বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ১৮
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
“বরপক্ষ এসে গেছে” তিন শব্দের কথাটিই আমার মনে শিহরণ জাগানোর জন্য যথেষ্ট ছিলো! ঠান্ডা হাত-পা যেন আরেকটু গুটিয়ে গেলো আমার! মাথা নিচু করে নিজরুমে চুপচাপ বসে আছি। একটু পরই রুমে প্রবেশ করলো রাইসা। এসেই আমার পাশে দাঁড়িয়ে মুখটা তুলে দাত কেলিয়ে মাশাল্লাহ বললো। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,
—এত দেরি করে আসলি কেন তুই? বিয়ে হতে না হতেই তো আমাকে ভুলে গেছিস!!
—সরি তুর সোনা, তুই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিস শুনে আমি কাল রাতেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোর ভাইয়া আসতে দেয়নি! পরে আমিও ভাবলাম এখন তো আমি ছেলেপক্ষের তাই আজকেই এলাম। আমি এখন তোর বোন না, তোর হবু জা। বুঝেছিস? সম্মানের সাথে কথা বল আমার সাথে!
ওর কথা বলার ধরন দেখে হেসে ফেললাম আমি! আমার হাসি দেখে রাইসা বললো,
—জানিস তুরফা, আমার না বিশ্বাসই হচ্ছেনা তুই আর আমি একি ঘরের বউ হয়ে থাকবো! আমি সবসময় এটাই চাইতাম যেন আমরা দুজন আলাদা না হই আর এখন এটা সত্যি হতে দেখে আমি এক্সাইটমেন্টে থাকতে পাচ্ছিনা!! আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো পূর্ণ ভাইয়া বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন?? ওহ মাই গড!! আমি জাস্ট ভাবতে পাচ্ছিনা এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভব হয়ে গেলো?? সত্যি করে বল তো, তুই কোন জাদুটোনা করিস নি তো পূর্ণ ভাইয়ার উপর??
ওর কথা শুনে আমি চোখ পাকিয়ে তাকালাম ওর দিকে। ও ভেটকি হাসি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমিও আর কিছু বললাম নাহ! আমরা দুজন কিছুক্ষণ গল্প করার মধ্যেই আন্টি এলেন। এসেই বললেন,
—বরপক্ষ এসে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তুরফাকে নিয়ে বের হতে হবে। আর তুরফা, তুই কি এখনও খাবিনা? সকাল থেকে খাওয়ার কথা বলছি কিন্তু তোর খাওয়ার নাম-গন্ধই নেই! কাল রাত থেকে কিছু খাসনি। এভাবে চললে হবে? দেখা যাচ্ছে বিয়ের আসরেই অজ্ঞান হয়ে যাবি!
রেগে বললেন আন্টি।
—ওফফো আন্টি তুমিও কিসব বলছো? আমি কি সিরিয়ালের নায়িকা যে একদিন না খেলেই অজ্ঞান হয়ে যাবো?
হেসে বললাম আমি কিন্তু আন্টি চোখ পাকিয়ে তাকালেন আমার দিকে তাই নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,
—আমার প্রচন্ড নার্ভাস লাগছে আন্টি। একটুও খেতে মন চাচ্ছেনা। কেমন যেন বমি বমি লাগছে, খুব অসস্তি হচ্ছে মনের ভেতর।
আন্টি এবার একটু নরম হয়ে গেলেন। আমার পাশে বসে গালে হাত রেখে বললেন,
—দেখ মা, বিয়ের আগে এটা হওয়া খুব স্বাভাবিক। সব মেয়েরই এমন লাগে। তাই তোরও লাগছে। চিন্তা করিস না, ঠিক হয়ে যাবে।
আন্টি আর কিছু বলার আগেই আংকেল নক করে রুমে আসলেন। উনি এসেই বললেন
—কি করছো তোমরা?? বাহিরে ছেলেপক্ষরা সবাই আছে। কাজি সাহেবও এসে গেছেন। তাড়াতাড়ি তুরফাকে নিয়ে এসো।
আংকেলের কথা শুনে উনার সাথে বের হয়ে গেলেন আন্টি। তার পাচ মিনিট পর আমাকে নিয়ে বের হলো রাইসা। দুরুদুরু বুকে এগিয়ে চললাম আমি, নিজের নতুন জীবনের দিকে।
_________________
মেরুন রঙা পাঞ্জাবি পড়ে বসে আছেন সামনে পূর্ণ ভাইয়া। আড়চোখে এক পলকে উনাকে দেখে নিলাম আমি। যেহেতু বিয়েটা খুব সাদামাটাভাবে হচ্ছে তাই উনিও বেশ সাদামাটা লুকেই এসেছেন৷ কিন্তু এই সাদামাটা লুকেই উনাকে কি মারাত্মক লাগছে আনমনে ভাবলাম আমি! ব্রাশ করা চুলগুলো সামনের দিকে হালকা এলোমেলো, হাতের ঘড়িতে টাইম দেখছেন। এখন কিসের সময় দেখছেন? বিয়ে শেষ করেই আবার অফিস যাবেন নাকি? অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম আমি! অবশ্য উনার পক্ষে এটাও সম্ভব!!
এদিকে সামনে যে উনার হবু বউ বসে আছে সেদিকে কোন খেয়াল আছে উনার? আসলেই অনেক বোরিং একটা লোক। মুখ ফুলিয়ে ভাবলাম আমি!
পূর্ণ ভাইয়ার এক পাশে দাঁড়িয়ে প্রান্ত ভাইয়া, প্রিয়া। অন্যপাশে বড়াব্বু ও বড়াম্মু। তাদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম পূর্ণ ভাইয়া বাদে সবাই আমার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তারা কি দেখলো নাকি আমি উনার দিকে চেয়েছিলাম? ইয়া আল্লাহ! ছিঃ ছিঃ!!
তাদের হাসিতে লজ্জায় আরও বেশি অসস্তিতে পড়ছি আমি। একেতো কিছু না খাওয়ায় মাথা এমনিই ঘুরছিলো, এখন লজ্জায়-অসস্তিতে যেন আরও ভনভন করছে মাথার ভেতর আমার!
এদিকে কাজি সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু সেদিকে আমার খেয়াল নেই, মাথার উপর ফ্যান থাকা সত্বেও ক্রমাগত ঘেমেই চলেছি আমি। তখন আন্টিকে খাওয়ার কথা হেসে উড়িয়ে দিলেও এখন সত্যিই শরীর খারাপ লাগছে আমার!! ইশ একটু খেতে পারলে ভালো লাগতো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাইসার হাত শক্ত করে চেপে ধরলাম আমি। ও কাধে হাত দিয়ে সাহস দিচ্ছে আমায়। বেচারি বুঝতে পাচ্ছেনা আমার শরীর খারাপ লাগছে, হয়তো ও মনে করছে আমি নার্ভাস তাই সান্ত্বনা দিচ্ছে ওভাবে। এদিকে ক্ষুধায় আমার পেটের মধ্যে রীতিমতো মহাভারত শুরু হয়ে গেছে!! কিন্তু এখন কাউকে খাওয়ার কথা বলাও যাবেনা কারণ, কানে এলো কাজি সাহেব এতক্ষণে আমাকে কবুল বলার জন্য জিজ্ঞেসও করেছেন।
“কবুল” শব্দটা শুনেই গলার মধ্যে শব্দগুলো দলা পেকে গেলো ছোট্ট একটা শব্দ অথচ তার কত জোর!! কোনমতে নিঃশ্বাস নিয়ে ধীর গলায় বলে ফেললাম “কবুল”। এক এক করে তিনবার কবুল বলে পিছনের দিকে গা এলিয়ে দিলাম আমি। আন্টি এসে ধরলেন আমায়। উনার সাথে ঠেশ দিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম আমি। একটু পর পূর্ণ ভাইয়ার রাশভারি আওয়াজে “কবুল” শুনে বুকের ভেতর ধক করে উঠলো আমার। কাজি সাহেবের মুখে “বিয়ে হয়ে গেছে” শুনে মনের মধ্যে শিহরণ বয়ে গেলো আমার! সবার মুখে “আলহামদুলিল্লাহ” ধ্বনি শুনে রন্ধ্রে রন্ধ্রে কম্পন উঠলো!
আমি ও পূর্ণ ভাইয়া এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী?
এত দ্রুত ঘটে গেলো ব্যাপারটা যে বিস্ময়তার রেশ লেগে আছে আমার চোখে-মুখে।
এদিকে মন বলছে আমার এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বিদায়-ঘন্টা বাজছে!!
______________
গাড়িতে বসে আছি জানালার পাশে, সব ফর্মালিটিজ শেষ, এখন চলে যাওয়ার পালা। বাহিরে আন্টি কেদে কেদে পূর্ণ ভাইয়ার হাত ধরে বারবার আমার খেয়াল রাখার জন্য বলছেন যা বুঝতে পাচ্ছি দূর থেকে। তবে উনি কি বলছেন তার উলটোদিক হয়ে থাকার কারণে আমি বুঝতে পাচ্ছিনা। এদিকে আয়নায় নিজের শুকনো মুখ আর চোখের নিচের লেপ্টে যাওয়া কাজল দেখে ভাবলাম, জীবন কতটা চমকপ্রদ! সারাজীবন ভেবেছিলাম যেদিন আমি নিজের পরিবার ফিরে পাবো সেদিন নাচতে নাচতে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। অথচ আজ নাচতে নাচতে দুরের কথা হাসতে হাসতেও যেতে পাচ্ছিনা। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় আন্টির অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকালেই যেন তার এত বছরের ভালোবাসার কথা মনে পড়ে বারবার আবেগপ্রবণ হয়ে যাচ্ছি আমি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আসলেই উনাকে বড্ড মিস করবো আমি!
আমার চিন্তাভাবনার মধ্যেই পূর্ণ ভাইয়া এসে গাড়িতে বসলেন আমার পাশে। আমাকে পূর্ণ ভাইয়ার গাড়িতে বসিয়ে বড়াব্বুরা সবাই অন্য গাড়িতে করে যাচ্ছেন। ওই গাড়ি ড্রাইভ করবেন প্রান্ত ভাইয়া আর আমাদের গাড়ি ড্রাইভ করছেন পূর্ণ ভাইয়া।
এতক্ষণ যাবত বসে আছে অথচ উনি কিছু বলছেন না। প্রচন্ড বিরক্তিতে মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার, সেই সাথে চোখে ভর করছে রাজ্যের ঘুম। রেগে উনার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, আচ্ছা, লোকটা এত কম কথা বলে কেন? এতটা গম্ভীরতা আমার সহ্য হচ্ছেনা!! তবে আমি কিছু বলতে চেয়েও পরে ভাবলাম থাক না! উনার যদি আমার সাথে কথা না বলে থাকতে কোন অসুবিধে না হয় তাহলে আমিও কিছু বলবোনা! হুহ!
জানালা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে যাচ্ছিলাম এমন সময় গাড়ি হঠাৎ ব্রেক করায় ভড়কে গেলাম আমি। পাশে তাকিয়ে দেখি সিটবেল্ট খুলছেন পূর্ণ ভাইয়া। এই মাঝরাস্তায় উনি আবার কই যাবেন? আমাকে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছেন না তো? আমি তো একবার মাত্র গিয়েছি বড়াব্বুর বাসায়। রাস্তাও ঠিকমতো চিনিনা। আমি তাহলে কিভাবে যাবো?? তাই ভয়ে ভয়ে উনাকে বললাম,
—আমাকে ছেড়ে যেয়েন না, প্লিজ।
উনি গাড়ির দরজা খুলে আমার কথায় থেমে অবাক চোখে তাকালেন আমার দিকে। অতঃপর দরজা লাগিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন,
—হোয়াট?? কি বললে তুমি, আরেকবার বলো?
আমি আগেকার মতোই ধীর গলায় বললাম,
—আমাকে এই মাঝরাস্তায় ছেড়ে চলে যেয়েন না, প্লিজ। আমি সত্যিই রাস্তা চিনিনা ঠিকমতো।
—কিহ!! তুমি ভাবছো আমি তোমাকে এখানে গাড়িতে ফেলে রেখে একা বাসায় যাচ্ছি?
উনি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করলেন আমায়। আমি বোকার মতো মাথা নাড়লাম। পূর্ণ কিছুক্ষণ হতাশ দৃষ্টিতে আমাকে দেখে বললেন,
—কাকে বিয়ে করলাম আমি? সত্যিই তুমি আমার ধারণার চেয়েও বেশি স্টুপিড, তুরফা। তোমাকে গাড়িতে একা রেখে গেলে আমি বাসায় কিভাবে যাবো? আর গেলেও বাসায় যেয়ে সবাইকে আমি কি বলবো? ওহ গড!! ইউ আর রিয়েলি ক্রেজি!!
চোখ পাকিয়ে বললেন উনি। উনার কথায় প্রথমে অবাক হলাম আমি। তার কথায় লজিক আছে। তবে মাঝরাস্তায় আর কিজন্য গাড়ি থামাবেন আমি কিভাবে জানবো? উপরন্তু স্টুপিড বলায় আবারো রাগ হলো আমার। আমিও চোখ পাকিয়ে বললাম,
—তো এই মাঝপথে গাড়ি থামিয়েছেন কেন? আমি আর কি ভাববো? এমনিতেই তো কোন কথা বলছিলেন না এতক্ষণ, তাই আমি ভাবতেই পারি আপনি আমার সাথে থাকতে চাচ্ছেন না। এজন্যই ভেবেছিলাম আমায় ফেলে চলে যাচ্ছেন এখানে। আর কোন কারণ হবে গাড়ি থামানোর?
—সিরিয়াসলি? এই তোমার বুদ্ধি? আমি চুপ করে ছিলাম কারণ আমি এমনিতেও কম কথা বলি। আর তাছাড়াও তুমি কেদেকেটে ভুত হয়ে গেছো, এখন যে ঝগড়া করছো দেখতে পুরো পেত্নীর মতো লাগছে। ভয় পেয়ে কখন না জানি আমার হার্ট অ্যাটাক হয়!
উনার কথা শুনে রাগে বোম হয়ে গেলাম আমি। আমাকে একই সাথে ভূত-পেত্নী দুইটাই বানিয়ে দিলেন? এই লোকের সাথে আমি একটু আগে বিয়ে করেছি? নিজের কপালের উপর নিজেরই দুঃখ লাগছে এখন। কথাই বলবো না আমি তার সাথে আর! রেগে মুখ ফুলিয়ে চুপচাপ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলাম আমি। ভেবেছিলাম উনি হয়তো সরি-টরি কিছু বলবেন কিন্তু নাহ! উনি তো পূর্ণ ভাইয়া! আমাকে পাত্তা না দিয়েই গাড়ির দরজা খুলে বাইরে চলে গেলেন।
আড়চোখে উনার যাওয়ার দিকে অভিমানী চোখ চেয়ে রইলাম আমি!
লোকটা এমন করে কেন সবসময় আমার সাথে? আর এই মাঝরাস্তায়ও বা কি কাজ আছে উনার?? দরজা খুলার চেস্টা করে দেখলাম উনি লক করে রেখে গেছেন আমায়! আরেকদফা মেজাজ খারাপ হচ্ছে উনার উপর!! কি এমন করতে গিয়েছেন উনি?
হতাশ হয়ে গাড়ির সিটের সাথে হেলান দিয়ে ভাবতে লাগলাম আমি..!!
#চলবে
.
.