®রোজা রহমান
‘
” এই রাঙা মুলা, ভাঙা কুলা কোনো কাজের না “
” এ্যাই গোবর ঠাঁসা কি বললি তুই? আমি কোনো কাজের না? “
” তাইলে মানছো তুমি রাঙা মুলা, ভাঙা কুলা ? “
” গোবর ঠাঁসার বাচ্চা! “
কথাটা অতি রাগের সাথে বলে শিশির তেড়ে গেল কুয়াশার দিকে। কিন্তু নীহার আঁটকে দিল। ধমকে বলল,
” শিশির! হচ্ছে কি এসব? ”
” তুই দেখছিস না? ও হাত পা ধুয়েমুছে লেগেছে আমার সাথে? “
” ও ছোট বাচ্চা। ওর কথা কেন ধরবি তুই? আর বললেই কি তুই ওসব হয়ে যাবি? “
” ভাই তুইও এই কথা বলছিস? ওকে সহ্য হয় না আমার। চোখের সামনে থেকে সরতে বল। নয়তো আমিই গেলাম কর তুই তোর প্রেমের প্ল্যান একাই ”
এই বলে শিশির নিজেকে ঝাঁটকা মেরে ছাড়িয়ে নিল নীহারের থেকে। নীহার এবার একটু নরম হয়ে আবার শিশিরকে নিয়ে বিছানায় বসল। বলল,
” আরে রাগ করিস কেন আমার সোনা ভাই? তুইও আমার বাচ্চা ভাই। আয় আদর করে দিই একটু। তাও রাগ করিস না৷ কুশু তো ছোটই বল! তাই বললাম। ”
” সর, আগলা পিরিত দেখাতে হবে না “
” আগলা পিরিত কই দেখাচ্ছি? আমি তোকে ভালোবাসি না? আমার মতো ভাই পাবি তুই? “
শিশির কোনো উত্তর করল না। সে এটা মানে যে নীহার ও ভাই কম বন্ধু বেশি। সব কথা শেয়ার করে সে নীহারের সাথে। নীহার শিশিরের থেকে দশ মাসের মতো বড়। এই জন্য শিশির ওর সাথে তুই করে বলে আর নাম ধরেও ডাকে কোনো সময় আবার ভাইও বলে।
‘
এখানে প্রথমে ঝগড়া লাগার কারণ হলো তারা এখন নীহারের ঘরে বসে তার প্রেম সফল হবার প্ল্যান করছে৷ নীহার একটা মেয়েকে পছন্দ করে। কিন্তু বলতে পারেনা। এটার জন্যে সে শিশিরের সাহায্য নেবে কারণ মেয়েটা শিশিরের ক্যাম্পাসের। এই ঘরে এখন উপস্থিত আছে, কুয়াশা, ঈশা, ইয়াসমিন, বৃষ্টি, হিমেল, শিশির। নীহার কুয়াশার সাথেও বিষয়টা শেয়ার করেছিল। আর এ বাড়িতে হিমেল সবার ছোট সদস্য হলেও তাকে কখনো কোনো ভাই কোনো বিষয় থেকে দূরে রাখে না। বাড়িতে হিমেলকে সবাই হিম বলে ডাকে। নীহার কুয়াশাকে বাচ্চা কুশু বলে ডাকে।
ঈশা, ইয়াসমিন আজ থেকে গেছে। মূলত ফুপু যেতে দেয় নি এই জন্য রয়ে গেছে৷ তারা ফুপুর বাসায় আসে মাঝে মাঝেই কিন্তু রাত থাকে খুব কম। কারন আম্বিয়া বেগমের ভাই খুব কঠিন মানুষ। তিনি চান না বিয়ের আগে মেয়ে বোনের বাড়ি রাত কাটাক।
‘
বৃষ্টি বলল,
” মেজো দেবরজী, শোনো আমি বলছি তোমাকে মেয়েটাকে কিভাবে বলবে “
বৃষ্টির কথায় সবার ওর দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাল। সবার আগ্রহ নিয়ে তাকানো দেখে বৃষ্টি বলা ধরল,
“প্রথমে ক্যাম্পাসে যাবে তারপর মেয়েটাকে খুঁজবে তারপর মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে দেন হাঁটু মুড়িয়ে বসবে ও হ্যাঁ আগে কিন্তু এক তোরা গোলাপ কিনবে একদম লাল টকটকে দেন তোমার পিছে থেকে বের করবে তারপর তোমার মনের কথাটা তার কাছে পেশ করবে। দেখবে সে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারপর তুমি ওর হাতটা নিয়ে গোলাপ গুজে দেবে যদি তখনো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তো। তারপর একটা কিস করবে আরে না, ঠোঁটে না হাতে করবা। দেখবা মেয়ে জমে ক্ষীর হয়ে গেছে আর জমে ক্ষীর হয়ে গেলে ভাববা সেটা পায়েশ হওয়া কনফার্ম “
বৃষ্টি একের পর এক বলেই চলেছে আর উপস্থিত সবাই হা করে তাকিয়ে আছে। এ কি ভাবি রে ভাই!! ভাবি দেবরকে এমন করে প্রপোজ করার প্ল্যান দিচ্ছে? সবাই তখনো চেয়ে আছে৷ আর বৃষ্টি তার বক্তব্য শেষ করে সবার দিকে নজর দিয়ে কিছুটা ভড়কে গেল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” কি? ওভাবে কি দেখছো সবাই? আরে কুল আমি তোমাদের ডিজিটাল ভাবি। সো, কোনো ফর্মালিটি নাই আমার সাথে।”
কুয়াশা তাকিয়ে থেকে বলল,
” ভাবিইই!! “
বৃষ্টি অপ্রস্তত হলো। আমতা আমতা করে বলল,
” না মানে, আরে তেমন কিছু না। তোমাদের ভাই এভাবেই আমাকে প্রপোজ করেছিল ”
কথাটা বলে বৃষ্টি মাথা ঝুঁকিয়ে নিল৷ কেমন রক্তিম হয়ে উঠেছে তার দুই কোপল জোড়া। লাল আভায় ঢেকে আসছে। যেন কেউ আবিরে রাঙিয়ে দিয়েছে বৃষ্টিকে। মেয়েটা প্রেম বার্তা বলতে গিয়ে এতটা লজ্জা পাচ্ছে!!
সবাই বৃষ্টির অবস্থা দেখে জোরে জোরে হেসে দিল। আর বৃষ্টি আরো লজ্জা পেয়ে গেল। ইয়াসমিন হাসতে হাসতে এগিয়ে গিয়ে বৃষ্টির কাঁধের উপর হাত দিয়ে বলল,
” ভাবি আমার ভাইতো তাইলে সেই রোমান্টিক! “
বৃষ্টি লজ্জায় কথা বলতে পারল না। মেয়েরা ভালোবাসার মানুষের সান্নিধ্যে গেলেও লজ্জা পায় আবার তাদের নিয়ে ভাবলেও লজ্জা পায়৷ কি আজব এই মেয়েজাতি!
কুয়াশা কেমন ঘোরের মধ্যে থেকে বলতে লাগল,
” ভাইয়া তুমি একদম রোমিওর মতো করে প্রপোজ কোরো। মেয়েটার বাড়ির ঠিকানা নিয়ে রাতের আঁধারে মই বেয়ে মেয়েটাকে ডেকে এনে প্রপোজ করবে। ইশশ কি রোমান্টিক!! আর রোমিওর মতো কিস…”
আর বলতে পারল না। মাথায় চা-টি পড়ল। আর তা মে-রেছে অবশ্যই শিশির। সে ছাড়া আবার কে? একমাত্র শত্রুই তো এই বুনো ওল। কুয়াশা কথাগুলো বলার সময় শূন্যে দৃষ্টি দিয়ে একদম বিভোর হয়ে বলছিল৷ তাই শিশির কখন এসে তাকে মা-রল খেয়াল করেনি। মাথা ডলতে ডলতে শিশিরের দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসছে। শিশির বলল,
” অ-সভ্য, ফা-জিল হচ্ছিস দিন দিন৷ দুই দুইটা বড় ভাইয়ের সামনে কি বলছিস সেটাও পরোয়া করছিস না। তোর হচ্ছে দাঁড়া। আজই বাবাকে বলে বিয়ের জন্য পাত্র দেখতে বলছি। বেয়া’দব গোবর ঠাঁসা!”
কথা গুলো রাগের সাথে বলল শিশির৷ শিশিরের শুরুর কথাগুলোকে পাত্তা না দিলেও বিয়ের কথা শুনে সে আরো রেগে গেল। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সামনে থাকা শিশিরের উপর আ’ক্র’ম’ণ করে বসল। আর এটা যেমন তেমন আ’ক্র’ম’ণ না! একদম সিংহীর মতো আ’ক্র’ম’ণ করেছে। শিশির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সে শিশিরকে দুই বাহু আঁকড়ে ধরে দুই পা উঁচু করে শিশিরের বুকের বা পাশটার উপর কামড় বসিয়ে দিয়েছে৷ অনেকটা জোরেই দিয়েছে। আকষ্মিক ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তত ছিল না। তাই সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। রাগে নাকি মানুষের জ্ঞান বুদ্ধি লোপ পাই? ঠিক সেটাই হয়েছে কুয়াশার। সে কি করছে না করছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এদিকে শিশির যখন বিষয়টা বুঝল তখন ব্যথায় চোখ মুখ খিঁচিয়ে নিল। আর সবাই কুয়াশাকে শিশিরের থেকে ছাড়াতে ব্যস্ত। শিশির আর সহ্য করতে না পেরে এবার কুয়াশার দুই বাহু ধরে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিল৷ চোখ মুখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। যেন সেই চোখ দিয়েই কুয়াশাকে ভ’স্ম করে দেবে। কুয়াশা হাঁপাচ্ছে। মুখে নোনতা স্বাদ অনুভব হচ্ছে। বোধহয় রক্ত বের হয়ে গেছে। নোনতা স্বাদ পেতেই কুয়াশা নরম হয়ে এলো। রাগ পড়ে গেল শরীর থেকে। ভয় এসে হানা দিল তার মধ্যে। এটা সে কি করে বসল? আল্লাহ! এবার বোধহয় শিশির তার উপরে পাঠিয়েই ছাড়বে। আজই বোধহয় তার শেষ দিন হবে পৃথিবীতে। ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে তাকাল শিশিরের পানে। দেখল রণমুর্তি ধারন করে দাঁড়িয়ে আছে৷ শিশির এবার তেড়ে আসতে গেল উদ্দেশ্য ঠাঁটিয়ে একটা থা-প্পড় দিয়ে এই গোবর ঠাঁসাকে আজ বধির বানাবে। কিন্তু নীহার আর হিমেল আঁটকে নিল। নীহার বলল,
” ভাই, ভাই, আমার সোনা ভাই শান্ত হো। ও ছোট মানুষ বুঝে নি। মাফ করে দে এবারের মতো প্লিজ৷ ভাই আমার বাচ্চা ভাই, আমার আদর। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেছে ছেড়ে দে৷ আয় বোস তুই। ”
হিমেল বলল,
” হ্যাঁ ভাই ছেড়ে দাও। বুবু রাগের মাথায় করে ফেলেছে। কিছু বলো না৷ এবারের মতো ক্ষমা করে দাও “
আর কুয়াশা? সে তো তখনি ভোঁদৌড় দিয়েছে যখন শিশিরকে তেড়ে আসতে দেখেছে। শিশির চোখ মুখ লাল করে নীহার আর হিমের দিকে তাকাল। নীহার ভয় না পেলেও হিম ভয় পেয়ে গেল। বৃষ্টি সহ ঈশা, ইয়াসমিনও শান্ত করতে লেগে পড়েছে শিশিরকে। এর মাঝে ঈশার চোখ গেল শিশিরের বুকের উপর। চোখ যেতেই আৎকে উঠল সে। বিস্ময় নিয়ে মৃদু চেঁচিয়ে বলল,
” শিশির ভাইয়া আপনার বুক থেকে রক্ত বের হচ্ছে। ভিজে উঠেছে। ”
এই বলে সে হতদন্ত হয়ে শিশিরের বুকের উপর থেকে টি-শার্ট টা সরিয়ে ফেলল টেনে। এই ঘটনার আকস্মিকেও শিশির সহ সবাই ভড়কে গেল। মেয়েটা কি পাগল? ইয়াসমিন ধমকে উঠল। বলল,
” ঈশা! কি হচ্ছে কি? ছাড় শিশিরকে! “
কথাগুলো চোখ রাঙিয়ে বলল ইয়াসমিন। ঈশা কিছুটা ভয় তো পেল সাথে অপমান বোধ করল। কি এমন করল সে? রক্ত বের হচ্ছে বলেই তো দেখতে গেল সে। ঈশা সরে আসতেই নীহার শিশিরের বুকের উপর থেকে টি-শার্ট সরিয়ে পরখ করতে লাগল। দেখল কয়েকটা দাঁত বসে গেছে আর সেখান থেকে রক্ত উঠছে। নীহার কিছুটা বিব্রত হলো সাথে মন খারাপও করল। কি অবস্থা হয়েছে? মেয়েটা যে কেন এত পাগলামো করে! আর এই দু’টোই বা সবসময় এত লা-ঠা লা-ঠি কেন করে! শিশিরের দিকে তাকাল নীহার দেখল সে নিরুত্তর হয়ে বসে আছে৷ নীহার হিমকে বলল,
” ডয়ার থেকে ফাস্ট এইড বক্স দে। “
হিম কথামতো সেটা বের করে দিল। তা দিয়ে নীহার শিশিরের ক্ষত স্থান সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে এন্টিসেপ্টিক লাগিয়ে দিল। লাগাতে লাগাতে নীহার মজা করে ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
” কিরে ভাই ইনজেকশন লাগবে নাকি? না কামড় খেলি ইনফেকশন হতে পারে বলে বললাম। চিন্তা করিস না ডক্টরের কাছে গেলে নাভির উপর ইনজেকশন দিলে আর কিছুই লাগবে না। ”
সবাই মিটিমিটি হাসছে কথাটা শুনে। শিশির রাগে কটমট করতে করতে বলল,
” তাহলে মানছিস তোর বোন একটা বিষাক্ত জঙলী জন্তুু! “
নীহার তা শুনে কোনো প্রত্যুত্তর করল না। এরা দু’টোই এক। কারে ছেড়ে কারে কি বলবে? আর সব থেকে বড় কথা দু’টোই তাদের ভাই- বোন। আর কতকাল যে এসব দেখতে হবে সকলের কে জানে! কবে যে বড় হবে দু’টো।
______
সকাল আটটা। মালিথা ভিলার সকলে খাবার টেবিলে খাবার খাচ্ছে। সাথে ঈশা, ইয়াসমিনও আছে৷ তুহিন, ইয়াসমিন সামনাসামনি বসেছে৷ শিশির কুয়াশাও সামনাসামনি। দু’জন খাচ্ছে আর একে ওপরকে চোখ দিয়ে ভ’স্ম করছে। কুয়াশা আজ কিছুটা দমে আছে। কারণ কাল যে ঘটনাটা ঘটিয়েছে শিশির এখনো তাকে কিছু বলেনি। এমন নিরবতা কুয়াশাকে ক্রমেই ভয় গ্রাস করছে। এ যেন তান্ডবের পূর্বাভাস।
খাওয়া শেষ করে সবাই সবার গন্তব্যে রওনা দিল।
| চলবে |
all part