয়!!ওমা!আবার হাতে খামচিও মারে!!
—হুম!!জারজ তো!তাই স্বভাবেই প্রকাশ পাচ্ছে!!হা হা হা!!লীনা হেসে কথাটা বলে।
ওদের কথাগুলো ভালো ভাবেই আমার কানে ঢুকছিল। কিন্তু আমি শুনেও কিছু বলতে পারছিনা। কারণ আমার চোখের দৃস্টি,আমার ধ্যান,তখন তাদের দুজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আমি শুধু তাকিয়ে দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, মানুষ এতো দ্রুত কীভাবে পরিবর্তন হয়।হ্যা!!আমাদের প্রাক্তনদের কথাই বলছি। কি অবস্থা দুজনের!! চেহারার সেই ঝেল্লাভাব কোথায় গেলো??চেহারার মধ্যে রুক্ষতা বিরাজমান। চোখের নিচে এক গাদা কালি।বহুদিন একাধারে কাজল ব্যাবহার করে না ধুলে যে অবস্থা হয় তেমন দেখাচ্ছে।বড় আপার কাছে অবশ্য শুনেছিলাম –আমরা সুইজারল্যান্ড চলে আসার পর সিয়াম প্রতিদিনই বড় আপার বাসায় এসে ভাংচুর করতো। দাড়োয়ান বাধা দেয়ায় দারোয়ানকে বেশ কদিন মেরেছে।এ নিয়ে বড় আপার সাথে দুলাভায়েরও সমস্যা হয়।
বড় আপা নিজ উদ্যোগে তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।অনেক বোঝান সিয়ামকে লীনাকে বিয়ে করে নিতে। বড় আপার কথামতো সিয়াম লীনাকে বিয়ে করলেও সিয়াম নিজেকে আর লীনার সাথে আর শারীরিক
সম্পর্কে জড়ায়নি।নিজে নিজেই অন্যায়ভাবে জৈবিক ক্ষুধা মিটিয়ে নিত।দীর্ঘ তিন বছর মেনে নিলেও লীনা আর পারছিলো না।বড় আপার বাসায় চলে আসে লীনা।বাবা-র বাড়িতেও যেতে পারছিল না।কারণ লীনার নোংরামোর কাহিনি শুনে তার পরিবারও তাকে বয়কট করে। লীনাকে কোনভাবেই দুলাভাই সহ্য করতে পারছিলেন না।শেষে বড় আপা আবারও উদ্যোগ নেন দুজন কেই
মিলিয়ে দিতে।শত হলেও মা’র পেটের ভাই।তিনি
তাদের জরুরি ভিত্তিতে বেবি নিতে বলেন।বেশ কিছু
দিন পরও বেবি কনসিভ না হওয়ায় ডক্টর দেখাতে গিয়ে জানতে পারে সিয়াম চিরদিনের মত বাবা হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।কারণ দীর্ঘদিন অন্যায় ভাবে স্পার্ম আউট করার ফলেই এমনটা হয়েছে। লীনার যাওয়ার জায়গা না থাকায় সে থেকে গেলো
সিয়ামের কাছে।আবার গত দু’বছর ধরে লীনার ইউটেরাস এ টিউমার ধরা পরে।প্রতিমাসেই পিরিয়ড চলা অবস্থায় প্রচন্ড পেট ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হতে হয়। ডক্টর বলেছে টিউমার অপসারণ না করলে ব্যাথা কমবে না।বরং
পরবর্তীতে বড় কোন ক্ষতি হতে পারে। কিন্তু সিয়াম রাজী না হওয়ায় তা সম্ভব হচ্ছে না।
সাইম আমাদের দেখতে না পেয়ে ছেলেদের নাম ধরে জোরে জোরে ডাকছে। ছেলে দুটো কান মলা ও ঠোকর খেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখ লুকিয়ে আছে। পাপার ডাক শুনেও চুপ করে আছে।আমিও যেন জবাব দিতে ভুলে গেলাম।ওদের
কস্ট মনে হতেই দুঃখী চাহনি নিয়ে ওদেরই দিকে তাকিয়ে আছি।সাইম ডাকতে ডাকতে হন্ত দন্ত হয়ে এদিকটায় আসতেই মেয়েটি চিৎকার করে পাপা বলে ডেকে উঠে।সাইম পাগলের মতো ছুটে এসে বাচ্চাদের চুমু খেতে থাকে।আমার মাথায় চুমু খেতে খেতে বলে—মানা করেছিলাম!!বারবার মানা করেছিলাম আমার চোখের আড়াল হয়োনা!!কারণেই তো মানা করেছিলাম, নাকি!!
আমার হাতটা তার বুকের বামপাশে চেপে ধরে বলে -দেখো!!এখনো বুকটা কিভাবে ওঠানামা করছে!!! জানো কতটা পেরেশান হয়ে গেছিলাম!!! আরেকটু হলে হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত!উপরে তাকিয়ে বলে -শুকুর,আলহামদুলিল্লাহ!!!
এখনো বাচ্চাদের মাথায়, সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। রুমাল বের করে ছেলেদের মুখ মুছে দিচ্ছে,মুখের লালচে ভাব দেখে।
মাঝে মধ্যে সাইমের পাগলামি দেখলে আমারই বিরক্ত লাগে।অমন সব কান্ড করে, যেনো দুনিয়ায় তার একাই বউ,বাচ্চা আছে!!!এখন দুজন কি ভাববে!!যত্তসব আজাইরা কাজ!!!
সাইম আমাদের পেয়ে এতটা এক্সসাইটেড।এখনো পর্যন্ত বাচ্চাগুলান রে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিল। এখনো হাত বুলিয়ে, চুমু খেয়ে আদর করছে।একবারের জন্যও সামনে তাকিয়ে দেখেনি দুজন ব্যাক্তিকে যারা শকুনের দৃষ্টি দিয়ে সাইমের আদর প্রত্যক্ষ করছে। আর সাপের মতো ফোস ফোস করছে ছোবলের অপেক্ষায় ।
—–আরেহ বাহ!!!ভাসুর আর ছোট ভাইয়ের বউ মিলেতো ভালোই নস্টামির রাজত্ব বানিয়েছো!!আবার দেখি জারজ বাচ্চাও পয়দা করে ফেলেছো!!একটা না দুটো না, এক্কেবারে তিন তিনটি!!! ছি ছি ছি!! দেখেই গা গুলিয়ে বমি আসছে!!দেখেছো লীনা! তোমার বমি আসছে না!!!
এমন সব কথাবার্তা শুনে সাইম লোকটার দিকে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে যায়।দ্রুত বাচ্চাগুলোরে আগলে নেয় বাম হাতে আর আমাকে ডানহাতে আগলে নেয়।কয়েক মুহূর্ত দুজন কে অবলোকন করে নেয়। তারপর মুখে বাকা হাসি ফুটিয়ে বলে -আমরা নস্টামি করি আর যা-ই
করি না কেনো তোদের মতো ব্যভিচার করিনি!!পাথর নিক্ষেপ করে হত্যা করার কাজ করিনি!! নিজের স্বামী, স্ত্রী থাকা সত্বেও কুকুরের মতো মেলামেশা করিনি!!আর রইলো জারজ বাচ্চা!!কাদের জারজ বলছিস!!আমার বাচ্চাদের!!! হা হা হা!!!সেটা কিভাবে সম্ভব!!সেটাতো কোনভাবেই সম্ভব না!!!কারণ যেখানে আমাদের সম্পর্কটাকেই আমরা জায়েজ করে নিয়েছিলাম। জায়েজ করে নিয়েছিলাম বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে।
আমার বাচ্চারা দুটি প্রবিত্র আত্মার প্রবিত্র ভালোবাসার ফসল।যেখানে অপ্রবিত্রতার বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটাও নেই।সাইম অনেকটা ক্ষেপে যায়।
প্রচন্ড রাগে সাইম কাপছে।এই সাত বছরে আমি সাইমের এমন রুপ কখনও দেখিনি!!
সাইম আমাদের আবারো সতর্ক করতে করতে নিয়ে আসছে।এর মধ্যে আমি ইচ্ছে করেই একটু পেছনে ফিরে তাকালাম দু’জনের এক্সপ্রেশন দেখতে।তাদের অগ্নি ঝরা চোখ দেখে সাইমের বলা সে–ই–শব্দদুটোর কথা মনে হল-“”বিমূর্ত প্রতিশোধ। “”
সাইম আমাদের নিয়ে ফিরে আসার সময় ছেলে দুটা পাপাকে নালিশ করতেই সাইম আবার ওদের কাছে যাওয়া ধরে। আমি বার বার মানা করাতে সে আমায় আস্বস্ত করে বলে—কিচ্ছু করবো না!”তুমি দেইখো!!শুধু একটা কথাই বলবো যেটা আরো আগেই বলা উচিত ছিলো।
সাইম আবার সিয়ামের কাছে যায়।সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলে —তোর সব অন্যায় আবিচার সহ্য করেছি।কিচ্ছুটি বলিনি!!আজ আমার কলিজায় আঘাত করেছিস।তাও কিচ্ছুটি বললাম না!!কেন জানিস?? আমার মা’র গর্ভে তোর জন্ম!!আজ আমার সন্তানদের গায়ে আঘাত করার অপরাধে তোকে যে কি করতাম! তুই কল্পনাও করতে পারতিস না!!কিন্তু করিনি।কেনো করিনি জানিস!!কারণ তখন উপস্থিত সবাই তোকে আর আমাকে গালি দেয়ার পরিবর্তে আমার মা’র গর্ভকে গালি দিবে।ফের যদি আমার স্ত্রী ও সন্তানদের দিকে খারাপ দৃস্টিতে তাকাস তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না! এই বলে রাখলাম।কথাটা যতো তাড়াতাড়ি মস্তিষ্কে গেথে নিতে পারিস ততই মঙ্গল তোদের জন্য। নিজের জন্য ছাড় দিলেও আমার স্ত্রী, সন্তানদের জন্য ইঞ্চি পরিমাণ ছাড় পাবি না। কথাটা মনে রাখিস!!!
এর পরের সময়টুকুতে সাইম এক মুহুর্তের জন্যও আমাদের আড়াল হতে দেয় নি।সারাক্ষণই নিজের পাশে পাশেই রেখেছে।
চলবে….
(ইনশাআল্লাহ, আগামী পর্বে শেষ করে দিতে পারি,। সম্ভাবনা আছে।)
.