#অসহায়
প্রায় দশ লাখ টাকা যৌতুকের বিনিময়ে আমার বিয়ে হলো একটা এনজিওতে কর্মরত শহীদ নামক একজনের সাথে, বাবা-মায়ের টাকা গেলেও তারা এখন ভারমুক্ত কারন আমার মতো কালো বর্নের কুশ্রী চেহারার একটা মেয়ের সারা জীবনের জন্য একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ছেলেটার চাকরী অত্যন্ত সাধারণ, খুব কম আয় তাতে অবশ্য আমার বাবা-মায়ের কিছুই যায় আসে না, তারা বোঝা নামিয়েছেন।
আমার স্বামী শহীদ দেখতে আহামরি তেমন কিছু না, বোনের বিয়ে হয়ে গেছে , বাবা মারা গেছে বছর সাতেক আগে , মা তার সঙ্গেই থাকেন।
বিয়ের এক মাসের মাথাতেই আমি বুঝে গেলাম আমার প্রতি তার কোন আগ্রহ নেই ,আগ্রহ যতটুকু ছিল ওই দশ লাখ টাকার উপরে তাই এতদিন হয়তো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে আর এখন পান থেকে চুন খসলেই যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে এমনকি তুই-তোকারি করে, গালিগালাজ তো বাদই দিলাম।
কিছুদিন পর দেখলাম ও অন্য রুমে শুচ্ছে। ব্যাপারটা দেখে শাশুড়ি মা খুব চিন্তিত হয়ে গেলেন,
“মাগো তোমাদের মধ্যে কি কোন ঝামেলা হয়েছে?” উনি সহজ সাধারণভাবে জিজ্ঞেস করলেন।
কী উত্তর দেবো ,আমি তো কিছুই জানিনা? চুপ করে থাকলাম।
কৌতুহল থেকেই এক দিন আড়ি পাতলাম, কই শহীদ ঘুমায়নি তো, স্পষ্ট কথা বলার শব্দ শুনছি মাঝে মাঝে আবার হাসছে, তার মানে কারো সাথে ফোনে কথা বলছে। আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন, উনিই বা কি করবেন? এরকম প্রায়ই হতে লাগলো এক ছাদের নিচে থেকেও আমরা যেন অপরিচিত। ও আসে, খাবার খায়, নিজের ঘরে ঢুকে যায়।
এভাবে এক রাতে যখন ফিরে এসে গোসলে ঢুকলো, আমি ওর ফোনটা চেক করলাম ।একটা নাম্বার থেকে সারা দিনে প্রায় বারোবার কন্টাক করা হয়েছে । আমি নাম্বারটা টুকে নিলাম তারপর ফোনটা যথাস্থানে রেখে দিলাম। পরদিন ও অফিস যাওয়ার পর আমি ওই নাম্বারে ডায়াল করলাম ফোনটা একটা মেয়ে রিসিভ করলো।
অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন পেয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
– হ্যালো কে বলছেন?
-আমার পরিচয় আপনার না জানলেও চলবে তবে আপনি যার সাথে এখন ঘনিষ্ঠ ভাবে চলাফেরা করছেন দয়া করে তার সম্পর্কে একটু খোঁজখবর নিন
-মানে কি, আপনি কে, কি বলতে চাচ্ছেন?
এমন সময় আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে মা বলে উঠলেন, “শোনো মেয়ে, শহীদ আমার ছেলে আর এতক্ষন যার সাথে কথা বলছিলে সে আমার পুত্রবধূ । না জেনে না শুনে কি করে তোমরা দুম করে একটা ছেলের সাথে ঘোরাঘুরি শুরু করো আমি বুঝতে পারিনা । মা লাইনটা কেটে দিলেন।
রাতে কলিংবেলের শব্দ শুনে দরজা খোলার সাথে সাথে শহীদ হিংস্র জানোয়ারের মত আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো
-তুই শ্রেয়া কে ফোন করেছিলি, তুই বলেছিস যে তুই আমার বউ
শহীদ আমার চুলের মুঠি ধরে ছিল আমি কোনমতে ব্যথা সামলাতে সামলাতে বললাম “এটা কি ভুল কিছু?” বলার সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে ও আমার গালে একটা থাপ্পর মারলো তারপর আমাকে মেঝেতে ফেলে চড়, কিল ,ঘুষি ,লাথি মারতে লাগলো যেন একেবারে হিংস্র জানোয়ার হয়ে গেছে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে।
আমার ঠোঁট কেটে গেছে, কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।
এমন সময় মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,
-ও কিছু বলেনি , যা বলার আমি বলেছি, এখন কি আমাকে মারবি?”
-দরকার হলে তাই করবো,তুই বুড়ি মরিস না কেন ?আমার উপর বোঝা হয়ে বসে আছিস, তোর মরণ আসে না কেন? মা সহ আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম, আমার কান ঝাঝা করছিল, ওর এতটা অধঃপতন! শহীদ বলেই চলেছে,
-তোর কি ধারণা তোর মতো কালো পেত্নীকে আমি আমার বউ হিসেবে মেনে নেব শুধুমাত্র তোর বাবার টাকার জন্য তোকে বিয়ে করেছি না হলে তোর মুখ দেখলেই তো আমার বমি পায়। তোর চেহারা দেখলেই আমার দিন খারাপ যায়। অনেক কষ্টে অনেকদিন পেছনে পেছনে ঘুরে শ্রেয়াকে রাজি করিয়েছিলাম আর তুই আর এই বুড়ি মিলে সেটাতে পানি ঢেলে দিলি। এখন তোরা বুঝবি শাস্তি কাকে বলে ?
শহীদ রাগে গজগজ করতে করতে আমাকে আরো একটা লাথি মেরে নিজের ঘরে চলে গেলো আমি ওখানে স্থবির মূর্তির মত পরে রইলাম, মা আমার পাশেই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।
ঠিক তার পরদিন শহীদ একটা মেয়েকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলায় উপস্থিত হলো আমার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললো,
-তোর চেহারা দেখেই তো আমার মন উঠে যায় আর শরীর সেটা তো একটা কালো রঙের ডিপো। আজ থেকে আমার যখন ইচ্ছা হবে তখন আমার বাড়িতে আমি যে কোন মেয়েকে নিয়ে আসব তুই যা করার করে নে। বলে ও মেয়েটাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। আমি দরজা ধরে বসে পরলাম। এতটা অপমান ! আমার নিজের স্বামী অন্য একটা মেয়ের সাথে একই রুমে রাত কাটাচ্ছে তাও আবার আমার চোখের সামনে।
এভাবে ১/২ সপ্তাহ পর পরই শহীদ নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে আসতো । আমি যতটা না বিস্মিত হতাম তার চেয়ে অনেক বেশি অপমানিত বোধ করতাম।
মা সারাদিন কাঁদেন আর বলেন তাকে যেন আমি মাফ করে দিই আমার জীবনটা উনি নষ্ট করে দিয়েছেন। আমি দাঁত কামড়ে পড়ে থাকলাম, যাবার কোন জায়গা নেই, বাবা-মা জায়গা দিবে না ইতোমধ্যে আমার পেছনে দশ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেছে আর আমি যে তাদের বোঝা এটা ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি আমার গায়ের রং আমার চেহারা সবকিছু মিলিয়ে আমি যেন তাদের জীবনে এক দুর্বিষহ অধ্যায়। ইতোমধ্যে মা আমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনি এখন থেকে আমাকে সেলাই শেখাবেন। উনি এরকম অসংখ্য মেয়েদের সেলাইয়ের ট্রেনিং দেন। যেহেতু মায়ের পরিচিত তাই টাকা পয়সা কিছু লাগবেনা। আমি খুব মন দিয়ে কাজ শিখতে লাগলাম, আমার আগ্রহ দেখে উনি নিজেই আমাকে আরো নতুন নতুন কাজ শেখাতে লাগলেন। এভাবে কেটে গেল প্রায় ছয় মাস, শহীদের কোন পরিবর্তন হয়নি। সে তার মত করে জীবন কাটাচ্ছে।
কয়েকদিন পর একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলো, শহীদ বাইক একসিডেন্ট করেছে আমাকে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে বললো। আমি কোন রকম ভাবে ব্যাগটা নিয়ে হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছলাম ততক্ষণে ওকে ওটিতে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে। ডাক্তার এসে বললেন, পেশেন্টের পায়ের উপর দিয়ে ট্রাক চলে গেছে এমতাবস্থায় যদি রোগীকে বাঁচাতে হয় তাহলে দুটি পা-ই কেটে ফেলতে হবে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কনসেন্ট ফরমে সাইন করে দিলাম। প্রায় বাইশ দিন পর হাসপাতাল থেকে ওকে ছেড়ে দেয়া হলো। একটা হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করতে হলো। আমি ওকে বাড়ি নিয়ে আসলাম। দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করলাম, খাওয়া-দাওয়া সব কিছু শেষ হলে বললাম,
-এতদিন আমার গায়ের রঙ আর খারাপ চেহারার জন্য তোমার অনেক অত্যাচার, অপমান সহ্য করেছি আর এখন তুমি পঙ্গু, নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে আসা তো অনেক দূর বাথরুমে যেতে হলেও অন্যের সাহায্য প্রয়োজন তোমার
-প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও
-আমি দুঃখিত শহীদ, আমি এতটা উদার নই মহান নই অনেকেই হয়তো আমার নামে অনেক বাজে কথা বলবে যে পঙ্গু স্বামীকে ছেড়ে চলে গেছে কিন্তু তারা কেউ ভেতরের খবরটা জানে না । আমি নিজে আমার চেহারা তৈরি করিনি মহান সৃষ্টিকর্তা সেটা তৈরি করেছিলেন আর সেই দোষে তুমি আমাকে দোষী করেছ আজ তোমার সাথে যা ঘটে গেছে সেটাও সেই সৃষ্টিকর্তার আদেশেই ঘটেছে, সৃষ্টিকর্তা নিজেই যেখানে তোমার প্রতি মহানুভবতা দেখাতে পারেননি সেখানে আমি তো কোন ছার। জানি অনেকেই ভুল বুঝবে আমার আড়ালে অনেক কটু কথা বলবে কিন্তু যেই যন্ত্রণা যে অপমান আমি সহ্য করেছি দিনের পর দিন তা কেউ দেখবে না । আমি তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি সারা জীবনের জন্য, আরো আগেই যেতে পারতাম কিন্তু আমি চাইছিলাম এমন একটা মুহূর্ত যখন তুমি নিজে থেকে অসহায় বোধ করবে যেমনটা আমি সবসময় করতাম। আমার এই কুৎসিত রূপ আর কখনো তোমাকে দেখতে হবে না। এ কি, তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছো কেন? আমার চেহারা দেখলে না তোমার বমি পায়। আমি একটু হেসে ফেললাম।
নিজের ঘরে এসে আগেই গুছিয়ে রাখা ব্যাগ টা নিয়ে বের হতে চাচ্ছিলাম ঠিক এমন সময় মা এসে বললেন,” মাগো আমি একটা অমানুষ জন্ম দিয়েছি ।এই অমানুষের সাথে এক ছাদের নিচে আমিও থাকবো না। আমাকে কি তোমার সঙ্গে নেবে? একবেলা খাবার দিলেই চলবে, আমি না হয় কোথাও না কোথাও একটা কাজের ব্যবস্থা করে নেব, অন্তত অন্যের বাড়িতে ঝি গিরি তো করতে পারবো।”
আমি মাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম।
অনেকদিন পর খোলা রিকশায় মায়ের সাথে বসে ছুটে চলেছি অজানা গন্তব্যে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই, আমি জানি আমি পারব ,আমাকে পারতেই হবে।