#বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
ভ্রু কুচকে পূর্ণ ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিছু না বলেই অযথা আটকে রেখেছেন তিনি! এর মধ্যেই খেয়াল করলাম উনি আস্তে করে পা সরালেন আমার ওড়নার উপর থেকে। এতক্ষণ ধরে এটারই অপেক্ষায় ছিলাম আমি! তাই দ্রুতবেগে মাটি থেকে ওড়নার অংশ তুলে নিয়ে চলে যেতেই উনি তড়িৎ গতিতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। হঠাৎ করে তাকে নিজের সামনে দেখে ভয় পেয়ে আমি রেলিং এর দাড় ঘেঁষে দাড়ালাম। উনার রাগভরা মুখ যেন আমাকে সিগনাল দিচ্ছে তার সামনে থেকে পালানোর জন্য!
সাইড দিয়ে পালানোর চেস্টা করতেই উনি হাত ধরে আটকালেন আমায়। তার শক্ত মুঠোয় ছটফট করতে লাগলো আমার ছোট্ট হাত। কিন্তু উনি সেদিক ভ্রুক্ষেপ না করে চোখ রাঙিয়ে থামালেন আমায়, তারপর আস্তে করে হাত ছেড়ে দিলেন। হাফ ছেড়ে বাচলাম যেন আমি! তবুও শান্তি পেলাম না কারণ আমি না পারছি পালাতে, না পারছি নড়তে। কি বিশ্রি একটা অবস্থায় ফেসে গেছি এই লোকটার সাথে! হঠাৎ আমার মনে চিন্তা হলো কেউ যদি আমাদের এইভাবে দেখে তবে কি মনে করবে? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, না কেউ নেই এদিকটায়। সবাই হয় ছাদে না হয় নিচে ব্যস্ত যে যার মতো!
যদিও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট দুরত্ব রেখেই দাড়িয়েছেন উনি কিন্তু তাও এভাবে দুজন মানুষকে একাকী দেখলে স্বাভাবিকভাবেই উল্টাপালটা ভাবতে পারে মানুষ। আমি তো তাহলে ভরাসন্ধ্যায় বিয়েবাড়িতে বদনাম হয়ে যাবো!! হায় হায়!!
—সমস্যা কি তোমার?
আমার ভাবনার মাঝেই রাগী গলায় দাতে দাত চেপে জিজ্ঞেস করলেন উনি। তার প্রশ্ন শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। নিজেই আমাকে অযথ রাগ দেখিয়ে আটকে রেখে আবার নিজেই জানতে চাচ্ছে সমস্যা কি। মনে প্রশ্ন উকি দিলো,আচ্ছা উনার কি মাথার তার ছিড়া আছে নাকি দুই-একটা?
—কথা বলছোনা কেন, স্টুপিড? কি সমস্যা তোমার আমাকে বলো!!
তার কথা শুনে রেগে গেলাম আমি।
— প্রথমত আমাকে স্টুপিড বললে আমি কোন কথাই বলবোনা। আর দ্বিতীয়ত আপনি কিসের সমস্যার কথা বলছেন আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনা! সমস্যাটা তো আপনার মাথায় আছে বলেই মনে হচ্ছে আমার। নয়তো আমাকে অযথা আটকে রাখবেন কেন এইভাবে??
—শাট আপ। তোমাকে শখ করে আটকে রাখার প্রতি কোন ইন্টারেস্ট নেই আমার বুঝেছো? তোমার জন্য যে একটু আগে আমার হয়রানি হতে হলো সেটার দায়ভার তুমি ছাড়া আর কে নিবে বলো??
উনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম! আমার জন্য উনার হয়রানি হয়েছে? মানেটা কি? আমি তো কিছুই করিনি! কিন্তু উনার ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে সত্যি কথাই বলছেন তিনি। তাই গোলগোল চোখে অবাক হয়ে উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
—আমি না সত্যিই বুঝতে পাচ্ছিনা আপনি কিসের কথা বলছেন। আর কিছু হলেও আই প্রমিস আমি কিছুই জানিনা আর আমি ইচ্ছা করে কিছুই করিনি। (ভয়ে ভয়ে)
—যাক, ফাইনালি লাইনে এসেছো। তবে কাজটা তুমি ঠিক করোনি। ছোটমানুষ আছো, ছোটমানুষের মতোই থাকবে। যাকে তাকে আমার ইনফরমেশন দেওয়ার চেস্টা করবেনা আর কখনও, বুঝেছো? (কড়া চোখে ধমক দিলেন আমায়)
চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে রইলাম উনার দিকে। আমি আবার কাকে তার ইনফরমেশন দিয়েছি। কয়েক মুহূর্ত মাথা খাটাতেই মনে হলো সামা আপুর কথা। হ্যাঁ, আমি তো উনাকে বলেছিলাম পূর্ণ ভাইয়ার কথা! তার মানে নিশ্চয় উনিই বলে দিয়েছেন! ধুর!! কাজটা মোটেও ঠিক করলো না আপু! পূর্ণ ভাইয়াকে পটাতে পারলেন না বুঝলাম, তাই বলে আমাকে এভাবে ফাসিয়ে দেওয়ার কোন মানে হয়??
ধরা পড়া চোরের মতো মাথা চুলকে ইতস্তত হাসলাম তার সামনে। কিন্তু আমার হাসি তার গম্ভীর ভাবমূর্তির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটালো না। উনি একিভাবে চোখ পাকিয়ে আছেন আমার দিকে। তবে আমার মনে চলছে অন্য কথা। সামা আপু ঠিক কি করেছেন যার কারণে পূর্ণ ভাইয়াকে হয়রানি হতে হলো? জানার লোভ সামলাতে পাচ্ছিনা আবার ভয়ে তাকে কিছু জিজ্ঞেসও করতে পাচ্ছিনা। এমনিতেই রেগে আছেন না জানি আবার কখন ধমক দেন! তবে বেশিক্ষণ চুপ থাকতে পারলাম না আমি। কৌতুহলের বশে চকচকে দৃষ্টিতে এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম আপু কি করেছে উনার সাথে৷ ভেবেছিলাম হয়তো বলবেন না আমায়, নাহয় রেগে কিছু শুনাবেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন,
—আমার ভাইবোনদের সাথে কথা বলছিলাম স্টেজের পাশে। তখন তোমার ওই গুণধর কাজিন এসে গায়েপড়ে কথা বলতে শুরু করলো আমার সাথে। প্রথমে ভাবলাম বিয়েবাড়িতে খোজখবর অনেকেই নেয় তাই ভদ্রভাবে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম ওকে। সারা না কি যেন নাম ছিলো ওর।
—সামা।
আমি শুধরে দিলাম উনাকে কিন্তু বিনিময়ে উনার তীক্ষ্ণ রাগী দৃষ্টি ছাড়া কিছুই পেলাম না!
—হ্যাঁ, সামা। নাম যাই হোক কিন্তু মেয়েটা খুব নাছোড়বান্দা! তুমি ওকে আমার কথা বলে একদম ঠিক করোনি। আমি বরের বড় ভাই হয়েও কেন এখনও বিয়ে করিনি, আবার আমি কাউকে ভালোবাসি কি না, ওকে দেখতে ভালো লাগছে কি না, ওর সাথে প্রেম করবো কি না এগুলো পর্যন্ত জিজ্ঞেস করছিলো আমাকে। সোজা কথায় যাকে ফ্লার্টিং বলে! ভাবা যায়? উফ, ডিজগাসটিং!!
প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে শেষ করলেন পূর্ণ ভাইয়া। উনার মুখ দেখে আর সামা আপুর কর্মকাণ্ড কল্পনা করে আমার ভেতর হাসির বন্যা বয়ে যাচ্ছিলো। অনেক কস্টে ঠোঁট টিপে নিজেকে সামলানোর চেস্টা করছিলাম কিন্তু তার চোখ এড়াতে পারলাম নাহ! চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে থাকলেন উনি আমার দিকে।
—স্টপ লাফিং! এখানে হাসার মতো কিছু বলিনি আমি তোমায়! তুমি জানো আমার কাজিনরা আমাকে কতটা সম্মান করে? ওদের সামনে কখনো এইরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি আমায়। আর আজ তোমার জন্য ওরা আমাকে ক্ষেপানোর সুযোগ পাচ্ছে, আমাকে দেখতেই হাসাহাসি করছে। এটাকে কোনদিক দিয়ে ফানি মনে হচ্ছে তোমার কাছে?? (রেগে)
তার কথা শুনে আমার আরও বেশি হাসি পেলো কিন্তু তার সামনে সেটা প্রকাশ করলাম না! আরে বাবা কাজিনরা ক্ষেপাতেই পারে, রাগাতেই পারে। এটাই তো কাজিনধর্ম। কিন্তু এই সামান্য বিষয় নিয়ে লোকটা এত রেগে যাবে আমি ভাবতেও পারিনি! এত গম্ভীর কি কেউ হয়? পূর্ণ ভাইয়া পারেনও বটে।
তবে যাই হোক, আর বেশিক্ষণ এখানে থাকা যাবেনা উনার সাথে। যেকোন মুহুর্তে কেউ আসতে পারে আর দেখে ফেলতে পারে আমাদের। তাই আমি কিছু বুঝে উঠার সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ করে ধাক্কা দিলাম তাকে। যদিও তার বিশাল দেহে আমার ছোট্ট ধাক্কায় তেমন একটা প্রভাব পড়লো না তবুও খানিকটা অবাক হয়ে কিঞ্চিৎ দূরে সরে গেলেন তিনি। আর এই সুযোগে আমি এক দৌড়ে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠে গেলাম!
তাড়াহুড়ো করে ছাদে উঠতেই রায়হান ভাইয়ার সামনে পড়লাম। তার হাতে খাবারের ট্রে ছিলো। হঠাৎ করে নিজের গতি সামলাতে না পারলেও কোনমতে তাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের ধাক্কা লাগা থেকে রক্ষা করলাম আমি। কিন্তু উনার হাতে থাকা ট্রের সাথে বারি ঠিকই খেলাম হাতে। ট্রের সুচারু কোণ হাতে লাগতেই নিজ থেকেই আহসূচক ধ্বনি বের হলো আমার মুখ দিয়ে! আড়চোখে হাতের দিক তাকিয়ে দেখি ছিলে গিয়েছে কনুই এর নিচের অংশটা, খানিকটা রক্তও বের হচ্ছে ওখান থেকে! এদিকে ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলেন রায়হান ভাইয়া। পাশের টেবিলে ট্রে-টা রেখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।
—তুরফা, হাতে কোথায় ব্যাথা পেয়েছো তুমি? দেখি একটু। বেশি লেগেছে কি তোমার?
চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন উনি। তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে বেচারা গিলটি ফিল করছেন তার হাতে রাখা ট্রে দিয়ে আমি আঘাত পেয়েছি বলে। তাই ছিলে যাওয়া অংশের উপর ওড়না দিয়ে ঢেকে ব্যাথা পাওয়া সত্বেও আমি মুখে ছোট হাসি টেনে বললাম,
—আরেহ না, ভাইয়া। আমি একদম ঠিক আছি। এইসব ছোট-মোট ব্যাথায় তুরফার কিছু হয়না।
খানিকটা ভাব নিয়ে বললাম তাকে হালকা করার জন্য। আমার কথা শুনে উনি হাসলেও যেন পুরোপুরি সন্দেহমুক্ত হলেন না।
—তুমি সত্যি বলছো তো? দেখো তুরফা, আঘাত পেলে লুকিয়ো না। নিচে চলো, মলম দিচ্ছি। ওটা লাগালেই ঠিক হয়ে যাবে।
আমি উনাকে আবারও মানা করলাম যে কিছু লাগবেনা, আমি ঠিক আছি। বলার মাঝেই খেয়াল করলাম উনার দৃষ্টি আমার থেকে সরে আমার পেছনে গিয়ে ঠেকলো। উৎসুক চোখে পেছনে ফিরে পূর্ণ ভাইয়াকে দেখলাম। উনিও ছাদে এসে গেছেন এতক্ষণে। কেমন যেন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে। তবে আমায় বিশেষ পাত্তা দিলেন না উনি। আমাকে পাশ কাটিয়ে সরাসরি রায়হান ভাইয়ার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। তাকে দেখে রায়হান ভাইয়া হাত বাড়ালো হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে, প্রত্যুত্তরে উনিও করলেন দেখলাম। ওনারা নিজেদের মধ্যে পরিচয়-বিনিময় করতে লাগলেন। তাই আমিও আর কিছু না বলে চলে গেলাম ছাদের অন্য পাশে।
___________
প্রান্ত-রাইসার আংটি বদল সম্পন্ন হলো সুন্দরভাবে। বর-বউ এর বেশ কিছু সুন্দর ছবিও তুলা হলো। মেহমানরা ছবি তুলে খেতে গেলেন নিচে। ওখানেই খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। নিচে আংকেল-আন্টি মেহমানদের আপ্যায়নে ব্যস্ত, উপরে আমরা ছোটরা ছবি তুলছি এই সুযোগে!
এতক্ষণ সবার সাথে হৈ-হুল্লোড়ের মধ্যে থাকায় ব্যাথার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম আমি। বাকি কাজিনদের ছবি তুলতে ব্যস্ত দেখে একা একা একটি টেবিলে গিয়ে বসলাম আমি। হাতের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে দেখি রক্ত শুকিয়ে গেছে এতক্ষণে। চামড়ায় টান লাগায় ব্যাথায় চিনচিন করছে জায়গাটা। হয়তো তখন মলম লাগানোই উচিত ছিলো তাহলে এত জ্বলতো না। ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোন টিপতে লাগলাম আমি!
একটু পরেই নিচ থেকে আন্টি ডাকলেন আমায়। মনে হয় কোন সাহায্য দরকার তাই টেবিলের উপর ফোন রেখেই তাড়াতাড়ি করে নিচে চলে গেলাম আমি! মিনিট পাঁচেক মেহমান আপ্যায়ন করে ক্লান্ত হয়ে ছাদে ফিরলাম। ফোনের কথা মাথায় আসতেই টেবিলের কাছে গেলাম।
ক্লান্ত গায়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে টেবিল থেকে ফোন তুলতেই তার পাশে একটি প্যাকেট চোখে পড়লো আমার। ভ্রু কুচকে ভাবলাম এটা আবার কে রেখে গেছে এখানে? একটু আগে তো ছিলোনা! কৌতুহলবশত প্যাকেটটি খুলেই চমকে গেলাম আমি। ওর ভেতরে একটা মলম রাখা, সাথে ব্যাথানাশক ওষুধও আছে! এটা আবার কে আনলো? রায়াহান ভাইয়া?? কারণ উনি ছাড়া তো আর কেউই জানতো না আমার ব্যথার কথা! আর ভাইয়া নিজেই তখন মলমের কথা বলেছিলেন। তাহলে উনিই হবেন! বিস্মিত হলেও মনে মনে রায়হান ভাইয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম আমার কথা চিন্তা করার জন্য।
হাতে মলম লাগিয়ে হাত ধুয়ে এসে ছাদের কোণে এসে দাড়ালাম। এই জায়গা থেকে পুরো রাস্তা দেখতে পাওয়া যায়! খুব সুন্দর লাগে দাড়ালেই। চুপচাপ দাড়িয়ে বাতাস উপভোগ করছি এমন সময় রাস্তা দিয়ে রায়হান ভাইয়াকে যেতে দেখলাম। উনাকে দেখে আপনাআপনিই ভ্রু কুচকে গেলো আমার। এতটুকু সময়ে ছাদে মলম রেখে আবার রাস্তা পর্যন্ত কিভাবে পৌঁছে গেলেন উনি? মাথায় খেললোনা ব্যাপারটা!
নাহ! এত তাড়াতাড়ি এতখানি পথ যাওয়া-আসি করা তো সম্ভব নয়। তাহলে কিভাবে কি হলো? হঠাৎ করেই অবচেতন মনে প্রশ্ন উঠলো, মলমটা অন্য কেউ রাখেনি তো? কিন্তু রাখলেও বা কে রাখবে। রায়হান ভাইয়া ছাড়া তো আমার ব্যাথার কথা কেউ জানেনা!! চোখ-মুখ কুচকে ভাবতে লাগলাম আমি মলমদাতার কথা! কে হতে পারে? তিনি কি আদৌ রায়হান ভাইয়া ছিলেন নাকি অন্য কেউ??
#চলবে
কেমন লাগছে আপনাদের গল্পটা? সবার গঠনমূলক মন্তব্য চাই ।