বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা
সকাল থেকেই জোরেশোরে চলছে আকদের প্রস্তুতি। যেহেতু ঘরোয়াভাবেই অনুষ্ঠান হবে তাই আমরাও সবাই যে যতটা পারি সবধরনের কাজে সাহায্য করছি। দাদি সোফায় বসে গান শুনতে শুনতে তদারকি করছেন সবাই ঠিকমতো কাজ করছে না। অবশ্য কাজ করতে আমাদের কারও মন্দ লাগছেনা। বিয়েবাড়িতে কাজ করার মজাও আলাদা!
“কেন রোদের মতো হাসলেনা
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না”
রেডিওর তালে তালে গুনগুন করতে করতে কাজ করছি। কাজ বলতে গেটের সামনে ফুলের মালা দিয়ে সাজানো। যেটা করার কথা ছিলো রায়হান ভাইয়ার, অবশ্য উনি করছিলেনও কাজটা। তবে মালা লাগানো শেষ হওয়ার আগেই আন্টির ডাকে কাজ ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। আমি ভাবলাম যেহেতু বসেই আছি ভাইয়া আসা পর্যন্ত আমিই লাগিয়ে দিই। যেই ভাবনা সেই কাজ, উঠে পড়লাম চেয়ারে মালা লাগানোর জন্য। তবে হাইটে ছোট হওয়ার কারণে আমার হাত ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছিলো না গেইটের উপর পর্যন্ত। বার কয়েক চেস্টা করতে না করতেই আমার হাত ফসকে নিচে পড়ে গেলো মালাটা।
—হোয়াট ননসেন্স!
কারও রাগী গলার চিৎকার শুনে চমকে উঠলাম আমি। নিচে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ ভাইয়া চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে! তার মাথার উপর ঝুলে আছে মালাটা। ভীষণ হাস্যকর দেখাচ্ছে উনাকে! কিন্তু হাসতে ধরতেই তার রাগ দেখে ঘাবড়ে গেলাম আমি! তাই আপনাআপনিই মুখে চলে গেলো আমার। না জানি এখন কি বলে আমাকে লোকটা!
—ওয়াও! হোয়াট আ পিকচার!
মেয়েলি আওয়াজ শুনে পূর্ণ ভাইয়ার থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে পাশে তাকালাম আমি। হাস্যোজ্জ্বল তার বোনকে দেখে আরও চমকে গেলাম! ব্যাপার কি? দুই ভাইবোন এত সকাল সকাল এখানে কি করে?
—কিসের ছবি, প্রিয়া? দেখা আমাকে।
রেগে বললেন পূর্ণ ভাইয়া। কথা শুনে বুঝলাম উনার বোনের নাম প্রিয়া।
—না ভাইয়া, দেখানো যাবেনা। তোমাকে দেখতে যে কি ফানি লাগছে তুমি জানো? এই ছবি দেখলে নির্ঘাত আমার ফোন ফেলে দিবে তুমি। আমি ওই রিস্ক নিতে পারবোনা বাবা!
ভয়ে ভয়ে বললো প্রিয়া। ওর কথা শুনে পূর্ণ ভাইয়া কড়া চোখে তাকালেন আমার দিকে। তার চাহনি দেখে আমি শুষ্ক ঢোক গিললাম। মনে মনে ইনসাল্ট হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই তিনি বলে উঠলেন,
—কাজ করতে পারেনা আবার করতে যায়। হাইটে না কুলোবে না তাও সাজাতে চাচ্ছে। হাউ স্টুপিড।
এত বড় সাহস উনার! আমাকে আবার স্টুপিড বলছে! তার কথা শুনে আমি রেগে এক লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে নামলাম। তিনি শান্তভাবেই ভ্রু কুচকে তাকালেন আমার দিকে। আমি কোমড়ে হাত রেখে রাগী গলায় বললাম,
—আপনি আমাকে আবার স্টুপিড বললেন? আমি কি ইচ্ছা করে মালা লাগাতে গিয়েছি? রায়হান ভাইয়া করছিলেন কাজটা। উনি আন্টির ডাকে চলে গেছেন বলেই আমি উনার কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য হাত দিয়েছি, বুঝেছেন?
—খুব হেল্প করছো তুমি তা তো দেখতেই পাচ্ছি। সেজন্যই গেইটের জায়গায় মানুষের মাথার উপর মালা ফেলে দিচ্ছো। (তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন)
উনার কথায় আমি দাত কিড়মিড় করে বললাম,
—মালা ফেলেছি তা না হয় মানলাম কিন্তু আপনার মাথায় ওটা পড়েছে সেটাও কি আমার দোষ? আমি কি জানতাম আপনি সকাল সকাল এই বাসায় আসবেন? তাহলে কোন ভিত্তিতে আমাকে স্টুপিড বলেছেন?? (রেগে)
উনি কিছু বলতে নিতেই আমরা প্রিয়ার গলা শুনতে পেলাম। দুজনেই তাকালাম সেদিকে। দেখি প্রিয়া দাত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ওর হাতে ফোন। মনে হচ্ছে যেন ভিডিও করছে!
—হোয়াট ননসেন্স, প্রিয়া? তুই কি করছিস এখন? ডোন্ট টেল মি তুই ভিডিও করছিস আবার।
রেগে বললেন পূর্ণ ভাইয়া।
—ওফফো ভাইয়া। ডিস্টার্ব দিও না তো। তোমরা দুজন ঝগড়া কন্টিনিউ করো। দেখতে বেশ মজাই লাগছিলো। ভেরি ইন্টেরেস্টিং!!
হাসতে হাসতে বললো প্রিয়া।
এদিকে তাদের ভাইবোনের কথার কোন মাথামুণ্ডু খুজে পাচ্ছিলাম না আমি তাই চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। পূর্ণ ভাইয়া কিছু বলতে নিলেই তার ফোন বেজে উঠলো। উনি রিসিভ করে “আসছি” বলে ফোন কেটে দিয়ে বললেন,
—আমার হাতে এখন সময় নেই দেখে তুই বেচে গেলি। বাট ডোন্ট ফরগেট আমি তোর ফোন চেক করবো। একটা ছবি/ভিডিও যেন না থাকে তোর ফোনে, বুঝেছিস?? একটু পর থেমে বললেন,
—আমার এখন অফিসে যেতে হবে। আর তোকে ড্রাইভার বাসায় রেখে আসবে একটু পর। এর মধ্যে যা যা করতে এসেছিস করে নে।
বলে এক পলক আমার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে চলে গেলেন উনি। তার যাওয়ার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলাম আমি।
এখানে কি হলো এতক্ষণ কিছুই বুঝলাম না। তাই প্রিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
—তোমার নাম প্রিয়া?
—হ্যাঁ, আমি প্রান্ত ভাইয়ার ছোট বোন। তোমার নাম কি? তুমি নিশ্চয়ই ভাবীর বোন হবে, তাইনা?
—হ্যাঁ। আমার নাম তুরফা। আমি ওর বোন। (ইতস্ততভাবে বললাম)
—বাহ তোমার নামটা বেশ সুন্দর। ইউনিক নেম। তুমি দেখতেও খুব সুন্দর আপু। আর তোমাকে সাহসী মনে হচ্ছে। একদম ভাইয়াকে টক্কর দিতে পারবে। আমি তো অবাক হয়ে গেলাম তোমার জবাব দেওয়া দেখে! অনেকদিন পর আজকে বেশ জব্দ করা গেছে বড় ভাইয়াকে! অল থ্যাংক্স টু ইউ।
(দাত কেলিয়ে)
ওর কথা শুনে হালকা হাসলাম আমি। মনে মনে বললাম তোমার ভাইয়ের রাগী চোখ দেখলে আমার ভেতরে কি যে অবস্থা হয় সেটা না হয় না-ই বললাম। কেউ সামনে থেকে যদি আমাকে সাহসী ভাবে তবে নেহাৎ মন্দ নয় ব্যাপারটা! এই গল্পের আসল লেখিকা ‘তাসফিয়া হাসান তুরফা’।
প্রসঙ্গ পালটে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
—আচ্ছা, তুমি তখন ভিডিও করছিলে কেন? আর কিসের ছবি তুলছিলে একটু আগে। পূর্ণ ভাইয়াকে অনেক ফানি লাগছিলো নিশ্চয়ই? দেখাও আমাকেও। (হাসতে হাসতে বললাম আমি)
—আর বলো না আপু। ছবি তুলার পুরনো অভ্যাস আমার। যেকোন সময় ছোটখাট মুহুর্তের ছবি তুলে সেটাকে স্মৃতি হিসেবে সাজিয়ে রাখতে ভালোবাসি আমি। আর ভিডিও করাও হয় একি কারণেই। নতুন জায়গায় গেলে আশেপাশের ভিডিও করে রাখি ফ্রি টাইমে দেখি ওগুলো।
মুচকি হেসে বললো প্রিয়া। ওর কথা শুনে হাসলাম আমিও। বাহ, বেশ সুন্দর চিন্তা। এভাবে তো স্মৃতি ধরে রাখার কথা ভাবিনি কখনো! যাই হোক, প্রিয়া আমাকে ওর ফোনে ছবি দেখালো। একটিতে পূর্ণ ভাইয়ার মাথার উপর মালা ঝুলছে উনি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন উপরের দিকে। ছবিটি দেখে হুহু করে হাসি পেলো আমার! এত্ত ফানি লাগছে উনার এক্সপ্রেশন দেখতে! পরের ছবি দেখতেই আমার হাসি উড়ে গেলো। কেননা ওই ছবিতে আমিও আছি।
পূর্ণ ভাইয়া মাথার উপর মালা নিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে আর আমি মুখে হাত দিয়ে চেয়ারে দাঁড়িয়ে আছি। ছবিটি দেখে মুহুর্তটা মনে করে ভীষণ লজ্জা পেলাম আমি। তাই প্রিয়াকে ডিলিট করতে বললাম এটা। কিন্তু ও রাজিই হলোনা। আমাদের কথা বলার মাঝেই দাদি এলেন আমাদের কাছে। প্রিয়াকে দেখে হাসিমুখে বললেন,
—তুমি আসছো। তোমার মা এখনি ফোন দিয়ে জানায় দিলো তোমাদের আসার কথা। রাইসার জন্য বিয়ের শাড়ি পাঠায় দিসে তোমাদের হাতে। তুমি একা কেন? তোমার ভাই কই? ওরে দেখিনা যে।
বলেই পূর্ণ ভাইয়াকে খুজতে লাগলেন দাদি। প্রিয়া উনাকে সালাম দিয়ে বললো,
—বড় ভাইয়া চলে গেছেন দাদি। আমাকে নামিয়ে দিয়েই চলে গেলেন একটু আগেই। আমরা চলুন ভেতরে যাই ভাবীর কাছে।
প্রিয়ার কথা শুনে মাথা নাড়লেন দাদি। আমরা ভেতরে চলে গেলাম রাইসার রুমে। ওর জন্য পাঠানো শাড়ি-গহনা সব বের করে দেখলাম আমরা। প্রতিটি জিনিসই খুব রুচিশীলতার পরিচয় দিচ্ছে। মানতেই হবে ওর শশুড়বাড়ির লোকজনের চয়েস ভালো। আমি লাল বেনারসিটা ধরে শাড়ির আচল ওর মাথায় ধরলাম। ভীষণ মানিয়েছে রাইসাকে। সবাই মাশাল্লাহ বললাম ওকে দেখে। তারপর কিছুক্ষণ আমাদের সাথে গল্পগুজব করে প্রিয়াও চলে গেলো ওর বাসায়।
___________
অবশেষে কালকে রাইসার আকদ। বাসার সবার মনে বিষন্নতার ছোয়া লেগেছে৷ থম মেরে বসে আছে রাইসা। আন্টি ও দাদি একটু পর পর কাদছেন, আংকেল উদাস মুখে বসে আছেন। এমনকি রায়হান ভাইয়াও আজ কোন কথা বলছেন না।
সবার মুখ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে গেলো। যেদিন থেকে এ বাসায় এসেছি রাইসাই ছিলো আমার সকল সুখ-দুঃখের সাথী। আপন বোন না হয়েও কোনদিন আমাকে পর মনে করেনি ও। সকল হাসি-খুশির গল্প আমার সাথে শেয়ার করেছে। কালকে ও চলে গেলে বাসাটা সত্যিই ফাকা ফাকা লাগবে। তখন একা-একা এই বাসায় কিভাবে থাকবো ভাবতেই দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার!
আজকেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে কাল বিদায়ের সময় সবার কেমন লাগবে ভাবতে লাগলাম আমি। তবে কালকের দিনটা যে আমার উপরেও একটা ঝড় বয়ে আনবে সেটা কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি আমি।
#চলবে