বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ২৬
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
গ্রামের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে সাই-সাই করে ছুটে চলছে গাড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দাদিবাড়ি পৌঁছে যাবো আমরা। গ্রামের খোলা পরিবেশ আর সবুজ ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে অনুভব করলাম নির্মল ঠান্ডা বাতাসের ছড়াছড়ি। সেই বাতাসকে পুরোপুরি উপভোগ করতে জানালার কাচ পুরোটুকুন নামিয়ে দিয়েছি আমি! বাতাসের তোড়ে আমার খোলা চুলগুলো উড়ে চলছে আপন গতিতে, এমনকি আমার কাছে সীমাবদ্ধ না থেকে ছুয়ে দিচ্ছে পূর্ণকেও! আড়চোখে উনার দিকে তাকালাম আমি। একমনে সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করছেন উনি। আমার চুলগুলো যে উনার চোখে-মুখে লেগে ডিস্টার্ব দিচ্ছে সেদিকে যেন কোন ভ্রুক্ষেপই নেই তার!!
লোকটা বড্ড চাপা! বিরক্ত হলেও তো বলবেনা। এজন্য আমি নিজে থেকেই চুলগুলো টেনে নিয়ে হাতখোপা করতে লাগলাম যাতে উনার সমস্যা না হয়। একমনে খোপা করতে করতেই উনার কণ্ঠ শুনতে পেলাম,
—কি ব্যাপার? চুল বাধছো কেন? খোলা চুলে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে?
উনার কথায় থতমত খেয়ে গেলাম আমি! খোলা চুলে থাকতে আবার আমার সমস্যা হবে কেন? উনার যাতে সমস্যা না হয় এজন্যই তো আমি চুল বাধছিলাম! অবাক হয়ে বললাম,
—আমার কেন সমস্যা হবে বলুন তো? চুলগুলো উড়ে গিয়ে তো আপনার চোখেমুখে বাজছিলো। আপনার যাতে ড্রাইভ করতে ডিস্টার্ব না হয় এজন্যই তো আমি চুল বাধছিলাম!
—আমি তোমাকে একবারও একবারো বলেছি আমার কোন ডিস্টার্ব হচ্ছে?
উনার শান্ত স্বরের প্রশ্ন শুনে আপনাআপনিই চোখ গেলো আমার তার দিকে! উনি গভীর চোখের চাহনী নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। তার প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারলাম নাহ! আসলেই উনি তো কিছু বলেননি!
চুলগুলো ছেড়ে চুপচাপ মুখ ফিরিয়ে নিলাম আমি। এবার উনিও সামনের দিকে তাকিয়ে পুনরায় ড্রাইভ করায় মনোযোগ দিলেন। দেখতে দেখতেই আমরা পৌঁছে গেলাম দাদিবাড়ি। উঠোনের পাশে খোলা জায়গায় আরেকটি গাড়ি দেখে বুঝলাম বড়াম্মুরা এসেছেন। পূর্ণ গাড়ি থেকে নেমে আমার জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিলেন। আমিও কথা না বলে বের হয়ে হাটতে শুরু করলাম ভেতরের দিকে। আচমকা হাতে টান পড়ায় পেছনে ফিরে তাকালাম আমি। পূর্ণ আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি দুই ভ্রু তুলে ইশারায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম “কি হয়েছে?”
পূর্ণ কোন জবাব না দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তারপর আলতো হাতে আমার শাড়ির আঁচলটুকু নিয়ে মাথায় বসিয়ে দিয়ে খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। আমি বিস্মিত নয়নে দেখছিলাম তাকে। উনি কয়েক মুহুর্ত আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখলেন।
—এবার ঠিক আছে। এখন একদম নতুন বউ লাগছে!!
হঠাৎ করেই আমার গাল টেনে দিয়ে বললেন উনি। এদিকে উনার কথায় আর কাজে লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করলো আমার গাল দুটো। মাথা নিচু করে রইলাম চুপচাপ। আমাকে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ কিঞ্চিৎ কেশে বললেন,
—কি ব্যাপার? এভাবে বাড়ির বাহিরে দাঁড়িয়ে সময় নস্ট করছো কেন? সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ভেতরে চলো।
বলেই আমার হাত ধরে হনহন করে হেটে চললেন বাড়ির ভেতর। এদিকে আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি উনার দিকে! আমি নাকি সময় নস্ট করছিলাম?? বলে কি! এই লোকটার মুড কেমন মিনিটে মিনিটে চেঞ্জ হয় যেটা আমার পক্ষে ভাবা দায়!!
______________
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করতেই একটি মধ্যবয়সী মহিলা আমাদের হাসিমুখে বরণ করলেন। আমাদের ভেতরে আসতে দিয়ে আমার গালে হাত রেখে বললেন,
—তুই আমাদের তুরফা? আমায় চিনেছিস? আমি তোর কাকি হই। এত্ত বড় হয়ে গেছিস, বুড়ি? সেই যে ছোট্ট থাকতে দেখেছিলাম তোকে। একদম পুতুলের মতো ছিলি।
—আর এখন দেখতে ভালো নেই, কাকিমা?
দুঃখী দুঃখী মুখে প্রশ্ন করলাম আমি। আমার কথায় কাকি উত্তর দেওয়ার আগেই পাশ থেকে পূর্ণ বিরবির করে বললেন,
—নাহ, এখন দেখতে পেত্নীর মতো লাগে।
উনার কথা শুনে রেগে চোখ পাকিয়ে তাকালাম তার দিকে। উনি সেটা দেখেও দেখলেন না এমন ভাব করলেন। কাকিমা হেসে বললেন,
—আরে পাগলি এখন তো দেখতে আরও সুন্দর হয়েছিস। এটাও আবার বলা লাগে?
কাকিমার কথায় হেসে ফেললাম আমি। এক এক করে ফুপি, চাচুদের সাথে পরিচয় হলো আমার। এতদিন পর পরিবারের এত্তজনকে সাথে পেয়ে আমি আবেগাপ্লুত হয়ে সবার সাথে কথা বলছি আর কুশল বিনিময় করছি। দাদি নামাজ পড়ছেন বিধায় এখনও আসেননি। বাকি সবাই জিজ্ঞেস করছেন কেমন ছিলাম এতদিন, কত মিস করেছে সবাই আমায়! একিসাথে তারা আমায় আদর করছেন, আমায় কত খুজেছে এগলো বলছেন! আমিও সেসব মনোযোগ দিয়ে শুনছি, তাদের আদর উপভোগ করছি আর সবার সাথে কথা বলছি।
আড়চোখে চোখ গেলো পূর্ণর উপর, যিনি পারতপক্ষে সোফায় বসে বসে প্রান্ত ভাইয়ার সাথে কথা বললেও উনার চোখ আমার দিকে। যেটা দেখে একিসাথে লজ্জা ও অসস্তিতে পড়লাম আমি! হয়েছেটা কি উনার? সবার সামনে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন লোকটা? কেউ দেখলে তো লজ্জায় আমাকেই পড়তে হবে!!
আমার ভাবনার মধ্যে চলে এলেন একজন বয়স্কা নারী। যাকে আমি না চিনেও এক দেখাতেই চিনে ফেলেছি। উনি হলেন আমার দাদি। উনাকে ধরে নিয়ে আসছিলেন বড়াম্মু। দাদি আমায় দেখেই কাদতে শুরু করলেন। আমায় দুহাতে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমোয় ভরে দিলেন আমার মুখ। এতদিন পর প্রিয়জনদের অঢেল ভালোবাসা পেয়ে চোখ দিয়ে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়লো আমার নিজেরও! যেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা দায়!
—আমার তুর, আমার বাচ্চাটা। আমার ছোটছেলের রেখে যাওয়া শেষ স্মৃতি। এতদিন কই ছিলি তুই? কত খুজেছে সবাই তোকে জানিস? যেদিন তোর বাপ-মা মরলো আর তুই হারায় গেছিলি সেদিন ছিলো আমাদের জন্য সবচেয়ে দুঃখের দিন। আর আজ তোকে ফিরে পেয়ে আমার চেয়ে খুশি কেউ নাই। আজ তোর খাতিরযত্নের কোন অভাব হবেনা। ওরে ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরেছে!! চল আমার সাথে।
বলেই দাদি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন খাবার-টেবিলে। এদিকে টেবিলভরা খাবার দেখে আমার মাথা ঘুরে উঠলো। এত্ত এত্ত রান্না করেছে সবাই আমার জন্য, এত খাতিরযত্ন, আদর-ভালোবাসা দিয়েছে এখানে সবাই আমায়। এমন দিন আমার কপালে আসবে এটা কি আমি ভেবেছিলাম কখনো? হয়তো এজন্যই সৃষ্টিকর্তা বলেছেন দুঃখের পরেই সুখ আছে। আজ নিজের পরিবারকে ফিরে পেয়ে এত বছরের দুঃখের কথা একবারো মনেও পড়ছেনা আমার!
খেতে যেয়ে বসলো আরেক বিপত্তি। দাদির নির্দেশে বড়াম্মু-কাকিমারা আমায় একটার পর একটা খাবার তুলে দিচ্ছেন আর আমি মানাও করতে পাচ্ছিনা। মনে হলো যেন খেতে খেতে বেহুশ হয়ে যাবো। ভাবখানা এমন যেন মেয়েআদর না, জামাইআদর হচ্ছে এখানে। এদিকে আমি পরিবারের ভালোবাসার স্রোতে হাবুডুবু খাচ্ছি, অপরদিকে সোফায় বসে আমার বেহাল দশায় মজা লুটে নিচ্ছেন প্রিয়া, প্রান্ত ভাইয়া, রাইসারা। আমি করুণ চোখে চেয়ে রইলাম তাদের দিকে। ঠিক তখনি পূর্ণ ভাইয়া এসে বললেন,
—কাহিনি কি দাদি? তোমার কি একটাই নাতি এসেছে নাকি বাসায়? আমাদেরকে চোখে পড়েনা?
পূর্ণর কথায় দাদি একগাল হেসে বললেন,
—তোরে চোখে পড়বেনা এমন সাধ্য কারও আছে, বাপজান? তুরফা বড় হওয়ার পর এই প্রথম গ্রামের বাড়িত আসছে, তোরা তো মাঝেমধ্যেই আসিস। এত বছর ওর খেয়াল রাখতে পারিনি, একদিনে তো পোষাতে পারবোনা। তাও আজ আমাদের মন ভরে ওর যত্ন করতে দে।
—সোজাসুজি বললেই পারো ভাইয়া যে তোমার তুরফার থেকে হিং/সা হচ্ছে।
প্রান্ত ভাইয়াও উঠে এসেছেন সোফা ছেড়ে ততক্ষণে। পূর্ণ রাগী দৃষ্টি নিক্ষে/প করলেন সেদিকে। প্রান্ত ভাইয়া সেটাকে পাত্তা না দিয়ে আমায় বললেন,
—জানো তুরফা, এতদিন দাদুবাসায় সব কাজিনরা এলেও ভাইয়া সবচেয়ে বেশি এটেনশন পেতো। সবচেয়ে বেশি খাতিরযত্ন ওরই হতো। আর আজকে তুমি সেটা নিয়ে নিলে। এজন্যই ভাইয়ের খুব হিং/সা হচ্ছে। জ্ব/লছে বড় ভাইয়া তোমার থেকে।
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় হেসে উঠলো সবাই। আমি খাচ্ছিলাম বিধায় কিছু বললাম না। মিটিমিটি হেসে শুনতে লাগলাম উনাদের কথা। পূর্ণ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
—আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই আমার যে তুরফার মতো পিচ্চির থেকে জ্ব/লবো। তোরা পারিসও বটে!
সবার সামনে পিচ্চি বলার রাগে গা জ্ব/লে গেলো আমার। মুখে খাবার নিয়েই চোখ পাকিয়ে তাকালাম উনার দিকে। বিনিময়ে পূর্ণ বাকা হাসি দিলেন। লোকটার ঢং দেখে বাচিনা। উনাকে ভেংচি কে/টে খাবার শেষ করে উঠলাম আমি। সবার সাথে গল্প-খু/নসুটি চলতে লাগলো আর অনেকক্ষণ!!
_______________
সন্ধ্যায় উঠোনে বসে আছি দাদির সাথে। শরতের বাতাস যেন গায়ে হিম ধরিয়ে দিচ্ছে কিছুটা। শরীরে-মাথায় ওড়না পেচিয়ে চুলোর কাছে বসে আছি আমি। বড়াম্মু-কাকিমা রা পিঠা বানাচ্ছে এক পাশে। অন্যপাশে আমি, রাইসা ও প্রিয়া বসে বসে দাদির গল্প শুনছি। বাহির থেকে ছেলেরা সবাই ফিরলো ঘরে। বিকেলে সবাই একসাথে বাজারের দিকে গিয়েছিলেন। পূর্ণ হাত-মুখ ধুয়ে আসতেই দাদি উনাকে বসার জন্য টুল দিলেন। উনি দাদির পাশে বসলেন, আমার মুখোমুখি। আড়চোখে চেয়ে রইলাম আমি উনার দিকে। আগুনের আলোয় চেহারায় অন্য সৌন্দর্য এসেছে সবার মধ্যে, আর আমার চোখ দুটো পূর্ণর দিকে আটকিয়ে। কেন হঠাৎ করে লোকটাকে এত ভালো লাগছে আমার??
আমার ভাবনাচ্ছে/দ হলো দাদির কথায়। পূর্ণর দিকে ঘুরে উনি বললেন,
—একটা কথা ভাবতেছিলাম, বাপজান। যদি তুমি রাজি থাকো তাইলে।
—কি কথা দাদি? বলে ফেলো।
—এতদিন পর তুরফা আমাদের কাছে আসছে। ওর সাথে মনভরে কথাই বলা হলোনা। আসলাই তো তোমরা দুইজন দুপুরে। তাই ভাবতেছিলাম রাতে তুরফা আমার সাথেই থাকবে। সব মেয়েরা একসাথে রাতভর গল্প করবো আমার রুমে। জানি নতুন নতুন বিয়ে তোদের, বর-বউরে আলাদা রাখা উচিত না। তাও মনে আসলো কথাটা এজন্য তোরে বললাম। তুই যা বলবি তাই হবে। এতে তোর কোন সমস্যা নাই তো?
পূর্ণর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা হঠাৎ করেই গম্ভীর হয়ে গেলো। আগুনের তাপে যে মুখটা উজ্জ্বল হয়েছিলো তাতে হঠাৎ করেই অন্ধকার নামলো! এদিকে দাদির কথায় থম মে/রে আড়চোখে উনার দিকে চেয়ে রইলাম আমি। দাদির মতো আমিও বসে রইলাম উনার উত্তর জানার অপেক্ষায়..!!
#চলবে
.
.