®রোজা রহমান
‘
দিনটা মিষ্টি মেঘলা দিন। মেঘরাজীরা উড়ে বেড়াচ্ছে। সকালে খাবার পর শিশির রিজভীর সাথে একবারে বেরিয়ে গেছে। সাথে স্মৃতিকে নিয়ে গেছে৷ রিজভী গতকাল রাতে সম্মৃতিকে তার অনুভূতির কথা জানিয়েছে৷ জানিয়েছে তাকে সে পছন্দ করে। তার ভালোবাসা সঙ্গী হবে কিনা! স্মৃতি এটা আগে থেকে কুয়াশার থেকে যদিও শুনেছিল তবুও মেয়েটা লজ্জা পেয়ে উত্তর তৎক্ষনাৎ করেনি। সে জানিয়েছে তার সময় লাগবে৷ একটা মানুষের প্রতি অনুভূতি তৈরি হতে সময় লাগে৷ হুট করে কিছুই হয় না৷ মনের মিলন ঘটতে সময়েরও ব্যপার স্যাপার আছে। তেমনই স্মৃতিও সময় চেয়েছে৷ তবে রিজভীকে সে রিজেক্ট করে নি তারও পছন্দ আছে রিজভীকে। দু’জনকে বেশ মানাবে। সেই কথা স্মৃতি যাবার সময় কুয়াশাকে বলে গেছে। কুয়াশা খুশিই হয়েছে। সময় নিয়ে তারা এগুক। স্মৃতি রিজভীর বাইকেই গেছে সে কলেজে যাবে। কুয়াশা আর আজ কলেজে যায়নি। ইচ্ছেটা আসেনি৷ বাড়িতে থেকে একটু সময় কাটাক।
শশী,মিহির রেডি হচ্ছে। তারাও চলে যাবে৷ নীহার আর বের হয়নি এখনো। সে শশীদের এগিয়ে দিয়ে বের হবে৷ সেই সময়ে ঈশা এলো দেখা করতে। তার আর ভালো লাগছিল না একা একা বাড়িতে। কলেজেও যায়নি সে। তাই চলে এসেছে। এসে মিহিরের কাছে গেল। তাদের ভাবভঙ্গি ভালো না৷ কিছু একটা বোধহয় চলছে তাদের মাঝে। নয়তো এত চিপকানো স্বভাব কেন? ইয়াসমিন সেটা লক্ষ্য করেছে।
ঈশা আর মিহিরের মাঝে পজেটিভ অ্যাট্রাকশন আছে৷ এটা তৈরি হয়েছে ইয়াসমিনের বিয়ের মধ্যে। ঈশার যে শিশিরের প্রতি ভালোলাগা কাজ করত সেটা সেই ভালোলাগা অবধি রয়ে গেছিল। কখনো সেটাকে বাড়তে দেয়নি। কারণ শিশিরকে একে তো সে ভয় পেত তারউপর সে যে তাকে পছন্দ করে না, বললেই রিজেক্ট ছাড়া কিছু হবে না এটা ঈশা বুঝে গেছিল৷ তাই কখনো ভালোলাগাকে প্রশ্রয় দেয়নি। এরই মাঝে মিহিরের সাথে তার ভালোই সক্ষতা গড়ে উঠেছে। হুয়াট্সআপে চ্যাটিংচুটিং ভালোই হয়৷ তবে এখনো মনের কথাটা কেউই বলেনি। ভালো বন্ধত্বের মধ্যে আছে৷ সময়ের সাথে দু’জন দু’জনের অনুভূতি বুঝলে হয়তো কিছু একটা হলেও হতে পারে৷
শশী কুয়াশার ঘরে তৈরি হচ্ছে। কুয়াশা সহ ভাবিরা সেখানেই আছে৷ মূলত শশীকে সঙ্গ দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে নীহার এলো সেখানে। জিজ্ঞেস করল তৈরি হওয়া হয়েছে কিনা! শশী জানাল হয়ে এসেছে। নীহার তা শুনে বলল রেডি হয়ে তার ঘরে আসতে একটু। ভাবিরা তা শুনে ঠোঁট টিপে হাসল৷ নীহার বলে চলে যাচ্ছিল কিন্তু ভাবিদের হাসি দেখে থেমে গেল। শশী লজ্জা পেল এভাবে সকলের সামনে ডাকাতে। নীহার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল,
” হাসছো কেন তোমরা? ”
” কই হাসছি? হাসছি না তো। তুমি নিয়ে যাও তোমার ইঁচড়েপাকা গার্লফ্রেন্ডকে। আমরা কিছু মনে করছি না “
বৃষ্টির কথায় সকলে আবার হাসতে লাগল মিটমিট করে। নীহারও কম যায় না সে-ও পাল্টা জবাব দিল,
” এমন ভাব ধরেছ তোমরা ভাবে লাগছে আমি আমার বিয়ে করা বউকে দিন দুপুরে কিসের না কিসের জন্য ডাকছি! “
সকলে এবার জোরে জোরে হেসে দিল। ইয়াসমিন বলল,
” নীহার একটু তো মুখে লাগাম দে। বড় ভাবি আমরা ”
” তোরা মনে করলে দোষ নেই আর আমি বললেই দোষ? তোরা যেমন ভাবে হাসছিস ভাবে লাগছে তেমন কিছুরই জন্য শশীকে ডাকছি আমি! আজব! আর হ্যাঁ তোকে আমার ভাবি মানতে বইয়ে গেছে। সেদিনের ছ্যাড়ি হয়ে আজ আমার ভাবি হইছিস! আমার তো এখনো মনে পরে তোকে পুকুরে চুবানি দিছিলাম। “
শুনে আবার হাসল সকলে। ইয়াসমিন চোখ রাঙানি দিল। বলল,
” হচ্ছে তোর দাঁড়া! “
বলে উঠে আসার জন্য প্রস্তত হচ্ছিল। তখনি নীহার হাওয়া। যেতে যেতে বলে গেল,
” আমার পেছনে না এসে আমার বাচ্চা ইঁচড়েপাকা গার্লফ্রেন্ডটাকে আমার ঘরে পাঠা জলদি। ”
” পারব না, দূর হ বে’দ্দপ”
মৃদু চেঁচিয়ে উত্তর করল ইয়ামিন। শশী শুধু দেখেই গেল। কিছু বলতে আর পারল না।
নীহার, ইয়াসমিন সেম ইয়ার হবার দরুণ তুই করেই বলত। আবার তারউপর মামাতো বোন এই জন্য অভ্যাসটা পাল্টায়নি।
কুয়াশা বলল,
” এ্যাই যে, নীহার ভাইয়ের ইঁচড়েপাকা গার্লফ্রেন্ড যান কী বলে শুনে আসেন ”
বলা শেষে ঠোঁট টিপে হাসল৷ উপস্থিত ওরাও হাসল৷ শশী লজ্জা পেয়ে দিল দৌড়।
‘
শশী দরজার কাছ থেকে দেখল নীহার এসে শুয়ে আছে। জিজ্ঞেস করল,
” আসব? “
নীহার শুনে উঠো বসে বলল,
” এসো ”
ধীর পায়ে এগিয়ে গেল৷ এই ঘরে সহযে আসে না শশী। এই নিয়ে দুইবার আসল। কেমন কেমন জানি ফিল হয় এই ঘরটাতে। মনের মানুষের বলেই কী এমন ফিল হয়? অনুভূতিটা কেমন জানি শিরশিরানো। এই যে এখন হচ্ছে যেমন। শরীর শিরশির করছে৷ লজ্জায় নজর এদিক ওদিক ঘুরাতে লাগল মেয়েটা৷ নীহার তা দেখে দুষ্ট চোখে ঠোঁট কামড়ে মুচকি হাসল। বলল,
” আমার ঘরে এসে আমাকে না দেখে আমার ঘরের জিনিস দেখছ? ”
শশী কথা বলতে পারল না। লোকটা এখন শুধু লজ্জা দেয়৷ নীহার আবার বলল,
” এদিকে এসো ”
শশী এগিয়ে গেল। নীহারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নীহার বেডসাউড টেবিলের উপর থেকে একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল,
” এটা নাও ”
শশী ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নীহার আবার নেবার জন্য ইশারা করল। শশী ইতিউতি করে হাতে নিল। জিজ্ঞেস করল,
” কি আছে এতে? “
” খুলে দেখো “
শশী প্যাকেট বের করে চোখ কপালে তুলে ফেলল। চোখ বড় বড় করে দেখল স্মার্টফোনের প্যাকেট৷ তাকাল নীহারের দিকে৷ নীহার মুচকি হেসে বলল,
” খুলে দেখো পছন্দ হয়েছে কিনা ”
শশী অবাক হবার রেশ না কাটিয়েই কথা অনুযায়ী প্যাকেট খুলল দেখল বেশ ভালো মানেরই ফোন৷ ব্র্যান্ডের নাম দেখল,
Redmi Note12 Pro+
নাম দেখে আরো বড় বড় করে তাকাল। নীহার এবার হেসে সামনে থেকে শশীর হাত ধরে টেনে এনে কোলের উপর বসিয়ে নিল৷ কেঁপে উঠল শশী৷ কোলের উপর বসিয়ে একটু আদুরে ভাব ধরল নীহার। শশীর পেটের উপর টাচ না করে দুই হাত সহ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। দুষ্টু হেসে শশীর কাঁধের উপর চিবুক রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” হ্যাপি বার্থডে ইন অ্যাডভান্স উইশেস ফর ইউ মাই বেবি প্রিন্সেস। দিস ইজ ফর ইউ। ইট’স ইউর বার্থডে গিফট ফ্রম ইউর উডবি হাজবেন্ড। ”
শিউরে উঠল শশী৷ সাথে এতটা কাছে নীহার আবার তার ফিসফিসানি শব্দ গুলো মাদকতার ন্যায় মনে হলো৷ তার চিকন শরীরটা আলতো হাতে নিজের আয়ত্তে রেখেছে নীহার। এরপর হাতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়ল আর চোদ্দ দিন পর তার জন্মদিন। আগস্টের সতের তারিখ। নীহার জানল কিভাবে? সে তো তারিখ বলে নি? ঘাড় ঘুরিয়ে নীহারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আপনি কি করে জানলেন জন্মদিনের কথা? ”
” তুমি সেদিন বলেছিলে সামনে তোমার জন্মদিন। আর তোমার ফোন নেই৷ কিনে দেবার প্ল্যান অনেক আগেই করেছিলাম। কিন্তু কাছে তেমন বাজেট ছিল না। যদিও এটাও সামান্য তবুও নিজের কাছ থেকে দিয়ে কিনেছি। জন্মদিনের এসব আদিক্ষেতা আমার পছন্দ না। কিন্তু ফোনটা দেবার প্ল্যান ছিল আর সামনেও তোমার জন্মদিন তাই ভাবলাম আমার হবু বউয়ের জন্মদিনেই দিই৷ আর তারিখ শিশিরের থেকে জেনেছি। “
বলে শশীর নাক টেনে দিল হাত দিয়ে। শশী আনন্দে আটখানা তো হলোই সাথে ইমোশনালও হয়ে গেল৷ লোকটাকে পাবার জন্য কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছিল৷ আর এখন না চাইতে ভালোবাসাও দ্বিগুণ পেয়ে যাচ্ছে। আজকের এই উইশ এবং জন্মদিনের গিফট সব থেকে বেস্ট। ছলছল চোখে কান্না ভেজা কন্ঠে বলল,
” আপনাকে জড়িয়ে ধরব একটু? ”
নীহার শুনে হেসে ফেলল। পাগলীটা এতটা ইমোশনাল আর অল্পতেই খুশি হয়ে যায়। নীহার চোখের ইশারায় অনুমতি দিয়ে বলল,
” এসো, ঝাঁপিয়ে পড়ো বুকে। তোমার জন্য বরাদ্দকৃত জায়গায় ”
নীহারের বলতে দেরি হলো কিন্তু শশীর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেরি হলো না৷ নীহারের কোলের উপর বসে থেকেই দু’হাতে নীহারের গলা জড়িয়ে ধরে শক্ত হাতে জড়িয়ে ধরল। নীহার শব্দহীন হেসে আগলে নিল আলতোভাবে। বলল,
” ইঁচড়েপাকা মেয়ে, ফোন পেয়ে আবার পড়াশুনো চাঁদে তুলো না যেন। ড্রামা, সিরিয়াল দেখার জন্য কিন্তু ফোন দিই নি আমি। ভালো রেজাল্ট না পেলে বিয়ে কিন্তু ক্যান্সেল! “
নিঃশব্দে কাঁদতে ছিল সে এতক্ষণ। উত্তর করল,
” মন দিয়ে পড়ব। ফোনে শুধু আপনার সাথে কথা বলব। আর কিছু করব না “
মুচকি হাসল নীহার তার ইঁচড়েপাকা পাগলীর কথায়৷ ছেড়ে দিয়ে বলল,
” চলো তোমাদের এগিয়ে দিয়ে আমি আবার ক্যাম্পাসে যাব। ”
” হু ”
সম্মতি দিয়ে উঠে পড়ল শশী। ফোনটা নিয়ে বেড়িয়ে গেল। নীহারও পেছনে গেল।
_________
বিকেলের দিকে। বাড়িতে রীতিমতো চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। আর এই চেঁচামেচির মূল কারণ কুয়াশার নাক ফুটো করা৷ সে এই কথা শুনতেই বাড়ি মাথায় করেছে। ছোট বেলায় জাকিয়ার থেকে কান ফুটো করতে গিয়ে ঐ যে ব্যথা পেয়েছিল আর জীবনেও নাক ফুটো করার কথা মুখে কেন মাথাতেও আনে নি। কানে, নাকে আস্ত সুঁই ঢুকিয়ে দেয়! এটা কি চারটেখানি কথা? মনে উঠলেই তার জীবন যায় যায় অবস্থা হয়ে যায়।
সুঁই দিয়ে করবে না যখন পার্লার থেকে করে আসুক। কিন্তু সেটাতেও সে নারাজ। কারণ পার্লার থেকে তো আরো ভয় করবে। কিভাবে অপেল ঢুকায় দেখলেই শিউরে ওঠে শরীর। নিজের শরীরে ব্যথা দিতে সে নারাজ। হাজার কিছু বলেও মানাতে পারছে না কেউ। তার এক কথা,
” আমি নাক ফুটো করব না৷ আমার ব্যথা লাগবে। তাছাড়া আমার পছন্দ না। ”
আজমিরা এবার রাম ধমক দিলেন। বললেন,
” বেয়াদবি কম কর। মুসলমান বউদের স্বামীর জন্য নাকে নাকফুল পড়া নিয়ম। এটা স্বামীর মঙ্গলের জন্য পড়তে হয়। এতদিন কিছু বলি নি কিন্তু এখন করতে হবে। কোনো কথা শুনব না। কোথা থেকে করবি তুই ভাব ”
কুয়াশা ধমক খেয়ে ছলছল চোকে জাকিয়াকে বললেন,
” ও বড় আম্মু লাগবে আমার। আমি এসব করব না ”
” লাগবে না মা। আমার ছেলের জন্য এইটুকু কষ্ট সহ্য করে নে। বউদের এই নাকফুলের স্বামীদের অনেক জোর থাকে রে মা৷ আমার দাদিরা তা বলতেন। বলতেন স্বামীর এবং সংসারের মঙ্গল কামনার জন্য বউদের নাকে নাকফুল, হাতে চুড়ি পড়তে হয়। বিপদাপদ কম হয়৷ যদিও এসব সত্যি কিনা জানা নেই৷ আল্লাহ যখন যার বিপদাপদ দেন। কিন্ত তবুও বউরা স্বামীদের ভালোবেসে এইসব করে৷ যেন স্বামীরা ভালো থাকে। এছাড়া নাকে নাকফুল, হাতে চুড়ি এগুলো বিবাহিত মেয়েদের বিয়ের চিহ্ন। করে নে না মা!”
কুয়াশা কি বলবে? বুঝল না। কিন্তু কেন জানি চুপ হয়ে গেল৷ জাকিয়ার কথাগুলো শুনে। এখন বউ হয়েছে করতেই হবে৷ কি আর করার? চুপ থাকতে দেখে জাকিয়া আবার জিজ্ঞেস করলেন,
” কিরে মা বল করবি না? ”
” নিয়ে এসো। আমি পার্লার থেকে করব না। হাতে করব। ”
সকলে মুচকি হাসল। বুঝল কথাগুলো কাজে দিয়েছে। বৃষ্টি পাশে বসে টিপ্পনী কেটে বলল,
” বাবাহ, কুশু..! আমার দেবরের প্রতি একদিনেই এত টান? ”
কুয়াশা লজ্জা পেল কি? বোঝা গেল না। কিন্তু বলল,
” ধুরর ওসব কিছু না৷ ওই বুনো ওলের জন্য ভাবতে আমার বইয়ে গেছে৷ আমি আমার পরিবারের কথা ভাবছি ”
উপস্থিত সকলে আবারও ঠোঁট টিপে হাসল। কবুলের জোর বড় জোর৷ মনে মনে কথাটা সকলেই আওরালেন। জাকিয়া সুঁই , সুতা এনে পাশে বসল। কুয়াশা তা দেখে আবার ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে উঠল। দৌড় চলে যেতে নিলে আজমিরা আটকে দিল। ধমকে বলল,
” বস চুপচাপ! একটুও লাগবে না। ”
জাকিয়া বললেন,
” বৃষ্টি ওকে চাল এনে দাও। চাল নিক মুখে”
প্রশ্ন করল বৃষ্টি,
” এতে কি হবে আম্মু? “
উত্তর করল আম্বিয়া,
“চাল নিয়ে দাঁত মুখ শক্ত করে চেপে বসে থাকলে ব্যথা অনুভব হবে না। ”
বৃষ্টি তা শুনে শাশুড়ীর কথা মতো চাল এনে দিল। কিন্তু কুয়াশা মুখে নিল না জেদ করে। সে অসহায়, সরল চোখে তাকাল মা চাচিদের দিকে। জাকিয়া সব রেডি করে কুয়াশার কাছে ঘেঁষে বসতেই আবার কেঁদে উঠল সে। বলল,
” লাগবে আমার ”
কী করবে এই মেয়েকে নিয়ে? জাকিয়া এবার সকলকে ইশারা করতেই সকলে ওকে ঠেসেঠুসে পেড়ে ধরল। আর কুয়াশা একেরপর এক চেঁচাতে লেগে গেল। জোর করে নাকে সুঁই ঢুকিয়ে দিল। কেঁদে ফেলল তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিয়ে। ঠিক সেই সময়ে শিশির বাড়িতে এলো। সে এতক্ষণ ক্যাম্পাসে ছিল৷ চেঁচামেচি আর কুয়াশার চিৎকার দিয়ে কান্না শুনে কিছুটা জোর পায়ে এলো। এসে সকলে মিলে কুয়শাকে চেপে ধরে রাখতে দেখে অবাক হলো। কী করছে এরা ঐ গোবর ঠাঁসাকে ধরে রেখে? জিজ্ঞেস করল,
” কি হচ্ছে এখানে? কি করছ তোমরা ওর সাথে? কাঁদছে কেন ও ওমন? ”
ইয়াসমিন বলল,
” তোর ওর সাথে আমরা কিছুই করছি না। তোর ও-কে নাক ফুটো করাতে গিয়ে রীতিমতো যু-দ্ধ করছি আমরা। দেখ কী নাজেহাল অবস্থা করছে ”
তা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকাল শিশির৷
” নাক আবার ফুটো করাতে হবে কেন? আর তার জন্য এমন পেড়েই বা ধরতে হবে কেন? “
প্রশ্নগুলো করতে করতে এগিয়ে এলো৷ এসে দেখল কুয়াশার নাকে আস্ত সুঁই ঢুকানো। হতবাক, হতভম্ব হয়ে গেল তা দেখে। চোখ বড় বড় করে বিস্ময়কর ভাবে তাকাল এ কী অবস্থা? করেছে টা কী!! বিস্ময় নিয়ে বলে উঠল,
” আরে আরে, আম্মু করছো কী এসব? সত্যি তো লাগছে মেয়েটার। এভাবে নাকে আস্ত একটা সুঁই ঢুকালে যে কেউই তো স্ট্রোক করবে? ”
সকলে শিশিরের তড়পানো দেখে মুচকি হাসল। কে বলবে দরদ নেই? কুয়াশা এবার সঙ্গ পেয়ে আরো জোরে চেঁচাতে শুরু করল। চোখের পানি নাকের পানি এক করে ফেলল। কারণ সত্যি মেয়েটার লাগছে। রক্ত বেড়িয়ে গেছে। জাকিয়া কুয়াশার নাকে সুঁই ঢুকিয়েছেন কিন্তু বের করতে একটু সমস্যা হচ্ছে কারণ নাক একটু শক্ত হয়ে গেছে। ঐ অবস্থা দেখে শিশির তড়িঘড়ি করে এগিয়ে গেল কুয়াশার কাছে৷ কুয়াশার দুই বাহু ধরে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বলল,
” আরেহ্, আম্মু ছাড়ো ও-কে। বেড় করো এসব! কী আশ্চর্য! কী সব পাগলামো এসব? মেয়েটা কাঁদছে তবুও কী করছো! ছাড়ো! “
” তোকে এত দরদ কে দেখাতে বলছে এখন? অন্যসময় তো চুলোচুলি ঠিকই করিস। তখন ব্যথা পায় না? “
জাকিয়ার কথায় ঠোঁট টিপে হাসল সব। শিশির বিরক্ত নিয়ে বলল,
” আজব..! কিসের সাথে কিসের তুলনা করছো? “
বলে বৃষ্টিকে সরে দাঁড়াতে বলে নিজেই পাশে বসে পড়ল৷ সে যে সকলের সামনে কী করছে সেসব খেয়াল নেই। সে এখন ব্যস্ত তার বউকে সকলে মিলে ধরে বেঁধে নাক ফুটো করছে সেটাতে। কুয়াশার পেছনে বসে এক হাতে কুয়াশাকে টেনে ওর পিছে বুকের সাথে নিয়ে আগলে ধরল। অন্যহাতে কুয়াশার চিবুক ধরে মুখ ঘুরিয়ে পর্যবেক্ষণ করল নাকের অবস্থা। দেখে নিয়ে বলল,
” ইশশ করেছে কী দেখো তো! আম্মু, যা করার জলদি করো! “
বলে কুয়াশার চোখ ঢেকে দিল এক হাতে অন্যহাতে কুয়াশাকে একটু ঘুরিয়ে ওর বাহু ধরে মাথা সমেত শরীরটা নিজের মাঝে আগলে নিল। বুকের সাথে ধরল কুয়াশার মাথাটা। কুয়াশা কেন জানি এতগুলো জোর খাটানো হাতের থেকে বাঁচতে এখন শিশিরকেই ভরসা মেনে আঁকড়ে ধরল। সে-ও শিশিরের পিঠে দিকে কোমড়ের কাছে একহাত দিয়ে শিশিরের পরিহিত শার্ট মুঠো পাকিয়ে ধরল শক্ত করে। আর এক হাতে শিশিরের হাঁটুর উপরিভাগের ঊরু খামচে ধরল। যেন নিজের দেহের ব্যথা শিশিরের দেহে দিয়ে দেবে। শিশিরও তা সাদরে গ্রহণ করছে৷ কুয়াশা যে এতটা জোরে ধরছে সেদিকে খেয়াল নেই৷ একদিন আগে কেউ কাউকে এভাবে ধরার সাহসই ছিল না৷ কুয়াশার কষ্ট দেখলেও কী এভাবে এগিয়ে আসত শিশির? তার কাছে তো কুয়াশার আদিক্ষেতা দেখার টাইম-ই ছিল না।
সকলে শিশিরকে এইরকম আগলে নেয়া দেখে প্রশান্তিময় হাসল। এদের সময় দিলে সব মানিয়ে নেবে আস্তে আস্তে। আঁকড়ে ধরবে একে অপরকে। কুয়াশা চোখ মুখ শক্ত করে শিশিরের বুকে পড়ে রইল আর জাকিয়া ছেলের বউয়ের নাক থেকে সুঁই একটানে বেড় করে আনল। তখন আরেকটু ব্যথা পেল। ব্যথা পেয়ে ‘আহ্’ মতো শব্দ করে শিশিরের মাংসবহুল নরম ঊরু আরেকটু শক্ত হাতে খামচে ধরল। চোখ মুখ খিঁচিয়ে ঢুকে যেতে চাইল শিশিরের বুকের মাঝে। সে-ও বউকে ব্যথা থেকে বাঁচাতে আরেকটু শক্ত করে ধরল। অজান্তেই মুখ দিয়ে বলল,
” এই তো হয়ে গেছে, আর লাগবে না। কাঁদিস না। ”
মুচকি হাসছে সব ওদের এমন বাচ্চামি দেখে। এদের দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে নাক ফুটো করা আহামরি বিশাল কিছু। একজন ব্যথায় কুপকাত তো একজন সেই ব্যথা নিরাময়ের জন্য ঢাল। কী আশ্চর্য ব্যপার নাহ্!! এমন দিনও চলে এলো একে অপরকে ভরসা মানা ও আগলে নেয়া! আগামীতে এর থেকে ভালোকিছু আসবে হয়তো। এভাবেই মিলে যাবে বুনো ওল বাঘা তেঁতুলের মন। তখন মধুর মিষ্টি সংসার গড়বে তারা। পরিবারের সকলে চোখ ভরে দেখবে তাদের দুই’টা আদরকে।
জাকিয়া সুতা বেঁধে দিয়ে বললেন,
” নেহ্ হয়ে গেছে। বাপরে কী বউ পেলাম আমার ছেলের জন্য! শাশুড়ীকে পর্যন্ত নাকানিচুবানি খাওয়াচ্ছে। সামান্য নাক ফুটো করতে গিয়ে এতগুলো মানুষের নাজেহাল৷ আর দেখ এখন কী সুন্দর আছে বিড়াল ছানার মতো করে! যাহ্ নিয়ে বিদায় হ তোর বিড়াল ছানাকে ”
শেষ কথাটা ছেলের উদ্দ্যশে বললেন। উনার কথায় সকলে হেসে ফেলল। আজমিরা দু-চোখ ভরে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে দেখল৷ শিশির বিরক্ত চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকাল মায়ের কথায়। কুয়াশা এখনো ফুঁপাচ্ছে। শিশির বলল,
” সামান্য এটা? আস্ত সুঁই ঢুকিয়েছিলে নাকে। আবার বলছে সামান্য! ”
” হয়েছে দরদ দেখাস না। একটু পড়েই আবার লাগবি দু’জন ”
শিশির বিরক্তিতে মুখ কাচুমাচু করল। শুধু এক কথা। এবার কুয়াশা দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,
” এসব করার কি প্রয়োজন ছিল? পাকনামী করতে কে বলেছিল? পাকনামী করতে এসে আবার ভেঁবাচ্ছিলি কেন? ”
কুয়াশা কান্নার রেশ থাকা কন্ঠে বলল,
” আমি করতে চাইনি। এরাই জোর করল বলে। ”
তা শুনে মায়ের পানে তাকাল। জাকিয়া বলল,
” বিয়ে হয়েছে। বউ মানুষের নাকে নাকফুল থাকা শোভনীয়। তার থেকে বড় কথা বিয়ের পর বউদের স্বামীর নামে নাকফুল পড়তে হয়। ”
শিশিরের শরীরে ঝাঁকানি দিল। নিজেকে সামলে নিয়ে একবার কুয়াশার মুখের দিকে তাকাল। কেঁদে কেটে চোখ মুখ লাল করে ফেলেছে৷ রাগ নিয়ে বলল,
” কিসব অবাস্তব, ভিত্তিহীন কথা বার্তা তোমাদের! এসব কেন করতে হবে? যত্তসব পাকনামী। ”
বলে উঠে দাঁড়াল৷ দাঁড়িয়ে কুয়াশার হাত ধরে তুলে নিতে নিতে বলল,
” ওঠ, ঘরে চল ”
বলে হাঁটা ধরল কুয়াশাকে নিয়ে। কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে৷ ওদের যাবার পানে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর দম ফাটা হাসিতে মেতে উঠল সকলে। ওদিকে ওরা দু’জন শুনেও তা পাত্তা দিল না৷ যা ইচ্ছে ভাবুক গে৷ আজব সব ভাবনা এদের! বউকেই তো নিয়ে এলো আর বউয়ের জন্যই তো দরদ দেখাল এখানে হাসাহাসির কি আছে? অদ্ভুত!!
| চলবে |
তোমাদের লেখিকা আপু নিজেও ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে নাক ফুটো করেছিল। কিন্তু তার কোনো শিশির ছিল না
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click