“আরে দীপুর প্রথম বউ তো অনেক সুন্দর আর মর্ডান ছিল। যৌবন বয়সেই দীপু বিয়ে করেছিল। বড়োলোক ঘরের মেয়ে ছিল তার প্রথম বউ। দীপুদের সম পর্যায়েই তাদের অবস্থান ছিল। মেয়ে বেশ সুন্দর এবং লক্ষীও ছিল। সব মিলিয়ে মেয়ের গুণ,রুপ সামর্থ্যের কোনোটারেই অভাব ছিল না।
দীপুকে আমরা ভালোই জানতাম। ঢাকায় থাকত। বেশ শান্ত শিষ্ট স্বভাবের। ভাবীর কথায় উঠত বসত। মানে মায়ের বাধ্য ছেলে।
দীপুর প্রথম বিয়েটা অনেক ধুমধামে হয়। আমরা তো বেশ মজাও করি। নাচ গান করি। সাতদিন ধরে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়।
বিয়ের পর যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে যাই। হঠাৎ ছয় মাসের মাথায় শুনি দীপুর ডিভোর্স হয়ে গেছে। মেয়ে দীপুর নামে নারী নির্যাতনের মামলা করেছে। এর জন্য দীপু জেল ও খাটে। দীপু নাকি নেশা করত আর নেশা করে বউয়ের গায়ে হাত তুলত। এটা প্রথমে আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারিনি। কারণ দীপুকে ভাবীর বাধ্যগত সন্তান হিসেবেই জানতাম। ভেবেছি মেয়ের অন্যত্র সম্পর্ক তাই দীপুর নামে মিথ্যা মামলা করে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। এ বিশ্বাস থেকে আমরা দীপুর পক্ষ ধরেই কথা বলেছিলাম, স্টেটম্যানও দিয়েছিলাম। তবে মেয়ের পরিবারও প্রভাবশালী ছিল তাই ৬ মাস জেল খাটতে হয়েছে। আর মেয়েকে কাবিনের ২০ লাখ টাকাও বুঝিয়ে দিতে হয়েছে।
সে পর্যন্তই আমরা দীপুকেই সাপোর্ট দিয়ে গেছি। দীপুর জন্য আবার মেয়ে দেখা শুরু করলাম। এবার দীপুর মা বলল বড়োলোকের মেয়ে বিয়ে করাবে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে চায়। বড়োলোকের মেয়েদের পরকিয়া থাকে। অনেক বাজে স্বভাব থাকে। আগের বউ দিয়ে তারা সেটা বুঝেছে। তাই তারা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে চায়।
আমরাও সে মতে মেয়ে খোঁজা শুরু করলাম। এক সময় খুঁজে পেলাম আমার বোনের বান্ধবীর মেয়েকে। আমার বোনের বান্ধবীর মেয়ের নাম জুঁই। সে খুব সুন্দরীও ছিল আবার গুণীও ছিল। কাজকাম সব পারত। আর জ্ঞানী ও ছিল। তাদের কাছে আমার বোন প্রস্তাব নিয়ে যায়। এখন আমরা তো জানি দীপু একদম ভালো একটা ছেলে। তার নামে মিথ্যা অপবাদ দিছে। তাই আমরা দীপুর সাফাই গেয়েই মেয়ের মাকে রাজি করাই। দীপুর একটা দোষ ছিল সে ডিভোর্সি ছিল। তবে টাকা পয়সা কোনো কিছু কমতি ছিল না তাই এ দোষটাও তাদের কাছে ফিকে হয়ে গেছে। আর আমরাও সাপোর্ট দিচ্ছিলাম তাই রাজি ও হয়ে গেছে।
এবারও বিয়েটা ধুমধাম করেই হলো। এখন এবার কাহিনির মোড় নিল অন্যদিকে। বিয়ের পর থেকেই জুঁইয়ের মা বারবার আমাকে কল দিয়ে বলত দীপু নেশা করে। আমরা কেউ বিশ্বাসেই করতে পারছিলাম না। কারণ যে ছেলেকে একটা সিগারেট খায়তে দেখি নাই সে নেশা করবে এটা আশাও করতে পারি না। সব মিলিয়ে জুঁইয়ের মাকে আমরা এটা বুঝাতে লাগলাম তাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।
বেশিরভাগ সময় ফোনেই কথা হত। একদিন তারা তাদের বাসায় আমাকে দাওয়াত করে। আমি যাই। যাওয়ার পর তারা জুঁই এর শরীরটা খুলে দেখায়। পুরো শরীরে মাইরের দাগ ছোপ ছোপ হয়ে আছে। একটা ভিডিও দেখায় যেখানে সে নেশা করে আছে। সব মিলিয়ে আমরা তো পুরোপুরি হতবাক। তখন তো এনড্রয়েড ফোন এত এবাইলেবল ছিল না। ছোটো ফোন দিয়েই ১ মিনিটের ঝাপসা একটা ভিডিও করেছিল।
এবার তো আমরা বুঝতে পারি সমস্যা দীপুর। তাই ভাবীকে এসে বলি সমাধান করতে। ভাবী তার ছেলের পক্ষেই সাফাই গাওয়া শুরু করে। আমরা কতবার বুঝালাম এটা ঠিক না। উনি মানলেন না। এ নিয়ে আমাদের সাথে দীর্ঘদিন কথাও হয় নি।
এরপর জুঁই সইতে না পেরে এক পর্যায়ে বাপের বাড়িতে আত্মহত্যা করে। বাপের বাড়িতে আত্মহত্যা করায় দোষটা তার পরিবারের উপর চাঁপিয়ে দিয়েই দীপুরা হাফ ছেড়ে বাঁচে।
সেদিন বুঝেছিলাম অদিতির কথা মিথ্যা ছিল না। ওহ বলায় হয়নি দীপুর প্রথম স্ত্রীর নাম অদিতি ছিল বুঝছো? অদিতির মামলাও মিথ্যা না। অদিতির বাবার দাপট ছিল বলেই তারা দীপুকে একটু হলেও শায়েস্তা করতে পেরেছে।
এরপর দেখতে দেখতে ৫ বছর কেটে গেল। হঠাৎ করে এরা গ্রামে এসে থাকা শুরু করল। হুট করে দাওয়াত পেলাম দীপুর বিয়ে। বিয়ের অনুষ্ঠান এখানেই হবে। আমরা যেন আসি। আসলাম দাওয়াত খেতে। বুঝলাম তোমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না। তবে একটা কথা কী জানো দীপুর তিনটে বউ এই অনেক সুন্দরী। আগের দুজনও সুন্দরী ছিল তুমি সুন্দরী। কথাটা বলে একটু হেসে পাশে থাকা উনার জা কে বলে উঠলেন
“তাই না ভাবী? ঠিক বলেছি না?”
তিনি একটু হেসে উত্তর দিলেন
“হ্যাঁ ঠিক। তবে দীপুর এ বউ টিকবে তো। বিয়ের প্রথম রাতেই এত গায়ে হাত তুলল৷ এ বউ থাকবে তো?”
“আরে থাকবে না কেন? এজন্যই তো হতদরিদ্র বিয়ে করিয়েছে যাতে করে সহ্য করে পড়ে থাকে।”
কথাটা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
“তোমার নামের সাথে রূপের অনেক মিল। তুমি কী জানতে না দীপুর আরও বিয়ে হয়েছে? না জানলে তো তোমাকে বলা ঠিক হয়নি৷ তোমার শ্বাশুড়ি জানলে তো আবারও আমাদের সাথে কলহ বাঁধাবে।”
আমার বুকে যেন বড়ো পাথর চেপে বসেছে। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম
“আমি এগুলো কিছুই জানতাম না। আমি পড়াশোনা করতে চাই। যত মাইর গুতা আমাকে দিক না কেন আমি পড়তে চাই। এগুলো বলেছেন আমি তাদের বলব না। আমাকে শুধু পড়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে যাইয়েন৷ আমাকে যেন পড়তে দেয় এতটুকু বুঝিয়ে যাবেন।”
চাচী শ্বাশুড়ি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
“কত দূর পড়েছো তুমি?”
আমি কাঁদতে কাঁদতেই উত্তর দিলাম
“ঢাকা ভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে চান্স পেয়ে ভর্তি হয়েছিলাম সবে।”
তারা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বলল
“তোমার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ ছিল। তোমার বাবা, মা তো একটু অপেক্ষা করলেই আরও ভালো ছেলের কাছে বিয়ে দিতে পারত। দীপুর মতো ছেলের কাছে কেন?”
আমার কান্না আরও ভারী হয়ে গেল। আমার হেঁচকি উঠে কান্না আসতে লাগল। নাক, চোখ, মুখের পানি একাকার হতে লাগল। কেঁদেই উত্তর দিলাম
“টাকার কাছে সব হেরে যায়। বাবা মা ও টাকার কাছে পর হয়ে যায়। দুনিয়াটা টাকার গোলাম হয়ে গেছে। আমাকে একটু পড়ার সুযোগ দিতে বলবেন। এ অসহায়ত্ব কেবল আমার শিক্ষায় গুচাতে পারে। আমার ভেতরটায় হাহাকার করছে। আমি পারছি না কেবল চিৎকার করে কাঁদতে। আমাকে এভাবে ঠকানো হয়েছে আমি জানতাম না। আল্লাহর আরশ কী আমার চোখের পানিতে কাঁপছে না? আমার যন্ত্রণা কী আল্লাহর কাছে পৌঁছাচ্ছে না। আমার জীবনের সব আশার আলোয় থমকে গেল। আমি বাঁচব কী করে?”
তারা আমাকে স্বাত্ত্বণা দিতে লাগলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে থামালেন। তারপর আমাকে সাজালেন। বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরুও হয়ে গেল। অনেক লোক আসলো গেল। সবাই কত সুখী আনন্দিত একমাত্র আমিই কষ্টের দাবানলে পুড়ছি। এত বড়ো অন্যায় আমার সাথে করা হলো। নিজের বাবা মাকে বলে কী হবে? তারা তো আমাকে পর করেই দিয়েছে। বাঁচতে হলে হয়তো নিজের সাথে লড়াই করেই বাঁচতে হবে।
সারাদিন পার হয়ে রাত নামল। বাসার মেহমান সবাই চলে গেল। মুখরিত বাড়িটা নিস্তব হয়ে গেল। আমি হাত মুখ ধুয়ে কাপড় পাল্টে বিছানায় বসে আছি। ভেতরে আমার কেবল যন্ত্রণা গ্রাস করছে।
এমন সময় দীপক রুমে প্রবেশ করল। আজকে সে নেশা করে আসেনি। আমি বুঝতেছি না তার বিয়ের ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করব কিনা। অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম জিজ্ঞেস করব না। কারণ সত্যি হলেও আমার কিছু করার নেই এখানে। যে আগুনে পুড়তেছি সেটা নেভানো এত সহজলভ্য নয়।
এর মধ্যে দীপকের অশ্রাব্য কিছু কথা আমার কানে ধেয়ে আসলো। যা শুনে আমি হতবাক। মনে হচ্ছিল জীবনের এ পর্যায়ে এসে আমার মতো অসহায় আর কেউ নেই।
কপি করা নিষেধ।
চলবে?
শারমিন নিপা
শারমিন আক্তার