#শারমিন আঁচল নিপা
ময়না তদন্তে জানতে পারলাম বড়ো আপার তিনমাসের পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছে এক মাস আগে। তার মানে বড়ো আপা ডিভোর্সের সময় এক মাসের অন্তস্বত্ত্বা ছিল। আপার উপর যে মিথ্যা তকমা দিয়েছিল সেটা পুরোপুরি মিথ্যা ছিল। তাহলে তো আপার ডিভোর্সও হয়নি। আর বউ রেখে বিয়ে করাটা তো আপার জামাইয়ের অন্যায়। কিন্তু বিষয়টি সামনে আসার পর উল্টো আপার শ্বশুড়বাড়ি আমার মৃত বোনের উপর বদনাম রটিয়ে দিল। তারা বলে উঠল এ পেটের বাচ্চা আপার নতুন কোনো নাগরের ছিল। তাই নষ্ট করেছে। তাদের হলে আপা তাদের বলত। সবার মুখোমুখী হত। তবে আপাকে তো আমি চিনি। আপা এমন ধরণের মেয়ে মানুষ কখনই ছিল না। মৃত মানুষটাও তাদের কথার কবল থেকে রক্ষা পেল না। আপার জামাই যে একটু অনুতপ্ত হবে সেটাও তার মুখ দেখে মনে হলো না। ইচ্ছা করছিল আপার জামাইয়ের মুখে একটু থুথু মেরে আসি। তবে ১৩ বছরের ছোট্ট আমির মধ্যে এত সাহস ছিল না। তাই ইচ্ছাটা আর পূরণ করতে পারিনি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো আপার শরীরে নেশার আলামত পাওয়া গেছে। মৃত্যুর আগে আপা নেশা করেছে এমনটায় বলা হয়েছে। রিপোর্ট বলতেছে আপা হয়তো আত্মহত্যা করেনি। হতে পারে এটা হত্যা নহয় আত্মহত্যা। তবে বিষয়টি খতিয়ে আর দেখা হয়নি। আপার শ্বশুড়বাড়ির লোকজন পুলিশকে টাকা দিয়ে রিপোর্ট পরিবর্তন করে। আর তাতে লেখা হয় আপা মাদক আসক্ত ছিল। তাই নেশার ঘোরে এমন কাজ করেছে। আপা নাকি দীর্ঘদিন যাবত নেশা করত। মৃত লাশটাও যেন বদনামের ভাড়ে নুইয়ে পড়ল। সে বদনামের ভারটা হয়তো খাটিয়াও নিতে পারেনি। তাই আপাকে আর খাটিয়ার উঠানো হয়নি।
আপার জানাজা হয়নি। কারণ আপা আত্মহত্যা করেছে তাই। কোনো কবরস্থানে আপাকে দাফন করতে দেওয়া হয়নি। তাই বাড়ির পেছনে জঙ্গলে আপাকে দাফন করা হয়। আমার বিশ্বাস ছিল আপা আত্মহত্যা করেনি। হয়তো আপাকে নেশার দ্রব্য খাইয়ে খুন করা হয়েছে। আপা অন্তঃসত্ত্বা সেটা হয়তো আপা জানত। তাই ভাইয়াকে জানিয়েছিল। আর ভাইয়া হয়তো আপাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বাচ্চাটাকে নষ্ট করেছে আপার অজান্তেই।
একদিন আপাকে দেখেছিলাম খুব কাঁদতে। পেটে ধরে মুচরে মুচরে কাঁদতে। আপার কান্নার শব্দ হত না। মুখটা লাল হয়ে যেত। আর চোখ লাল হয়ে ফুলে টলটল করে পানি পড়ত। সেদিনেই হয়তো আপা তার বুকের ধনকে হারিয়েছিল। যেহেতু বাবা, মা ও আপাকে বুঝত না, তাই আপা কাউকে কিছু বলেনি। একদিকে প্রিয় মানুষটার বিয়ে অন্যদিকে নিজের বাচ্চা হারানোর তীব্র যন্ত্রণা আপা মানতে পারেনি। আর সেখান থেকেই হয়তো প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। আর তারা সে সুযোগ নিয়েই আপাকে মেরে দিল।
ডিভোর্সের চার মাস পর আপার মৃত্যু হয়। এ শক্ত মেয়েটা এত দ্রূত ভেঙ্গে কীভাবে পড়ে? আপার মৃত্যু রহস্যটা এখনও কেমন জানি ধোঁয়াশায় রয়ে গেল।
দুনিয়াতে যে, কেউ কারও না সেটা আপার মৃত্যু পরই বুঝতে পেরেছিলাম। আমার বাপ, মা ও আপাকে গাল দিত। সবসময় বলতো মরেও শান্তি দিলি না। কারও কাছে মুখ দেখাতে পারি না। নিজের বাবা, মা এতটা হীনও হতে পারে সেটাও দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম আপার মৃত্যুর পর বাবা, মা হয়তো কষ্ট পাবে। আপাকে নিয়ে লড়বে তবে ঘটেছিল বিপরীত। তারা হয়তো হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল। আপাকে অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারত না সহজে। ঘাড়ের উপর বসে বসে খাওয়ার থেকে ম/রে গেছে এটাই হয়তো তাদের কাছে ভালো মনে হয়েছে। তবে মরে যাওয়ার পর আক্রোশ যেন কমেনি। তাই উঠতে বসতে আপাকে যা নয় তা বলত। আমাকে আপার উদাহরণ টেনে টেনে শাসন করত। অথচ আপার মৃ/ত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে তারাই দায়ী ছিল। কারণ জোরে করে মতের বিরুদ্ধে টাকা দেখে যাচাই বাছাই না করে বিয়ে দিয়েছিল। আপার এখানে কোনো দোষ ছিল না। আপার একটায় দোষ আপা কেন আরও সহ্য করে মা/ইর গু/তা খেয়ে থাকল না।
বিয়ের পর আমি কখনও আপাকে হাসতে দেখি নাই। বাবার বাড়ি যখন আসত তখন বাবা, মায়ের আবদারে যেন ডুবে যেত। এত বড়ো ঘরে বিয়ে দিয়েছি এভাবে খালি হাতে কেন এসেছিস? কিছু আনবি না? আপা শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলত
“মা অভাব নেই ঠিক৷ সে সাথে তাদের কাউকে কিছু দেওয়ার মানসিকতাও নেই। এই যে তোমাদের জন্য কিছু আনি না তারপরও কথা শুনতে হয় চুরি করে ঘরের জিনিস নাকি বাপের বাড়ি পাচার করি। কত কটু কথা মা। সয়ে আছি এটাই তো অনেক মা। এখানে আসি একটু নিঃশ্বাস নিতে শান্তিতে। কিন্তু তোমাদের চাওয়ার কাছে সেটাও হয় না মা। বিয়ে দেওয়ার সময় খোঁজ নিতে পারলে না? আমি আসলে মন ভরে তোমাদের জন্য কিছু আনতে পারব কি’না। চেয়েছিলাম একটু পড়ে চাকুরি করে তোমাদের খাওয়াতে। সে সুযোগটাও তো দিলে না। পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর বড্ড ইচ্ছা হয় মা। নিজের ঘরে দা/সীর মতো খাটতে হয়। তাতেও কোনো কষ্ট নেই মা। নিজের সংসার বলে মেনে নেই। কিন্তু ননাসের জামাইয়ের আন্ডারওয়্যারটাও যখন ধুইতে হয় তখন মা কলিজায় লাগে। গরীব ছিলাম মা, আত্মসম্মান তো কম ছিল না। তারপরও সেটা বিসর্জন দিয়ে থাকতে হচ্ছে। এরপরও তোমরা এটা সেটা চাও কী করে? মাঝে মাঝে তোমাদের বেশ লোভী মনে হয় মা। বিয়ের আগের মা টা কে আমি আর দেখতে পায় না। আমার মনে হয় বিয়ের পর পর আমার মা ও মারা গেছে।”
আপার এসব কথায় মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠত। আপার ছাড়া দীর্ঘশ্বাসে যে কত যন্ত্রণা ছিল বুঝত না। মায়ের এসব অশান্তিতে আপা এ বাড়িও আসা বন্ধ করে দেয় এক পর্যায়ে। সব মিলে মনে হচ্ছিল আপাকে আমরা ভীষণ পর করে দিয়েছি। না ছিল আপার শ্বশুড় বাড়ি, না ছিল আপার বাপের বাড়ি। বিয়ের পর নিজের বলতে হয়তো কিছু থাকে না। যেটা থাকে সেটা হলো যন্ত্রণা বর্ব/রতা, আর কষ্ট। শুধু আপার ক্ষেত্রেই না এ সমাজের অনেক পরিবারেই মেয়েদের বিয়ের পর আলাদা করে দেয়। পরিবারের মানুষ গুলোকেই তখন অপরিচিত লাগে। আপার ভেতরের হাহাকার দেখার মতো কেউ ছিল না। খুব/লে খু/বলে খাওয়া মনটাও দিন দিন ম/রে যেতে লাগল। আপার মৃ/ত্যু তো বিয়ের পরেই হয়ে গিয়েছিল। জাম গাছে যেটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা আপার শরীর।
আপার মৃ/ত্যুর তিনমাস পর থেকে আমাদের জন্য গ্রামে টেকা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ছিল। আমাদের সাথে কেউ কথা বলত না। আমাদের এক ঘরে করে দেয়া হয়। আপার শ্বশুড় বাড়ির লোকের দাপটেই এমন হয়েছে। আমি স্কুলে গেলেও আমাকে ঢুকতে দিত না। সব জায়গায় শুধু কলরব আমার আপা চরিত্রহীন। আমার আপা পরপুরুষের সাথে শুইয়ে পেট বাজায়ছে। আমার আপা শয়তান তাই গলার দঁড়ি দিছে। আমার আপা কলঙ্কীনী। তাই আমাদের পরিবারের সাথে মিশলে তাদের জাত যাবে।
দিনকে দিন আমাদের চলা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যেদিন গ্রাম ছাড়ব সেদিন আপার কিছু জিনিসপত্র ঘাটতে গিয়ে একটা খাতা আমার চোখে পড়ে। আপার একটা খাতা। খাতাটা নীল মলাট করা ছিল। সে মলাটে লিখা ছিল
“আমি জানি ছুটকি আমার এ খাতাটা তোর চোখেই পড়বে। যেদিন পড়বে সেদিন হয়তো আমি নাও থাকতে পারি। এ খাতাটা যখনেই পাবি এর ঠিক বারো বছর পর খাতাটা খুলবি। আমার জমানো কথা গুলো তখন শুনবি, আমার সাথে কী হয়েছিল সে আর্তনাদগুলো শুনবি। এখন মোটেও খুলবি না। এ বয়সে আমার ভেতরের হাহাকার আর্তনাদ শুনার মতো শক্তি তোর হয়নি। বারো বছরে ঠেকতে ঠেকতে কাদামাটির এই তুই শক্ত ঢেলায় পরিণত হবি। আর তখনই এ খাতাটা খুলবি। আমার আত্মা নাহয় শান্তি পাবে না।”
আজকে বারো বছর পর সে খাতাটা সামনে নিয়ে বসলাম। আজকের দিনটার জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলাম। খাতাটা খুলার আগেই স্মৃতি গুলো যেন চোখের পাতায় ভেসে উঠল।
নিঃশ্বাস ভারী হয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। এমন সময় একটা আওয়াজ আসলো কানে। আমি পাশ ফিরে তাকিয়ে থমকে গেলাম।
চলবে?
শারমিন আক্তার
শারমিন নিপা