বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৪১
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
ইষৎ ফাঁকা রাস্তায় রিকশা ছুটে চলেছে নিজের মতো করে। ঢাকা শহরে জ্যামের অভাব না থাকলেও কাকতলীয়ভাবে আজকে রাস্তায় জ্যাম কম। রিকশায় উঠার পর থেকেই চুপচাপ বসে আছি দুজনে, কথা বলছে নীরবতা। সন্ধ্যাবেলায় যেন রাস্তাঘাটের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে, ঘরফেরা মানুষের কোলাহলে চারপাশ মুখোরিত থাকে। আশেপাশে সে-সব দেখতে দেখতে চলছি আমরা! চায়ের টং এ আড্ডা দিচ্ছে লোকজন, সুখ-দুঃখের গল্প হচ্ছে চায়ের কাপের সাথে, দোকানিরা ক্রেতা পেয়ে ব্যবসায় মত্ত, চারদিকে রমরমা অবস্থা। জামা, চুড়ি কতকিছুর দোকান একসাথে! ফুলের দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মৌ-মৌ গন্ধে মোহনীয় হয়ে আছে চারপাশ!
রঙ-বেরঙের ফুলের সমাহার মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখছি আমি। হঠাৎ মনে হলো এই মুহুর্তে এক তোড়া ফুল হাতে নিয়ে থাকলে নেহাৎ মন্দ হতো নাহ! আর কিছুদূর যেতেই পূর্ণ রিকশাওয়ালা মামাকে বললেন,
—মামা, রিকশাটা একটু সাইড করো তো।
উনার কথামতো রিকশা থামলো। আমরা রিকশা থেকে নামতেই পূর্ণ আমাকে একটা চুড়ির দোকানের সামনে নিয়ে গেলেন। চুড়িগুলোর দিক চেয়ে বললেন,
—দেখো তো কোন রং এরটা পছন্দ হচ্ছে?
—আমার জন্য?
—নাহ, আমার আরেকটা বউ আছে তার জন্য বলছিলাম। তোমার সতীনের জন্য পছন্দ করো।
আমি সরু চোখে তাকিয়ে উনার হাতে চিমটি দিলাম। পূর্ণ বাকা হেসে বললেন,
—হারি আপ, তুরফা। বাসায় যেতে হবে আমাদের। রিকশা দাড় করিয়ে রেখেছি তো!
আমি মাথা নাড়িয়ে চুড়িগুলো দেখতে লাগলাম। এরই মাঝে পূর্ণ কোথায় যেন গেলেন। আমি একজোড়া নীল চুড়ি হাতে পড়ে দেখছিলাম। তখনি পূর্ণ ফিরে এলেন। আমার হাতের দিকে তাকিয়ে মানিব্যাগ বের করতে করতে বললেন,
—পারফেক্ট। এটা মানিয়েছে তোমার হাতে। হাতে পড়েই থাকো, খুলো নাহ।
অতঃপর চুড়ির দোকানিকে দাম দিয়ে আমায় নিয়ে রিকশায় উঠলেন। আমি হাতের চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ কোমড়ে পূর্ণর স্পর্শে শিউরে উঠে উনার দিকে তাকালাম। উনি পকেট থেকে একটা গোলাপ বের করে আমার কানে গুজে দিতে দিতে বললেন,
—কোন কিছু ভালো লাগলে তুমি আমাকে বলোনা কেন? তোমার তো অধিকার আছে আমাকে বলার। সবসময় কেন আমাকেই নিজে থেকে বুঝে নিতে হবে? এরপর থেকে কোনকিছু নিতে মন চাইলে আমাকে সরাসরি বলবে, ঠিক আছে?
উনার ভারী কন্ঠে তার দিকে আড়চোখে তাকালাম আমি। পূর্ণ কান থেকে হাত সরিয়ে ভ্রু তুলে বললেন “কি?” আমি মাথা নেড়ে বললাম “কিছু না”। এরপর আর কোন কথা হলোনা আমাদের। মিনিট পাচেকের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে গেলাম। রিকশা থেকে নেমে বাসায় ঢুকবো এমন সময় পূর্ণ পেছন থেকে বললেন,
—ভাবছিলাম যে কোন ফুলটা বেশি সুন্দর, বলো তো? তোমার গোলাপ না আমার গোলাপ?
উনার প্রশ্নে থমকে দাড়ালাম আমি। পেছনে ঘুরতেই চোখে পড়লো তার মুখের স্নিগ্ধ হাসি। যে হাসিতে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা দায়!
_______________
বাসায় প্রবেশের পরই চুড়ি আর ফুল দেখে হইহই করছে রাইসা আর প্রিয়া। এমনকি ওদের সাথে যোগ দিয়েছেন প্রান্ত ভাইয়াও! কেউ আমাকে ক্ষেপাতে বাকি রইলোনা, বড়াম্মু শুধু মিটমিটিয়ে হাসছিলেন। এদিকে আমি লজ্জায় শেষ আর পূর্ণ দিব্যি নির্বিকারভাবে ফ্রেশ হতে চলে গেলেন উনার গম্ভীর মুখখানা প্রদর্শন করে। ভাবখানা এমন যেন এখানে কি হচ্ছে উনি কিছুই জানেন নাহ! রাইসা আমার দিকে ভ্রু তুলে জিজ্ঞেস করলো,
—জল গড়িয়ে তাহলে এতদূর গিয়েছে আর আমি জানলামও নাহ?
—চুপ কর। এখনো তেমন কিছুই হয়নি।
—তা তো দেখতেই পাচ্ছি বেবি। আর কিছু হওয়া বাকি আছে কই?
আমি রাইসার দিক চোখ পাকিয়ে তাকাতেই ও হেসে মুখ বন্ধ করলো। এদিকে প্রিয়া উদাসী মুখ করে বললো,
—আজ আমার জামাই নেই বলে কেউ এভাবে চুড়ি, গোলাপ গিফট করেনা! জীবনটাই কস্টের!!
ওর রিয়েকশন দেখে হেসে ফেললো সবাই। প্রান্ত ভাইয়া প্রিয়ার মাথায় গাট্টি মেরে বললেন,
—তাই না? খুব শখ হয়েছে তোর বিয়ে করার? দাড়া আজকেই বাবাকে বলছি তোর জন্য পাত্র খুজতে!
—পাত্র তো খুজেই ফেলেছি, ভাইয়া। বিয়ে হওয়াটাই বাকি এখন।
বিরবিরিয়ে বললো প্রিয়া। প্রান্ত ভাইয়া ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলেন,
—কি বললি? স্পষ্ট করে বল। বুঝিনি।
—কিছু নাহ৷ এখন বুঝা লাগবেনা তোমার। যাকে বুঝা দরকার তাকেই এখনো বুঝাতে পারিনি তোমায় আর কি বুঝাবো!
প্রিয়ার কথায় হতাশ দৃষ্টিতে তাকালেন প্রান্ত ভাইয়া। উনার মুখ দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে তিনি কিছুই বুঝেননি। অবশ্য উনি একা নাহ, আমরা কেউই বুঝলাম নাহ প্রিয়ার কথার অর্থ। মেয়েটা কেমন জানি অদ্ভুত কথাবার্তা বলছে আন্টির বাসায় থেকে আসার পর থেকে!
প্রান্ত-প্রিয়ার খুনসুটির মধ্যেই কিছুক্ষণ পর পূর্ণ এসে প্রিয়ার পাশে বসে ওর দিকে নিজের কার্ড এগিয়ে দিয়ে রাশভারি বললেন,
—এই নে। যা মন চায় শপিং করিস কাল। এরপর থেকে আর কখনো বলবিনা তোর কেউ নেই। যতদিন না তোর বিয়ে হচ্ছে তোর সমস্ত শখ-আহ্লাদ পূরণ করার জন্য তোর বড় ভাই এখনও জীবিত আছে। কথাটা সবসময় মাথায় রাখবি৷
—ইয়েএএএ! থ্যাংক ইউ, বড় ভাইয়া। তুমি দিন দিন আরও সুইট হয়ে যাচ্ছো। লাভ ইউ।
পূর্ণকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো প্রিয়া। পূর্ণও হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রান্ত সেদিকে চেয়ে বললেন,
—হ্যা হ্যাঁ, এখন তো বড় ভাইয়াকেই তোর সুইট লাগবে। এরপর কোনকিছু কিনতে হলে আমার কাছে টাকা চাস। আমিও সোজা বড় ভাইয়ার কাছেই পাঠিয়ে দেব।
প্রিয়া তার দিকে ভেংচি দিয়ে বললো,
—আর কিছু চাবোনা তোমার কাছে। তুমি সবসময় আমাকে ক্ষেপাও। আমি বড়ভাইয়ার কাছেই চাবো এরপর থেকে। তুমি ভালো নাহ।
—আচ্ছা? আমি তো ভালো নাহ, ভালো নিয়াই থাক তুই। দেখবোনি কতদিন এমন থাকিস।
ব্যস! পুনরায় শুরু হয়ে গেল ভাইবোনদের টকঝাল ঝগড়া। সেদিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি আর রাইসা। কত মজা লাগে এমন দৃশ্য দেখতে! রাইসার তো তাও একটা ভাই আছে। আচ্ছা ওর কি মনে পড়ছে রায়হান ভাইয়ার কথা? মনের প্রশ্নটা মুখে করেই ফেললাম। রাইসাকে বললাম,
—রায়হান ভাইয়ের কথা মনে পড়ছে?
রাইসা হালকা হেসে মাথা নাড়লো। আমি ওর কাধে হাত রেখে বললাম,
—সমস্যা নেই। শীঘ্রই দেখা হবে ভাইয়ার সাথে। আমরা আবার আন্টির বাসায় যাবো।
—আম্মুর বাসায় যাওয়ার দরকার নেই। কালকে এমনিতেও ভাইয়ার সাথে দেখা হবে।
হেসে বললো রাইসা। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—কাল দেখা হবে মানে? রায়হান ভাই এখানে আসবেন নাকি?
—নাহ। তবে কাল একটা পার্টি আছে প্রান্তদের অফিসের। অনুষ্ঠানে অন্য কোম্পানির মানুষদেরও ইনভাইট করা হয়েছে, ভাইয়াও যাবে।
—ওয়াও। তাহলে তো ভালোই। এটা তুই জানলি কিভাবে? প্রান্ত ভাইয়া বলেছে?
—হ্যাঁ, প্রিয়াও জানে। ওই-ও যেতে চাইছে কাল। প্রান্ত প্রথমে রাজি না হলেও পরে প্রিয়ার জিদের কারণে রাজি হয়েছেন। ওর জন্য তোকে আর আমাকেও যেতে হবে পার্টিতে!
—বাহ! এত কিছু হয়ে গেলো, তোরা সবাই জানতি অথচ পূর্ণ আমাকে কিছুই বলেন নি এ ব্যাপারে।
গোমড়া মুখে বললাম আমি। সবাই জানে অথচ পূর্ণ আমাকে জানালেন না একবারও। হুহ! আড়চোখে উনার দিকে তাকাতেই আমাকে চোখ টিপ মারলেন পূর্ণ। থতমত খেয়ে গেলাম আমি। উনার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে প্রিয়ার দিকে তাকাতেই ওর হাসোজ্জল চেহারা চোখে পড়লো! মেয়েটাকে বেশ খুশি খুশি দেখাচ্ছে। তবে এই খুশির আসল কারণ কি? ওর এমন পরিবর্তিত আচরণেরই বা কারণ কি? জানার আগ্রহ বেড়ে চললো মনে!
#চলবে
.