#শারমিন আঁচল নিপা
বিভোর নামটা আনহারির মুখেই শুনেছিলাম। তাহলে এ মানুষটায় আমাকে পেইন্টিং টা পাঠিয়েছিল। আমি বেশ উত্তেজিত গলায় বললাম
“হুট করে আমার বাসায় কেন পেইন্টিং আর চিঠিটা পাঠালেন? অনেক প্রশ্ন আমার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। আনহারি কে? অনন্যা কী আদৌ মরেছে? আমি এসব আর নিতে পারছি না। আমাকে ভীষণ প্যারা দিচ্ছে এ প্রশ্ন গুলো। এত সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে কবে জানি না।”
বিভোর স্থিত গলায় বলল
“আনহারির সাথে আমার পরিচয় হয় বারো বছর আগে। আমি একটা ছবি প্রদর্শনীতে অনন্যার ছবি দিয়েছিলাম। এরপর সেখানে সে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আমি কেন তার ছবি বিনা অনুমতিতে এঁকেছি এবং প্রদর্শন করেছি। প্রথমে তাকে দেখে আমিও ভেবেছিলাম সে হয়তো অনন্যা তবে সে ধারণা আমার পাল্টে যায় তার সাথে কথোপকথনের পর। সেদিন অনন্যার ঠিকানা, সবকিছু আমার থেকে সে নিয়ে চলে যায়। এরপর আর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি। আমিও অনন্যাকে না পেয়ে মানসিক ভাবে একটু বিদ্ধস্ত ছিলাম। সব মিলিয়ে তাকে হারিয়ে ফেলি।”
অনন্যার মৃত্যুর খবর আসায় আমি অনেক ভেঙে পড়ি। তবে সে সময়টায় আনহারিকে দেখার আমার ভীষণ ইচ্ছা জাগে। তাই আমাদের একটা গ্রূপে তাকে নিয়ে পোস্ট করি। যেখানে লেখা ছিল,
একই দেখতে দুজন মানুষ একজন আমার গ্রামের অন্যজন অন্য শহরের। একজনের নাম অনন্যা অন্যজনের আনহারি। আমি অনন্যাকে হারিয়ে ফেলেছি তবে তার প্রতিচ্ছবি মানে আনহারিকে দেখার একটা ইচ্ছা আমার জাগছে। যদি কেউ তাকে চিনে থাকেন আমাকে জানাবেন। আমি এক নজর তাকে দেখতে চাই।
তখন এখনের মতো ফেসবুক, মেসেন্জার এত হাতে হাতে ছিল না। গুটিকয়েক মানুষ চালাত। সে সময়টায় স্ট্যাটাস দেখে আমাকে নক করে আনহারির মামা লিয়াকত জোহা। তিনি আমাকে দ্রূত পোস্টটি ডিলেট করার অনুরোধ করেন। তিনি এটা জানান আনহারির পরিবারের অনেকেই এখানে আছে যদি তাদের চোখে পোস্টটি পড়ে তাহলে মানহানি হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে৷
আমি উনার কথামতো পোস্টটি ডিলেট করি৷ এরপর উনার থেকে উনার ব্যক্তিগত নম্বর নিয়ে উনাকে কল দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“কেন সে এমনটা বলেছে।”
তিনি আমাকে হাত জোড় করে বলেছিল বিষয়টি যেন কাউকে না জানাই। তবে এত ঘটনার পর বিষয়টি চেপে রাখলেও অন্যায় হবে৷
বিভোরের কথা যতই শুনছিলাম ততই আমার মনটায় অসম্ভব অস্থিরতা কাজ করতে লাগল। তাই অস্থির গলায় বলে উঠলাম।
“প্লিজ বলুন। এগুলো চেপে রাখলে সহজ বিষয়টি এখন ঘোলাটে হয়ে যাবে৷”
বিভোর হালকা একটা ঢুক গিলে বলল,
“লিয়াকত জোহা অনন্যার বাবা হয়। তোমার মায়ের প্রথম স্বামী লিয়াকত জোহায় ছিল। যে আনহারির মামা এখন। সে এ গ্রামে এসেছিল একটা কাজে। সেখানে তোমার মাকে দেখে পছন্দ করেছিল। আর পছন্দ থেকে প্রণয়। গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করত৷ সে সুবাদেই এখানে পোস্টিং হয়েছিল। তোমার মায়ের প্রেমে পড়ে এখানেই থেকে যায়। জায়গা জমি কিনে নেয়। লিয়াকত জোহার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিল তোমার মা। তার আগের বিয়ের কথা তোমার মা জানত না। যেহেতু গোয়েন্দাতে কাজ করত তাদের কাজের ব্যাপারে কিছু বিধি নিষেধ থাকায় সে তার পরিচয় এ গ্রামের কাউকে দেয় নি৷ দ্বিতীয়ত এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ায় সে তোমার মাকেও চাকুরির ব্যাপারে কিছু বলে নি। সব মিলে সে সংসার কিছুদিন করার পর লিয়াকত জোহার প্রথম স্ত্রী বিষয়টি জানলে সে এ বিষয়টি নিয়ে ঝামেলা করে। আর সে ঝামেলা যেন বড়ো আকার ধারণ না করে সে জন্য লিয়াকত জোহা হুট করেই নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। সে সময়টায় লিয়াকত জোহা জানত না তোমার মায়ের গর্ভে সন্তান আছে। জানতে পারে তোমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কিছুদিন পর। তবে তোমার মায়ের সংসারের কথা ভেবে তিনি আর সামনে আসেন নি।
একইসাথে লাবনী জোহা সন্তানসম্ভাবা হয়। লিয়াকত জোহার স্ত্রী সন্তান দানে অক্ষম ছিল। তাই তাদের ঘরে আর কোনো সন্তান নেই। তারা বর্তমানে বিদেশেই স্যাটল আছে। আর আনহারি বিদেশেই বড়ো হয়েছে বেশি। সে সূত্রপাতে লিয়াকত জোহার কাছেই ছিল। আর লিয়াকত জোহার স্ত্রী এখন পর্যন্ত জানে না আনহারি তার সন্তান, লাবনী জোহার না।
আমি কিছুটা হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলাম
“তাহলে আনহারি কীভাবে লাবনী জোহার কাছে পৌঁছালো? আর যতদূর জানি আনহারি হয়েছে দেশের বাইরে আর অনন্যা আমাদের গ্রামে।”
বিভোর একটা দম নিয়ে বলল
“জানো ফিয়না জীবনটা একটা থ্রিলার নাটকের মঞ্চ। লিয়াকত জোহা যখন জানতে পারে তোমার মায়ের সন্তান তার। আর সেটাও জানতে পারে বিশেষ এক কাহিনীর মাধ্যমে। লিয়াকত জোহা তোমার মাকে শুধু একটা ডাকঘরের ঠিাকানা দিয়েছিল। সেখানে তোমার মা লিয়াকত জোহার নামে শেষ একটা চিঠি লিখে। চিঠিতে এটা লেখা ছিল সে সন্তানসম্ভ্যাবা তাকে যেন নিতে আসে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত চিঠিটা যখন লিয়াকত জোহার হাতে পৌঁছে, তখন তোমার মায়ের তোমার বাবার সাথে বিয়ে হয়ে যায়৷ সে সময় চিঠিটা পেয়ে লিয়াকত জোহা সিদ্ধান্ত নেয় তার সন্তান নিয়ে আসবে। তবে তোমার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে হওয়ায় সেটা আর সম্ভব ছিল না। কারণ তোমার বাবা জানত এটা তার সন্তান। তোমার মামার সাথে লিয়াকত জোহা প্রথম যোগাযোগ করে। তখন তোমার মামা জানায়, সে তার বোনের সম্মান আর নষ্ট করতে চায় না। এটা যদি গ্রামের মানুষ জানে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এ সন্তান তারা দিতে পারবে না। আর লিয়াকত জোহার নিকট হাত জোড় করে বলে সে যেন এ বিষয় নিয়ে কোনো স্টেপ না নেয়। তবে লিয়াকত জোহার মধ্যেও হঠাৎ করে পিতৃত্ব জেগে উঠে। সে কৌশলে তোমার মাকে হাসপাতালে এনে আল্ট্রা করায়। সন্তানের অবস্থা জানার জন্য। সে সময় জানতে পারে তার জমজ সন্তান হবে। তখন সে তোমার মামাকে প্রস্তাব দেয় তাকে যেন অন্তত একটা সন্তান দেওয়া হয়। আর তার বিনিময়ে সে সব গোপন রাখবে সে সাথে তাকে বিদেশ পাঠাতে যা টাকা লাগে দিবে।
এবার তোমার মামা বিষয়টি চিন্তা করে দেখল এতে কারো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বরং লাভ হচ্ছে। তোমার মা জানতই না তোমার মায়ের জমজ বাচ্চা হবে। আর বাচ্চা নরমাল ডেলিভারি হওয়ার দরুণ সবটা চাপা পড়ে যায়। যে আয়া বিষয়টি জানত তাকেও দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার দরুণ এত বছরে একবারও বিষয়টি খোলাসা হয়নি।
যেদিন অনন্যা আর আনহারি হয় সেদিন তোমার মামা একটা সন্তান মানে আনহারিকে লিয়াকত জোহার হাতে তুলে দেয় আর অনন্যাকে রেখে দেয়। লিয়াকত জোহা সে সন্তান নিয়ে ঢাকায় যায়। যেহেতু লিয়াকত জোহার পরিবার দেশের বাইরে থাকে। তাই সকল প্রসেসিং করে লিয়াকত জোহা বাচ্চা নিয়ে দেশের বাইরে যায়। প্রথমে তার স্ত্রী কে বাচ্চার ব্যাপারে কিছু না জানিয়ে ডে কেয়ারে রাখে। ভেবেছিল সময় সুযোগ বুঝে বলবে সে একটা বাচ্চা দেশ থেকে দত্তক নিয়ে এসেছে ,যেহেতু তাদের বাচ্চা হবে না।
কিন্তু ঘটনা মোড় নেয় অন্যদিকে। লাবনী জোহার অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। তার বাচ্চার স্বাভাবিক ডেলিভারি হবে না ডাক্তার বলেছিল। তাই ইমারজেন্সি তাকে দেশের বাইরে নেওয়া হয় বাচ্চার ডেলিভারির জন্য। তোমার মায়ের ১৭ দিন পর বাচ্চা ডেলিভারি হয় লাবনী জোহার। তবে দূর্ভাগ্যবশত মৃত বাচ্চা হয়। কিন্তু লাবনী জোহার অবস্থার এতই অবনতি হয়েছিল যে তার বাচ্চা মারা গেছে এ কথা তাকে জানানো সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে লিয়াকত জোহা আনহারিকে লাবনী জোহার কোলে তুলে দেয়। বাকি বিষয় সে চাপা রাখে।
আমি কথার মাঝে বলে উঠলাম
“তাহলে তো ওয়াজেদ চৌধুরি জানার কথা।”
বিভোর হালকা গলায় বলল
“লাবনী জোহার এ সময়টায় ওয়াজেদ চৌধুরির ভিসার জটিলতার জন্য যেতে পারে নি। লিয়াকত জোহা কেবল তার তত্ত্বাবধানে লাবনী জোহাকেই বিদেশ নিয়ে যায়। আর ওয়াজেদ চৌধুরি যায় তিনদিন পর। এর মধ্যে সে তো জানে যে তার বাচ্চা আনহারি। কিন্তু সত্য এটাই এ বাচ্চা লিয়াকত জোহা আর তোমার মায়ের। আর আনহারিকে যেহেতু সতেরো দিন পর লাবনী জোহার কাছে দিয়েছিল তাই আনহারির জন্মদিন অনন্যার সতরো দিন পরেই পালন হত৷ আর অনন্যার সতেরো দিন আগে। এজন্যই আনহারিকে সবাই জানে বিদেশে জন্ম। দুজন জমজ হয়েও প্রকৃতির লীলা তাদের আলাদা করে দিয়েছিল। একজন সাজানো অট্টালিকায় বড়ো হয়েছে অন্যজন কুঁড়ে ঘরে।”
বিভোর থেমে গেল। আমার মাথা থেকে বড়ো একটা বোঝা নেমে গেল। তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায় কে বেঁচে আছে সেটা কী আনহারি নাকি অনন্যা? আমি বিভোরকে জিজ্ঞেস করলাম
“আচ্ছা আপনি কী উনার থেকে আনহারির খোঁজ নিয়ে পরবর্তীতে যোগাযোগ করেছিলেন?”
বিভোর হালকা গলায় বলল
“লিয়াকত জোহা বলেছিল আনহারি তার মায়ের সাথেই আছে। তবে আমার পড়াশোনা আর কিছু সমস্যাজনিত কারণে সে সময়টায় আমি ভীষণ বেকায়দায় পড়ে যাই। যার দরুণ আনহারির সাথে দেখা করার ইচ্ছাটা চলে যায়। দীর্ঘ কয়েকটা বছর পার হয়ে যায়। আমি সকল জটিলতা কাটিয়ে উঠি। আবারও আমার মনে আনহারিকে দেখার তীব্র আকাঙ্খা জাগে। তখন তার খোঁজ নিয়ে জানতে পারি সে লন্ডনে গিয়েছিল এম আর সিপি করার জন্য। তবে হঠাৎ করে তার একটা সমস্যা হয় সে পূর্বের সবকিছু ভুলে যেতে শুরু করে। তাই সে সমস্যার জন্য সে এম আর সি পি আর কমপ্লিট করতে পারে নি। সোজা চলে আসে লাবনী জোহার কাছে। আস্তে আস্তে লাবনী জোহার তত্ত্বাবধানে আনহারি একটু সুস্থ হয়। তবে হুট করে তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে ভীষণ প্যারা দিতে লাগল। সে যখন দেশে ছিল তিন বছর আগে আমি তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। পরিচয় দিয়েছি তবে সে আমাকে চিনতে পারে নি। হয়তো তার রোগের জন্য। এরপর তার মৃত্যু সংবাদও আমাকে বেশ ব্যহত করে। হঠাৎ করে আনহারি ফিরে আসায় আমার কাছে মনে হচ্ছিল হয়তো এটা অনন্যা। তাই সে সময়টায় পেইন্টিং পাঠিয়েছিলাম তোমাকে। আর অনন্যার মৃত্যুর ভারটাও আমি নিতে পারছিলাম না। জানি না কে ফিরে এসেছে আনহারি নাকি অনন্যা। যতটুকুই আমি জানি, ততটুকুই বললাম।”
বিভোর একটু থেমে আরও বলল
“আরও কোনো তথ্য পেলে আমাকে জানিও প্লিজ। আমিও সবার মতো গুলিয়ে ফেলছি আনহারি নাকি অনন্যা কে বেঁচে আছে। লিয়াকত জোহার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। লাবনী জোহার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কঠোর নিরাপত্তার জন্য পারি নি৷ “
বিভোর একটা ফোন নম্বর দিয়ে চলে গেল। আমি চুপচাপ হাঁটছি আর ভাবছি এটা কী করে সম্ভব। লাবনী জোহা এবং লিয়াকত জোহার ভাষ্যমতে আনহারি তিন বছর আগেই দেশে এসেছিল। আর এক বছর দেশে থাকার পর তার এক্সিডেন্ট হয়। আর অফিসার মাহিদের ভাষ্যমতে আনহারি চার বছর যাবত দেশের বাইরে ছিল। তাহলে কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা? কী হচ্ছে এসব। একটা রহস্য ভেদ করতে গিয়ে আরেকটা রহস্যে তলিয়ে পড়ছি। এ রহস্য যেন আমাকে আবারও মাতাল করে তুলছে। আর লিয়াকত জোহা কী অনন্যার কথা জানে? সে কী জানে তার আরেকটি মেয়ে কতটা কষ্ট সহ্য করেছে?
এখনও কয়েকটা প্রশ্ন আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে বারো বছর আগে এবং দুই বছর আগে কার মৃত্যু হয়েছিল? কে ফিরে এসেছে? ফাতেমাকে কে হত্যা করেছে? আর দীপকের এতগুলো স্ত্রীকে সে কীভাবে হত্যা করে পার পেল? আর সবচেয়ে বিদ্ধস্ত প্রশ্ন হচ্ছে আনহারি কোথায়?
এর মধ্যেই অফিসার মাহিদ কল দিয়ে দ্রূত থানায় যেতে বললেন। আর কিছু বিস্তারিত বলল না। বাকি বিস্তারিত থানায় গেলে বলবেন। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। সে সাথে একটা ভয় চড়াও দিয়ে উঠল। আনহারির কিছু হয়নি তো?
নামসহ এবং নামছাড়া কোনো অবস্থায় কপি করা যাবে না।