# দরজার ওপাশে
প্রচন্ড মেজাজ খারাপ নিয়ে বাসর ঘরে ঢুকলাম। ঢুকে দেখি আমার নববিবাহিত স্ত্রী মিলা মন খারাপ করে বসে আছে।
উচ্চবিত্ত পরিবারের একমাত্র মেয়ে মিলা, আমাদের তিন বছরের সম্পর্কের এই বিয়েতে ওর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন কেউ রাজি ছিল না ,একমাত্র ওর জেদের কারণে বিয়েটা সম্ভব হয়েছে।
-আমি খুব দুঃখিত মিলা, প্লিজ আমার ছোট ভাই আসিফের ব্যবহারে তুমি কিছু মনে করো না।
আসলে গাড়ি থেকে নামার পর আমি কিছু বোঝার আগেই আসিফ মিলাকে কোলে তুলে নিয়ে আসলো ঘরের দরজার সামনে। মিলা হতচকিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আমিও তখন কি বলবো বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকলাম। মোটামুটি আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে যখন সবাই চলে গেল, মিলা তখন বাসর ঘরে।
আমি আসিফ কে ডেকে পাঠালাম, এবং মায়ের সামনেই প্রচন্ড কড়া ভাষায় কিছু কথা বললাম।
আসিফ আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
– আসলে আমি কিছু করতে চাইনি, বড়রাই আমাকে বলেছে এরকম নাকি নিয়ম।
-আরে আরিফ ছাড় না এসব, কিছু কিছু নিয়মকানুন মজা করার জন্য করা হয় , তোর মামা খালারা বলছিল-এই বেচারাকে দোষ দিচ্ছিস কেন? মা পাশ থেকে বলে উঠলেন
আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে রুমে ঢুকে গেলাম।
তার পরদিন বিকেলে মিলাকে নিয়ে বাইরে যাবো, মিলা ডাইনিং রুমে গেল পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে। তারপরেই চিৎকার ভেসে আসলো ।চিৎকার করছিলেন আমার মা,
এটা তুমি কি করলে বৌমা ? অলুক্ষণে কাজ বিয়ের পর পর এসেই এরকম কাচের জিনিষপত্র ভাঙছো?
তাকিয়ে দেখি মিলা থর থর করে কাঁপছে। আমি আমার মায়ের চোখে একটা ক্রোধ দেখতে পাচ্ছি, বুঝলাম না মিলা কে নিয়ে তার সমস্যা কোথায় ? বরং উনিই তো মিলাকে পুত্রবধূ করার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছিলেন।
-মা কি শুরু করলে একটা গ্লাস ভেঙেছে শুধু?
-গ্লাসটা ভেঙেছে সেটা বড় ব্যাপার না কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখলাম ইচ্ছে করে তোর বৌ হাত থেকে গ্লাসটা ফেলে দিয়েছে
মিলা ভয়ার্ত চোখে চুপ করে আমার পেছনে লুকিয়ে আছে। -তুমি ভুল দেখেছো মা ।আমি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মায়ের দিকে কথাগুলো ছুড়ে মিলার হাত ধরে ঘরে ঢুকলাম।
মিলা বড় হয়েছে খুব আদরে, আমি জানতাম ও যেই ফ্যামিলি থেকে এসেছে সেরকম লাইফস্টাইল ওকে আমি দিতে পারবো না কিন্তু এটা কখনো আশা করিনি যে আমার পরিবার থেকে ও দুঃখ পাবে। কি বলবো সান্ত্বনা দেয়ার ভাষা আসলে আমার ছিলনা। মিলা খুব চুপচাপ হয়ে গেছে। ও আর আগের মত হাসে না, আমাকে জড়িয়ে ধরে আইসক্রিমের বায়না ধরে না, মন খুলে আমার সাথে কথা বলে না , সব সময় কেমন একটা ভয়ে থাকে।
একদিন মাঝরাতে ওর গোঙানির শব্দ পেলাম, পাশ ফিরে দেখি কেমন একটা ছটফট করছে। ডেকে তুললাম রীতিমতো ঘেমে গেছে মনে হয় কোন স্বপ্ন দেখেছে। আমাকে জড়িয়ে ধরে শুধু একটাই কথা বললো
-আরিফ আমি এখানে থাকবো না।
-কেন, কি হয়েছে? আমি সাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা দিতে দিতে ওকে বললাম।
মুহূর্তে ওর মুখ ফাকাসে হয়ে গেল, “না কিছুনা শুয়ে পড়ো।”
আমি আর চাপাচাপি করলাম না, সকাল হোক দেখা যাবে।
আমাদের বিয়ের আট মাসেও আমি মিলাকে ঠিকঠাকমতো এই বাড়িতে হাসতে দেখি নি। নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিল তবে কি আমি মিলার জীবনটা নষ্ট করে দিলাম?
অফিস থেকে ফিরে নেটে একটু সময় কাটাচ্ছিলাম,
-তোমার একটু সময় হবে ?কেমন যেন আড়ষ্ঠ ভাবে মিলা বলে উঠলো
-এভাবে বলছ কেন মিলা ?তোমার জন্য আমি সব সময় ফ্রী, বসো আমার পাশে কি হয়েছে বলো।
-তুমি কিছু মনে করবে না তো?
-আরে আগে বলেই দেখো না
-দেখো আরিফ ,আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি, আমি তোমাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারবো না কিন্তু এই বাড়িতে থাকাটা আমার জন্য খুব মুশকিল হয়ে গেছে।
-আমি বুঝতে পারছি মিলা
-না আরিফ তুমি আসলে কিছুই বুঝতে পারোনি ।এখন আমি তোমাকে যে কথাটা বলবো সেটা তোমার বিশ্বাস হবেনা আর হয়তো তুমি আমাকে কাল সকালে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে
আমি একমনে মিলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম ওকে বলার সুযোগ দিলাম
-আরিফ প্লিজ কিছু মনে করো না কিন্তু তোমার ভাই আসিফের মতিগতি ভাল না, ওর চোখ আমার দিকে যেন অন্য ভাবে তাকায় বলতে বলতে মিলা চোখ নামিয়ে নিলো।
যতক্ষণ বাসায় থাকে আমার খুব অসহায় লাগে।
-তুমি আগে কেন এসব কথা বলোনি?
-মাকে বলেছিলাম কিন্তু মা বললেন, ছেলেমানুষ সব ঠিক হয়ে যাবে ।তোমাকে বলতে বারণ করেছিলেন তাই কিছু বলিনি। কিন্তু গতকাল ও আমার গায়ে হাত দিয়েছে, আমাকে বাজে ইঙ্গিত করেছে।
মুহূর্তে আমার রক্তে যেন আগুন জ্বলে উঠলো মনে হলো এই মুহূর্তে আসিফ কে ডেকে এনে ওর হাড় গুলো সব ভেঙ্গে দেই। তাছাড়া আমি নিজেও লক্ষ্য করেছি ওর সামনে মিলা সবসময় তটস্থ থাকে। মায়ের ব্যবহারও মিলার প্রতি কেমন যেন।
-তুমি চিন্তা করো না মিলা, আমি এর একটা ব্যবস্থা করবো।
-প্লিজ আরিফ তুমি ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করো না, আমি ওর চোখে আমার জন্য বাজে ইঙ্গিত গুলো সব সময় দেখতে পাই এখন যদি তুমি ওর সাথে ঝামেলা করো তাহলে আমার গর্ভে আসা তোমার সন্তানের যদি কোন ক্ষতি করে দেয়
-তুমি সত্যি বলছো মিলা আমি বাবা হতে যাচ্ছি? আমি খানিকটা থতমত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
মিলা আলতো করে হাসলো।
মুহূর্তে আমার সব রাগ পানি হয়ে গেল, না এই সময়ে মিলাকে আমি মানসিক অশান্তির মধ্যে রাখতে পারবো না, ওকে নিয়ে ওর বাবার বাড়ি চলে যাবো। ওটাই ওর জন্য এখন একমাত্র সুরক্ষিত জায়গা।
পরদিন সকালে আমাদেরকে বেরোতে দেখে মা ছুটে বেড়িয়ে আসলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আমি বললাম,
– আমি আর তোমাদের মুখ দেখতে চাই না, আমি চলে যাচ্ছি।
-কিন্তু কি হয়েছে , কেন চলে যাবি?
-তোমার ছোট ছেলেকে জিজ্ঞেস করো সে মিলার সাথে কি করতে চেয়েছিল? পারভার্ট একটা, ছি ওকে ভাই বলতে আমার লজ্জা করে। আমি মিলা কে নিয়ে বের হয়ে আসলাম। আসিফ পেছনে ছুটে আসলো
– ভাইয়া তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে ।ওর চেহারা দেখেই আমার রাগ যেন মাথায় উঠে গেল একটাও কথা না বলে ঠাস করে একটা থাপ্পর মারলাম ,পেছন থেকে মা আহাজারি করে চলেছেন।
মিলাদের বাড়িতে ঢুকতেই মিলা যেন প্রাণ ফিরে পেল। পরদিন সকাল থেকেই আমি আমার সেই পুরনো মিলাকে খুঁজে পেলাম যেন আমার স্ত্রী নয় সেই পুরনো প্রেমিকা, পুরনো হাসি, পুরনো ভালবাসা। কিছু মাস পরেই মিলার কোল জুড়ে আসলো আমাদের প্রথম পুত্র সন্তান, বছর দুয়েক পরে আমি আবার একজন পুত্র সন্তানের পিতা হলাম। বলাই বাহুল্য আমি আমার ফ্যামিলির সাথে আর কোন যোগাযোগ করিনি। ওরকম নোংরা জায়গায় আমার মিলাকে মানায় না আর এখন তো আমার সাথে আমার দুই ছেলেও আছে। কি আশ্চর্য সে দিন যদি সাহস করে মিলার হাত ধরে বের হয়ে না আসতাম তাহলে আজকে আমার জীবনটা এত সুন্দর হতো না। এত সুন্দর একটা ফ্যামিলি আমি নিজে থেকে ওই বাড়িতে কখনোই পেতাম না। আমার শ্বশুর মারা গেছেন বেশ কিছুদিন হয়েছে তার অবর্তমানে উনার বিজনেস আমি সামলাচ্ছি। আমি মাঝে মাঝে খুব চিন্তা করি মানুষের ভাগ্য আসলেই হাতে থাকে না, কোথায় ছিলাম আমি এক অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে আর আজ আমি কোথায়, সবটাই মিলার জন্য। অথচ এই মিলা কত কষ্ট পেয়েছে আমার ফ্যামিলির কাছ থেকে, শুধু কষ্ট না সাথে ছিল অপমান। দেখতে দেখতে ছেলেরা বড় হয়ে গেল। একজন ক্লাস নাইন আরেকজন সেভেন। ওদের দুই ভাইকে যখন খুনসুটি করতে দেখি আমার বুকের মধ্যে কেমন একটা আঁচড় লাগে আমি আর আসিফ ঠিক এমন ছিলাম।
অনেকগুলো বছর পর নিজের বাড়িতে এসে দাঁড়ালাম
কেমন যেন পর পর লাগছে। দরজা খুলে দিলেন আমার মা। চুলগুলো একেবারে সাদা হয়ে গেছে, একদম নাজুক হয়ে গিয়েছেন। মা ইশারায় আমাকে বসতে বললেন যেন আমি কোনো মেহমান ।
“আসিফ কোথায় মা?”
মা কোন কথা না বলে ভেতরে চলে গেলেন, মায়ের হাতে একটি চিঠি। উনি প্রায় রোবটের মত আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন, কাগজটা অনেক পুরনো
ভাইয়া,
আমায় ক্ষমা করো আমি জানিনা তোমাদের মধ্যে কি সমস্যা হয়েছে ? তবে আত্মীয়-স্বজন আর পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখে যতটুকু শুনেছি তাদের মূল বক্তব্য হলো সমস্যার কারণ হচ্ছি আমি , যার কোন কিছু আমি জানিইনা। স্ত্রীকে অবিশ্বাস করা কোন স্বামীর কর্তব্য বা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না কিন্তু ঠিক তেমনভাবে নিজের পরিবারের কাউকে মনে মনে দোষারোপ করার আগে সেটা যাচাই করা উচিত ভাইয়া। আমায় মাফ করো আমি এই দোষারোপ নিয়ে আর বাঁচতে পারছি না, বাইরে বের হতে পারি না আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই কেমন চোখে যেন তাকায়। পারলে মাকে দেখে রেখো, জানি সেটা তোমার দ্বারা সম্ভব না, কারণ তুমি একপাক্ষিক কথা শুনেই বিচারের দণ্ড ঝুলিয়ে দাও, তোমার মনে আছে বিয়ের দ্বিতীয় দিনেই ভাবির হাত থেকে একটা গ্লাস পড়ে গিয়েছিল না ওটা পড়ে যায় নি ভাবি ইচ্ছে করে ভেঙেছিল এবং মায়ের সামনে খুব ডেসপারেটলি, যেন মা রিএক্ট করে বসেন। আসলে ভাবি কখনোই চায়নি আমাদের সঙ্গে থাকতে , ভাবি শুধু তোমাকে নিয়ে থাকতে চেয়েছে আর সে সফল হয়েছে। ভাইয়া চিঠিটা তোমার উদ্দেশ্যে যদি কখনো আসো তাহলে হয়তো হাতে পাবে আমি জানি যে গন্তব্যের পথে আমি যাচ্ছি তা কোন সমাধান না কিন্তু এই সমাজ থেকে পালিয়েও আর বাঁচতে পারছিনা, সবাই আমাকে দেখে হাসে, তবে কষ্টটা সেখানে না মূল কষ্টটা হলো তুমি একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করো নি, জানতে পর্যন্ত চাওনি আসল সত্যটা কি? উল্টো আমার গায়ে হাত তুলেছো। ভালো থেকো ভাইয়া ,খুব ভালো তোমার নতুন পরিবারের সাথে।
আমি বাচ্চাদের মত কাঁদতে লাগলাম , মা এসে আমার হাত থেকে পরম যত্নে চিঠিটা নিয়ে নিলেন।
-আপনি এবার আসুন
আমি মায়ের কথায় চমকে উঠলাম।
-মা তুমি এভাবে কেন কথা বলছো
-কারণ একজন মা তার সন্তানের খুনি কে কখনোই ক্ষমা করতে পারে না।
-আমি কি তবে তোমার সন্তান নই আর আমি এসব তো জেনে বুঝে ইচ্ছে করে করিনি আমি ,প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম।
-আমার বড় ছেলে বহু আগে মারা গেছে আর আমার ছোট ছেলে এখনো আমার সঙ্গেই আছে, ওপারে চলে গিয়েও আমি ওর স্মৃতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছি সেখানে কোন খুনির জায়গা নেই। দরজাটা ওদিকে, কঠোর কন্ঠে মা বলে উঠলেন, মায়ের এইরূপ আমি কখনো দেখিনি।
আমি বের হতেই সশব্দে দরজাটা লাগিয়ে দিলেন। আমি জানিনা আমি এখন কি করবো ,কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো, কেন যাবো ,আমার কি করা উচিত ?একের পর এক প্রশ্ন যার কোন উত্তর নেই। বদ্ধ দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম হয়তো দরজাটা খুলবে কখনো। কিন্তু আজ মাকে দেখে বুঝে গেছি আমি শুধু অপেক্ষাই করবো, ওই দরজা আমার জন্য আর কখনোই খুলবে না।