বৃষ্টিময় প্রেম .
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
পর্ব ১৭
ছাদের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি আমি, পাশেই রেলিঙ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ ভাইয়া। আমাকে ও পূর্ণ ভাইয়াকে বিয়ের ব্যাপারে একান্তে কথা বলতে ছাদে পাঠানো হলো। আমরা কথা বলার পরই বড়াব্বুরা চলে যাবেন। আমি আড়চোখে চেয়ে আছি উনার দিকে। তবে পূর্ণ ভাইয়ার দৃষ্টি আমার দিকে নয়, দূর আকাশে অস্ত যাওয়া সূর্যের দিকে।
পড়ন্ত সূর্যের রক্তিম আভা উনার ফর্সা মুখে আছড়ে পড়ছে, সূর্যের লালিমা ও উনার পুরুষালি সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে! সেদিকে নির্লজ্জের মতো নিষ্পলক চেয়ে আছি আমি। একটু পর হুশ ফিরতেই মনে মনে বকা দিলাম নিজেকে!
ভাগ্যিস উনি খেয়াল করেননি নয়তো কি ভাবতেন এভাবে উনার দিকে চেয়ে থাকার জন্য??
উনার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলা কেশে উনার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। উনি কিছু না বলেই এক পলক আমার দিকে চাইলেন। কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে উনি চেয়ে থাকায় অসস্তিতে পড়ে গেলাম আমি। মুখ অন্যদিক করে ধীর গলায় বললাম,
—আপনি নির্দ্বিধায় “না” বলতে পারেন, বুঝেছেন?
আমার কথা শুনে ভ্রু কুচকে গেলো উনার। দুই ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন কি বলছি। বিরক্তিতে চোখ কুচকে গেলো আমার। উনি কি জানেন না আমি কি বিষয়ে বলছি? নাকি ইচ্ছা করে আমার মুখ দিয়ে বিয়ের কথা উচ্চারণ করানোর জন্য এমন করছেন? বিয়ের কথা বলতে কি লজ্জা লাগেনা আমার? খুব খারাপ তো এই লোকটা!! আসলেই উনি কোনদিন ভালো হবেন নাহ।
—আপনি কি জানেন না আমি কোন বিষয়ে বলছি?
চোখ পাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম উনাকে।
—নাহ তো। আমি জানিনা। বলো আমাকে, কোন বিষয়ে কথা বলছো তুমি?
এবার মুখ খুললেন উনি। বাকা হেসে বললেন কথাটা। উনার হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলো। অনেককিছু বলতে যেয়েও বহুকস্টে নিজেকে থামিয়ে দাতে দাত চেপে উনাকে বললাম,
—দেখুন,, আপনি নিজেও জানেন আমি কোন বিষয়ে কথা বলছি। বড়াব্বু আমাদের দুইজনকে ভাবার জন্য সময় দিয়েছে কিন্তু আমরা দুজনই জানি আমাদের উত্তর কি। তাই আপনি ইজিলি মানা করে দিতে পারবেন। কোন ঝামেলাই আর হবেনা!
আমার কথা শুনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। এক কদম এক কদম করে এগিয়ে আসতে লাগলেন আমার দিকে। উনার এগিয়ে আসায় ভড়কে গেলাম আমি। তাল মিলিয়ে পিছাতে লাগলাম আমিও। অবশেষে রেলিঙের কাছে পৌঁছে যাওয়ায় থামতে হলো আমাকে! আমি ততক্ষণে ভ্রু কুচকে দেখছি উনাকে, উনি মনোযোগ দিয়ে দেখছেন আমাকে! তার মতিগতি বুঝার চেস্টা করছি আমি।
হঠাৎ একটু পর উনি আমার কাছে থেকে সরে গিয়ে চোখ টিপ মেরে ফিসফিস করে বললেন,
—দেখা হচ্ছে কাল।
বলে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হেটে চলে গেলেন নিচে। উনার কথার মাথামুণ্ডু বুঝলাম না আমি। কাল আমাদের দেখা হচ্ছে এটা তো আমি জানিই! কাল কাবিন হোক বা না হোক, আমি তো বড়াব্বুর বাসায় এমনিতেও যাবো সুতরাং এভাবে চোখ টিপ মেরে কথাটা বলার কি আছে আমি বুঝলাম নাহ। লোকটা আসলেই অদ্ভুত!! অবচেতন মনে হঠাৎ প্রশ্ন এলো উনি আবার বিয়েতে “হ্যাঁ” বলবেন না তো? অবশ্য পরক্ষণেই নিজের চিন্তাকে হেসে উড়িয়ে দিলাম আমি। চুপচাপ হেটে চলে গেলাম নিচে বড়াব্বুদের বিদায় দিতে!!
________________
গোমড়া মুখে বসে আছি মাটিতে। হাতের জামাকাপড় চারদিকে ছড়ানো-ছিটানো।
আন্টি একটু আগেই ফোনে কথা বলছিলেন বড়াম্মুর সাথে। পূর্ণ ভাইয়া নাকি উনার জবাব দিয়েছেন। যেহেতু আমি শিওর ছিলাম উনি না বলবেন তাই মনের সুখে ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম বড়াব্বুর বাসায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু আন্টির কাছ থেকে শুনলাম পূর্ণ ভাইয়া নাকি “হ্যাঁ” বলেছেন বিয়ের জন্য। এটা শুনেই আমার মাথা নস্ট হয়ে গেছে! উনি কিজন্য রাজি হলেন আমায় বিয়ে করতে? আশ্চর্য তো!
তখন লোকটাকে এতবার বললাম নির্দ্বিধায় না বলে দিতে কিন্তু উনি শেষ মুহুর্তে এসে পল্টি মারলেন কেন? ভালোই পল্টিবাজ তো লোকটা।
রাগে আমার গা রিরি করে উঠলো!!
আন্টি এসে আস্তে করে আমার পাশে বসলেন। আমার থমথমে মুখ দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
—তোর কি মন খারাপ? পূর্ণ বিয়েতে রাজি হয়েছে শুনে রাগ হচ্ছে তোর??
কিছু না বলে ছলছলে চোখে তাকিয়ে রইলাম আন্টির দিকে। উনি তা দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—দেখ মা, আমি জানি এই মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিতে তোর অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। হবেই না বা কেন? বিয়ের ব্যাপার, হুট করে সিদ্ধান্ত নেওয়াও যায়না। তবে তোর অভিভাবক হিসেবে আমি তোকে উপদেশ অবশ্যই দিতে পারি। কিছু কথা বলতে চাই। শুনবি?
আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। কারণ বাবা-মা যাওয়ার পর থেকে উনিই আমাকে মানুষ করেছেন। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সব ক্ষেত্রে ডিসিশন নেওয়ার সময় উনার মতামত দেওয়ার অধিকার আছে। আমি তাকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারিনা। শুনলাম আন্টি বলছেন,
—আমি পূর্ণকে আগে থেকে চিনিনা। তাই ওর সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারবোনা ঠিকি কিন্তু এই কয়দিনের পরিচয়ে আমার এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে ছেলেটা সত্যিই চমৎকার! বাহিরে থেকে ওকে গম্ভীর মনে হলেও ওর মনটা কত ভালো সেটা আমি সেদিনই টের পেয়েছি যেদিন তোকে আর রায়হানকে নিয়ে গুজব রটে! আমরা তোর চেনা মানুষেরাই যেখানেই ভাবতে পাচ্ছিলাম না কিভাবে কি করবো সেখানে ও নিজ দায়িত্বে ওর বোনের সাথে প্ল্যান করে তোকে নির্দোষ প্রমাণ করে। অচেনা এক মেয়ের জন্য কয়জনই বা এরকম করবে বল? পূর্ণ সেদিনই আমার মনে ধরেছিলো। এমন দায়িত্ববান আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন পুরুষের হাতে তোকে তুলে দিলে আমার আর কোন চিন্তা থাকবেনা। আমি নিশ্চিত থাকতে পারবো ও সারাজীবন তোর খেয়াল রাখবে।
আন্টির কথা শুনে থমকে গিয়েছি আমি। হঠাৎ করেই মনের মধ্যে ঘুরতে থাকা ঝড় যেন কিছুটা শান্ত হয়েছে। আমাকে উনার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে আন্টি পুনরায় বললেন,
—আর একটা কথা না বললেই নয়। রায়হানের সাথে যেহেতু তোর বিয়ের কথাটা উঠেছিলো তাই সেই বিষয়েও আমি বলবো। রায়হান আমার ছেলে হলেও আমি চাইনি ওর সাথে তোর বিয়ে হোক কেননা এই বাসায় আমার শাশুড়ির হুকুম ছাড়া কিছু হয়না। এতদিন বহু কস্টে তোকে উনার অত্যাচার থেকে আগলে রেখেছি আমি। এভাবে সারাজীবন রাখতে পারবো সেটার গ্যারান্টিও নেই। তাই আমি নিজেই চাই তুই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যা, যেখানে তুই নিজের মতো করে বাচতে পারবি। নিজের সংসার, নিজের পৃথিবী হবে তোর। তোকে ছাড়া থাকতে কস্ট হলেও তোর বাকি জীবনের খুশির জন্য হাসিমুখে আমি তোকে এ বাসা থেকে বিদায় জানাতে চাই। আমি চাই আমার এ মেয়েটা আজীবন খুশি থাকুক!!
ছলছলে চোখে বলা আন্টির কথাগুলো আমার ভেতরকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আসলেই উনি খুব ভালোবাসেন আমায়, একদম নিজের মেয়ের মতোই। এজন্যই এতকিছু বললেন। আন্টির প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসায় ছেয়ে গেলো আমার মন। উনি আমাকে ভাবার আরেকটু সময় নিয়ে চলে গেলেন। ঠান্ডা মাথায় ভেবে আমি আন্টির কথা মেনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমি পূর্ণ ভাইয়াকে বিয়ে করবো। জীবন যখন নতুন ধাপে প্রবেশ করার হাতছানি দিচ্ছে আমায় তখন আমার এক কদম আগে বাড়াতে দোষ কোথায়? আল্লাহর নাম নিয়ে আমিও “হ্যাঁ” বলে দিলাম বিয়েতে। এখন যা হবার তা দেখা যাবে ভবিষ্যতে!!
_________________
চোখের পলকে রাত পেরিয়ে দিন হয়ে গেলো। বিয়ের চিন্তায় বলতে গেলে নির্ঘুম রাতই কাটিয়েছি আমি এক প্রকার। ৮টা বাজতেক ডাক দিলেন আন্টি আমাকে। সকাল সকাল গোসল করে ফ্রেশ হতে বললেন। এক প্রকার পুতুলের মতোই সবকিছু করলাম আমি। একেবারেই ঘরোয়া আয়োজনে কাবিন হবে বলে বেশি কেউ নেই বাসায়। রায়হান ভাইয়াও নাকি অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে চলে গেছেন সকালবেলাই। অবশ্য উনি সত্যিই অফিসের কাজে গেছেন নাকি অন্য কারণে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না কারণ উনার ছুটি আরও বাকি ছিলো যতদূর জানতাম। যাইহোক এখন এসব ভাবার সময় নেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আমি।
কিছুক্ষণ পরই বড়াব্বুর বাসা থেকে বড়াম্মু এসেছেন আমার জন্য শাড়ি নিয়ে। আমার আম্মুর বিয়ের শাড়ি নাকি ছিলো উনার কাছে, সেটা নিয়েই আসছেন আমার জন্য। মায়ের শাড়ি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ বুকের সাথে চেপে ধরে রাখলাম আমি, যেন আনমনেই মা-কে অনুভব করার প্রচেষ্টা। বড়াম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন উনি খুব খুশি হয়েছেন আমার সিদ্ধান্তে, বাসার সবাইও নাকি খুব খুশি! উনার বড়ছেলের অবশেষে বিয়ে হবে এই আনন্দে উনি নাকি ঘুমাতে পারেননি গতকাল! আমি আলতো হাসলাম উনার কথা শুনে। আমাকে ভালো করে নতুন বউয়ের মতো রেডি হতে বলে চলে গেলেন বড়াম্মু।
আন্টি নিজহাতে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে তার মনের মতো করে সাজালেন আমাকে। এরপর থুতনি ধরে চুমু খেয়ে মাশাল্লাহ বললেন। আয়নায় নিজেকে বধুরুপে দেখে নিজেই চমকে গেলাম আমি। বেশ খানিকটা লজ্জাও লাগলো। বেশ ভালোই লাগছে দেখতে আমায়!
একটু পরই পূর্ণ ভাইয়ারা আসবেন। উনার আসার কথা ভেবেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেলো আমার। সত্যিই তার সাথে আমার বিয়ে হচ্ছে?? মনে পড়ে গেলো আমাদের বৃষ্টিতে প্রথম দেখা হওয়ার মুহুর্ত, আমাদের ঝগড়াগুলো, উনার আড়াল থেকে আমাকে সাহায্য করা। সময় কত দ্রুত চলে যায়!!
কিছুদিন আগেই উনার সাথে পরিচয় হলো আর খানিকক্ষণ বাদে আমাদের বিয়ে?? কি থেকে কি হয়ে গেলো, কখনো কি ভেবেছিলাম আমি?
ধুকধুক করতে থাকা হৃদয়ে বড়াব্বুদের আসার অপেক্ষা করতে লাগলাম আমি!!
#চলবে
.