#শারমিন আঁচল নিপা
কিন্তু অফিসার মাহিদ বলে উঠলেন
” এ কাবিন নামা সত্য। আর উনিই অনন্যা। দুজনের হাতের ছাপ মিলে গেছে। দীপক সাহেব অনন্যা মরেনি। সে বেঁচে আছে। আর এটাই আসল কাবিননামা। সে সময় আপনারা কোন মেয়েকে অনন্যা বলে চালিয়ে দিয়েছিলেন এটা আমার জানা চাই। আমি অবশ্যই পুরনো ফাইল খুলব।”
আনজুমান, অফিসার মাহিদের কথা শুনে হা করে আছে। আনহারি আনজুমানকে বলে উঠল
“হা করে থাকিয়েন না, মশা ঢুকে পড়বে।”
আনজুমান তার ঠোঁট দুটো গুটিয়ে নিল। আনজুমানের স্বামী এখনও রান্না ঘরে । ভয়ে সে এদিকে আর আসছে না। আনজুমানের মতো আমার ভেতরটাও কেঁপে উঠল। তার মানে আনহারিই অনন্যা। আমি কী বলব কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। অফিসার মাহিদ দীপক ভাইয়াকে আবার বলল
“যেহেতু প্রমাণ হয়েই গিয়েছে এই মেয়ে অনন্যা। সেহেতু এ বাড়িতে সম্মান মতো থাকার অধিকার তার আছে। আর আপনারা তালাক দেওয়ার ডকুমেন্টস যেহেতু দেখাতে পারছেন না সেহেতু আইন অনুযায়ী এখনও আমরা ধরে নিব আপনাদের তালাক হয়নি। এ বিষয় নিয়ে পরবর্তীতে কোনো পদক্ষেপ নিলে সরাসরি আমার কাছে যাবেন। আর অনন্যার যদি এখানে থাকা অবস্থায় কিছু হয় তাহলে সেটার জন্য কঠোর জবাবদিহি আপনাদের করতে হবে। আজ আমি উঠলাম পরে আবার দেখা হবে।”
অফিসার মাহিদ চলে গেলেন। যাওয়ার সময়টায় আমার ভীষণ মন খারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল জোড়বদ্ধ কোনো জিনিসকে আলাদা করা হচ্ছে। যাদের আলাদা করাতে এক পক্ষ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, আরেকপক্ষ মুক্তি পাওয়ার নেশায় খুশি হচ্ছে।
অফিসার মাহিদ চলে যাওয়ার পর আনহারি রুমে প্রবেশ করল৷ আমি এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিই কী এটা অনন্যা? যদি অনন্যা হয় তাহলে আনহারির হাতের ছাপের সাথে কীভাবে ম্যাচ হলো? আর যদি আনহারি হয় তাহলে অনন্যার হাতের ছাপের সাথে কীভাবে ম্যাচ হলো? দুটো আলাদা মানুষ, আলাদা জায়গায় জন্ম। তাদের সবকিছু তো এভাবে মিলে যাওয়ার কথা না। আমার তাকিয়ে থাকা দেখে আনহারি বলে উঠল
” আমার সাথে অনন্যার ফিংগার প্রিন্ট কীভাবে ম্যাচ হয়েছে সেটাই ভাবছো তো? আমি অনন্যা কি’না আবার মনে প্রশ্ন ঝেঁকে ধরেছে তো?”
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উত্তর দিলাম
“প্রশ্ন তো অনেক কিছুই আছে। সব প্রশ্নের উত্তর তো মিলছে না। আচ্ছা সত্যি করে বলেন তো আপনি সত্যিই অনন্যা নাকি আনহারি?”
“আমি আনহারি। অনন্যাকে আমি চিনতাম না। অনন্যা সম্পর্কে জেনেছিলাম লন্ডনে একজন ছেলের মুখে। আমার বাসায় আমার একটা পেইন্ট করা ছবি দেখলে না? অথবা তুমি যে আমাকে পেইন্ট করা ছবি দেখিয়েছিলে তোমার বোনের মনে আছে?”
“হ্যা আছে তো। একই পেইন্টের ছবিটা আপনার বাসায় দেখে আমি চমকে গিয়েছিলাম। সে ছবিটার কাহিনি তো আপনাকে আমি বলেছিই। কিন্তু কোনোভাবেই আমি রহস্যের গোলক ধাঁধা থেকে বের হতে পারছি না। আমাকে একটু বলুন আপনি কে? বারো বছর আগে কে মারা গেছে, আবার দুই বছর আগে কে মারা গেছে? সব মিলে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মনে হচ্ছে হরর ফিল্মের রহস্যের গোলকে আমি আটকে গেছি। কেউ কাট ও বলছে না আর আমি এ রহস্য থেকে বেরও হতে পারছি না।”
“রিলাক্স হও। ঐটা অনন্যার ছবি। আমি এ ছবিটা দেখেছিলাম লন্ডনের একটা ছবি প্রদর্শনীতে। সেখানে অনেক ধরণের ছবি প্রদর্শন করা হচ্ছিল। আর চড়া দামে সেগুলো চায়লে কেউ কিনতে পারত। এ ছবিটা সেখানের বেস্ট ছবি হিসেবে ঘোষিত হয়। আমি সে জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলাম। নিজের ছবি ঐ জায়গায় দেখে আমি হতভম্ব হয়ে পড়ি। এটা কী করে সম্ভব তাই ভাবছিলাম। একদিকে ভালো লাগছিল অপর দিকে রাগও লাগছিল। কারণ পারমিশন ছাড়া আমার ছবি প্রদর্শন করায়। আমি সেখানে ক্লেইম করি বিষয়টি। সাথে সাথে ছবির আর্টিস্টকে আনা হয়৷ উনার নাম বিভোর। দেখতে আট দশটা সাধারণ ছেলের মতো। খুব একটা লম্বা নয়। আবার আহামরি সুন্দর নয়। তবে সুদর্শন। জানো তো সুন্দর আর সুদর্শনের মধ্যে বেশ তফাৎ আছে। ছেলেটি দেখতে বেশ মানানসই ছিল।
উনি আসার পর আমাকে দেখে চমকে যান। আমি উনাকে দেখা মাত্রই সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম
” আমার পারমিশন ছাড়া আমার ছবি কেন প্রদর্শন করেছেন? আমার পারমিশন ছাড়া আমার ছবি অঙ্কন করাও তো আপনার অপরাধ।”
তখন সে জানায় সে অনন্যা নামের একটি মেয়ের ছবি একেঁছে। ছবিটি তার বাল্যকালের এক বন্ধুর। সে তাকে ভীষণ পছন্দ করত। সে ভালোবাসার ব্যকুলতার জন্যই এ ছবিটি সে এঁকেছে। সে তার ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই ছবিটা এখানে এনেছে।
বিষয়টি একদম আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তখন সে তাদের স্কুলের কিছু ছবি দেখায় আর সেটাতে অনন্যাও উপস্থিত ছিল। সে সময় মাকে কল দিয়ে বিষয়টি জানালে মা জানায় আমার কোনো জমজ বোন নেই। আমি দেশের বাইরে জন্ম নিই। কারণ আমার মায়ের অবস্থা বেশ জটিল ছিল। তাই চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে রাখা হয়। তখন এটাই ভেবে নিয়েছিলাম একরকম দেখতে সাতজন মানুষ হয় এখানে তো মাত্র একজন পেলাম। আরও পাঁচজন বাকি৷ সেখান থেকে অনন্যার গ্রামের বাড়ির নাম জানি৷ আর সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না আমি কীভাবে গ্রামের নাম জানলাম? সেখান থেকেই জেনেছিলাম তবে তোমাকে বলা হয়নি৷ প্রথমে তোমাকে বিষয়টি বলিনি কারণ অনেক কিছুই জড়িয়ে ছিল এখানে। আমি আগে সত্যতা বুঝতে চেয়েছিলাম। আজকে তোমার পেরেশানি দেখে বললাম। আমার খুব ইচ্ছা ছিল অনন্যার সাথে দেখা করব৷ তবে যখন দেশে আসলাম তখন অনন্যা মারা গেছে৷ এরপর থেকে আমার দেশের বাইরেই বেশিরভাগ সময় কেটেছে।
এরমধ্যে দেশে আসি। আসার পর আমার এক্সিডেন্ট হয়। এক্সিডেন্ট হওয়ার পর আবার দেশের বাইরে যাই। এবং দেশের বাইরে থেকে ফিরে এসে জানতে পারি নিজের বাবায় আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। জীবন অনেক কিছু শেখায় ফিয়না৷
রহস্যকে উপভোগ করতে শেখো। এই যে আনহারি নাকি অনন্যার যে রহস্যটা তোমার মনে ঝেঁকে বসেছিল সেটা তো এখন দূর হলো? আস্তে আস্তে সকল রহস্যের পর্দা ফাঁস হবে।
তবুও কিছু ধোঁয়াশা আমাকে ধরে বসলো। তাহলে দুই বছর আগে কে মারা গেল? আর চাচার দোকানে ৫ বছর আগে কে গিয়েছিল? অনন্যা আনহারির বাইরেও কী কোনো সত্ত্বা আছে যেটা আমার চোখ আড়াল করে যাচ্ছে। আমি আবারও বলে উঠলাম
“আপার সাথে আপনার এত মিল কীভাবে? আর অনন্যার ফিংগার প্রিন্টের সাথেই বা ম্যাচ হলো কী করে? আর ঐ ছেলেটি কে ছিল? তার এ নাম ছাড়া কী আরও নাম ছিল। তার কী কোনো ছবি আছে?”
আনহারি হালকা দম নিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
“খেলার ময়দানে সব গোপন ফাঁস করতে নেই ফিয়না। দেয়ালেরও কান আছে। খেলা শেষ হলে নাহয় জানিয়ে দিব ফিংগার প্রিন্ট কীভাবে ম্যাচ হলো। আর ঐ ছেলেটির নাম আমার জানা নেই। আমি কেবল ঐ সময় ঐ ছবিটি অনেক দাম দিয়ে সেখান থেকে কিনেছিলাম। এরপর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি৷ হয়তো সে এই যোগাযোগের পথটা বন্ধ করে দিয়েছে। যাইহোক প্রসঙ্গ পাল্টাই এবার। আমি যাই, দেখে আসি আনজুমানের হাসবেন্ড কেমন পায়েস বানিয়েছে।”
কথাটা বলে আনহারি রুম থেকে বাইরে গেল। আনজুমানের মেয়ে তখন বের হলো। আনজুমানের মেয়ে একটা কাগজ নিয়ে খেলছিল। ময়েটির নাম তরী। হঠাৎ করে আনহারির চোখ পড়ে সে কাগজের দিকে। আনহারী কাগজটা তরীর হাত থেকে নেয়। তরী বেশ শান্ত বাচ্চা হওয়ায় কাগজ না ফিরিয়ে দেওয়ার জেদ ধরেনি। আনহারি কাগজটা হাতে নিল। আমি রহস্যের গন্ধ পেয়ে আনহারির কাছে আসি। আনহারি কাগজটা হাতে নিয়ে লক্ষ্য করল এটা একটা রিপোর্ট। রিপোর্টটা দীপকের। আর দীপক কেনোদিন বাবা হতে পারবে না এটা তারেই রিপোর্ট।
রিপোর্ট টা দেখার পর আমার ভেতরটায় এত জোরে অজানা একটা আঘাত হানা দিল যেটা সইতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছ। দীপক যদি কখনও বাবা হতে না পারে তাহলে বড়ো আপার পেটে কার সন্তান ছিল? এটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে এ আনহারি অনন্যা নয়। তাহলে যে মারা গেছে সে অনন্যা। তাহলে অনন্যা কী করে প্রেগনেন্ট ছিল?
কপি করা নিষেধ
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার