#বিচ্ছেদ পর্ব ১৭
আশিক গরম কফিতে চুমুক দিলো।
সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি দূর হয়ে যায় ওর দিনের শেষ কফিতে চুমুক দিলেই।
অদ্ভুত এক প্রসন্নতা ছড়িয়ে পড়ে ওর মনে।
বিয়ের পর পরই রিয়া জানতে পেরেছিল আশিকের এই অভ্যাসের কথা। স্ট্রং ব্লাক কফির প্রতি ওর দূর্বলতার কথা।রিয়া বুদ্ধিমতি মেয়ে।
খুব জলদি সে আশিকের পছন্দের স্ট্রং ব্লাক কফি বানানো শিখে নিয়েছিলো।
সকালে এবং রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে রিয়ার হাতের কফিতে মারাত্মক অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিলো আশিক।
ডিভোর্সের পর খুব কষ্ট হতো আশিকের।
কফিতে কোন স্বাদ পেতো না।
রিয়ারও কি কষ্ট হতো আশিকের জন্য ?
ওরা প্রায়ই রাতে বের হয়ে যেতো শুধু কফি খাওয়ার জন্য। ঢাকা শহরের ভালো ভালো কফি শপ গুলো খুঁজে খুঁজে বের করতো আশিক।
কফি খেতে খেতে গল্প করতো।
রিয়ার ছোট ছোট সপ্নের কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতো আশিক।
রিয়ার হাতে হাত রেখে বলতো,
তোমার স্বপ্নপূরণে আমাকে সবসময় তোমার পাশে পাবে।আশিকের থাকা হয়নি রিয়ার পাশে।
রিয়া কি আজও সেই স্বপ্নগুলো দেখে ?
নাকি সম্মানজনক ভাবে বাঁচার জন্য লড়তে লড়তে ক্লান্ত রিয়া ?
কষ্ট হয় আশিকের। কেন নিজের কথা রাখতে পারলো না ?
রিয়া খুব ভালো আবৃতি করতো।
কতো যে কবিতা ওর মুখস্থ থাকতো !
কথায় কথায় কবিতার লাইন আওড়াতো।রিয়া কথাও বলতো খুব মিষ্টি করে। কবিতার চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলতো আবৃতির অপূর্ব মূর্ছনায়…
আশিক অসম্ভব কবিতা ভালবাসতো।
এখনো বাসে। কবিতা পড়া এবং শোনা আশিকের প্রিয় অভ্যাস।
তাই রিয়ার সঙ্গে তার কবিতার প্রেম চলতো..অহর্নিশি। কি মায়াময় ছিলো সেসব দিন !
মানুষ জানতে পারেনা তার ভবিষ্যৎ কি ?
তাই এতো এতো পরিকল্পনা করে, স্বপ্ন দেখে।
ওদের স্বপ্ন আর পরিকল্পনার মাঝখানে.. ইগো আর জেদ চলে এসেছিল।
রিয়া সাজতে খুব ভালবাসতো তবে খুব পরিপাটি করে সাজতো। একটা স্নিগ্ধ ভাব ফুটে উঠতো রিয়ার সমস্ত অবয়বে। আশিক রিয়ার এই পরিপাটি সাজ খুব পছন্দ করতো। রিয়া এখনো আগের মতোই খুব পরিপাটি সাজে। তবে কোথাও একটা কিছু কম আছে, আশিক সেটা ধরতে পারেনি।
কেবলই মনে হয়েছে, কোথাও কিছু মিসিং !
রিয়া কি আবার কোনদিন সেই আগের মতো করে শুধু আশিকের জন্যেই সাজবে ?
জানে না আশিক।
একবার আশিক অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপে খুব ব্যস্ত ছিল অফিসের কাজ নিয়েই। রিয়ার দিকে ভালো করে তাকানোর সুযোগই পায়নি সেদিন।
রিয়া ঐদিন শাড়ী পরেছিলো। তারপরও সবই ঠিক ছিল।রাতে খাবার টেবিলে গিয়ে আশিক বুঝতে পারলো রিয়া ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে,
কথা বলছেনা।
কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেও ঠিকমতো উত্তর পেলো না,আবার রিয়ার মনের মেঘও কাটছিলো না।
রাতে ঘুমোতে এসে আশিক টের পেয়েছিল রিয়া কাঁদছে।
বিচলিত হয়ে আবারও জানতে চেয়েছিল আশিক, কি হয়েছে ?
অনেক কথা বার্তার পর আশিক বুঝতে পেরেছিলো অভিমানের কারণ।
সন্ধ্যা থেকেই শিখার সঙ্গে ফোনে বার বার কথা বলতে হচ্ছিলো। শিখা আশিকের ক্লাসমেট। ওরা একসাথে বুয়েটে পড়েছে।ওরা একই ডিপার্টমেন্টে চাকুরী করতো,পোস্টিং আলাদা জায়গায় ছিল। পেশাগত বিষয় নিয়েই সেদিন বার বার শিখার সঙ্গে কথা বলতে হচ্ছিলো।কথা বলার সময় বার বার রুমে এসে ল্যাপটপের সামনে বসতে হচ্ছিলো জরুরী তথ্যের জন্য।
রিয়া ভেবেছে আশিক আলাদা করে কাকে এতো গুরুত্ব দিচ্ছে যে, একবারও ভালো করে তার দিকে তাকাতে পারলো না ?
আশিক বুঝতে পেরে হো হো করে হেসেছিলো ঘর ফাটিয়ে। যদিও রিয়ার মান ভাঙাতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।
বেলী ফুলের মালা, রাত জেগে গল্প করা, এরকম আরো কত কি করে ওর মান ভাঙ্গিয়েছিল। বেলী ফুলের মালা হাতে নিয়ে রিয়া বলেছিল,তোমার পাশে কাউকে সহৃ করতে পারবো না।
আশিক হেসে বলেছিল,দূর ! শিখা তো আমার ক্লাসমেট। তুমি তো না বুঝেই অভিমান করে বসে আছো। আর আমার পাশে অন্য কাউকে সহৃ করতে হবে কেন ?
তুমি ছাড়া এখানে অন্য কারো এন্ট্রি হবেনা,বুঝেছো বোকা মেয়ে ?
সময়ের সাথে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।
ওরা ছিটকে পড়লো জীবনের আলাদা পথে।
আশিকের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও রিয়ার কি কষ্ট হয়েছিলো তখন নীলার কথা জানার পর ?
খুব জানতে ইচ্ছে করে আশিকের।
রিয়াকে বলেছিলো যদিও কারো এন্ট্রি হবেনা,তবুও নীলার আগমন ঘটেছিল জীবনে।
ক্ষমা করো রিয়া,মনে মনে বললো আশিক।
স্কুল থেকে বাসায় ফিরে বাবা-মাকে দেখে অবাক হয়ে গেল রিয়া।
বাবা-মা এসেছেন ওর বাসায়। রায়না খুব খুশী নানাভাই-নানুকে পেয়ে। মা ওকে খাইয়ে দিচ্ছেন আর রায়না টিভিতে কার্টুন দেখছে।
বিকেল চারটায় রায়নার গানের ক্লাস আছে। রহিমা খালা নিয়ে যাবে।
আজ রায়নার গানের ক্লাসেও যেতে ইচ্ছে করছেনা একটুও।
নানাভাই – নানু এসেছে তাদের বাসায়।
তাদেরকে ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা।
রিয়া খুশী খুশী গলায় বাবাকে বললো,
— কি ব্যাপার বাবা, হঠাৎ চলে এলে যে ?
বাবা হাসলেন,
— খুব দেখতে ইচ্ছে করলো তোদের । সেদিন গিয়ে তো বেশীক্ষণ থাকলিও না। তাই আমরাই চলে এলাম।
—- খুব ভাল করেছো বাবা। আমি শাওয়ার নিয়ে আসি। একসাথে খাব, বলতে বলতে রিয়া তার বেডরুমের দিকে চলে গেল।
বাবা-মায়ের সাথে খেতে বসেছে রিয়া। মা হটপট ভর্তি করে খাবার রান্না করে নিয়ে এসেছেন। রিয়ার এবং রায়নার সব পছন্দের খাবার। চিংড়ি মাছ দিয়ে কাঁচ কলার মোচার ঘন্ট,শুটকি মাছ, গরুর মাংস, হাঁসের মাংস এবং গলদা চিংড়ীর মালাইকারি।
মালাইকারিটা বিশেষ ভাবে রায়নার জন্য।
মা বললেন,
— সব খাবারই অল্প অল্প করে খেয়ে দ্যাখ।
রিয়া আঁতকে উঠে বললো,
— কি বলো মা ! এতো খাবার একসাথে খাওয়া যায় নাকি ?পরে খাব। এখন আমি মোচার ঘন্ট আর শুটকি দিয়ে ভাত খাব। কতদিন তোমার হাতের রান্না খাইনি বলো তো মা ?
মা হাসলেন।
ওরা গল্প করতে করতে খাওয়া শেষ করলো।
মা রায়নাকে নিয়ে পাশের রুমে বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করছেন। রায়না গল্প শুনতে খুব ভালবাসে।
বাবা টিভিতে ডিসকাভারি চ্যানেল দেখছেন।
রিয়া চা নিয়ে বাবার পাশে এসে বসলো।
ইন্ডিয়ান সেনা অফিসারদের কমান্ডো ট্রেনিং দেখাচ্ছে। কতো কঠিন কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয় টগবগে তরুণ অফিসারদের না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।
ঠান্ডা গভীর জলে পা দু’টো বেঁধে নামিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা খুব কঠিন একটা প্রশিক্ষণ।
সবাই সারভাইভ করতে পারেনা। দু’জন অফিসার মানসিক ভাবে মেনে নিতে পারলো না,অসুস্হ হয়ে পড়লে তাদেরকে দ্রুত এমার্জেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হলো।
আবার কয়েকজন অফিসার কঠিন মনোবলের সাথে প্রশিক্ষণ শেষ করলো।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে রিয়া বললো,
— কত কঠিন ট্রেনিং দেখেছো, বাবা ?
বাবা মাথা ঝাঁকালেন।
রহিমা খালা বিকেলের নাস্তার জন্য ডালের পিয়াজু আর ঝাল মুড়ি মাখানোর জন্য সবকিছু গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
— আমি রায়না বাবুর কেলাস থ্যাইকা আইসা নাস্তা বানাইয়া দিমু সগলরে।
রিয়া হাসলো, ঠিক আছে।
পৌনে চারটায় রায়না গানের ক্লাসের জন্য বের হয়ে গেলো রহিমা খালার হাত ধরে। গেটের বাইরে গিয়েই রিক্সা নিয়ে নেবে।
রিয়া বাবা মাকে নিয়ে ওর বেডরুমে বসে গল্প করছে। বাবা বিছানার পাশে রাখা চেয়ারে বসে আছেন। মা বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে বসেছেন। রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে রায়নায় যাওয়া দেখলো।
বড় কামিনী গাছটার আড়ালে চলে না যাওয়া পর্যন্ত রিয়া দাড়িয়ে থাকে।
এই গাছ টা অনেক পুরনো আর বড়। রাতের বেলা যখন ফুল ফোটে তখন রিয়ার ঘরেও সেই ফুলের সুবাস ছুটে আসে।
রিয়ার মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায় কামিনীর সুগন্ধে।
রিয়া ঘরে এসে বিছানার আরেক পাশে বসলো। টুকটাক কথা-বার্তার পর মা বললেন,
তুই কি সিদ্ধান্ত নিলি ?
রিয়া আচমকা মায়ের এই প্রশ্নে একটু বিব্রত হলো। কিছু বললো না। চুপ করে থাকলো।
মা তখন বললেন,
সেদিন তোর ছোট খালা এসেছিলো। আশিক দেশে এসেছিলো শুনে জানতে চাইলো, সে কি তোদের ফিরিয়ে নিতে এসেছিল কিনা। আমি হ্যাঁ বলেছি।
রিয়া মার দিকে তাকিয়ে থাকলো।
কিছু বললোনা।
সত্যিই তো আশিক তাদের ফিরিয়ে নিতেই তো চাইছে। মা তো এক অর্থে ঠিকই বলেছেন। মার জন্য রিয়ার কষ্ট হলো।
রিয়ার এমন একাকী জীবন মা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না মনে মনে।
কতবার রিয়াকে বোঝাবার চেষ্টা করেছেন যে, রিয়ার নতুন করে শুরু করা উচিৎ।
ছোট খালা,মেঝো খালা আগে কত প্রস্তাব নিয়ে আসতো রিয়ার জন্য। বাচ্চা সহই ছেলে পক্ষ রাজি আছে… এরকম কতো কথা।
রিয়া রাজী হয়নি।
কেন হয়নি কাউকে বলতে পারতো না।
আশিককে এতো ভালবেসেছিলো..সেই আশিকের সঙ্গেই তো ঘর করা হলোনা।
তাই অন্য কারো কথা ভাবতে ইচ্ছে হয়নি রিয়ার। আশিকের জন্যেই কি কোথাও কোন পিছুটান ছিলো রিয়ার ?
রিয়া জানে না।
আশিক শান্ত স্বভাবের হলেও খুব রোমান্টিক ছিল। একবার ওরা আশিকের দেশের বাড়ীতে বেড়াতে গিয়েছিল। আশিক রাতের বেলা রিয়াকে নিয়ে নৌকায় ঘুরতে বেরিয়েছিল। চাঁদনী রাত ছিল।
নদীর দু’পাড়ে কত নাম না জানা গাছ। সেবারই প্রথম রিয়া হিজল গাছ দেখেছিল।
রাতের নিস্তব্ধতা কেটে বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দটা রিয়ার মনে এক রিদম সৃষ্টি করেছিল।
আশিক রিয়ার হাত ধরে বসেছিল।
রিয়া মুগ্ধ চোখে আশিককে দেখছিল।
ওর মনে হয়েছিল,জীবনে সব পেয়ে গেলাম।আর কি চাইবার আছে !
সেই ‘সব পাওয়া’ রিয়ার জীবনটা হঠাৎ না পাওয়ায় ছেয়ে গেল। বাবার কথায় রিয়া বাস্তবে ফিরলো।
বাবা বললেন, কিছু কি ভেবেছিস মা ?
তবে আশিকের সাথে আবার নতুন করে সম্পর্কটা করতে চাইলে কিছু ব্যাপার মাথায় রাখতে হবে।
তুই সেসব ব্যাপারে কতোটা জানিস আমার জানা নেই। তাই,সেটা ভেবেই আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে চাই তোর সঙ্গে।
রিয়ার মনে পড়লো এরকম কিছু কথা ভিপি ম্যাডাম সেদিন রিয়াকে বলেছিলেন,
—- রিয়া একবার ডির্ভোস হয়ে যাওয়ার পর আবার যদি নতুন করে পুরনো সম্পর্কে ফিরে যেতে চাও তাহলে কিছু বিষয় ভালোবভাবে জানতে বুঝতে হবে তোমাকে এবং সেটাই ভালো হবে তোমার জন্য।
কিন্তু কি বিষয় সেটা আর বলার সুযোগ পাননি ম্যাডাম। তার আগেই জরুরী ফোন এলো এবং তারপর ম্যাডাম প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসে চলে গেলেন।
রিয়াও ব্যস্ত হয়ে ছিল নিজের কাজ নিয়ে,তাই আর কথা বলা হয়নি এটা নিয়ে।
রিয়া একটু অবাক হয়েই জানতে চাইলো,
— কি ব্যাপার বাবা ?
বাবা নরম গলায় বললেন,
— কিছু নিয়ম-কানুন আছেরে মা !
তুই বরং নিজেই পড়ে দেখিস।
বাবা রিয়ার হাতে পবিত্র কোনআন শরীফ এর একটি বাংলা অনুবাদ তুলে দিলেন এবং বললেন,
—- এখানে সূরা আল-বাকারার ২২৬ থেকে ২৩০ আয়াত পর্যন্ত তালাক এবং তালাক পরবর্তী বিষয়ে বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আল্লাহ্ তায়ালার সুস্পষ্ট নির্দেশনাও দেয়া আছে। আমার মনে হয় তোর জানা দরকার।
রিয়া মাথা ঝাঁকালো পড়বে বলো।
রিয়ার ভেতরটা কেঁপে উঠলো কেন জানি।
রহিমা খালা সন্ধ্যার পর পর সবাইকে গরম গরম পিয়াজু আর মুড়ি মাখা দিয়ে নাস্তা দিলো। ওরা হৈ চৈ করে খেলো।
রিয়ার বাবা এধরনের খাবার পছন্দ করেন। চা খেতে খেতে কত গল্প করলো ওরা। মা রিয়ার ছোট বেলার গল্প করলেন।
রায়না খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছিলো সেই গল্প।
তখন রিয়া অনেক ছোট স্কুলে পড়তো।
শরৎকালের এক সকালে ঘুম ভেঙ্গে মা দেখলেন রিয়া ঘরে নেই।
অতো সকালে একা একা বাড়ীর বাইরে যাওয়ার মতো বড়ও তখন হয়নি।
মা পাগলের মতো বাসার ভেতরে খুঁজলেন,
কোথাও নেই। ছাদেও নেই।
ততক্ষণে বাড়ীর সবাই উঠে পড়েছে।
ছোট রিয়া কোথায় যেতে পারে ভেবে যখন সবাই অস্থির, তখন সে ফ্রকের সামনেটা দুই হাতে উঁচু করে ধরে গুটি গুটি পায়ে বাসায় ঢুকছে।
মা রাগে কাঁপছিলেন।
বাবা অবাক হয়ে বলেছিলেন,জামার ভিতরে কি ওগুলো,মা ?
রিয়া উজ্জ্বল মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল,
—বাবা.. দ্যাখো কত্তো ফুল !
ফ্রকের দু’কোনা ছেড়ে দিতেই টুপ টুপ করে ঝরে পড়েছিল অজস্র শিউলি ফুল।
ভোরের শিশিরে ভেজা শিউলি !
দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।
সেদিনও বাড়ীর সবার মন ভালো হয়ে গিয়েছিলো।
মা আর বকুনী দিতে পারেনি বাবার কারণে।
বাসার কাছেই ছিলো বড় একটা শিউলী গাছ। ভোর বেলা আশে পাশের মেয়েরা শিউলী ফুল তুলতে আসতো।
প্রতিদিন বারান্দায় দাড়িয়ে রিয়া ওদের ফুল কুড়োন দেখতো। তার ভারী ইচ্ছে করতো ওদের মতো ফুল কুড়োতে।
সেদিনও ঘুম ভেঙে বারান্দায় এসে দাড়িয়েছিলো।
মা রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিলেন। রিয়া বারান্দায় দাড়িয়ে মেয়েগুলোর ফুল কুড়োন দেখতে দেখতে নিজেও টুক করে দরজা খোলা পেয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো।
রায়না মায়ের ছোটবেলার গল্প মুগ্ধ হয়ে শুনলো। রিয়াকে বললো,
— মা আমিও একদিন শিউলী ফুল কুড়োতে যাব !
রিয়া হাসলো,
আচ্ছা মা যাব একদিন।মাত্র তো শিউলি ফোটা শুরু হয়েছে। জানো তো রায়না…এটা শরৎকাল?
শিউলী ফোটে শরৎকালে।
নভেম্বরের মাস।
স্কুলে এখন পরীক্ষার মৌসুম। প্রচুর ব্যস্ততা।
রিয়ার নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই।
রায়নার পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
নভেম্বরের ১ তারিখে জিইসি শুরু হয়েছিল,এরপর পিইসি। এখন সাধারণ ছাত্রীদের ফাইনাল শুরু হয়েছে।
এবার কি ঢাকায় ঠান্ডা পড়বে সেভাবে ?
এখন আর ঢাকায় শীত পড়েনা বললেই চলে।
হালকা পাতলা শীতের কাপড় পরলেই হয়।
ভারী কিছু পরার মতল শীত গত কয়েক বছরে অন্তত পড়েনি।
এবার মনে হচ্ছে একটু বেশীই পড়বে শীতটা।
আজ খুব ভোরে স্কুলে চলে এসেছে রিয়া।
জরুরী কিছু কাজ আছে। একটু নিরিবিলি বসে করে নেবে।
এতো সকালে সাধারণ; টিচাররা আসেন না। সাতটার পর থেকে আসা শুরু হয়।
রিয়া সাতটার আগেই চলে এসেছে।
টিচার্স রুমে ব্যাগ, জরুরী খাতা-পত্র রেখে বারান্দায় এসে দাড়ালো।
টিচার্স রুমের আয়া পারুল নিজেই আগ্রহ করে রিয়ার জন্য ক্যান্টিন থেকে গরম চা আনতে গেছে।
সকালের মৃদু বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। মাঠের পূর্বদিকে বিশাল বড় বট গাছটার দিকে তাকিয়ে রিয়ার একটু শীত শীত করতে লাগলো। রিয়ার ভাল লাগলো শীতের এই অনুভূতি টুকু।
এবার রিয়ার চোখ পড়লো গাছের নীচে পড়ে থাকা শিউলি ফুলের উপর। অডিটোরিয়ামের পাশেই শিউলি গাছটা। গাছটার নীচে ফুল পড়ে পড়ে সাদা ফুলের বিছানা হয়ে আছে।
রিয়া বারান্দা থেকে নেমে এলো।
সেই ছোট্টবেলার মত নিজেকো ধরে রাখতে পারলো না।শিশির ভেজা ঘাস মাড়িয়ে শিউলি গাছের নীচে এসে দাড়ালো।
আহ্… কি সুন্দর ফুল !
সাদা ফুলের নীচে হালকা কমলা রঙের ছোঁয়া। কি সুন্দর দৃশ্য।
সাদা ফুল গুলোর উপর টুপ্ টাপ্ করে ঝরে পড়েছে শিশির। সকালের নরম রোদে চিক্ চিক্ করছে ঝরে পড়া শিউলি গুলো।
রিয়া মুগ্ধ হয়ে গেল।
নীচু হয়ে দু’হাত ভরে তুলে নিল মুঠো মুঠো শিউলি…চোখ বন্ধ করে ফেললো রিয়া।
শিউলির সুবাস নিতে নিতে বিড় বিড় করলো রিয়া, তোমাকে আরো একবার মুঠো মুঠো শিউলির দিতে চাই, আশিক !
তুমি কি নেবে ???
(চলবে )
#উপন্যাা_বিচ্ছেদ
#কাকলী_প্রকাশনী
#প্রকাশকাল_গ্রন্থমেলা_২০১৮
#লেখক_মাশাওফি_আমিন
মাশাওফি আমিন
১৪.০৫.২০২১