এমন সময় আমজাদ সাহেবের মোবাইলটা বেজে উঠল। উনি বারবার কল কাটছেন। তবুও কলটা যেন বেজেই চলেছে। যতবার উনি কল কাটছেন ততবারেই অপরপক্ষ পুনরায় কল দিচ্ছেন। এবার বেশ বিরক্ত হয়েই মোবাইলটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে এগুলেন। করিডোরের এক পাশে আসলেন। আমি কেন জানি না উনার পিছু পিছু গেলাম। আমাকে উনি চেনেন না। তাই হয়তো আমার উপস্থিতি তিনি বেশি পাত্তা দিলেন না। কলটা ধরেই বলে উঠলেন
“মালিহা ডোন্ট কল মি নাউ। আমি এখন খুব ঝামেলায় আছি। ভেবেছিলাম খুব দ্রূত সবকিছুর মালিক হব কিন্তু এখন সবকিছুই ভেস্তে যাচ্ছে। আনহারি বেঁচে আছে। আমি আর তুমি মিলে তাকে হত্যা করেছিলাম। কীভাবে ও বেঁচে রইল। মৃত মানুষ কীভাবে বেঁচে উঠে? রতন আমাদের সাহায্য করেছিল। সে তো আনহারিকে দেখে কোমায় চলে গেছে হয়তো। ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে তার।”
কথোপকথনে যতদূর বুঝলাম মালিহা আমজাদ সাহেবের প্রেমিকা। আর সেই নিজের হাতে তার সন্তানকে খু/ন করেছিল। একটা বাবা এটা কীভাবে পারে। তাহলে বড়ো আপার খু/নের সাথেও কী আমার বাবা জড়িত? সবমিলিয়ে আমি যেন পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমি আরও ভালো করে তার কথোপকথনে মন দিলাম। কথোপকথনের স্রোত দেখে বুঝতে পারলাম অপর পক্ষ বলছে
“এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আনহারির মৃত্যুর পর আমরায় তাকে মর্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। মর্গের লোককে টাকা খাইয়ে রিপোর্টে রোড এক্সিডেন্ট লিখতে বলেছিলাম। এমন না তার মুখ থেতলে গিয়েছিল। তার মুখ অবয়ব একদম স্পষ্ট ছিল। ময়না তদন্তে নিজ চোখে তাকে নিতে দেখেছি। আনহারি বেঁচে থাকবে এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নিশ্চয় মেয়েটা ফেইক। ভালো করে খোঁজ লাগাও। ডি এন এ টেস্ট করাও। কোনোভাবেই আনহারি বাঁচবে না। এটা কখনই সম্ভব না।”
আমজাদ সাহেবের অস্থিরতা বাড়ছে সেটা তার মুখের প্রতিচ্ছবি দেখেই মনে হচ্ছে। ফর্সা মানুষটা একদম ঘেমে একাকার। নীল হয়ে গেছে তার মুখ। বড়োলোকের চরিত্র হয়তো এমনই হয়। তিনি নির্দ্বিধায় একটি মেয়ের জন্য নিজের মেয়েকে খুন করেছিল। কিন্তু এখানেও প্রশ্ন তাহলে এ মেয়েটি কে? এসব ভাবতে ভাবতেই তিনি কল কেটে দিলেন। আমি এ পাশ থেকে সরে দাঁড়ালাম। হয়তো খুব শীঘ্রই বিষয়টা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আমজাদ সাহেব আনহারির সামনে আসতেই আনহারি বলে উঠল
“পাপা তুমি কোথায় গিয়েছিলে? রতন এমন কেন বলল আমাকে?”
আমজাদ সাহেব রেগে গেলেন। আনাহরির মুখের উপর বলে উঠলেন
“তুমি আমার মেয়ে নও। আমার মেয়ে মারা গেছে। কে পাঠিয়েছে আমার মেয়ে সাজিয়ে বলো? মনে হচ্ছে এত এত টাকার লোভে কেউ তোমাকে সার্জারি করে পাঠিয়েছে।”
এ কথা শুনে আনহারির মা তীব্র গলায় বলে উঠল
“আমার বিশ্বাস ছিল আমার মেয়ে বেঁচে আছে। এবং বলেছিও আমার মেয়ে বেঁচে আছে একদিন তোমাকে এসে সারপ্রাইজ দিবে। দেখো আমার মেয়ে ঠিকই ফিরে এসেছে। এরকম কথা আর বলবে না। এটাই আমাদের আনহারি। মা কখনও মেয়েকে চিনতে ভুল করবে না।”
“লাবু তুমি আবেগে সব গুলিয়ে ফেলছো। আমাদের মেয়ে মারা গেছে। নিজ হাতে তাকে কুরবানী করেছি।”
আনহারির মা আমজাদ সাহেবের এ কথা শুনে সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলেন
“কুরবানী করেছো মানে?”
আমজাদ সাহেবের মুখ ফসকে সত্যিটা বের হয়ে গেলেও তিনি কথার স্রোত পাল্টিয়ে বললেন
“কুরবানী কবর কেন? কবর দিয়েছি। আমি আমার মেয়েকে নিজ হাতে কবর দিয়েছি। এটা আমাদের মেয়ে না।”
আনহারি কপাল কুচকে জবাব দিল
“বাবা আমি মরিনি। সেদিন এক্সিডেন্টের পর আমাকে মা বিদেশে ট্রিটমেন্ট করতে নিয়ে গিয়েছিল। আমি সুস্থ হয়ে সেখানেই থেকে যাই। আমার এক্সিডেন্টের পর পর মা সিঙ্গাপুর ছিল না একমাস? তুমি কী ভুলে গেছো সব?”
আমজাদ সাহেব আমতা আমতা করে জবাব দিলেন
“হ্যা ছিল তবে সেটা লাবুর ট্রিটমেন্টের জন্য।”
লাবু এর পুরো নাম হচ্ছে লাবনী জোহা। আনহারির মায়ের নাম লাবনী জোহা । লাবনী জোহা আমজাদ সাহেবকে থামিয়ে বললেন
“এটা একটা সারপ্রাইজ। আমার মেয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে বলেই আমাকে নিষেধ করেছিল ওর ব্যাপারে যেন না বলি৷ এখন সে পড়াশোনা শেষ করে সারপ্রাইজ দিতে এসেছে। এখানে আর কোনো কথা থাকতে পারে না আমজাদ। এটাই আমাদের মেয়ে। “
আনহারি এবার আবেগী গলায় বলে উঠল
“মা.. বাবা তো আমাকে একদম মানতেই পারছে না। আমি মরে গেলেই হয়তো বাবা খুশি হত। রতনেরও আমার জন্য এ হাল। একদম ভালো লাগছে না আমার।”
লাবনী জোহা একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন
“এখানের সবাই জানে তুমি মারা গেছো। অনেকবার বলেছি তারা তো আমাকে মানসিক রোগী বানিয়ে দিত। তুমি চায়তে একেরবারে দেশে এসে কথা বলবে তাই কাউকে যেন তোমার নম্বর বা কিছু না দিই৷ সেজন্য প্রমাণও করতে পারিনি। তোমার বাবার কথায় কিছু মনে করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে আস্তে আস্তে। রতন শকে চলে গেছে এর বাইরে কিছু নয়।”
তারপর লাবনী জোহা আমজাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন
“তুমি চাচ্ছ তার ডি এন এ টেস্ট হোক। তবে সেটাই হবে। কাল আনহারির ডি এন এ টেস্ট করাব। সে আমাদের মেয়েই এটা যদি প্রমাণ হয় তখন তো মানতে অসুবিধা নেই?”
আমজাদ সাহেব স্বাভাবিক এবং পরিপক্ক গলায় উত্তর দিলেন
“আলবাদ ফেইক প্রমাণ হবে। মৃত মানুষ কখনও ফিরে আসতে পারে না। এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
“আচ্ছা এখন আমরা রতনের বিষয় নিয়েই আলোচনা করি। আনহারির বিষয়টা কাল বুঝবো। আমি রাতে ডাক্তারের সাথে কথা বলে রাখব৷ অবশ্যই বিষয়টি গোপন রাখবে। কারণ মান সম্মান জড়িয়ে আছে এতে।”
আমি এসব কথার মধ্যে একদম চুপ রইলাম। একটু আগের শুনা সব কথায় আমি বুকে চেপে রাখলাম। কারণ এখন এসব বলতে গেলে কেউ বিশ্বাস নাও করতে পারে। আর আমজাদ সাহেবও পল্টি নিতে পারে। বুদ্ধিমানের কাজ হলো চুপ হয়ে থাকা।
এদিকে রতনকে হাসপাতালের আই সি ইউ তে রাখা হলো। সন্ধ্যা নেমে আসলো। অনেকক্ষণ বাসার বাইরে। মা কল দিল। কল দিয়েই বলতে লাগল এত দেরি কেন করছি। আমি মাকে কোনোরকম একটা বুঝ দিলাম। তারপর আনহারি আর লাবনী জোহার কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। বিদায় নিয়ে আসার সময় আনহারি আমার হাতটা চেপে ধরে বলল
“নম্বরটা দিয়ে যাও তুমি। কাল অবশ্যই দেখা করবে। তারপর বাকি কথা হবে। তোমার বোন অনন্যার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটা কাহিনি আমাকে বলবে।”
আনহারির মুখ থেকে অনন্যা নাম শুনে আমি চমকে গেলাম। একটা বারের জন্যও আমি তাদের বড়ো আপার নাম বলিনি তাহলে সে কী করে নাম জানল? আমি আর কিছুই ভাবতে পারছি না। ভেতরে ভেতরে একটা ভয় জাগতে লাগল। ভয়টা কেন হচ্ছে জানি না। আমি কী কোনো গোলক ধাঁধায় ফেসে যাচ্ছি না তো? আমি কাঁপা গলায় বললাম
“আপনি আমার আপার নাম জানলেন কীভাবে?”
জোর দিয়ে তিনি উত্তর দিলেন
“কথায় কথায় তুমিই বলেছিলে।”
আমি আর কিছু বললাম না। বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলাম। বাসায় আসার পর থেকে আমার কেবল এটাই মনে হচ্ছে এই আনহারিই অনন্যা। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় মারা গেল কে? মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম এ বাড়িতে যে করেই হোক আমি ঢুকে থাকব। এমন সময় মা এসে রেগে গিয়ে বললেন
“কই ছিলি সারাদিন? দুইটা টিউশন থেকে কল দিয়েছে তুই সেখানে যাস নি। ছিলি কোথায় তুই? তুই ও যদি বড়োটার পথ ধরিস, বলার কিছু নাই। এক মেয়ে মুখ পুড়লো। আর সেজন্য গ্রামে থাকতে পারলাম না। আর তুই যদি মুখ পুড়াস শহরেও থাকতে পারব না।”
মায়ের কথায় কিছুটা রাগ চড়লেও। আমি সেটা দমিয়ে নিয়ে মৃদু গলায় বললাম
“মা আমি একটা চাকুরি পেয়েছি। আমি কাল থেকে সেখানেই থাকব। টিউশন আর করতে হবে না। ঐখানে থাকা খাওয়া ফ্রি আর কিছু টাকাও পাব। পড়াশোনাটাও আরেকটু ভালো করে করতে পারব। তুমি না করো না প্লিজ।”
আমি জানি মায়ের না করার সাধ্য নেই। কারণ অভাবের সংসারে আমার গতি হয়েছে এতেই তিনি খুশি। মা সহজে রাজি হয়ে গেলে।
ভাবনার সাগরে ডুবতে ডুবতে কখন যে ঘুমের সাগরে ডুবে গেলাম খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে লক্ষ্য করলাম ১১ টা বেজে গেছে। আমি তাড়াহুড়ো করে উঠলাম। মাকে অনেক পটিয়ে জবের নাম করে আনহারির ভবনের দিকে রওনা দিলাম। সে বাসায় যাওয়ার একটায় লক্ষ্য, রহস্য উদঘাটন করা।
এবার কেউ আমাকে ভবনে ঢুকতে আটকায় নি। খুব সহজে ভবনে ঢুকে গিয়েছি আমি। তবে ঢুকার সাথে সাথে একটা বিষয় আমার পরিষ্কার হয়ে গেছে। যেটা নিয়ে আমি দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলাম সেটা কেটে গেছে। সে সাথে আনহারির এবং আনহারির বাবার সকল প্রশ্নের উত্তর মিলে গেছে। কারণ এ আনহারিই হলো, কী মনে হচ্ছে? এ আনহারি কী অনন্যা নাকি সত্যিই আনহারি?
বিঃদ্রঃ আমার নতুন বই “তবুও ভালোবাসি তোমায়” কিন্তু প্রকাশ পেয়েছে। আপনারা যদি বই টি নিতে চান তাহলে অর্ডার করতে Habib Shikder কে ইনবক্স করুন।