#শারমিন আঁচল নিপা
নিয়ামত চাচার চিৎকার শুনে ভেতর থেকে সবাই হই হই করে বের হলো। আপার ননদ আনজুমান সবার প্রথম বের হলো। আনজুমানও বেশ নেতিয়ে গেছে। বুড়ি হয়ে গেছে বুঝা যাচ্ছে। তার সাথেই একটা ছোটো বাচ্চা মেয়ে দাঁড়ানো। মেয়েটির বয়স সাত বছরের মতো হবে। হয়তো এটা আনজুমানের সন্তান। আনজুমানের সাথে তার জামাই বের হয়েছে। আপার শ্বাশুড়ি বের হয়েছে পরপরই। আপার শ্বাশুড়ি বেশ বৃদ্ধ হয়ে গেছে। এতটুকু রাস্তা আসতে তার ভীষণ সময় লেগেছে। আগের মতো শক্তি হয়তো তার শরীরে নেই। একটা সময় সবাইকেই এ অবস্থানে যেতে হয়। কিন্তু জোয়ান অবস্থায় এটা সবাই ভুলে যায়। আপার কষ্টের মূল কাহিনি রচনা করেছিল এ মহিলা। সব বৃদ্ধ দেখলে সম্মান আসে না মন থেকে। কিছু কিছু বৃদ্ধ দেখলে বমিও আসে, ঘৃনাও আসে। তার মধ্যে একজন হলো আপার শ্বাশুড়ি। দীপক ভাইয়াও এসেছে সাথে একটি মেয়ে নিয়ে। কম বয়সী মেয়ে। বুঝতে পারছি না এটা কে? দুলাভাই যাকে বিয়ে করেছিল সেটা অন্য মেয়ে ছিল। এ মেয়ে কে এটাই জানার বিষয় এখন। সবাই এসে প্রথমে নিয়ামত চাচার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল
“কী হয়েছে এভাবে চেঁচিয়ে উঠলি কেন? ভর সন্ধ্যায় এভাবে চিৎকার করার মানে কী?”
নিয়ামত চাচা ঢুক গিলে আনহারির দিকে ইশারা করল। এবার সবাই আনহারি দেখে চমকে গেল। আনজুমানের স্বামী সেখানেই ফিট হয়ে পড়ে গেল। শ্বাশুড়ি স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। দীপক হা করে তাকিয়ে থেকে আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করল
“অনন্যা তুমি বেঁচে আছো?”
আনহারি হেসে জবাব দিল
“আপনাকে সারপ্রাইজ দিব বলেই বেঁচে আছি। বাইরে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছি। আমি আবার কবে মরলাম?”
“তাহলে জাম গাছে কে গলায় দড়ি দিয়েছিল?”
আনহারির হেয়ালি উত্তর
“সেটা আমি কীভাবে জানব? কে না কে গলায় দড়ি দিয়েছে এ বিষয় নিয়ে আমি তো স্টাডি করিনি। আমি উপস্থিত ও ছিলাম না। জলজ্যান্ত একটা মানুষকে জিজ্ঞেস করছেন বেঁচে আছি কিনা? আসতাম না আপনাদের এখানে। তবে ডিভোর্স যেহেতু হয়নি সেহেতু নিজের প্রাপ্য অধিকার তো আদায় করতে হবেই। নাহয় আপনাদের মতো মানুষদের উপর আমি থুতু মারতাম। যাইহোক অনেক দূর থেকে এসেছি আমি এখন ক্লান্ত। যা কথা বলব রাত দশটার পর। কে জাম গাছে মরে/ ছিল খুঁজে বের করেন। আর সব থেকে বড়ো কথা আমার পরিবারের সাথে এত বড়ো অন্যায় করা হয়েছে এটার জবাবদিহি তো পুরো গ্রাম বাসীকে দিতে হবে। আর কাকে জাম গাছে ঝুলিয়ে হ/ত্যা করেছেন সেটার উত্তর আপনারা পুলিশকে দিবেন। আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে আসব। আমার সাথে যদি আগের মতো একটা অন্যায় করার চেষ্টা করেছেন, আমি একদম ভেঙে গুড়িয়ে দিব। সামনে থেকে সরেন ঘরে যাব।”
কম বয়সী মেয়েটা কথাগুলো শুনে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল
“আপনার বউ মারা গেছে বলেছিলেন। তার নাম তৃনা ছিল। তাহলে এ অনন্যা কী করে আপনার বউ হয়? আমি গরীব ঘরের মেয়ে বলে বাবা, মা বিয়ে দিয়েছে। আর এত বড়ো অন্যায় আমার সাথে করলেন? কত অপমান কষ্ট সহ্য করি আর আমাকে এভাবে ঠকালেন?”
মেয়েটির কথা শুনে দুলাভাই মেয়েটির চুলের মুঠি ধরে বলতে লাগল
“আরে মা/গি চুপ কর। তোর মা/গিগিরি পরে করলেও হবে। এ মেয়ে তো মারা গেছে। বিয়ে তো আমি অনেক গুলো করেছি। তোকে বলেছি একটার কথা। বেশি ইতরামি করলে তোকেই আমি জাম গাছে ঝু/লিয়ে দিব।”
আরও কিছু বলতে নিবে এমন সময় আনহারি দুলাভাইয়ে হাতটা চেপে ধরে ডান দিক থেকে বা দিকে ঘুরিয়ে দিল। হাতটা মটমট করে একটা শব্দ হলো। মনে হচ্ছে হাতটার হাড় ভেঙে গেছে। তারপর জোর গলায় বলল
“কাপুরুষ কোথাকার। মেয়েদের গায়ে হাত তুলে নায়ক সাজতে চাস? কুলাঙ্গার কোথাকার। নারী নির্যাতনের মামলা ঠুকে দিব। আর একবার যদি কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলতে দেখি হাত ভেঙে দিব। এক বউ থাকতে আরেকটা বিয়ে করার সময় মাথা ঠিক ছিল না? আর তোর বউ সব মারা যায় কেন? এর আগেও আরো দুটো বিয়ে করেছিস আমাকে রেখে। সব জবাব কীভাবে দিবি সেটা রেডি কর। একে তাকে মেরে কালপুরুষ না হয়ে।”
দীপক চুপসে গেল আনহারির কথা শুনে। আনহারির শ্বাশুড়ি শরীরের শক্তি কমে গেলেও গলার জোর কমেনি। সে জোর গলায় বলে উঠল
“তুই বাঁইচা থাকস মন চায় মইরা উইঠা আইছস সেটা দেখার বিষয় না। তোরে তো আমার পুতে তালাক দিছে। তাইলে এ বাড়িতে তোর কোনো জায়গা কেমনে হইব?’
বুড়ি যেন ঠিক জায়গায় পয়েন্ট টা ধরেছে। সকল প্ল্যান কী তাহলে ভেস্তে যাবে? এটাই ভাবতে লাগলাম আমি। আপার ছাড়াছাড়ি গ্রাম বাসীর সামনে হয়। তাহলে তো তালাককৃত বউয়ের কোনো অধিকার থাকে না। তবে আনহারি তার বুদ্ধি দিয়ে উত্তর দিল
“আমাকে ছেড়েছে তার কোনো ডকুমেন্টস আছে? আমার কাছে তো আমার বিয়ের ডকুমেন্টস আছে। ডিভোর্স দিলে তো ডকুমেন্টস লাগে। সেটা কোথায়? আর ডিভোর্স বললাম, দিয়ে দিলাম আর হয়ে গেল? আমাকে বারো বছর গুম করে রাখার অভিযোগ আসবে আপনাদের উপর। আমার সাথে যেদিকেই বাড়বেন সেদিকেই পথ থুবরে পড়বেন। সব কিছু নিয়েই যুদ্ধে নেমেছি। যা করার করেন। আপাতত আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।”
এরপর আনজুমানের কাছে যেতেই সে ভয়ে কাঁপতে লাগল। আনহারি তার কাঁপুনি দেখে বলল
“ভয় তো আমার পাওয়ার কথা আপনি পাচ্ছেন যে? যাইহোক পুরনো হিসাব নিকাশ নাহয় পরেই করব। আপাতত নিজের স্বামীর জ্ঞান ফেরানোর ব্যবস্থা করেন আপা।”
এরপর আনহারি আমাকে ডেকে বলল
“ফিয়না আমার সাথে আসো। অনেকক্ষণ জার্নি করে এসেছি আমার মাথাটা বেশ ধরেছে।”
আমি আনহারির সাথে সাথে গেলাম। এখানের কেউ আমাকে চিনেছে বলে মনে হয় না। নিজের পরিচয়টা পরেও দেওয়া যাবে । আপাতত কাহিনি পর্যবেক্ষণ করতে থাকি।
আনজুমানের হাসবেন্ড কে দীপক আর নিয়ামত চাচা ধরে ভেতরে নিল। জ্ঞান ফেরানোর জন্য পানির ঝাপটা দিল। দীপকের বর্তমান স্ত্রীর নাম পিয়ালি। পিয়ালি সোফায় বসে কাঁদছে। আমি যতদূর বুঝতে পারলাম কয়েকদিন পর পর বউ পাল্টানো দীপকের একটা স্বভাব। আর পরিবারও এটাকে বেশ সাপোর্ট করে বুঝা যাচ্ছে। বারোটা বছর কেটে গেল। গ্রামের কত কিছু পাল্টালো তবে পাল্টালো না কেবল এ পরিবারের ব্যবহার। আপার নানী শ্বাশুড়িকে চোখে পড়ল না। হয়তো গত হয়েছেন।
আনহারি আর আমি দীপকের রুমেই প্রবেশ করেছি। আনহারি দীপকের রুমের বিছানাতে শুয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সে। আমি কেবল ভাবতে লাগলাম এরপর কী হতে চলেছে। এটা কী ইতিবাচক দিকে যাবে নাকি নেতিবাচক দিকে? সে সাথে খুঁজতে লাগলাম সে লোকটিকে যে এ সময় আপার পেইন্টিং করা ছবিটা আমাকে পাঠিয়েছে। সে কী এ গ্রামেই আছে এখনও?
কতশত চিন্তা আমার মনে বাসা বাঁধছে। সে সাথে ভয় তো আছে। আর কিছু প্রশ্নের বেড়াজালেও আটকে যাচ্ছি। সব মিলে কেমন অশান্তি কাজ করছে আমার মনে। তবে আনহারিকে দেখে একদম তা লাগছে না। বেশ রিলাক্স হয়েই সে শুয়ে আছে। কপাল কুচকে চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। আপাও ঠিক এভাবে শুয়ে থাকত। আনহারির সাথে বড়ো আপার কত মিল। অথচ দুজনের জন্ম দুদেশে। দুজনের জন্মদিনেও ১৭ দিনের মতো ব্যবধান। এ দুজন জমজ হওয়া অকল্পনীয়। মাঝে মাঝে মনে হয় আনহারির ভেতরে আপার আত্মা ভর করছে। তবে সেটাও নিমিষে ভুল প্রমাণ হয় বিজ্ঞান এর দিক চিন্তা করলে।
সব মিলে এ বিষয় গুলো নিয়ে আমি যতই ভাবি ততই আমার ভেতরটায় একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে হাজার প্রশ্ন ঝেঁকে বসে।
আধা ঘন্টার মতো কেটে গেল। বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে লাগলাম। আমি কিছুটা অস্থির হয়ে বের হলাম। সাথে সাথে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠল। তাহলে কী আমরা হেরে যেতে চলেছি?
কপি করা নিষেধ।