বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৭৪
লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সময় উড়ে চলে চোখের পলকে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে প্রায় বছর খানেক সময়। আমাদের রিসেপশনের ক’দিন পর আমাকে ঢাকার প্রথম সারির একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়। যেহেতু রেজাল্ট ভালো ছিলো তাই কাঙ্ক্ষিত সাবজেক্টেই ভর্তি হতে পেরেছি। নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়জীবন, পূর্ণর সাথে সুখের সংসার ও পারিবারিক সম্প্রীতির মাধ্যমে জীবন বেশ ভালো চলছিলো৷ সময়ের সাথে দুজনের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে ঠিকি৷ একদিকে আমি ভার্সিটির পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি, ওদিকে পূর্ণর উপর কাজের চাপ বেড়ে গেছে। তবুও দিনশেষে সব কাজের ব্যস্ততা একদিকে রেখে একে-অপরের জন্য জন্য একান্ত সময় বের করতে ভুলিনা কেউ। এতদিনেও পূর্ণর আমার প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং বেড়ে চলছে প্রতিনিয়ত সময়ের সাথে। যেদিন আমার ভার্সিটিতে প্রথম দিন ছিলো সেদিন উনি ক্যাম্পাসে রাখতে গিয়েছিলেন আমায়। ক্যাম্পাসে ঢুকে আশেপাশে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে বেশ শান্তভাবেই বলেছিলেন,
—দেখো বউ, ভার্সিটির আগামী চার বছর বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হবে তোমায়। যেহেতু তোমার অনেক আগেই আমি এ ধাপ পার করে এসেছি তাই হলফ করে বলতে পারছি সামনে অনেক রঙিন সময় কাটবে তোমার। দেখবে উঠতি বয়সে এসব চাকচিক্যে অনেকেই বিপথে চলে যায়। কিন্তু আমি জানি তুমি যাবেনা এবং আমার তোমার উপর পুরো বিশ্বাস আছে। কিন্তু অন্যদের উপর বিশ্বাস নেই, তাই সাবধানে থাকবে। নিজের খেয়াল রাখবে। আর যেকোনো সমস্যায় পড়লে নির্দ্বিধায় আমায় বলবে। মনে রেখো, তোমার পূর্ণ সবসময় তোমার পাশে আছে। মনে থাকবেনা, তুর পাখি?
আমি সেদিন উনার আমার প্রতি বিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। উনার বিশ্বাস ও ভালোবাসাকে আমি সম্মান করি। তাই হাসিমুখে উনার কথা মেনে নিয়েছিলাম৷ তখন থেকে এ পর্যন্ত ভালোই চলছে জীবন। এরই মাঝে রাইসার ডেলিভারির সময় এসে যায়। ওর তখন নয় মাস শুরু হয়েছে মাত্র। প্রান্ত ভাইয়া সেসময় অফিস যাওয়া বাদ দিয়েছিলেন বলতে গেলে, বাসাতেই থাকতেন কখন কোন প্রয়োজন পড়ে না পড়ে সেজন্য! যার দরুন পূর্ণর উপর কাজের চাপ বেড়ে যায়। উনি বেশ দেরি করে বাসায় ফিরতেন, আমিও পড়াশুনায় ব্যস্ত থাকি। তো এভাবেই একদিন ক্লাস শেষে ভার্সিটি থেকে বের হয়ে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম এমন সময় হঠাৎ পূর্ণ চলে এলেন গাড়ি নিয়ে। তাকে আচমকা এমন সময় দেখে কিছুটা চমকেই গিয়েছিলাম। কিছু বলার আগেই উনি গাড়ি থেকে বের হয়ে দ্রুতকদমে এসে আমার হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলেন। গাড়ি চালু হতেই আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম,
—আপনি এ সময়ে এখানে যে? কি হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?
—রাইসার ডেলিভারি পেইন উঠেছে। সবাই ওর সাথে হসপিটাল গিয়েছে। বাসায় কেউ নেই, প্রিয়া আমায় ফোন করে যেতে বললো তাই আমি তোমায় নিয়ে ওখানে যাওয়ার জন্য এসেছি।
একদিকে ঘরে নতুন মেহমান আসার খুশি, অপরদিকে রাইসার জন্য চিন্তা, দুটো ভাবনা-ই জেঁকে বসলো মনে। অতঃপর দুজন মিলে চলে গেলাম হসপিটালে। কাঙ্ক্ষিত জায়গায় যেতেই সবার দেখা মিললো। আমাদের পরিবার, রাইসার পরিবারের সবাই এসেছে। তাদের থেকেই জানতে পারলাম, অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাইসাকে। রুমের বাহিরের করিডোরে একনাগাড়ে পায়চারি করছেন প্রান্ত ভাইয়া। রুমের ভেতরে অবস্থানরত নিজের বউ ও অনাগত সন্তানের চিন্তায় তার কপালে ভাজ পড়েছে বেশ। পূর্ণ এগিয়ে গিয়ে তার কাধে হাত রাখতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে পেছন ফিরলেন প্রান্ত ভাইয়া। পূর্ণকে দেখেই একপ্রকার ঝাপিয়ে পড়লেন তার উপর। বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে হুড়মুড়িয়ে বললেন,
— আমার খুব ভয় লাগছে, ভাইয়া। ওর কিছু হবেনা তো? আমাদের বাচ্চা ভালোভাবে দুনিয়ায় আসবে তো?
পূর্ণ এক মুহুর্ত থমকে গেলেন। ভাইকে কিভাবে আশ্বাস দিবেন ভাবতে লাগলেন যেন! অতঃপর ভাইকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,
—রাইসার কিছু হবেনা। তোর বাচ্চাও ভালোভাবেই দুনিয়াতে আসবে দেখিস। এত চিন্তা করিস না! আল্লাহর উপর ভরসা রাখ!
ভাইয়ের আশ্বাস পেয়ে প্রান্ত কিছুটা শান্ত হয়ে গেলেন যেন৷ সেভাবেই এগিয়ে চললো অপেক্ষার প্রহর। ঘনিয়ে এলো নতুন মেহমান আসার সময়। খানিকক্ষণ বাদেই কানে এলো সবার কাঙ্ক্ষিত ধ্বনি! বাচ্চার কান্নার স্বর। মুহুর্তেই খুশির ঝলক খেলে গেলো সবার চোখেমুখে! বাচ্চাকে ক্লিন করা শেষে নার্স বাহিরে নিয়ে এলো সবার মাঝে। রাইসা একটি সুস্থ ছেলে বাচ্চার জন্ম দিয়েছে। বাচ্চাকে প্রান্ত ভাইয়ার কোলে দিতেই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন উনি। প্রাণভরে দেখতে লাগলেন নিজের সন্তানকে। প্রিয়া রীতিমতো ভিডিও করছে সবকিছু। কোনো মুহুর্ত ক্যামেরাবন্দী হতে মিস না হয়ে যায় সে খেয়াল রাখছে পুরোপুরি! রায়হান ভাইও ওর সাথে তাল মিলিয়ে ভিডিও করছেন আশেপাশের! আমি প্রান্ত ভাইয়ার কোল হতেই বাচ্চাকে দেখতে দেখতে পূর্ণর বাহুতে হেলান দিয়ে বললাম,
—কি কিউট হয়েছে না? মাশাল্লাহ!
—হু। খুব কিউট।
—বাবু দেখতে রাইসার মতো হয়েছে, বলুন?
—এত ছোট বাচ্চা দেখতে কার মতো হয়েছে সেটা বুঝলে কিভাবে তুমি? সব ছোটবাচ্চা দেখতে তো একিরকম লাগে আমার কাছে! আরেকটু বড় হলে না বুঝা যাবে কার মতো হয়েছে।
আমি উনাকে কিছু বলতে যাবো এমন সময় ডক্টর বের হয়ে এলেন। তাকে দেখে প্রান্ত ভাইয়া জিজ্ঞেস করলেন,
—আমার ওয়াইফ কেমন আছে, ডক্টর?
—শি ইজ ফাইন। একটুপর জ্ঞান ফেরার কথা। তখন দেখা করতে পারবেন। কংগ্রাচুলেশনস ফর ইউর বয়!
প্রান্ত ভাইয়া সহ সবাই হাসিমুখে ধন্যবাদ দিলেন ডক্টরকে। ডক্টর চলে যাওয়ার পর নার্স বাচ্চাকে মায়ের কাছে নিয়ে গেলো। অতঃপর সবাই এক এক করে বাসায় চলে এলো। সকলের মনে স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছাস একটি নতুন প্রাণের দেখা পেয়ে! একটি বাচ্চা আল্লাহর তরফ থেকে রহমত নিয়ে আসে! কিভাবে যেন পৃথিবীতে আসামাত্রই সকলের মনে খুশির জোয়ার বয়ে আনতে পারে! অদ্ভুত সুন্দর না ব্যাপারটা?
________________________
আজ রাইসার ছেলের প্রথম মুখে ভাত। সেদিনের বাচ্চাটা কত দ্রুতই যেন ছয়মাস অতিক্রম করলো। নাম রাখা হয়েছে রাফসান। প্রান্ত ভাইয়া-ই রেখেছেন এ নাম। বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছি। আমার সাথে ওর বেশ ভাব বলা চলে। খুব পছন্দ করে আমার কোলে থাকতে। ওকে নিয়ে বেশ আনন্দের সাথেই কাটে আমাদের সবার দিন, বাসাটা ভরা ভরা লাগে যেন। অস্পষ্ট বুলিতে আধো আধো ধ্বনি মনপ্রাণ জুড়িয়ে দেয়। আজ শুক্রবার হওয়ার বাসায় সবাই আছে। জুম্মার নামাজ পড়ে মাত্র বাসায় ফিরেছেন ছেলেরা। আকাশি রঙা পাঞ্জাবি পরিহিত পূর্ণ পাশে এসে বসলেন সোফায়। বসেই পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে আমার কোল থেকে রাফসানকে নিয়ে নিলেন। কোনো এক অদ্ভুত কারণে সে কেন যেন পূর্ণর কাছে যেতেই চায়না। তবুও উনি ওর বুঝে উঠার আগেই আমার কোল থেকে ওকে নিয়ে নিলেন। তো রাফসান বেচারা উনার কোলে যেতেই মুখ ফুলিয়ে ভ্যা ভ্যা করে কেদে ফেললো। ফ্যালফ্যাল চোখে সেদিক চেয়ে বেশ কয়েকবার ওকে থামানোর চেস্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন পূর্ণ। এরপর ওকে আমায় ফেরত দিয়ে দিলেন। অথচ আমার কাছে এসে দিব্যি কান্না থামালো সে। এবার আমার কোলে বসেই গোলগাল চেহারায় হাসি ফুটিয়ে মনের সুখে এখান থেকেই পাশে বসা পূর্ণর চুল টানার চেস্টা করছে সে, অস্পষ্ট গলায় এটা সেটা বলে একা একাই খেলছে। এসব দেখে সরু চোখে চেয়ে আছেন পূর্ণ, উনার মুখ দেখে ঠোঁট চেপে হেসে ফেললাম আমি। যা দেখে বিরক্তির সাথে তিনি বলে উঠলেন,
—হেসো না, তুরফা। মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার।
উনার কথায় হাসি থামার পরিবর্তে আরেকটু বেড়ে গেলো আমার। হাসতে হাসতেই বললাম,
—আচ্ছা সরি৷ কিন্তু কি করবো বলুন? আপনার ভাতিজার কাজকর্ম দেখে না হেসে পারছিনা। সত্যি করে বলুন তো, কি করেছেন আপনি ওকে? যেতে চায়না কেন আপনার কাছে?
—আমি কিছুই করিনি। ওকে তো আদরই করি। তাও কেন আসতে চায়না বুঝিনা।
—হয়তো তোমার গম্ভীর মুখ দেখে ভয় পায়, বড় ভাইয়া। একটু হাসিখুশি থেকো তাহলেই যাবে।
ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে প্রিয়া বলে উঠলো। ওর সাথে প্রান্ত ভাইয়া, রাইসাও চলে এসেছে। প্রিয়ার কথায় আমাদের হাসি আরেকটু বৃদ্ধি পেলো।
—বেশি কথা বলছিস যে? কয়দিন পর না তোর এইচএসসির রেজাল্ট দিবে সে হিসেব আছে? আমার কিন্তু ঠিকি মনে আছে।
—হুম, তোমার মনে থাকবেনা তো কার থাকবে!
পূর্ণর কথায় বিড়বিড়িয়ে উত্তর দিলো প্রিয়া। বেচারি খানিকটা চুপসে গেলো বোধহয়! এক মাস আগেই এইচএসসি শেষ হয়েছে ওর। রেজাল্টের পরেই রায়হান ভাইদের এ বাসায় আসার কথা বিয়ের ব্যাপারে খোলাখুলি আলোচনা করার জন্য। পূর্ণর কথায় ও রাগী চাহনি দেখে আমাদের হাসি আর বেশিক্ষণ টিকলোনা, নিমিষেই মিলিয়ে গেলো ঠোঁটের কোণে। পরিস্থিতি ঠিক করতে প্রান্ত ভাই সামনের সোফায় বসে বললেন,
—ইশ রে আমার ছেলেটা। একেতো ভাইয়ের কাছে যেতে চায়না, তার মধ্যে আবার তুরফার কোলে বসে থাকে সারাদিন। বেচারা যে দুইদিক থেকে বড় ভাইয়াকে ডিস্টার্ব করছে সেটা বুঝেনা।
এবার পূর্ণর চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হলোনা। প্রান্ত ভাইয়ার কথায় আরেকদফা হাসাহাসি হলো। মাঝখান দিয়ে রাফসান পিচ্চিটা সবার হাসির দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকলো। এসবের মাঝেই রাইসা আমায় বললো,
—ওকে দে এবার। মা আসছে একটু পর ভাত নিয়ে। খাওয়াবেন ওকে।
অতঃপর আমার কোল থেকে ভালো বাচ্চার ন্যায় মায়ের কোলে চলে গেলো সে। একটু পর বড়াম্মু এলেন। শুরু হলো বাচ্চাকে প্রথম ভাত খাওয়ানো। বাচ্চাটা বড় হওয়ার প্রথম ধাপ অতিক্রম করলো। সবকিছু শেষে রাফসানকে ঘুম পাড়িয়ে আমাদের নিজেদের খাওয়াদাওয়া শেষে সবাই যার যার রুমে চলে গেলো রেস্ট নিতে।
__________________________
গোধূলির আলোয় রাঙিত প্রকৃতি। নীড়ফেরা পাখির কিচিরমিচির ডাক ও বহমান খোলা হাওয়ায় বারান্দায় বসে থাকতে বেশ লাগছে। পূর্ণ রুমে ঘুমাচ্ছেন, কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই এক অদ্ভুত কারণে। যত দিন গড়াচ্ছে, রাফসানের সাথে সময় কাটাচ্ছি, আমার মনেও একটি সুপ্ত ইচ্ছা জাগ্রত হচ্ছে। আমাদের নিজের সন্তান হলে কেমন হয়? আমার ও পূর্ণর একটি অংশ আমাদের মাঝে বেড়ে উঠবে, আদুরে গলায় আমায় মা ও তাকে বাবা বলে ডাকবে! ভাবতেই তো মনের মাঝে শিহরণ জাগে! মা-বাবা হওয়ার অনুভূতি যে কতটা চমৎকার তা রাইসা-প্রান্ত ভাইয়াকে চোখের সামনে দেখে খুব কাছে থেকেই অনুভব করেছি এ কয়মাসে! আমি মনে মনে নিশ্চিত যে পূর্ণ নিজেও বাবা হতে চান। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো সরাসরি আলাপ হয়নি আমাদের মাঝে। যতবারই বলতে গিয়েছি ততবারই “তুমি এখনো ছোট” কথাটি বলেই মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন আমার। কিন্তু এখন মনের ইচ্ছে কে আর ভেতরে চেপে রাখা যাচ্ছেনা। তাই উনাকে এ বিষয়ে কিভাবে বলবো ভাবছিলাম একা একা! ঠিক এমন সময় পায়ের আওয়াজ কানে এলো, বুঝে গেলাম তিনি উঠেছেন ঘুম থেকে। এরপর নির্ঘাত আমার খোজেই বারান্দায় আসছেন! ভাবতে দেরি হলো কিন্তু তার জড়িয়ে ধরতে দেরি হলোনা! পেছন থেকেই কোমড় জড়িয়ে কানের কাছে মুখ এনে ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বললেন,
—এত তাড়াতাড়ি উঠে গেলে যে? রেস্ট নিতে কি মন চায় না তোমার?
—ঘুমালামই কই? ঘুম ধরেনি তো!
—কেন ধরবেনা? আমি তো ঘুম না ধরার মতো কিছু করিনি যে ঘুম ধরবেনা!
—ধুর! আপনার এসব ফাজলামো রাখেন তো! সরুন এখন। ছাড়ুন আমায়।
বিব্রত স্বরে তার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে উঠলাম। তবে এতে তার ভাবমূর্তির বিশেষ পরিবর্তন হলোনা। আমায় পেছন থেকে তার দিকে ঘুরিয়ে বারান্দার রেলিঙের সাথে মিশিয়ে দুই পাশে হাত রেখে বলে উঠলেন,
—কি হয়েছে? আগে সেটা বলো।
—কিছু না।
—কিছু না মানেই তো “অবশ্যই কিছু হয়েছে”। এখন জলদি বলো।
খানিকটা থেমে কোমল গলায় বললেন,
—কি হয়েছে, বউ? বলো না! কোনো কারণে মন খারাপ?
উনার কোমল সুরে একটু সাহস পেলাম আমি। গলা নামিয়ে নমনীয় কণ্ঠে বললাম,
—একটা কথা বলি? রাগ করবেন না বলুন।
—করবোনা। তোমার উপর এমনিতেও আমি খুব একটা রাগ দেখাতে পারিনা আজকাল। এখন জলদি বলো কি হয়েছে।
মনোযোগী দৃষ্টিতে আমার দিক চেয়ে বললেন তিনি। তার আগ্রহ দেখে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম,
—আপনার কি মনে হয়না আমাদের ঘরেও একটা ছোট্ট পুতুল আসা উচিত এখন? যে আমাদের জীবনকে পরিপূর্ণতা দিবে?
কথাটি শুনেই তার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। শান্ত চেহারাটাও নরম হয়ে এলো। কিছুক্ষণ আমার দিক তাকিয়ে থেকে হালকা কেশে সরে গিয়ে বললেন,
—এ ব্যাপারে তো আগেও বলেছি না, তুর পাখি? তুমি তো ছোটই আছো। আমাদের বাচ্চা হওয়ার জন্য এখনো ঢের সময় বাকি আছে!
—বলেছে আপনাকে? আমার এ বয়সে থাকতে রাইসা প্রেগন্যান্ট হয়েছিলো। তখন তো আপনার কাছে ওকে ছোট লাগেনি। তবে আমার বেলায় এসব বলছেন কেন?
কিছুটা বিরক্তি নিয়ে কোমড়ে হাত রেখে সরু চোখে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম। আমায় এভাবে রাগতে দেখে যেন বেশ মজা পেলেন তিনি, হুহা করে হেসে উঠলেন গালভরে! তা দেখে রাগের শিখা আরেকটু বেড়ে গেলো আমার। পূর্ণ বুকে হাত দিয়ে বলে উঠলেন,
—এভাবে রাগ করেনা, তুর পাখি। বুকে লাগে!
রসিকতা করে উনি কাছে এগোতে নিলেই তার হাত সরিয়ে দিয়ে রুমের ভেতরে চলে যেতে যেতে বলে উঠলাম,
—সরুন তো। এখন এসব ঢং করতে হবেনা। কাছে আসবেন না একদম। যত্তসব!
কিন্তু বারান্দা থেকে পা বের করার আগেই হঠাৎ করে পেছন থেকেই পাজাকোলে তুলে নিলেন তিনি।
—কাছে আসবোনা মানে? একেতো রাফসানটা সারাদিন তোমার কোলে উঠে বসে থাকে। না ও নিজে আমার কাছে আসে, না তোমায় আমার কাছে আসতে দেয়। নিজের বাচ্চা হলে যে আরও কেমন দিন দেখতে হবে আল্লাহ মালুম! তার মধ্যে তোমার মুড সুয়িংস তো আছেই! এই তুর পাখি, আমার উপর কি দয়া হয় না তোমার?
একনাগাড়ে কথাগুলো হাসতে হাসতেই আমায় নিয়ে প্রবেশ করলেন রুমের ভেতর। দরজার পেছনে চাপা পড়ে রইলো আমার সকল অভিযোগ এবং তার উচ্চ গলার হাসিতে মুখোরিত হলো এতক্ষণের নিশ্চুপ পরিবেশ!
চলবে…………..