সামনের টেবিলে বসে থাকা মেয়েটার কথা শুনে বুঝতে পারলাম মেয়েটা বেশ আনাড়ি। ঢাকা শহরের জীবনযাত্রা সম্পর্কে তার সঠিক জ্ঞান নেই। নাহলে সামান্য সাড়ে সাত হাজার টাকার বেতনে কিভাবে সংসার বাঁধতে চায় ছেলেটার সাথে।
তবে মেয়েটার পাশে বসা ছেলেটাকে চতুর বলেই মনে হলো। সে সব হিসাব করে মেয়েটাকে বুঝাতে লাগলো। সে বললো,”এর আগে যে বাসায় সাবলেট দেখলাম সেখানে আর একটু জোড়াজুড়ি করলে মনে হয় তিন হাজার টাকায় দিয়ে দিবে। কিন্তু বাকি সাড়ে তিন হাজার টাকায় দুজন একমাস খেতে পারবো কিনা। চালডাল মিলিয়ে তিন হাজার টাকা পেরিয়ে যাবে। খুব ভালো কিছু খাওয়া হবে না হয়তো ভর্তা ভাত ছাড়া। মেয়েটা তখন ছেলেটার হাত ধরে বললো, আমিতো ভর্তা ভাত ই বেশি পছন্দ করি। তোমাকে না সব সময় বলতাম। আমার যেকোনো ভর্তা খুব ভালো লাগে। তুমি বেশি করে শুটকি আলু টমেটো আর টুকিটাকি কাঁচাবাজার কিনে রাখবা। দুজন মিলে ভর্তা ভাতে মাস কাটিয়ে দিবো।
ছেলেটা বললো, তবুও নতুন সংসার শুরু করতে যাচ্ছি। টুকটাক অনেক জিনিস কিনতে হবে। সে সব এর বেশির ভাগই অবশ্য আমার মেসে আছে। তবুও মাস চলতে আরও দু’তিন হাজার টাকা হলে ভালো হতো। দেখি অফিস শেষ করে সন্ধ্যায় কিছু করতে পারলে হয়তো অতিরিক্ত কিছু টাকা পাওয়া যাবে। তোমাকে এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি একটা ব্যবস্থা করে নিবো।
মেয়েটার মুখে স্পষ্ট অন্ধকার দেখতে পেলাম। আমার তখন চায়ের অর্ধেক বাকি। খুব আস্তে আস্তে হোটেলের বিশ্রী চায়ে চুমুক দিচ্ছি। পাশের টেবিলে বসে ওদের গল্প শুনতে ভালো লাগছিল বলে।
হঠাৎ কি ভেবে মেয়েটা যেন বলে উঠলো, আমি ভালো পিঠা বানাতে পারি। বাবা আমার হাতের পাটিসাপটা খুব পছন্দ করে। তুমি চাইলে সন্ধ্যার পরে তোমার অফিস শেষে বাসার সামনে বসতে পারো। তোমার মেসের সামনে কাল এক ভাইকে দেখলাম ভাপা পিঠা নিয়ে বসেছে। দিনে একশো টাকা লাভ এলেও মাস শেষে তিন হাজার টাকা। বোঝাই যায় মেয়েটার কন্ঠে গভীর আত্মবিশ্বাস।
ছেলেটা বললো, কিন্তু মানুষ যদি না খায়? মেয়েটা এবার খেকিয়ে উঠে বললে, আমার হাতের পিঠা যে একবার খাবে। তাকে অবশ্যই আবার পিঠা খেতে হবে। এটা নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। তুমি তাড়াতাড়ি খাবার শেষ করো। উনাকে কিছু এডভ্যান্স দিয়ে আসি। নাহলে বাসা পাবোনা।
অফিসের সময় হয়ে যাওয়ার কারণে সেদিন তাদের এসব কথার মাঝে উঠতে হয়েছিল। বাসে উঠে অনেকক্ষণ তাদের কথা ভাবলাম। আজ থেকে বারো বছর আগে আমিও একটা মেয়ের হাত ধরে এই শহরে এসেছিলাম। তারপর এ শহরের অলিতে-গলিতে নির্মম বাস্তবতার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। বাড়িওয়ালার ভাড়া জমে গিয়েছিল। পকেট ফাঁকা থাকার কারণে নিয়মিত বাসায় বাজার আসেনি। কতদিন শুধু ভাত আর আলু ভর্তা খেয়ে থেকেছি ইতি আর আমি। ভাবলে এখনো অবাক হই। অথচ আজ আমার সব হয়েছে। ভালো একটা চাকরি হয়েছে। মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে একটা ভালো বাসায় থাকছি। মেয়েকে ভালো স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। এসবের মূলে অবশ্য ইতির হাত। ওর আত্মবিশ্বাস ই আমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে। আজ কেন যেন মনে হলো মেয়েটার মধ্যে ইতির সেই আত্মবিশ্বাস দেখতে পেলাম।
অফিসের কাজের চাপে আর সংসারের নানা ব্যস্ততায় সেদিনের সে দুজন মানুষের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ ইতির ন্যাপকিন কিনতে গিয়ে বাসার সামনের ফার্মেসী থেকে দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে নতুন একটা পিঠার দোকান বসেছে। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ফার্মেসীর ছেলেটা বললো, নতুন দোকান ভাই। দু’দিন ধরে সন্ধ্যার পরে বসে। বিশ্বাস করবেন না ভাই। ঢাকা শহরে এত সুস্বাদু পাটিসাপটা পিঠা জীবনে খাই নাই। আর চুটকিপিঠার ত কথাই নেই! ফার্মেসীর কাজ শেষ করে এগিয়ে গেলাম সেই ছোট্টো পিঠার দোকানের দিকে।
একটা টেবিল আর কাঠের চেয়ার নিয়ে বসে আছে সেদিনের সেই ছেলেটা। মুখ হাস্যোজ্জ্বল। দেখলেই যেন মনে হয়ে বহুকালের পরিচয়। সেদিনের থেকে আরও আত্মবিশ্বাসী। খুব যত্ন করে একেকটা পিঠা সাজিয়ে রেখেছে। পুলিপিঠা, নকশিপিঠা, পাটিসাপটা থেকে শুরু করে চিতই, চন্দ্রপুলি, ফুলঝুরি খোলাদানী।কি নেই এখানে! টুকটাক ওর থেকে পিঠা সম্পর্কে জানতে চেয়ে একে একে কয়েক প্রকার পিঠা নিয়ে বাসার দিকে চললাম।
বাসায় এসে ইতির হাতে পিঠাগুলো দিয়ে আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলাম। মনে হলো সেই বারো বছর আগের পুরনো আমিকে দেখতে পেলাম। পকেটে সামান্য টাকা। আমার হাত শক্ত করে ধরে থাকা একটা মেয়ে। আর বুকভরা স্বপ্ন। কল্পনা ভাঙলো ইতির কথা শুনে। ও বললো, এতদিন বাসায় কত পিঠা করলাম। একদিন ও মুখে দিলে না। আজ এত পিঠে নিয়ে এসেছ যে। আমাকে বললে বাসাতেই বানিয়ে দিতাম।
ওকে বললাম, আজ অনেক পিঠা খেতে ইচ্ছে করছিল। তাই কিনে নিয়ে আসলাম। মনে মনে ভাবলাম, এখন থেকে প্রতিমাসে একবার ওর থেকে পিঠা কিনে নিয়ে আসবো।
জীবনযাত্রা
রিফাত আহমেদ