®রোজা রহমান
‘
একেকটা দিন পার করে চলে গেল বেশ কয়েকটা সপ্তাহ। জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারী মাস পড়েছে কিছুদিন আগে। সকলের দৈনন্দিন জীবন নিজ গতিতে চলছে৷ পড়াশুনো সহ সংসার জীবনের সকল কাজই সব ছেলে মেয়ে গুলো চালিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির বড়রা নিজেদের সংসার সহ প্রতিটি সন্তানকে আগলে রেখে দিন পাড় করছেন৷
কুয়াশা নিজের পড়াশুনো সহ সংসারে মন দিয়েছে। স্বামী সেবা সহ স্বামীর যত্ন নেওয়া টুকটাক সকল কাজের মাধ্যমে কাজ শেখা সবই করে। রান্না বান্না বেশ শিখে গেছে৷ মাঝে মাঝে সে আর ইয়াসমিন মিলে রান্না করে সকলকে খাওয়ায়। তার এক-দুই মাস পরেই নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হবে।
শিশির নিজের ক্যারিয়ারের পেছনে দৌড়ে চলেছে। বউয়ের প্রতি দায়িত্ব আর যত্ন অবশ্য কমায়নি। খু্ঁনসুটিময় ভালোবাসার সংসার তাদের মিষ্টতায় পরিপূর্ণ। নিজেদের সত্ত্বাকেও ধরে রেখেছে। সুযোগ পেলেই কেউ কাউকে ছাড় দেয় না। ঝগড়া বাঁধিয়ে তা চুলোচুলি পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। দুই-এক মাস পর বউয়ের থেকে, পরিবার থেকে দূরে যাবে এই জন্য সকলকে একটু বেশি সময় দেবার চেষ্টা করে। প্রয়োজন ছাড়া বাড়িতেই বেশি থাকে। আর হাসি আড্ডাতে মাতে। বাহিরে চলে গেলে বিশেষ করে এই পরিবারের এই হাসি, মজাটাই বেশি মিস করবে সে। তাদের পরিবার বেস্ট।
বৃষ্টির এই মাসের শেষে ডেলিভারি ডেট দিয়েছে। তাকে এখন সম্পূর্ণ রকম রিলাক্স মুডে চলতে বলা হয়। সব সময় ভালোকিছুর সাজেশন দেয়া হয়। এসবকিছু করেন শাশুড়ীরা। বৃষ্টির শরীর অনেকটা ফুলেছে। হরমোনাল চেঞ্জের জন্য শরীরে কিছু কিছু এলার্জি টাইপ চুলকানি হয়েছে। যেগুলো সবসময় চুলকায়।
তুষার ডিউটি সহ বউকে সামলায়। রাতে বৃষ্টির সম্পূর্ণ দেখভাল সে করে। সারাদিন ডিউটি করে এসেও তার মাঝে কোনো ক্লান্তিভাব থাকে না হবু সন্তানের জন্য। সন্তান আসার সুখ সে সব সময় টের পায়। বৃষ্টি শুধু মুগ্ধ হয়। রাতে অর্ধেক সময় ঘুমায় আর অর্ধেক তার জেগে থেকে যায়। সেই সময়ে তুষার নিজে না ঘুমিয়ে বউকে সঙ্গ দেয়।
নীহার জানুয়ারি মাসের মাঝে বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে (স’শ’স্ত্র) কমিশন অফিসার ক্যাডেট পদে আবেদন করে এসেছে। আবেদন এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলবে নাকি। এরপরই পরীক্ষার জন্য চলে যেতে হবে জানিয়েছে। সেখানে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তার ট্রেনিং শুরু। শশীর সাথে আগের মতোই সম্পর্ক ধরে রেখেছে। ব্যস্ততায় অবশ্য কম কথা হয় এখন তবুও শাসন সহ ভালোবাসা কম হয়নি।
শশীর এসএসসি পরীক্ষা আর দেরি নেই। সে পুরোদমে এখন পড়াশুনোয় ডুবে থাকে৷ তাকে একটা কথা সবসময় মনে করিয়ে দেয় নীহার যে, ভালো রেজাল্ট না করলে বিয়ে ক্যান্সেল। পাগলীটা এই ভয়ে বই নিয়ে ডুবে থাকে৷
হিমেরও পরীক্ষা শুরু হয়েছে৷ সে এবার ক্লাস টেন এ উঠবে। ছেলেটার বুদ্ধি বাড়ছে। সকলের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চায় এখন৷ বড় ভাই গুলোকে দেখে তাদের মতো চলার চেষ্টা করে। সে-ও স্বপ্ন বুনা শুরু করেছে। মায়ের কাছে জানিয়েছে ডক্টর হবার ইচ্ছে তার। এটা এখনো বাড়িতে কেউ জানে না৷ সে-ও সাহস পায় না বলার৷ আজমিরা স্বামীর পাওয়া অংশ থেকে ছেলের স্বপ্ন পূরণ করার চিন্তা ভাবনা করেছেন। কুয়াশার চিন্তা করতে হয়নি কখনো। জাকির মালিথা সহ জাহিদ মালিথা, তুষার দিয়ে গেছেন৷ হিমের বেলায় একটু ভাবনা পাল্টেছেন। স্বামীর অংশ যখন আছেই সেটা না হয় ছেলের পেছনেই দিক! এখন শুধু পরিবারের সাপোর্টের প্রয়োজন৷
ইয়াসমিন, তুহিন সংসার জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে। ইয়াসমিন ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষাটা দিয়ে জানিয়েছে আর পড়বে না। পড়াশুনোয় তার ইচ্ছে নেই৷ বেবি নেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সে। তুহিন এমএসসি কোর্সটা কমপ্লিট করতে বলেছে এরপর এসব নিয়ে ভাবতে বলেছে। কিন্তু সে পড়বে না জানিয়েছে। তুহিনও বউকে এই নিয়ে আর কিছু বলে নি। যার নিজেরই ইচ্ছে শক্তি না থাকে তাকে অন্যরা বলে কি করবে?
জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা আগের মতো চলাফেরা করে। জাকিয়া স্বামীর সেবায় সব সময় ব্যস্ত বেশি থাকে। সঙ্গ হিসেবে দুই জা’কে পাশে পায়।
জাকির মালিথার প্রচুর সুস্থ হবার ইচ্ছে শক্তি যেটা দ্বারা তিনি দিন দিন উন্নতির দিকে যাচ্ছেন। মাসে মাসে ঢাকায় গিয়ে চেকআপ করিয়ে আনার কথা ছিল। আগের মাসে গেছিলেনও। ডক্টর জানিয়েছেন রুগীর সুস্থ হবার প্রচুর ইচ্ছেশক্তি যার জন্য রিকোভার করতে টাইম নিচ্ছে না৷ এভাবে চলতে থাকলে ইনশাআল্লাহ খুব জলদি আবার হাঁটতে পারবেন জাকির মালিথা।
জাহিদ মালিথা সুযোগ পেলেই বাড়িতে আসেন। এসে ভাইকে সঙ্গ দেন৷ তিনিও ভাইয়ের ব্যায়াম করান। বিকেলে তিনি হুইল চেয়ারে করে নিয়ে ভাইয়ের সাথে হাঁটতে যান। আগের অভ্যাসটা ধরে রেখেছেন তবে এখন তা ভিন্ন তারিকায়। ভাই তার আবার আগের মতো নিজের পায়ে হেঁটে হাঁটতে বেরুবেন এই প্রত্যাশায় দিন গুণেন।
রিজভী, স্মৃতি, ঈশা, মিহির নিজেদের জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে। রিজভী, স্মৃতি সংসার সহ পড়াশুনো চালিয়ে যাচ্ছে। স্মৃতি বাবার বাড়িতে থাকে। রিজভী এক-দুই সপ্তাহ পর পর শ্বশুর বাড়িতে যায়। বউয়ের সাথে সময় কাটায়।
এভাবেই সকলের গত দিনগুলো কেটে যাচ্ছে। নিজের আপন সত্ত্বাকে ধরে রেখেই এগিয়ে যাচ্ছে সকলে।
____________
আজ শিশিরের পরীক্ষা ছিল। বিকেলের দিকে মাত্রই বাড়িতে এলো। শীতের আবহাওয়াটা অনেকটা কমে আসছে৷ মাঘ মাসের অর্ধেকের বেশি চলে গেছে কিনা!
নিজের ঘরে এসে দেখল কুয়াশা নেই। হয়তো বৃষ্টির কাছে। ভেবে বাহিয়ে এসে ডাকল,
” কুয়াশা..! এ্যাই কুয়াশা! “
ডেকে নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে এলো কফি করে আনতে মাথা ধরেছে তার। প্রচুর চাপ যাচ্ছে। কুয়াশা ডাক শুনে তৎক্ষনাৎ চলে এসেছে৷ এসে দেখল বাহিরের জামা-কাপড় চেঞ্জ করছে সে। জিজ্ঞেস করল,
” এখন কফি খাবে? দুপুরের খাবার খেয়েছ? “
” হ্যাঁ, খেয়েছি বাহিরে। মাথা ধরেছে কফি লাগবে।”
কাটকাট কথায় কুয়াশা তাকাল শিশিরের মুখের দিকে৷ কেমন শুকনো হয়ে গেছে মুখটা। দেখে গলে গেল সে। এগিয়ে এলো দরজার সামনে থেকে৷ শিশির বিছানায় বসল। সে-ও পাশে গিয়ে বসল৷ বলল,
” এত চাপ কেন নিচ্ছ? চাপ একটু কমাও”
শিশির তাকাল কুয়াশার পানে। বলল,
” একায় চলে আসে, চাপ নিতে হয়না৷ “
দীর্ঘ শ্বাস ফেলল কুয়াশা তা শুনে। বলল,
” আবার কবে আছে পরীক্ষা? “
” এগারদিন পর আছে “
” গোসল করবে? “
” হ্যাঁ “
শুনে নিয়ে কুয়াশা উঠে যেতে নিল শিশির আঁটকে দিল। উঠে দরজা বন্ধ করে এলো। বলল,
” আগে গোসলের সঙ্গ দে”
বলেই শুয়ে পড়ে কুয়াশাকে টেনে নিল। কুয়াশা আর উচ্চবাচ্য করল না৷ সে কখনো তা করেও না অবশ্য। অসুস্থ না থাকলে স্বামীকে কখনো ফেরায় না। এই বিষয়ের হাদিসটা বৃষ্টি তাকে শুনিয়েছিল সেই শুরুর দিকে।
‘
রাত বাড়তে বাড়তে শিশিরের গায়ে জ্বর এসে হানা দিল। শরীরে অনেকটা জ্বর উঠেছে৷ পড়ার আর শক্তি পেল না। নয়টার দিকে উঠে পড়ল। কুয়াশাকে ডাকল৷ সে নিজের ঘরে পড়ছে। কুয়াশা এসেই দেখল শিশিরকে অনেকটা অস্বাভাবিক লাগছে। চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। আৎকে উঠল সে। তড়িঘড়ি করে বিছানায় বসে থাকা শিশিরের কাছে এলো। বলল,
” এই, তোমায় এমন লাগছে কেন? “
” জ্বর উঠেছে অনেকটা “
বলেই শুয়ে পড়ল৷ কুয়াশা তড়িঘড়ি করে চেক করল৷ সত্যি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। সে তড়িৎ ফাস্ট এইড বক্স থেকে জ্বরের প্রাথমিক অ্যান্টিবায়োটিক গুলো বের করে পানি নিয়ে শিশিরকে উঠতে বলল৷ শিশির উঠে আগে খেয়ে নিল৷ কুয়াশা বলল,
” মাথায় পানি দিতে হবে মনে হচ্ছে! “
শিশির কোনো কথা বলল না। ভালো লাগছে না তার৷ কুয়াশা বাথরুম থেকে বালতি করে পানি আনল। মায়ের ঘরে গেল এরপর৷ কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো হাতে পলিথিন টাইপ কাগজ নিয়ে। পেছন পেছন আজমিরাও এসেছেন৷ এসে চেক করে বললেন,
” জ্বর তো ভালো আসা এসেছে রে! “
উত্তরে কুয়াশা বলল,
” হ্যাঁ, কি করব আম্মু?”
আজমিরা মেয়ের অস্থিরতা দেখল৷ যেন জ্বর তার শরীরে। এদের এতটা ভালোবাসা বাসি কবে কবে, কীভাবে হলো! আজমিরা বললেন,
” তুই পানি দিতে থাক, আমি বড় বুবুকে ডাকি। না হলে হসপিটালে নিতে হবে। “
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে স্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে লাগল৷ শিশিরকে ডাকল। সে ঘুমে না কিন্তু তাকিয়েও না। একটু ঘুরে শুতে বলল। শিশির কথা না বলে তাই করল৷ কুয়াশা মাথার নিচে কাগজটা দিয়ে কাগজের নিচে বালিশ দিল। শিশিরের শরীরে কম্বলটা ভালোভাবে জড়িয়ে দিল৷ এরপর বালতির পানিতে কাগজের নিচটা ডুবিয়ে দিল৷ মগে করে পানি তুলে শিশিরের কপাল সহ মাথায় পানি দিতে থাকল৷ প্রথমে পানি পেয়ে শরীরে কাঁটা দিল শিশিরের শীতে৷ অতিরিক্ত শীত করছে আর অসহ্য লাগছে। জ্বরটা খুবই ভয়াবহ রূপ নিয়েছে৷
কুয়াশা পাশে বসে একহাতে পানি ঢালতে লাগল আর এক হাতে শিশিরের চুলে বিলি কাটতে লাগল৷ কপাল সহ মাথায় ম্যাসাজ করল হাত দিয়ে। বলল,
” আরাম লাগছে? “
” হুঁ “
শিশিরের ছোট্ট উত্তর। শুনে বলল,
” এতটা জ্বর ওঠল কখন কখন? এসব সব টেনশনের জন্য হচ্ছে। তুমি টেনশন কমাও তোহ্। “
শেষ কথাটা বিরক্ত নিয়ে বলল৷ শিশির উত্তর করল না৷ এরই মাঝে জাকিয়া, নীহার আর আজমিরা এলো। এসে জিজ্ঞেস করল খুব বেশি জ্বর কিনা! কুয়াশা জানাল বেশিই। জাকিয়া বললেন,
” পানি ঢেলে দেখ কী হয়, নয়তো ডক্টরের কাছে নিতে হবে “
কুয়াশা সম্মতি দিল। জাকিয়া ছেলের কাছে এসে বসলেন৷ আজমিরাও একপাশে বসে রইলেন৷ নীহার ডিভানে বসল৷
অনেকক্ষণ একনাগাড়ে পানি ঢালতে ঢালতে জ্বরটা নিয়ন্ত্রণে এলো। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকের জন্যও জ্বরটা ছুটল। তখন শরীর ঘেমে উঠতে লাগল৷ শিশির জেগে ছিল। জানাল তা৷ কুয়াশা চেক করে দেখল সত্যি অনেকটা ছুটেছে জ্বর৷ মা’য়েদের কাছেও বলল। জাকিয়া জানালেন আর পানি দিতে হবে না, শরীরটা মুছিয়ে দিতে বলেই আরো কিছু নির্দেশনা দিয়ে নীহার সহ ওনারা চলে গেলেন৷ মা’য়েরা যেতেই দরজা বন্ধ করে এলো৷ কম্বল সরিয়ে শিশিরকে উঠতে বলল৷ শিশির উঠে বসলে শরীর থেকে শার্ট সহ পাতলা সোয়েটার ছিল কুয়াশা নিজেই খুলে নিল একে একে৷ শিশির নির্বিকার। সামনে বসে তোয়ালে ভিজিয়ে পুরো শরীর মুছতে লাগল। শিশির এখন একটু সুস্থতা পেয়ে কুয়াশার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিল৷ কুয়াশা নিজের কাজে মগ্ন। সে বলল,
” এত দায়িত্ববান হওয়া কবে থেকে শিখলি? “
কুয়াশা প্রশ্ন পেয়ে তাকাল৷ মুচকি হেসে বলল,
” আমার দায়িত্ববান স্বামীর থেকে শিখেছি। আমার দায়িত্ববান স্বামীকে দেখে শিখে গেছি আপনাআপনি যে, নিজের জিনিসের প্রতি কতটা দায়িত্ববান ও যত্নবান হতে হয় আর তা কতটা ভালোবাসা দিয়ে আগলো রাখতে হয়”
শিশির হৃদয় জুড়ানো উত্তর পেয়ে প্রশান্তিময় হাসল মুখ খুলে৷ কুয়াশার কপালে চুমু দিয়ে বলল,
” বড্ড পাকনা হয়েছিস তুই, সেটা কি জানিস? “
” হ্যাঁ জানি”
শিশির আবার হেসে ফেলল। কুয়াশার মাথায় আলতো করে চাটি মে-রে বলল,
” আমার গোবর ঠাঁসা আহ্লাদী বউটা পাকনি হয়েছে। “
কুয়াশা মাথায় মে-রে আবার আহ্লাদী কথা বলায় বিরক্ত হলো৷ ভ্রু কুঁচকে বলল,
” হ্যাঁ, তো এটা মে-রে বলার কি হলো? বুনো ওল একটা “
বলেই আবার নিজের কাজে মন দিল। শিশির বলল,
” আর লাগবে না৷ যাহ্ সব গুছিয়ে আয় “
কুয়াশা কথা না বাড়িয়ে বালতি তালটি নিয়ে গিয়ে বাথরুমে রেখে এলো। শিশির বলল,
” একটা পাতলা টিশার্ট দে “
কুয়াশা এনে হাতে দিলে সে পড়ে শুয়ে পড়ল। লাইট অফ করে দিতে বলল ঘুমাবে সে। কুয়াশা বন্ধ করে এসে শুয়ে পড়ল৷ শিশির কুয়াশাকে টেনে বুকে নিয়ে গলায় মুখ গুঁজে দিল। কুয়াশা টের পেল শরীরটা এখনো গরম গরম৷ মাথার চুলে আঙুল চালাতে লাগল স্বামীর। বলল,
” শরীর এখনো গরম আছে “
” সেরে যাবে৷ “
উত্তর দিয়ে কুয়াশার পেটে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। ঘুমানোর চেষ্টা করল। কুয়াশা চিৎ হয়ে শোয়া। অন্ধকার ঘরে দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। তাকিয়ে থেকে কিছু কথা ভাবতে থাকল, থাকবে কি করে সে আর কিছুদিন পর থেকে? এভাবে রাত কাটিয়ে যার ভয়ঙ্কর অভ্যাস হয়ে গেছে! যে স্বামীর আদর, ভালোবাসা তার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে! তাকে ছাড়া কী একেকটা দিন, রজনী কাটবে তার? এ তো তুষের আ-গুনের ন্যায় জ্বলবে অন্তর যা ধিকিধিকি করে জ্বলে কিন্তু সহজে নেভে না।
ভাবতে ভাবতে মাথা কাৎ করে শিশিরের কপালের পাশ বরাবর ঠোঁট দাবিয়ে গাঢ় চুমু আঁকল। শিশির ঘুমিয়ে গেছে তার নিঃশ্বাসের গাঢ়তা তা জানান দিচ্ছে। সে-ও চোখ বুজল৷ ক্ষনিকের দূরত্বটায় যেন সে ধৈর্য্যশীল হয়।
_________
ঘড়ির সয়মের কাঁটা ঘূর্ণনমান। তেমনি তা ঘুরতে ঘুরতে আরো কয়েকটা সপ্তাহ কাটিয়ে দিল৷ আজ শিশিরের শেষ পরীক্ষা ছিল৷ পরীক্ষা দিয়ে এসে একটু রিলাক্স মুডে ছিল। কিন্তু সেই রিলাক্স মুডের ভাটা পড়ল ভোর পাঁচটার দিকে।
ভোর পাঁচটার দিকে বৃষ্টির প্রসব বেদনা শুরু হলো। তুষারের চিৎকারে জাকিয়ারা ছুটে এলেন। এসে দেখলেন পানি ভাঙছে৷ আম্বিয়া তড়িঘড়ি করে বৃষ্টিকে এসে আগলে ধরল। জাকিয়া ছেলেকে সান্ত্বনা দিলেন৷ বাড়ির কোনে জা’য়েরই নরমাল ডেলিভারির কাজও জানা নেই। শিশির কুয়াশা, নীহার, তুহিন, ইয়াসমিন হিম সকলেই ছুটে এসেছে। ওরা তিনভাই ঘরে আর ঢুকল না৷ কুয়াশা বৃষ্টির অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে গেল৷ বৃষ্টি চিৎকার সকলকে নাড়িয়ে তুলল।
এদিকে তুষার দিশেহারা হয়ে উঠল৷ বৃষ্টির যন্ত্রণা মাপার ক্ষমতা তার হচ্ছে না কিন্তু বৃষ্টির অবস্থা দেখে তার মাথা চক্কর দিচ্ছে। ইয়াসমিন, কুয়াশা এগিয়ে এসে বৃষ্টির কাছে বসে পড়ল৷ আজমিরা আতঙ্কিত স্বরে বললেন,
” বুবু এখানে হবে না হসপিটালে নিতে হবে!”
জাকিয়াও সেটা ভাবলেন৷ আম্বিয়া বৃষ্টিকে একের পর এক সাহস দিয়ে চললেন৷ জাকিয়া তড়িঘড়ি করে ছেলেকে বললেন,
” তুষার আব্বু! ইমারজেন্সি এম্বুলেন্স ডাক”
তা শোনা মাত্র এক সেকেন্ডও দেরি করল না৷ তৎক্ষনাৎ এম্বুলেন্স ডাকতে ফোন হাতে নিল। এদিকে আজমিরা সহ কুয়াশা, ইয়াসমিন প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে দিল৷ এত সকাল বলে এম্বুলেন্স আসল পনের মিনিটের মাঝে৷ এখন কথা হচ্ছে এতগুলো সিঁড়ি ভেঙে বৃষ্টিকে নিচে অবধি নিবে কি করে? এই চিন্তায় মাথা নষ্ট হয়ে গেল। বৃষ্টি উঠে বসতে পর্যন্ত পারছে না৷ তুষার বাহিরে এম্বুলেন্সের কাছে থেকে ছুটে এলো। শিশিররা নিচেই আছে। তারা ডক্টর ঠিক করছে ফোন দিয়ে দিয়ে সাথে রক্তের সন্ধান করছে ইমারজেন্সির মাধ্যমে। এসব আগে থেকে কিছুই করা হয়নি। তুষার এসে মা’য়েদের মুখে সব শুনে এক সেকেন্ডও দেরি করল না। জিজ্ঞেস করল,
” আম্মু কোলে তুললে বেবির সমস্যা হবে?”
জাকিয়া, আম্বিয়া, আজমিরা তিনজনই ছেলের দিকে তাকালেন। তুষারের অবস্থা একটু বোঝার চেষ্টা করলেন৷ ছেলেটা যে বৃষ্টিকে চোখে হারায়। জাকিয়া মাথা নাড়িয়ে না উত্তর বোঝাল৷ বলল,
” কোলে নে “
তুষারকে খুব এলোমেলো লাগছে৷ শোনা মাত্র তৎক্ষনাৎ কোলে তুলে নিল বৃষ্টিকে। বৃষ্টি মূলত ব্যথাটা সহ্য করার চেষ্টা করছে কিন্তু সহ্য করতে সক্ষম হচ্ছে না৷ এ যে পিরিয়ড ব্যথার থেকে ভয়ংকর সহ্য হবে কি করে?
তুষার বৃষ্টিকে ঐ অবস্থাতেই কোলে তুলে নিল। বৃষ্টি ব্যথার চোটে তুষারের হাতের বাহু সহ কাঁধ খামচে ধরল। তুষারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই অতি সাবধানে বৃষ্টিকে নিয়ে বেড়িয়ে এক একটা সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামল। কুয়াশা, ইয়াসমিন অবাক চোখে চেয়ে রইল। একটা হবু বাবা ও স্বামী কতটা যন্ত্রণায় আছে এই সময়ে? কতটা চিন্তা হতে পারে এই সময়ে?
একজন মানুষ ৪৫ ইউনিট ব্যাথা একবারে সহ্য করতে পারে। আর একজন মা যখন একটি শিশুকে জন্ম দেন, তখন তিনি ৫৭+ ইউনিট ব্যাথা সহ্য করেন! এই ব্যাথা একসাথে ২০ টি হাড় ভাঙার ব্যাথার থেকেও বেশি হয়। তাহলে প্রসব বেদনা কতটা কষ্টদায়ক, যন্ত্রণাদায়ক ভাবা যায়!! (ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী)
‘
হসপিটালে আগে বৃষ্টিকে নরমাল ডেলিভারির জন্য নেয়া হলো। বৃষ্টির ব্যথা ক্রমেই বাড়ছে। তুষারের অবস্থা দেখে তিন ভাই সাপোর্ট হলো। তবুও শান্ত হতে পারল না সে৷ বৃষ্টির সাথে এসেছে আম্বিয়া, জাকিয়া, কুয়াশা শিশিরের বাইকে এসেছে। ইয়াসমিন বাড়িতে রয়ে গেছে আজমিরাও আছে৷ বাড়িতে জাকির মালিথার কথাও ভুলে গেলে চলবে না৷
নরমাল ডেলিভারিতেও হচ্ছে না। আধা ঘণ্টা হয়ে গেল কিন্তু কিছুই হলো না৷ এদিকে বৃষ্টির অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মাঝে ডক্টর জানালের রুগী জ্ঞান হারিয়েছে ব্যথা সহ্য করতে না পেরে৷ জ্ঞান ফিরিয়ে ইমারজেন্সি সি-সেকশনে নিতে হবে৷ তুষার শুনে সেই মূহুর্তে যা মাথায় এলো বলে দিল,
” যেটা ভালো হয় করুন কিন্তু আমার বউকে জলদি সুস্থ করুন। জ্ঞান ফেরান জলদি। “
একদম ট্রিপিক্যাল টিভি, সিরিয়ালের মতো মনে হলো কী কথাগুলো? হয়তো যে বা যারা শুনল তাই মনে হবে। কিন্তু একবারও কি তুষারের মনের অবস্থা কেউ বোঝার চেষ্টা করল? ভালোবাসার বউ তার৷ কষ্ট কি করে নেবে? সন্তান দুনিয়ায় আসার সুখ এক আর এই যন্ত্রণা নিজের চোখে দেখার কষ্ট আরেক৷ চিৎকার দিয়ে দিয়ে বউ তার চোখের সামনে ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছে এটা কি একটা ভালোবাসার মানুষ সহ্য করবে? তবুও তুষার স্ট্রোং থাকা সর্বশেষ চেষ্টা চালাচ্ছে।
কুয়াশা, শিশির, নীহার, তুহিন, আম্বিয়া, জাকিয়া সকলে শুধু আল্লাহর নাম নিচ্ছে। আল্লাহকে ডেকে বাচ্চা ও মা’কে সুস্থ থাকার কামনা করছে।
কিছুক্ষণের মাঝে বৃষ্টির জ্ঞান ফিরিয়ে সি-সেকশনে নেয়া হলো। সার্জারিই করতে হবে। সব ঠিকঠাক করল শিশিররা। রক্ত সহ্য বড় ডক্টর আনাল।
‘
সকলের অপেক্ষা যেন শেষ হচ্ছে না। তুষার না পারছে স্থীর থাকতে না পারছে মা চাচিদের সামনে প্রকাশ করতে নিজের ভেতরের অস্থিরতা৷ এক ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে কোনো খবর পায়নি তারা৷ টেনশনে মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে সকলের৷
আরো কিছুক্ষণ পর একটা নার্স এসে জানালেন বেবি হয়েছে কিন্তু কোনো রেসপন্স করছে না। বেবির মা সুস্থ আছে। এই কথা শোনা মাত্র সকলে কেঁপে উঠল। প্রথম নতুন অতিথি আসার কথায় আনন্দিত হবে নাকি কষ্ট পাবে কোনটা? এক আনন্দ বার্তা তো দিল কিন্তু তার সাথে আতঙ্কিত বার্তা কেন দিল?
| চলবে |
বুনো ওল বাঘা তেতুল গল্পের লিংক ( all part ) click
নোট- আমার একটা জিনিস ভুল হয়েছিল তথ্যটা মূলত জানা ছিল না বলে লিখে ফেলেছিলাম। তাই এডিট করে দিলাম। আসলে নেভিতে বিসিএসের উপর ডিপেন্ড করে জব হয় না। এইচএসসি সাটিফিকেটের পরেই হয়। আর আঠার থেকে তেইশ বছরদের অফিসার পদপ্রার্থীতে এইচএসসি পরীক্ষা ও এসএসসির রেজাল্ট ভালো হলেই হয়। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মতো ভেবেছিলাম। আমার এ বিষয়ে একটুও জানা ছিল না। ক্ষমাপার্থী তার জন্য। নিশ্চয়ই পাঠকগন বুঝবে? কোনো হাঙ্গামা না করে!
এবার বলি নীহারের বয়স নিয়ে। অনার্স চতুর্থ বর্ষে পড়লে আমার মনে হয় না খুব বেশি বয়স হয়! জোর গেলে চব্বিশ হয়। সেক্ষেত্রে বার্থ সাটিফিকেটে যদি বয়স কমানো হয় তবে কি সমস্যা হবার কথা? নিশ্চয়ই পাঠকগন এটা নিয়েও হাঙ্গামা করবে না?