বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৫৮
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
পরেরদিন সকালে আমায় আন্টির বাসায় রাখতে এসেছেন পূর্ণ। প্রান্ত ভাইয়াকে হলুদ লাগিয়েই তার ছোয়া হলুদের ডালা নিয়ে আমরা ছুটে এসেছি তড়িঘড়ি করে! কারণ রাইসার হলুদ শুরু হয়ে যাবে যেকোনো মুহুর্তে। এইবার যেহেতু ঘটা করে বিয়ে হচ্ছে তাই আত্মীয়স্বজনে রীতিমতো গিজগিজ করছে চারপাশ, আন্টির বাসাতেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বাসায় ঢুকতেই আন্টির সাথে কথা বলে রাইসার কাজিনদের দেখে সেদিকে এগিয়ে গেলাম। পূর্ণ পিছনে আন্টির সাথে কথা বলায় ব্যস্ত আছেন। আমাকে দেখতেই সামা আপু বললো,
—কি ব্যাপার, তুরফা? তোমাকেই খুজছিলাম কাল থেকে। শুনেছি ফ্যামিলিকে ফিরে পেয়েছো, তাদের সাথে ভালোই চলছে দিনকাল নাকি?
—হ্যাঁ আপু, বেশ ভালোই আছি আলহামদুলিল্লাহ। তোমাদের কি খবর? নতুন ক্রাশ-ট্রাশ খেয়েছো নাকি কারও উপর?
দুষ্টু হেসে কথাটা বলাতেই পুনরায় কথার ঝুড়ি মেলে বসলো রাইসার বিচ্ছু কাজিনদল। আজকে কোন ছেলেকে পটাবে না পটাবে এসব আলোচনায় সরগরম হলো আড্ডা! অনেকদিন পর এসব ফিরে পেয়ে পূর্ণকে একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। তাইতো উনাকে ছেড়েই যথারীতি সবার সাথে চলে গেলাম রাইসার কাছে, একসাথে হলুদ ছোয়ালাম ওর গালে। এক ফাঁকে চুপি চুপি রাইসার কানে বললাম,
—তোর বরের গায়ে লাগানো হলুদ নিয়ে এসেছি কিন্তু তোর জন্য। এ হলুদের ছোয়ায় দেখবি তোর সৌন্দর্য বহুগুণ বেড়ে যাবে, বুঝলি?
রাইসা লাজুক হেসে মাথা নোয়ালো। খানিকবাদে আমায় উনার দিক ইশারা করে বললো,
—পূর্ণ ভাইয়াও এসেছে দেখছি। দেখ ওখানে একা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। ভাইয়া তো বাহিরের মানুষের সাথে তেমন একটা মিশেন নাহ, তার কাছে যা। বোর হচ্ছে হয়তো বেচারা।
এতক্ষণ পর পূর্ণকে দেখে আমার হুশ ফিরলো, নিজের গল্পগুজবে তো উনার কথা সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম! ফিচলে হেসে বললাম,
—ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস। আমি ভুলেই গিয়েছিলাম তার কথা। অবশ্য বেশিক্ষণ থাকবেনও না উনি। একটু পরেই চলে যাবেন।
আমার কথায় রাইসা চোখ বড় করে বললো,
—তুই থাকবি আজ এখানে? ভাইয়া রাজি হয়েছেন? এটা কিভাবে হলো?
—সবই আমার বুদ্ধির কামাল!
বেশ খানিকটা ভাব নিয়ে কথাটি বলতেই চাপা গুঞ্জন শুনা গেলো পেছনে কাজিনদের মধ্যে৷ সামা আপু এগিয়ে এসে পূর্ণর দিক হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন,
—এই এই, দেখো সবাই। রাইসার সেই হ্যান্ডসাম ভাসুরটা এখানে এসেছে। ওহ মাই গড! কতদিন পর তাকে আবার দেখলাম! তার মধ্যে কালো পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে উফ!! আমার তো চোখ জুড়িয়ে গেলো তাকে দেখেই!
আপুটার কথায় সেদিক তাকাতেই মন বিষাদে ছেয়ে গেলো আমার। তার মুখে পূর্ণর প্রশংসা সহ্য হলোনা একটুও। আর যতই হোক স্বভাবসুলভ কারণেই অন্য মেয়ের মুখে নিজের স্বামীর গুনগান বিতৃষ্ণা জাগালো অন্তরে। ভেতরের দহন হয়তো মুখের অভিব্যক্তিতেও কিছুটা প্রকাশ পেলো, যা দৃষ্টিগোচর হলোনা রাইসার। জ্বালাময়ী হাসি দিয়ে আমায় ফিসফিসিয়ে বললো,
—কেমন লাগছে, বড় জা? অন্য মেয়েদের মুখে আমার শ্রদ্ধেয় ভাসুরের প্রশংসা শুনে আপনি কেমন বোধ করছেন?
রাইসার কথায় চোখ পাকিয়ে ওর দিক তাকাতেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো সে। এদিকে বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে গেলো আমার! কিন্তু সামা আপুর সেসব দিকে পাত্তা নেই, নিজের দিকেই ব্যস্ত আছে সে। হঠাৎ করে আমার দিকে এগিয়ে এসে বললো,
—এই তুরফা, রাইসার শশুড় যেহেতু তোমার চাচা হয় তাহলে তো পূর্ণ তোমার চাচাতো ভাই, তাই না?
আপু কি বলতে চাইছেন কিছুটা আন্দাজ করে মাথা নাড়তেই সন্তোষজনক হাসি দিয়ে তিনি বললেন,
—তাহলে তো হয়েই গেলো। তুমি আমার হেল্প করো না প্লিজ? পূর্ণ কে আমার সাথে কথা বলতে রাজি করাবে একবার?
তার কথায় ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইলাম। তিনি কি আদৌ জানেন আমাকে কি করতে বলছেন? নাকি আসলেই জানেনা যে পূর্ণর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে? আমি কিছু বলার আগেই রাইসা বাহু ধরে টান দিলো ওর দিকে। সেদিকে তাকাতেই বললো,
—বোন, তুই যা ভাবছিস তাই হচ্ছে। সামাপু কিচ্ছু জানেনা তোদের বিয়ের ব্যাপারে, ইনফ্যাক্ট আমার কাজিনমহলের কেউই জানেনা। আম্মু শুধু বলেছে তুই তোর পরিবারকে পেয়ে তাদের সাথেই থাকিস এখন। সেটা শুনেই সবাই দফারফা হয়েছে, এর বেশি শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি তাই তোদের বিয়ের ব্যাপারে বলাও হয়নি!
—তাহলে এখন বলছি…
—এই না, একটু মজা নিতে দে নাহ।
—কিসের মজা?
চোখ পাকিয়ে বললাম। রাইসা ভিলেন মার্কা হাসি দিয়ে বললো,
—আরেহ, আপুকে একটু ভাইয়ার কাছে যেতে দে না। আমরাও দেখি ভাইয়ার রিয়েকশন।
—পাগল নাকি? আমার খুব বিরক্ত লাগছে। আর উনি জানলেও রাগ করবে। তার এসব পছন্দ না তুই তো জানিসই। আর এটা তো ঠিকও নাহ।
—ধুর কিচ্ছু হবেনা, তুই চুপ থাক। একটু মজা নিতে দে নাহ। সামা আপু যখন জানবে তার রিয়েকশনটা দেখার জন্য তর সইছেনা আমার!
অতঃপর সামা আপুর দিকে ঘুরে রাইসা বললো,
—তুরফা কিভাবে বলবে, আপু? ছোট হয়ে ও বড় ভাইকে এমন কথা বলতে পারে বলো? তার চেয়ে তুমি বরং নিজেই যাও ভাইয়ার কাছে। কথা বলার চেস্টা করে দেখো। অল দ্যা বেস্ট।
রাইসার কথায় খানিকটা ইতস্তত করে পূর্ণর দিকে হাটা শুরু করলেন সামা আপু। আমি এসব দেখে অসন্তুষ্ট হলেও পূর্ণর রিয়েকশন দেখার লোভে মুখে কলুপ এটে বসে রইলাম রাইসার পাশে!
—হাই। ভালো আছেন?
সামা আপুর কথায় এক মুহুর্তের জন্য চোখ তুলে তাকালেন পূর্ণ। আপুকে দেখে যেন চিনতে কিছুটা সময় নিলেন। চেনার পর পরই উনার অভিব্যক্তিতে পরিবর্তন এলো! চোখমুখ শক্ত করে পুনরায় ফোনে মনোযোগ দিতেই সামা আপু আবারো বললেন,
—আমাকে চিনতে পেরেছেন? অনেকদিন পর দেখা হলো আপনার সাথে।
—হ্যাঁ, চিনেছি। গতবারের মতো এবারো একি ভুল করতে যাচ্ছো তুমি। বাট আই এম নট ইন্টেরেস্টেড। নাউ এক্সকিউজ মি?
গলায় একরাশ গম্ভীরতা ঢেলে উনি কথাগুলো বলেই চেয়ার থেকে উঠে আপুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। বেচারি সামা আপু কালো মুখে পাশে এসে দাড়ালেন। দ্বিতীয়বার রিজেক্ট হওয়ায় হতাশ মুখে নিজের দলবলের সাথে গিজগিজ করতে করতে অন্যপাশে চলে গেলেন। এদিকে আমার পাশে রাইসা হেসে কুটিকুটি হলেও আমি কি রিয়েকশন দিবো ভেবে পেলাম নাহ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পূর্ণর দিকে যাওয়ার জন্য অগ্রসর হলাম।
________________
বাসার ছাদের এক কোণে নিজ মনে ফোনে কথা বলছিলেন পূর্ণ। আমি পাশে এসে আলতো করে তার বাহু ছুয়ে দিতেই পেছনে ফিরলেন। আমায় দেখে ফোনে কথা বলতে বলতেই এক হাতে হালকাভাবে জড়িয়ে ধরলেন। খানিকক্ষন বাদে ফোন রেখে বললেন,
—অবশেষে সময় হলো আমার কাছে আসার?
—আপনি এখানে ছিলেন? আমি তো নিচে খুজছিলাম এতক্ষণ। সব জায়গায় খুজে এলাম। তারপর না পেয়ে এখানে এসেছি।
—কি করবো বলো? যার জন্য এখানে আছি তার তো আমার জন্য সময় নেই, উল্টো অন্য আপদ পিছু নিচ্ছিলো। তাই বাধ্য হয়ে এখানে এসে দাঁড়িয়েছি।
তার চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। কি বুঝাচ্ছেন তা বুঝেও না বুঝার ভান করে আড়চোখে চেয়ে বললাম,
—অনেকক্ষণ ধরেই তো আছেন। এখন চলুন, খেয়েদেয়ে বাসায় যাবেন।
কথাটি বলে উনার হাত ধরে নিচে নামার জন্য অগ্রসর হতেই হাতে টান পড়ায় থেমে যেতে হলো। পূর্ণ এক কদম এগিয়ে এসে ভ্রু তুলে বললেন,
—আমায় তাড়িয়ে দেওয়ার এত আগ্রহ কেন তোমার? আমার এখানে থাকা ভালো লাগছেনা?
—নাহ৷ এটা মেয়ের গায়ে হলুদ। এখানে শশুড়বাড়ির লোকজন থাকেনা। আপনি এখনি খেয়েই চলে যাবেন, বুঝেছেন?
—সিরিয়াসলি, তুরফা? তুমি সত্যিই যেতে বলছো আমায়?
—জি হ্যাঁ। এখন চলুন তো।
কথাটি বলেই উনাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলাম নিচে। আর যাই হোক উনাকে কেন তাড়িয়ে দিচ্ছি তা উনাকে মুখে বলতে পারলাম নাহ। উনার উপর আমার বিশ্বাস থাকলেও অন্য মেয়েরা তার দিকে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বিষয়টি সহ্য করা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছিলো যেন। সকলের দৃষ্টির অগোচরে তাকে খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েই বাড়ির বাহিরে গাড়ির কাছে চলে এলাম দুজনে।
যাওয়ার আগে আমার দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন উনি। হঠাৎ শক্তভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন,
—এখন কেন তাড়িয়ে দিচ্ছো জানিনা। তবে যে কারণেই হোক, আজ কিছু বলছিনা। কাল তো আসছিই তোমায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন এমন করলে একদম তুলে নিয়ে যাবো সবার সামনেই, বুঝেছো?
—বুঝেছি। এখন সরুন তো। বাসায় যান!
যাওয়ার কথাটা আরেকবার বলতেই ঘাড়ে শক্ত কামড় অনুভব হলো। সূচালো ব্যথায় হাতের বাধন খানিকটা ঢিলে হলো৷ তবে মুহুর্তের মধ্যেই সে স্থানে পরপর কয়েকটা চুম্বন একে আরও কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে অবশেষে ছাড়লেন জনাব। অতঃপর তার রাশভারি আওয়াজ,
—ছাড়ো তো, তুরফা। কতক্ষণ ধরে বাসায় যেতে চাচ্ছি আর তুমি আটকে রেখেছো? বিয়েবাড়িতে এমন করলে হয়? মানুষ ভাববে কি!
কথাটি বলেই গাড়িতে উঠে গেলেন তিনি। লুকিং গ্লাসে আমার দিক চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে বিদায় নিলেন অবশেষে। সেদিক চেয়ে হতাশ চোখে মাথা নাড়তেই হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁটেও!
চলবে…………