রুপকথা পর্ব ১
আজ মাহিয়ার বিয়ে। বিয়ে বলতে এখন আখ্ত আর রাতে রিসেপশন। গতকালই হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেছে। বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হচ্ছে ওর। ঘরময় মানুষের ভিড়, সাজ সাজ রব চারদিকে। নানান প্রকৃতির সাজসজ্জা দিয়ে বাসাটা আজ মোড়ানো। মেয়েদের খিলখিল হাসাহাসি, বড়দের এটা ওটা নিয়ে জরুরি আলোচনা আর বাচ্চাদের বাধহারা দুষ্টুমিতে বাড়িটা ভরে উঠেছে।
মিসেস রোখসানা চৌধুরী, মাহিয়ার মা, এর আজ নিশ্বাস নেওয়ার জো নেই। কাল রাতে ঘুমিয়েছেন ভোর চারটার পরে আর উঠে গেছেন ফজরের ওয়াক্তে। কাজ যে আজ কোন কোন দিক থেকে উদয় হচ্ছে উনি বুঝে উঠতে পারছেন না। পেশায় ডাক্তার, রোখসানা খুব গোছানো একটা মানুষ। তবে আজ কোনোভাবেই কিছু গুছিয়ে উঠতে পারছেন না তিনি। তাকেও আসলে বেশী একটা দোষ দেওয়া যায় না এর জন্য। একমাত্র সন্তান মাহিয়া। ওর বিয়েতে তিনি আর তার স্বামী কোনো কিছুই বাদ রাখতে চাচ্ছেন না। মিলন চৌধুরীও পেষায় মেডিসিন স্পেশালিস্ট। এই ফিল্ডে ওনার বেশ নাম ডাক আছে।
ঘড়ি দেখলেন মাহিয়ার বাবা,
– এই রুখু, এগারোটা বেজে গেছে। ফোন দিয়েছিলাম বেয়াইন সাহেবাকে, ওনারা বের হয়ে গেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌছে যাবেন তারা। মাহিয়া কি রেডি হয়েছে? একটু গিয়ে দেখ না?
রোখসানা মাহিয়ার রুমের দরজায় টোকা দিয়ে নব ঘুড়িয়ে ভেতরে ঢুকলেন। মাহিয়া ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসা। ওকে সাজাচ্ছে কয়েকজন মিলে। বাকিরা হাসাহাসি আর মজা করলেও মাহিয়া চুপ করে বসে আছে। রোখসানার আখ্তের শাড়িটা পড়েছে ও। লাল বেনারসিতে মেয়েকে পরীর মতন লাগলো রোখসানার কাছে। শাড়ী, গয়না, মেকআপ সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছে মাহিয়াকে। মেয়ের সামনে গেলেন তিনি,
-আমার মা কে মাশাল্লাহ্ খুব বেশী সুন্দর লাগছে। আমারই না নজর লেগে যায় আজ।
মায়ের কথায় মাহিয়া চোখ তুলে তাকালো। মেয়ের চেহারাটা ধরে ওর কপালে একটা চুমু দিলেন রোখসানা।
– আম্মু দোয়া করি তোর জীবন নিহালের সাথে যেন অনেক বেশী সুন্দর হয়।
মাহিয়া শুধু হালকা একটা হাসি দিল। কিন্তু হাসিটা ওর চোখ পর্যন্ত পৌছলো না। কারণ হাসিটা সুখের ছিল না। মাহিয়া জানে নিহালের সাথে ওর জীবন, আর যাই হোক, কখনো সুন্দর হবে না। দয়ার বিয়ে কখনো সুন্দর হতে পারে না।
হ্যা, মাহিয়ার সাথে নিহালের এই বিয়েটা দয়ার বিয়ে। নিহাল মাহিয়ার ওপর দয়া করে ওকে বিয়ে করছে। এক প্রকার বলা যায় মাহিয়াকে নতুন একটা জীবন দেওয়ার জন্য সাহায্য করছে ওকে নিহাল। আর এইটাই ওর প্রথম সাহায্য না মাহিয়ার প্রতি। এর চাইতেও আরও অনেক বড় সাহায্য করেছে নিহাল ওকে। মাহিয়ার জীবন বাচিয়েছিল ও। নিহাল সেই রাতে না থাকলে মাহিয়ার পৃথিবীটা আজ অন্যরকম হতো।
সেই রাতের চিন্তাটা মাথায় আসতেই কেপেঁ উঠলো মাহিয়া। অজান্তেই খামচে ধরলো শাড়ির আঁচল। চোখ টলমল করে উঠলো ওর। কিন্তু মা কিছু বোঝার আগেই নিজেকে সামলে নিল ও। এভাবেই সামলে আসছে মাহিয়া সবকিছু গত ছয় মাস ধরে। সেই রাতের ঘটনা মাহিয়ার পরিবারের কেউ জানে না। প্রথম দিকে সব জানিয়ে দিতে চেয়েছিলো মাহিয়া। ওর অবস্থা এমনিতেই এতো শোচনীয় ছিল যে বাবা মার বুঝতে একটুও সময় লাগতো না। কিন্তু তারা দুইজনই তখন একটা মেডিকাল কনফারেন্সে দেশের বাইরে থাকায় মাহিয়াকে দেখেননি। তখন তনু, মাহিয়ার সবচে কাছের বান্ধবী, আর নিহাল মিলে ওকে অনেক বুঝিয়ে, কাউন্সিলিং করে রাজি করিয়েছে কাউকে কিছু না বলার জন্য। মাহিয়ার ব্যাপারটা নিহাল ছাড়া তনুও জানতো। ঘটনার সময় সেখানে ও ছিলো। নিহাল, তনুর সাহায্যেই মাহিয়াকে বাসায় নিয়ে এসেছিল সেই রাতে।
-আচ্ছা ছন্দা, মাহিয়ার সাজ কি পুরা শেষ? ছেলে পক্ষ প্রায় চলে এসেছে। সাজ শেষ হলে মাহিয়াকে খাটেই সুন্দর করে বসিয়ে দিও, আম্মু। ওরা পৌছলেই আখ্তের রসম শুরু হয়ে যাবে।
মায়ের কথায় চিন্তার সুতা কাটলো মাহিয়ার। বর্তমানে ফিরে এলো ও। সময়টা প্রায় এসে গেছে। আর ফেরা যাবে না। ফিরে তাকানোর অবশ্য আর কিছু নেইও মাহিয়ার, শুধু যন্ত্রণা ছাড়া।
সাজ শেষের পর মাহিয়াকে নিয়ে যেয়ে খাটে বসালো ওর কাজিনরা। পাশে তনুও বসলো। এই বাড়ির মধ্যে মাহিয়ার মনের আসল অবস্থা যদি এখন কেউ জানে তাহলে সেটা তনু। তাই বাকিদের হাসাহাসিতে বেশী একটা যোগ দিতে পারলো না তনু। পাশে বসে শুধু মাহিয়ার হাতটা ধরে রাখলো ও। ইতিমধ্যে ভার্সিটির বাকি ফ্রেন্ডরাও চলে এসেছে মাহিয়ার বাসায়। মাহিয়া ওর ডিপার্টমেন্টের কিছু ক্লোজ বান্ধবী ছাড়া বেশী কাউকে বিয়ের ব্যাপারে বলেনি। ইচ্ছা হয়নি বলার।
নিহালের সাথে মাহিয়ার বিয়ে হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই ওর বান্ধবীদের মাঝে হয়েছে অনেক আলোচনা। সেটার রেশ ধরেই ওদের মুখে চলছে এখনো সেই একই আলাপ,
– মাহিয়া, তোর যে কি ভাগ্য তা চিন্তা করলেই লোভ লাগে রে।
-এই তানভি, লোভ লাগবে ক্যান? বল্ হিংসা হয়।
– ধুর!তোরা কর্ হিংসা। আমার তো লোভই লাগে। নিহালের সাথে বিয়ে। নিহালকে হাসবেন্ড হিসাবে পাওয়া। ওর ওপর পুরা হক্ জমানো। ওর সাথে সব ইটিশ পিটিশ কান্ড কারবার। ইশ! আমার তো চিন্তা করতেই কেমন কেমন লাগছে রে মাহিয়া।
সব বান্ধবীরা তানভীর কথা খিলখিল করে হেসে দিল। ছন্দা এবার বললো,
– এটা কিন্তু ভুল বলিস নাই তানভী তুই। নিহালের বিয়েতে আজ যে ভার্সিটির কতো মেয়ের মন ভাঙসে তার কোন হিসাব নাই। আফটার অল হি ইস দা হার্টথ্রব ওফ দা ভার্সিটি। বর্তমানে ভার্সিটির সবচাইতে সুদর্শন ছেলেদের মধ্যে একজন ধরা হয় ওকে। সেই হার্টথ্রব যে মাহিয়ার ভাগ্যে পড়বে তা আর কে জানতো। মাহিয়া তুই ড্যাম লাকি রে দোস্ত।
মাহিয়া মাথা নিচু করে চুপ মেরে ছিলো। তনু বঝতে পারছিলো এইসব কথা ওর ভালো লাগছে না, কিন্তু এই সময় বান্ধবীরা এগুলা কথা বলবে তাই স্বাভাবিক। আর কেউ ভুলও বলেনি। নিহালের মতন ছেলে পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার। বাকিরা শুধু ওর সুদর্শনতার আর পারসোনালিটির প্রশংসা করলেও তনু জানে মানুষ হিসাবে নিহাল কতো বড় মনের। মাহিয়ার সাথে যা হয়েছে , সেটাকে সম্পূর্ণ রুপে নিহাল একা হ্যান্ডেল করেছে। মাহিয়াকে কিভাবে প্রোটেক্ট করেছিল সব তনুর নিজ চোখে দেখা। এই কাজে ওর পাশে থেকে নিহালকে বুঝেছে তনু। বাকিদের কাছে নিহাল একটা হাই এন্ড এলিট হাঙ্ক হলেও তনুর কাছে ও একটা মাটির মানুষ।
হঠাৎ বাইরে হইচই পড়ে গেল। নিহালরা চলে এসেছে। মাহিয়াদের বাসায় ঢুকেছে ওরা। নিহালকে বর রুপে দেখতে সবাই চলে গেল একমাত্র তনু ছাড়া। কিছু মুহূর্ত একা পেল মাহিয়ার সাথে। ওর হাতটা আরেকটু জোড়ে চেপে ধরলো তনু,
– মাহি, যা হচ্ছে একদম বেস্ট হচ্ছে। তুই প্লিজ মনমরা হয়ে থাকিস না দোস্ত।
– খুশি হওয়ারও তো কারণ নেই তাই না তনু। এই বিয়ে আর দশটা বিয়ের মতোন স্বাভাবিক না। এইটা দয়ার বিয়ে যা নিহাল আমার ওপর করেছে। কিভাবে এই বোঝা নিয়ে আমি সারাজীবন থাকবো আমি জানি না রে।
-তুই এইটাকে অন্যভাবে দেখছিস মাহি। নিহাল মোটেও তোর ওপর কোনো দয়া করছে না। এখানে দয়া করার আছেই বা কি বল্? তোর কি কোনো কমতি আছে যে তোর ওপর কাউকে দয়া করতে হবে?
-কমতি নাই তনু? সেই রাতে আই ওআজ গোইঙ্গ টুবি রেইপ্ড।
-ওহ ফর গুডনেস সেক মাহি! ইউ ওয়ের গোইঙ্গ টু বাট ইউ ওয়ের নট রেইপ্ড। তোর সাথে কোনো উল্টাপাল্টা কিছু হয়নাই ।
-সেটাও নিহালের জন্যই তনু। ও না থাকলে আমি হয়তোবা আজ একজন রেইপ ভিক্টিম হতাম।
-আচ্ছা মাহি, এই ফালতু কথাগুলোর সময় এখন না। এগুলা নিয়ে আমি আর নিহাল হাজার বার তোর সাথে কথা বলসি। সো এখন নতুন করে বলার কিছু নাই। নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছিস তোরা। ডু ইট ইন আ নাইস ওয়ে। দেখি আমার দিকে তাকা। চোখে পানি ভরে গেসে তোর। ঠিক ভাবে না মুছলে মেকআপ নষ্ট হবে।
তনু মাহিয়ার চোখ মুছতে মুছতেই অনেক মহিলারা রুমে ঢুকে পড়লো। নিহালের পরিবারের কেউ কেউও ছিলেন এদের মাঝে। নিহালের মা এসে মাহিয়াকে জড়ায়ে ধরলেন।
– আমার আম্মুটা কেমন আছে?
-আস্সালামুআলাইকুম আন্টি। ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– ভাল আছি মা। তবে এখন তো আর আন্টি শুনতে পারবো না। মা শুনলে আরও ভালো লাগবে আমার।
হবু শাশুড়ির কথায় একটু হাসলো মাহিয়া। রোখসানা এসে মাহিয়ার আরেক পাশে বসলেন। কিছুক্ষণ পর কাজি সাহেব বিয়ে পড়াতে রুমে আসলেন। বিয়ে পড়ানোর সময় মাহিয়ার চেহারায় কোনো ভাবান্তর ছিল না। শক্ত হয়ে বসে ছিল ও। শুধু কবুল বলার সময় পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ থেকে ওর, আর কাপাঁ হাতের সই পড়লো কাবিন নামায়।
এর পর নিহালকে বিয়ে পড়াতে চলে গেলেন কাজি সাহেব। কিছুক্ষণ পর ওদিক থেকেও সই সম্পন্ন হলো। বিয়ে হয়ে গেল মাহিয়া আর নিহালের।
চলবে…..
রুপকথা গল্পের লিংক
পর্ব ১- ৭
https://kobitor.com/category/uponas/rupkotha/page/2/
পর্ব ৮- শেষ