বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৫৩
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
জানালা দিয়ে হিম বায়ু প্রবেশ করতেই শিউরে উঠলো শরীর। চোখ খুলে নিজের পুরোনো রুম দেখে মনে পড়লো সবকিছু! দেয়ালঘড়িতে সময় দেখলাম বিকেল ৪.৩০ টা বাজতে চলেছে। মুখ ধুয়ে নিচে আসতেই আন্টি এগিয়ে এলেন আমায় দেখে। তাড়া দিয়ে বললেন,
—উঠেছিস? যাক ভালো হয়েছে। একটু রান্নাঘরে আয় না। নাস্তা বানানো বাকি আছে কিছু, বেয়াইনরা আসছেন বিয়ের কথা বলতে।
—কে কে আসছে আন্টি?
কৌতুহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম। উত্তরে কার কথা জানতে চাইছি বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলোনা আন্টির। মুখ টিপে হেসে বললেন,
—জামাইও আসছে শুনলাম। সবার আসার কথাই তো বললো বেয়াইন।
ধরা পড়ে খানিকটা ইতস্ততবোধ করলাম, হালকা হেসে চলে গেলাম রান্নাঘরে। আন্টির কাজে হেল্প করে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম রুমে। এরই মধ্যে এসে পড়লেন সবাই। নিচে নামতেই চোখে পড়লো রাইসাকে। ওর সাথে বসার রুমে ঢুকতে বাকি সবাই নজরে এলো। পূর্ণ, প্রান্ত, বড়াব্বু সবাই ফর্মাল লুকে। বাপ-বেটা সবাই সরাসরি অফিস থেকেই যে এখানে এসেছেন বেশ বুঝলাম। নাস্তার সাথে সাথেই আলোচনা চললো বিয়ের। আন্টিদের বাসায়ও কারো আপত্তি নেই সামনের সপ্তাহে অনুষ্ঠান করায়। বেশ খুশিমনেই রাজি হলেন উনারা, যেন প্রস্তুতই ছিলেন যেকোন দিন এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য! সব আয়োজনের দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেলো।
পূর্ণ বাকি সবার সাথে টুকটাক কথা বলছেন। আমি তার দিক তাকাতেই চোখ ফিরে নিলেন। এমন ভাব করলেন যেন এতক্ষণ দেখেই নি আমায়! ভ্রু কুচকে সেদিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম আমি। নিজেও আর তাকালাম না তার দিকে!
যথারীতি সমস্ত কথাবার্তা শেষে ডিনারের উদ্দেশ্যে সবাই খেতে বসলো টেবিলে। একপাশে খাবার সার্ভ করে পূর্ণর পাশের খালি চেয়ারে বসে পড়লাম আমি। আন্টি বড়াম্মুর সাথে কথা বলতে বলতে আমার প্লেটে খাবার দিচ্ছিলেন, আমিও সেসব শুনছিলাম। কথার ছলে আন্টি আমার প্লেটে গরুর মাংস তুলে দিয়েছেন, আমিও কথার ছলে ভাত মাখিয়ে মুখে দিবো এমন সময় পূর্ণ বললেন,
—এটা খেয়োনা। তোমার না গরুর মাংসে এলার্জি?
এতক্ষণ পর হঠাৎ পূর্ণর কথায় থেমে গেলাম আমি, চকিত দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকালাম। তিনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন। তার কথায় বাকি সবারও দৃষ্টি আমাদের দিকে এসে গেছে। আমার প্লেটে তাকিয়ে আন্টি জিব কেটে বললেন,
—আরেহ, তোর প্লেটে মুরগি না দিয়ে গরু দিয়েছি? আমি তো খেয়ালই করিনি। তুইও কি দেখবিনা?
—আমিও তো কথাই বলছিলাম, আন্টি। তোমার মতো আমিও টের পাইনি।
আমতা আমতা করে বললাম। আমার মুখোমুখি বসে ছিলেন দাদি। উনি যেন সুযোগ পেয়ে গেলেন আমাকে খোটা দেওয়ার। তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
—তুরফা আবার কোন জীবনে মনোযোগী ছিলো? ও তো সবসময়ই খামখেয়াল…
দাদি পুরো কথাটুকু শেষ করতে পারলেন না কারণটা আমার পাশেই বসে আছে। পূর্ণর কড়া তীক্ষ্ণ চাহনি উপেক্ষা করে আমাকে কিছু বলা উনার দ্বারা আর সম্ভব হলোনা। শুধু হাসার চেস্টা করে মিনমিন করে বললেন,
—আসলে খাবারগুলা নস্ট হইবো এখন তাই বলতেছিলাম..
দাদি পুরো কথা শেষ করার আগেই আমি বিরক্তিকর কণ্ঠে বললাম,
—কেন নস্ট হবে, দাদি? আমি খাবো তো। এইটুক খেলে কিছুই হবেনা। এত ভাবার কিছু নেই!
কথাটি বলে পুনরায় খাওয়ার উদ্যোগ নিতেই পূর্ণ আমার কাছে থেকে প্লেট নিয়ে নিলেন। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি! কি করছেন হঠাৎ করে? আমি কিছু বলার আগেই উনি নিজের প্লেটটা আমার সামনে রেখে বললেন,
—এখন খাও। এবার তোমার এলার্জিও হবেনা, খাবারও নস্ট হবেনা।
প্রথম কথাটা আমায় বললেও শেষের টুকু দাদিকে উদ্দেশ্য করে বললেন উনি। অতঃপর আমার প্লেট থেকে চুপচাপ খেতে লাগলেন যেন এতক্ষণ কিছুই হয়নি এখানে। পূর্ণর কথায় ও আচরণে দাদি বিড়বিড় করে কি যেন বললেন! তারপর চুপসে যাওয়া মুখে খাবার গিলতে লাগলেন, এদিকে বাকি সবাই মিটিমিটি হাসছে। আমিও আর উপায় না পেয়ে লজ্জায় অসস্তিতে মাথা নিচু করে চুপচাপ খাবার খেতে শুরু করলাম। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করলো হঠাৎ করে! উনি উপর থেকে আমার প্রতি রাগ দেখালেও ভেতর থেকে সেই আগের পূর্ণই আছেন! আমার ভালো-মন্দ সকল দিকে যার তীক্ষ্ণ নজর বিদ্যমান। চঞ্চল মনে বলছে তবে কি উনার শেষ হতে চললো উনার অভিমান?
________________
বাসায় যাওয়ার সময় চলে এসেছে। সবাই বের হয়ে যাওয়ার সময় বড়াম্মু আমায় হঠাৎ বললেন,
—সামনের সপ্তাহেই তো বিয়ের অনুষ্ঠান। রাইসা তো চলেই আসবে। সাথে কি তুরফাও এসে থাকবি নাকি? বেয়াইনের সাহায্য হবে।
বড়াম্মুর কথায় যুক্তি আছে বটে। কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বলে ফেললাম আমি। পাশ থেকে পূর্ণর দৃষ্টি নিজের উপর উপলব্ধি করলাম ঠিকই কিন্তু সেদিকে বিশেষ পাত্তা দিলাম নাহ। কৌতুকের ছলে আন্টির দিক চেয়ে বললাম,
—আমি না হয় আজ থেকেই থেকে যাই, কি বলো? রাইসা আসার সময় আমার জিনিসপত্র নিয়ে আসবেনি।
হাসির ছলে বলা কথাটাকে সিরিয়াসলি নিয়ে নিলেন আন্টি। খুশিতে গদগদ হয়ে আমায় বললেন,
—সত্যি তুই থেকে যেতে চাইছিস, মা? আমি আরও এটাই ভাবছিলাম মনে মনে কিন্তু বলতে পাচ্ছিলাম না। তুই থাকলে তো খুবই ভালো হয়।
অতঃপর পূর্ণর দিকে তাকিয়ে আন্টি বললেন,
—তোমার কোন সমস্যা নেই তো, বাবা? তুরফা আমার কাছে থাকুক এ কয়দিন? ওর কিছু কাপড়চোপড় এখানেই আছে, পড়াশুনারও চিন্তা করোনা। আগেকার নোটস এখানেই আছে আজ পড়ে ফেলবে সেগুলোই। রাইসা আসার সময় বাকি জিনিস সব নিয়ে আসবে। এমনিতেই বাসাটা আমার ফাঁকা পড়ে থাকে, তুরফ থাকলে খুব খুশি হবো!
আন্টির কথায় পূর্ণ শুধু শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে! এদিকে আন্টির কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে চুপচাপ নিচের দিক চেয়ে আছি আমি। কি বলবো না বলবো কিছুই বুঝে উঠলাম না। পূর্ণ কিছু বলছেন না দেখে বড়াব্বু নিজেই বললেন,
—ওকে কি জিজ্ঞেস করছেন, বেয়াইন? ও তো নীরস। দেখা যাচ্ছে মানা করবে তুরফাকে এখানে থাকতে। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানেই মানা করলো আর তো এটা! তুরফা মা, তোর যদি থাকতে মন চায় তুই এখানেই থাক বিয়ে পর্যন্ত। তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিস আমরা নিজেই পাঠিয়ে দিবো। পূর্ণর উত্তরের আশায় চেয়ে থেকে মন খারাপ করিস নাহ!
বড়াব্বুর কথায় জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়লাম আমি। তা দেখে জোরে করে শ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেলেন পূর্ণ। সেদিকে চেয়েও চোখ ফিরিয়ে নিলাম। ধীরে ধীরে সবাই চলে যেতে লাগলো। আমি মগ্ন রয়ে গেলাম নিজ ভাবনায়। আজ আমি মনে মনে চাইছিলাম উনি আমায় নিয়ে যেতে চাক, মুখ ফুটে বলুক আমাকে না নিয়ে তিনি যাবেন নাহ। কিন্তু নাহ, উনার ইগোর কাছে হেরে গেলাম আমি! এই রাগীটাকে নিয়ে আমি কি করবো?
এদিকে প্রিয়া অনেকক্ষণ ধরে উশখুশ করছিলো রায়হান ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্য কিন্তু এখানে পূর্ণ থাকায় সাহস পাচ্ছিলোনা। পূর্ণর গম্ভীর মুখের শক্ত চাহনি দেখে আড়চোখে দু-একবার রায়হান ভাইয়ের দিক তাকিয়েই মাথা নামিয়ে নিচ্ছিলো শুধু। এদিকে পূর্ণকে চলে যেতে দেখেই রায়হান ভাইয়ার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে এসেছে। কিছু বলতে যাবে এমন সময় ঘুরে এলেন পূর্ণ। কড়া গলায় প্রিয়াকে ডেকে বললেন,
—সবাই চলে গেছে গাড়ির কাছে তুই এখানে কি করতে থেমেছিস? তোকে কি এখন ইনভিটেশন দিতে হবে? বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে নেই নাকি তোরও এখানে থাকার শখ জেগেছে?
প্রিয়াকে ধমক দিলেও শেষের কথাটা যে আমার উদ্দেশ্যে বলেছেন বুঝতে বাকি রইলোনা! ভয়ে চমকে উঠে দ্রুতপায়ে গাড়ির দিকে চলে গেলো প্রিয়া। পূর্ণ আড়চোখে আমার দিক চেয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলেন একবার। এরপর নিজেও চলে গেলেন বাসা থেকে!
___________________
বারান্দায় ঠান্ডা বাতাসে কেপে কেপে উঠছে শরীর। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই আমার! একমনে চেয়ে আছি সুদূর ওই চাঁদটার দিকে! চাঁদটা যেন আজ একা, তাকে ঘিরে থাকা তারাগুলো নেই আজ আকাশে। ঠিক যেমন আমার পূর্ণ নেই আমার কাছে। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই ভালো-খারাপ উভয়দিক বিদ্যমান! কোন মানুষই বাস্তবিক অর্থে পারফেক্ট নয়! পূর্ণও ব্যতিক্রম নন, উনার সবদিক খুব ভালো হলেও এই একটা দিক আমার পছন্দ নাহ, উনার প্রচন্ড রাগ। ছোটবেলা থেকেই তার রাগ বেশি! একেতো স্বভাবতই উনি গম্ভীর, তাই নিজের অনুভুতি ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারেন না, এটা নিয়েও তার নিজের প্রতি খুব রাগ!
বলাবাহুল্য উনার সমস্ত অনুভূতিই বেশ প্রখর। এতদিন যেমন তার তীব্র ভালোবাসা অনুভব করেছি, এ কয়দিন অনুভব করছি অভিমান! কিন্তু একটা সম্পর্কে যে বেশিদিন রাগ-অভিমানকে প্রশ্রয় দিতে হয়না, এতে নিজেদেরই সম্পর্কের অবনতি হয়। এটা কি উনি জানেন না?
আমি তো সেটা চাইনি বলেই উনার থেকে কিছু গোপন করিনি। তাও যদি উনি আমাকে ভুল ভাবেন এতে আমার দোষ কোথায়? এসব মনে হতেই নিজের ভেতরের সুপ্ত অভিমান তর তর করে পুনরায় চাঙা হয়ে উঠলো, রাগে-দুঃখে আমিও ঠিক করলাম যতদিন না উনি নিজে থেকে আমাকে চলে আসতে বলবেন আমি এখানেই থাকবো! আমি তো আমার দিক থেকে ঠিকই চেস্টা করেছি উনাকে মানানোর তবুও যদি উনি না বুঝেন তাহলে আমার আর কিছুই করার নেই। উনি একা থাকতে চেয়েছিলেন না কয়দিন? তবে তাই হোক! একাই থাকুক। আমিও আর ডিস্টার্ব দিবোনা তাকে! ভাবতে ভাবতেই চোখের কোণে গড়িয়ে পড়লো জল।
আলগোছে হাতের উল্টোপিঠে সেটাকে মুছে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে চলে আসছিলাম। হঠাৎ বাসার সামনে রাস্তার কোণে চোখে পড়লো চেনা গাড়ি। দৃষ্টি আরেকটু গাঢ় করতেই চোখে পড়লেন গাড়িতে হাত ভাজ করে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পূর্ণ! ল্যাম্পপোস্টের নিচে সোডিয়ামের আলো গায়ে মেখে একদৃষ্টিতে চোখে চেয়ে আছেন আমার দিকে! প্রথমে নিজের চোখের ভুল মনে করে রুমের দিকে চলে আসছিলাম। কিন্তু অশান্ত মন মানতে নারাজ! মনের ইচ্ছায় হার মেনে পুনরায় পেছনে তাকাতেই আবারও চোখে পড়লো একজোড়া উদাস চোখ! সেই চোখের দৃষ্টি বড় গভীর, যেন উনার না-বলা দুঃখ বলতে চাইছে আমায়! যে কথা উনি মুখে প্রকাশ করতে পারেন নি, সে কথা তার চোখ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করছে! হঠাৎই হাত নাড়িয়ে ইশারায় আমায় ডাকলেন পূর্ণ, নিচে নামতে বললেন বোধহয়। এদিকে তার সংকেত পেয়ে প্রসন্ন হাসি খেলে গেলো বেহায়া মনে! ভাটা পড়লো এতক্ষণের অভিমানে! ভালোবাসা বুঝি এমনই হয়? প্রিয়তমের ভালোবাসার এক ইশারায় মান-অভিমান সব দূর হয়ে যায়?
দ্রুতপায়ে বারান্দা থেকে চলে গেলাম রুমে! উদ্দেশ্য এখন একটাই। নিচে দাঁড়িয়ে থাকা আমার একান্ত মানুষটার কাছে ছুটে যাওয়া, তার ডাকে সাড়া দেওয়া!
#চলবে
.