#শারমিন আঁচল নিপা
নিজের চোখকেও যেন আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। লাবনী জোহা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। আনহারি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। অতি শোকে সে হয়তো পাথর হয়ে গেছে। বাসায় পুলিশ ডাকা হলো। মদিনা কোনো কথায় বলছে না। কী হচ্ছে, না হচ্ছে এটা নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। কে মরল, কে বাঁচল তাতে তার কী আসে যায়। তার চাকুরি থাকলেই হয়তো সে খুশি। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে বড়োলোকদের ব্যপার স্যাপারে সে একদম নেই।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ আসলো। আমজাদ সাহেবকে ফ্যান থেকে নামানো হলো। আমজাদ সাহেবের শরীরটা দেখে কেন জানি না মনে হচ্ছে এটা খুন, আত্মহত্যা নয়। আচ্ছা আনহারি কী কোনোভাবে আমজাদ সাহেবের সবকিছু জানতো। আর সেজন্যই কী তাকে খুন করে দিয়েছে। নাহ! এটা আমি কী ভাবছি। আনহারি জানলে তো খুন করার প্রয়োজন ছিল না। আইনের মাধ্যমেই সবটা করতে পারত। ভাবনা যেন আমার পিছু ছাড়ছে না।
আমজাদ সাহেবের লাশটা ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো হলো। পুলিশ ভালো করে ঘরটা চেক দিল। ঘরে একটা চিঠি পেল। সেটাতে আমজাদ সাহেব নিজের হাতে লিখেছেন,,
“আমি মালিহাকে ভীষণ ভালোবাসি। মালিহার জন্য আমি নিজের মেয়ে আনহারিকে খুন করার এটেম্পড নিয়েছিলাম। আমার মেয়ের দুই বছর আগের এক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী। ভেবেছিলাম আমার মেয়ে মারা গেলে আমি সকল সম্পত্তি লাবনীর কাছ থেকে নিয়ে মালিহাকে দিব। আর দুজন সুখের সংসার গড়ব। কিন্তু দুই বছরে যখন আমি সবটা প্রস্তুত করি তখন আনহারি ফিরে আসে। মৃত মানুষ কীভাবে ফিরে আসে জানি না। তবে আনহারি ফিরে আসায় মালিহার সাথে আমার দ্বন্ধ বাজে। আর সে জন্য মালিহা আমাকে রেখে অন্য ছেলের সাথে রাত কাটায়। যেটা জানতে পেরে আমি আর নিজেকে সামলাতে পারিনি। একমাত্র ভালোবাসার মানুষের এ পরিবর্তন আমি মেনে নিতে পারিনি। আমার কাছে সবকিছু ছিল টাকা, পয়সা, বউ, মেয়ে, ভালোবসা। তবে একটা জিনিসেই ছিল না আমার ভালোবাসার মানুষ মালিহা। তাকে ছাড়া পুরো পৃথীবি আমার শূন্য লাগছে। বেঁচে থাকার কারণ পাচ্ছি না। তাই নিজেকে শেষ করে দিলাম। আমার স্ত্রীর কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি তাকে ঠকানোর জন্য। দীর্ঘ পাঁচবছর যাবত আমি এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্কে আছি। আর সেজন্যও আমি অনুতপ্ত। আমার মেয়ের কাছে আমি ক্ষমা চাচ্ছি। কারণ আমি আমার মেয়ের ভালো বাবা হতে পারিনি। প্রেমের মোহে নিজের মেয়েকেই খুন করতে চেয়েছি। আমি আমার জীবন স্ব ইচ্ছায় ত্যাগ করছি। এতে আমার পরিবার দায়ী নয়। কেউ যদি দায়ী থাকে সেটা মালিহা। আমার মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে সে দায়ী।”
পুলিশ অফিসার আলবিদ সাহেব জোরে চিঠিটা পড়লেন। তারপর আনহারি আর লাবনী জোহার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন
“এটা কী আমজাদ চৌধুরির হাতের লেখা?”
লাবনী জোহা কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলেন
“লিখা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে। তারপরও একবার এক্সপার্ট দিয়ে সবটা চেক আপ করুন। আমার স্বামীর এক্সট্রা ম্যারিটাল সম্পর্ক ছিল আমি মানতেই পারছি না। আমার স্বামী তার মেয়েকে খুন করতে চাচ্ছিল এটাও আমি মানতে পারছি না। এত বড়ো সত্য আমার থেকে লুকিয়ে ছিল আমার তো বিশ্বাসেই হচ্ছে না। সবকিছু এলোমেলো লাগছে আমার। “
বলেই ঢেকুড় তুলে কান্না শুরু করলেন। পুলিশ অফিসার এবার আনহারির দিকে তাকিয়ে বললেন
“আপনার কিছু বলার আছে? আপনার বাবার কী কোনো শত্রু আছে?”
আনহারি পাথরের মতো উত্তর দিল
“যে পিতা নিজের সন্তানকে খুন করতে পারে সে পিতার ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। দুনিয়াতে মায়ের পর আমি বাবাকেই ভালোবাসতাম। আর সে বাবা নাকি আমাকেই খুন করতে চেয়েছে। আমার তো এখন ঘৃনায় বমি আসছে। আপনারা দয়াকরে মালিহাকে এরেস্ট করুন। আমি তার নামে অভিযোগ দায়ের করে মামলা করব। মালিহার শেষ পরিনতি আমি দেখতে চাই। এ মেয়ের জন্যই আজকে আমাদের এ হাল।”
পুলিশ অফিসার আশ্বাস দিয়ে বললেন
“আপনারা সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষজন। আমরা যতটা পারি আপনাদের জন্য করব। মালিহাকে আজকের মধ্যেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আপনি কী তাকে চিনেন?”
“আমি তাকে চিনি না। এবং নামটাও জানতাম না। আজকে নাম জানলাম শুধু। হয়তো বাবার সাথে সংযোগ আছে কোনো। অপরাধীদের ধরার দায়িত্ব তো আপনাদের, আমাদের না। এ সময়ে নতুন কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে প্রস্তুত নই আমরা। আমাদের উপর কী যাচ্ছে সেটা তো বুঝতেই পারছেন।”
আলবিদ সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। আলামতের সকল ছবি তুললেন। আমজাদ সাহেবকে ময়না তদন্ত করতে অলরেডি পাঠানো হয়েছে। এবং বলে গেলেন সাতদিন যেন এ ঘরে কেউ প্রবেশ না করে।
আলবিদ সাহেবের কথা শুনে আনহারি কিছুটা রেগে বলল
“সাতদিন একটু বেশি সময় হয়ে যায়। দুদিন সময় নিন। বাবার প্রতি বিন্দু মাত্র আবেগ আমার কাজ করছে না। ঘর থেকে যত তাড়াতাড়ি সব স্মৃতি মুছব তত তাড়াতাড়ি শান্তি পাব।”
আলবিদ সাহেব বুঝতে পারছেন আনহারি বেশ রেগে গেছে। তাই তেমন কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিল
“আচ্ছা আমরা চেষ্টা করব। হয়তো আবার যোগাযোগ করা হবে। আর নিজের পিতার প্রতি এত রাগ ভালো নয়। যতই হোক পিতা।”
“তাকে আর আমি পিতা বলে স্বীকার করিনা। যে পিতা নিজের সন্তানকে অন্য মেয়ের জন্য মারার চেষ্টা করতে পারে সে কোনোভাবেই মানুষের কাঁতারে পড়ে না।”
পুলিশ অফিসার আলবিদ চলে গেলেন। লাবনী জোহা কান্নায় ভেঙে পড়লেন। লাবনী জোহা কাঁদতে কাঁদতে বললেন
“আমজাদকে আমি বিয়ে করেছিলাম শুধু তার ভালোবাসা দেখে। টাকা পয়সা কিছুই ছিল না। তবে অনেক মেধাবী ছিল। কিন্তু সে এমনভাবে ধোঁকা দিবে আমি মানতে পারছি না। ওর মৃত্যুটা আমাকে দাগ কাটছে না তেমন, ওর ধোঁকাটা যেভাবে দাগ কাটছে । প্রতারণার আঘাত এত প্রখর কেন যেটা মৃত্যুটাকেও ভুলিয়ে দেয়। সে সাধারণভাবে মরে গেলে যতটা না কষ্ট পেতাম তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছি আমাকে ঠকিয়েছে এটা ভেবে। এ টাকাটাকেই সে বড়ো করে দেখল আমার ভালোবাসা কে না। আমি তো মানতে পারছি না। আমার যন্ত্রণা আমি তো কাউকে দেখাতে পারছি না।”
আনহারি লাবনী জোহাকে জড়িয়ে ধরে বলল
“যে তোমার ছিল না তাকে নিয়ে ভাবার তো কোনো দরকার নেই। বাবা ৫ বছর আগেই তোমার পর হয়ে গেছে। এখন কেবল এটা অতীত ছাড়া কিছু না। অতীত নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না মা। নিজেকে সামলাও। ঘরে চলো। কিছু খেয়ে নাও। নাহয় তুমি অসুস্থ হয়ে যাবে। এ দুনিয়ায় তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই। তোমাকে হারালে আমি কী নিয়ে বাঁচব বলো। আমার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে মা।”
লাবনী জোহার কান্নার আওয়াজ টা স্মিমিত হয়ে গেল আনহারির কথা শুনে। আনহারি তাকে ভেতরে নিয়ে গেল। হালকা খাবার খাইয়ে দিল তাকে। তারপর ঔষধ খাইয়ে শুইয়ে দিল। আনহারি এবার আমার কাছে এসে বলল
“ঐ গ্রামে আর আজকে যেতে পারলাম না। হয়তো আগামী এক সপ্তাহেও পারব না। সময় দাও আমাকে। কথা যেহেতু দিয়েছি তোমাকে। তোমার বড়ো আপার অপরাধীদের আমি শাস্তি দিব।”
আমি কেবল আনহারির দিকে তাকিয়ে আছি। বাবাকে হারিয়েও কত শক্ত সে। কত অবলীলায় কথা বলছে সে। একটুও স্বজন হারানোর যন্ত্রণা তাকে ঘিরে ধরেনি। একদম স্বাভাবিক লাগছে। পুনরায় মনে প্রশ্ন জাগল তাহলে কী আনহারিই তার বাবাকে খু/ন করছে। সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। আনহারি তার রুমে গেল। বাড়িটাকে কেমন যেন ভুতুরে বাড়ি লাগছে। ভয়ে যেন গা ছমছম করছে। কিসের জন্য এসেছিলাম আর কী হচ্ছে এসব। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
আমি সোফায় বসেই চিন্তা করছিলাম এগুলো। এর মধ্যে মদিনা এসে বলল
“আপা এটুকু খাবার খেয়ে নিন। মরা বাড়ি কখন খাবার মিলে কে জানে।”
মদিনার কথা শুনে আমি একটু বিরক্ত হয়ে গেলাম। এমন সময় সে খাবার নিয়ে পড়ে আছে। ভীষণ রাগ হচ্ছে তার উপর। কিন্তু কিছুই বললাম না। শুধু হালকা গলায় উত্তর দিলাম
“এখন খাওয়ার মুড নেই। আপনার মন চায়লে আপনি খেয়ে নিন। আমার আপাতত ইচ্ছা নেই কিছু খাওয়ার।”
মদিনা আমার কথা শুনে বিরক্তবোধ করল তার চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তিনি খাবার নিয়ে চলে গেলেন।
এদিকে দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হওয়ার উপক্রম৷ পুরো বাড়ি শুনশান নীরব হয়ে আছে। এর মধ্যেই পুলিশ অফিসার আলবিদ সাহেব আবার আসলেন। আলবিদের উপস্থিতিতে আনহারি তার রুম থেকে বের হলো। লাবনী জোহা এখনও ঘুমুচ্ছে। আমি সোফায় বসে আছি। আনহারি আসতেই আলবিদ বলে উঠলেন
“একটা নিউজ আছে। এটা আপনাদের জন্য গুড নিউজও হতে পারে আবার বেড নিউজও।”
আনহারি রাগী কণ্ঠে বলল
“এত ভূমিকার কী দরকার। কী হয়েছে বলুন।”
“মালিহা রোড এক্সিডেন্টে আজকে মারা গেছে। গাড়িটা ব্রেক ফেল ছিল। আপনাদের গাড়িতেই সে মারা গেছে। গাড়িটা কী করে সেখানে গেল সেটাই এখন ভাববার বিষয়।”
অফিসার আলবিদ সাহেবের কথা শুনে আমি চমকে গেলাম। রাতে আমজাদ সাহেব নিজের হাতে সে গাড়ির ব্রেক নষ্ট করেছিল আনহারির মৃত্যুর জন্য। তাহলে সে গাড়ি কীভাবে মালিহার কাছে গেল?