#শারমিন আঁচল নিপা
পর্ব ৩
কালো কুচকুচে বিড়াল টা কোথায় থেকে দৌড়ে এসে মিলিয়ে গেল। বিষয়টি বুঝে উঠার আগেই যেন মাথা থেকে সরে গেল। আমি খাতাটা আবারও হাতে নিলাম। রাত এখন বারোটা বাজে। গ্রাম ছেড়ে আমরা শহরে চলে আসি সে সময়েই। এখানে এসে বাবা টুকটাক ব্যবস্যা আর সি এন জি চালায়। মা দর্জির কাজ করে। এতে আমাদের সংসার বেশ ভালো করেই চলে যায়। আমার বয়স এখন ২৫। এর মধ্যে অনেক বিয়ের প্রস্তাব আসলেও আপার কাহিনি জানার পর, বাড়িতে খোঁজ নেওয়ার পর, কেউ রাজি হয়নি। আমি পড়াশোনা শেষ করেছি সবে। টুকটাক টিউশন করে নিজের হাত খরচ টা চলে যায় আমার।
খাতাটা খুললাম। বড়ো আপার একটা ছবি অংকন করা। আপা বেশ ভালো আঁকতে পারত। যেকোনো জিনিস হুবুহু আঁকার গুণ আপার ছিল। সে গুণ থেকেই খাতার প্রথম পৃষ্ঠায় নিজেরেই একটা স্থিরচিত্র অঙ্কন করেছে সে। আপার কোনো ছবি আমাদের কাছে ছিল না। তাই মৃত্যুর পর আপাকে কল্পনা করে দেখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আজকে আপাকে ছবিতে দেখে বুকে ভীষণ ব্যথা করছে। আপা সত্যিই অনেক সুন্দরী ছিল। দুধে আলতা গায়ের রঙ, চোখ গুলো স্রোতসীনি নদীর মতো বাঁক করা। চোখের মনিটা কালো কুচকুচে রঙয়ের, লম্বায় ৫ ফিট ৬ ছিল। চুল হাঁটু পার হত। নাকটাও বেশ খাড়া ছিল৷ সব মিলিয়ে তাকে হুর পরীর মতো লাগল। সে হুর পরীটায় একটা সময় গিয়ে যন্ত্রণায় পেত্মীর মতো হয়ে যায়।
মানুষের সৌন্দর্য ফুটে উঠে তার মনের শীতলতা থেকে। যার মনে যত আনন্দ তার সৌন্দর্য ও তত গাঢ়। আর যার মন যত নির্জীব তার সৌন্দর্য ও আস্তে আস্তে তত নির্জীব হয়ে যায়।
ইশ আমি যদি তখন এ বয়সে থাকতাম তাহলে আপাকে আজকে হারাতে হত না। আপা আমার পাশেই থাকত। আপার জন্য কলিজাটা বেশ পুড়তেছে। আমার চোখ গড়িয়ে আবারও পানি পড়ল। পানিটা ঠিক আপার ছবির চোখে পড়ল। মনে হচ্ছে আপাও আমার কান্না দেখে কষ্ট পাচ্ছে।
আমি খাতাটার পরের পৃষ্ঠায় গেলাম। আপার জীবনের রচিত একটা কালো অধ্যায় পড়া শুরু করলাম।
আমি আনন্যা। মা, বাবার প্রথম সন্তান। পড়াশোনায় খুব পরিশ্রমী হওয়ার দরুণ আমার সবসময় চাওয়া ছিল আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। সবার দায়িত্ব আমি নিব। তবে নিয়তি আমাকে সেটা হতে দিল না। বাবা মায়ের সুখ আর শান্তির কথা চিন্তা করে নতুন জীবনে পা দিই। ভেবেছিলাম এ জীবনটা আমাকে সুখী করে তুলবে। আমাকে সুযোগ দিবে স্বপ্ন বুনার। তবে সে স্বপ্ন প্রথম দিনেই যেন শেষ হয়ে গেল।
আমি যেদিন প্রথম শ্বশুড়বাড়িতে পৌঁছায়। তখন তাদের অদ্ভুত রীতিনীতি দেখে আমি বেশ অবাক হই। কোনো ঘরে এমন রীতি আছে বলে আমার মনে হয় না। বিয়ের প্রথম রাতেই আমাকে বেনারসি খুলে সাদা কাপড় পরানো হয়। যেটা আমাকে অনেক বেশি অবাক করেছিল। শুধু আমি নই বরং সেখানে যারা উপস্থিত ছিল সবাই এমনটা করেছে। কেন করেছে এটা আমার জানা নেই।
রাতে কেবল আমাকে খেতে দেওয়া হয় ডিম ভাজি দিয়ে। হরেক রকমের খাবার থাকলেও আমার মুখে তা ওঠেনি। বিয়ের প্রথম রাতে এত খেলে নাকি ঘরের লক্ষী বিদায় নিবে। তখন সংসারে আর আয় উন্নতি হবে না। তাই সেদিন আমার কাপলে জুটেছিল শুধু ডিম ভাত।
খাবার খেয়ে আমাকে একটা বিছানায় বসানো হয়। সেখানে ননাসের জামাই এসে আমাকে বউ বউ বলে মজা করছিল। আরও কিছু নোংরা কথাও বলেছিল যেটা আমি সহ্য করতে পারিনি। এ কথাগুলো কেবল আমার স্বামীর বলার অধিকার আছে বলে আমার মনে হয়। তার মধ্যে মজা করে উনি আমাকে কোলে তুলে নিতে এসেছিল। যেটা আমার জন্য অপমানজনক লেগেছিল। একটু হতচকিয়ে দূরে গিয়ে কড়া কন্ঠে মুখের উপর বলে দিয়েছিলাম
“দুলাভাই আপনার এ মজা আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। এ ধরণের মজা আমার সাথে করবেন না। এটা উচিতও না।”
আমার কথা শুনে দুলাভাই চুপসে গেল। ননাসের কাছে দৌড়ে গিয়ে বিচার দিয়ে বলল
“কী বেয়াদব মেয়ে বিয়ে করে এনেছো মজা বুঝে না। আমাকে যা নয় তা বলল। আমি আর এ বাসায় থাকব না।”
এ নিয়ে লঙ্কা কান্ড বেঁধে গেল। ননাসের জামাই তৈরী হচ্ছে বাড়ি ছাড়বে বলে। আমার ননাসকে বলা শুরু করছে সব গুছাতে। এসব দেখে শ্বাশুড়ি কান্না জুড়ে দিল। আমি নাকি তার সংসারে এসেই আগুন লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার নাকি সহ্য হচ্ছে না তারা এখানে থাকে। তাই প্রথম দিনেই এসে একটা কান্ড ঘটিয়েছে যাতে করে তারা যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। শ্বাশুড়ির কান্না দেখে দীপক ছুটে আসে। দীপক আমার স্বামী। বয়সে আমার থেকে ২০ বছরের বড়ো। ব্যবসায় মন দিতে গিয়ে নাকি বিয়ে করা হয়ে ওঠেনি। তাই এ বয়সে সে চাচ্ছিল অল্প বয়স্ক মেয়ে বিয়ে করতে। তাই আমার মতো গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করা। দীপক এসেই মাকে জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে? মা কান্নার বেগ বাড়িয়ে দিয়ে বলল
“তোর দুলা ভাই তোর বউয়ের সাথে একটু মজা করেছে বলে তোর বউ যা মুখে আসে তা বলে অপমান করেছে। তোর দুলাভাই রাগে অপমানে এ বাসা থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। কী বউ বিয়ে করে আনলি তুই? আসতে না আসতেই আমার মেয়েকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। বাপ মরা মেয়েটা আমার। ভেবেছিলাম বড়ো ভাইয়ের ছায়ায় থাকবে সেটা আর হলো না রে। এ রাক্ষসী এসেই সব নষ্ট করে দিল।”
বিয়ের প্রথম দিনেই এমন পরিস্থিতি আমাকে ভেতর থেকে ভেঙ্গে দেয়। হাজার বুনা স্বপ্নগুলো নিমিষেই যেন ভেঙ্গে গেল। দীপক দুলাভাইয়ের হাতটা ধরে বলল
“দুলাভাই অনন্যা কী বলেছে বলুন। আমি শাসন করছি। তারপরও আপনারা যাবেন না। অনন্যার অধিকারের থেকে এ বাড়িতে আপনার অধিকার বেশি। আপনি বলুন অনন্যা কী বলেছে?”
দুলাভাই হালকা গলায় বলল
“আমি শুধু বলেছিলাম আমার শ্যালক তো সুন্দরী বউ বিয়ে করে এনেছে। বউ তো মাশআল্লাহ সুন্দর। এটা বলার পর আমাকে যা নয় তা বলল। আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল। আমি নাকি তোমার বউকে কুনজরে দেখেছি। এত কিছুর পর আমি এ বাড়িতে থাকব না। চলে যাব তোমার বোনকে নিয়ে।”
দুলাভাইয়ের মুখে মিথ্যা কথাটা শুনে আমি নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। মুখের উপর বলে দিলাম
“এত বড়ো মিথ্যা কী করে বলছেন? আপনি আমাকে নোংরা কথা বলেছেন। যা বলেছেন সেটা মুখ দিয়েও আসছে না।”
আমার কথা শুনে দীপক কিছু না বলেই আমার গালে কষিয়ে একটা থাপ্পর দিল। বিয়ের প্রথম দিনে স্বামীর থেকে পাওয়া প্রথম উপহারেই ছিল এটা আমার। আমি চুপ হয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একটা থাপ্পর দিয়ে ক্ষ্যান্ত হয়নি। পর পর কয়েকটা থাপ্পর দিয়ে বলল
“আমার বোন জামাই কেমন আমরা জানি। বাড়িতে আসতে না আসতেই কর্তৃত্বঘিরি করছিস? শুন আমার মা, বোন, দুলাভাই যা বলে শুনবি। নাহয় তোরে লাথি দিয়ে বাপের বাড়ি পাঠাব। নিজেকে শুধরা। ছোটোলোকের ঘর থেকে এনেছি বলে এখানেও ছোটোলোকি করবি না।”
কথাগুলো বলেই দীপক দুলাভাইয়ের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল
“দুলাভাই যাবেন না। আমি অনন্যাকে আরও শাসন করব। আপনি যাবেন না।”
দুলা ভাই আমার দিকে তাচ্ছিল্যের চোখ দিয়ে তাকিয়ে বলল
“তুমি বলেছো বলেই থাকছি নাহয় চলে যেতাম।”
এ কথার মাধ্যমে ঘটনা একটু শান্ত হলো। আমাকে এনে অন্য একটা রুমে রাখা হলো। আয়নার সামনে গিয়ে নিজের দিকে তাকালাম। ফর্সা দুটো গাল পাঁচ আঙ্গুলের ছাপে লাল হয়ে গেছে। আমার চোখ বেয়ে কেবল পানি পড়ছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটায় কী আমার ভুল ছিল? এসব ভেবেই কাঁদতে লাগলাম।
দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম শ্বাশুড়ি মা দাঁড়িয়ে। তিনি আসতেই আমি আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। তিনি আমাকে খাটের উপর বসতে বললেন। আমিও তাই করলাম। এরপর উনি যা বললেন তা শুনে আমি রিতীমতো স্তব্ধ। ভাবতে লাগলাম এটাই কী আমার জীবন? এ নাটকীয়তার কী শেষ হবে না?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার
চলবে?