#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব ২৩
মাশহুদের ভীষণ ইচ্ছে করছে জাফরিনের মাথায় নিজের হাতটা রেখে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলতে,
“ভয় নেই, তোমার কেউ নেই, কে বলে?আমি তো আছি।এই যে তোমার আশেপাশে, সবচেয়ে কাছে।তুমি যে আমার সাম্রাজ্যে এসেছো, আমার সম্রাজ্ঞী হয়ে।ফিনফিনে বাতাসকেও অনুমতি নিতে হবে তোমাকে ছুঁয়ে যাওয়ার আগে।”
কিন্তু এসব বলা হয় না। কারণ এসব মাশহুদ বলতে পারবে না।সবার সামনে নয় এমনকি দূরেও নয়। কারন এসব তার স্বভাবের সাথে যায় না।এ দেশে প্রেমিকা বদলানোটা পোশাক বদলানোর মতোন মনে হয়। বিয়ে ছাড়া থাকাটাও স্বাভাবিক অথচ জাফরিন যেমন পরিবেশ থেকে এসেছে সেখানে এই সম্পর্কটা ভীষণ পবিত্র বলে মনে হয় তার। সারা জীবন একজন অপেক্ষা করে অপর মানুষটার জন্য।
তার জন্য জমিয়ে রাখে দেহের সব আবেগ। এক মাত্র অধিকার দেয় তার স্বামীকে। অথচ মাশহুদের কালচার ভিন্ন।এখানে একজন কে জড়িয়ে ধরা কিংবা লিভিং এ থাকাটা যেমন স্বাভাবিক তেমনি সিংগেল মা-বাবা সন্তানদের বড় করছে এটাও।একেক দেশের একেক নিয়ম।তবে ভালোবাসার নিয়ম সব ক্ষেত্রেই কিন্তু এক।ভালোবাসলে প্রেমদহনে জ্বলতে হয়।যেমন জ্বলছে মাশহুদ।খুব ইচ্ছে করছে তার শক্ত করে আবেগে জড়িয়ে নিতে মেয়েটাকে।কেন কাঁদছে সে?
ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিলো মাশহুদ। আজ সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে পুরো এপার্টমেন্টে।অন্য কোনো উদ্দেশ্য নয়, জাফরিনের নিরাপত্তার জন্য এমন করা হয়েছে।কুঞ্জ ঠিক বলেছিল, মেয়েটা এখানে নিরাপদ নয়। এটার প্রমাণ আজ সকালেই পাওয়া গেছে।কেউ তাকে ফলো করছিল। যদিও এমিলি সাথে ছিল কিন্তু কত সময় থাকবে সে?প্ল্যান মোতাবেক জাফরিনকে তারা কোনো প্রকার সুযোগ সুবিধা দিবে না।বাকী পাঁচ জনের মতোন সেও নিজের পথ নিজে তৈরী করে এগিয়ে যাবে।প্রচন্ড বুদ্ধিমতি মেয়ে জাফরিন।একবার যদি বুঝতে পারে তাকে কেন আনা হয়েছে সে বদলে দিবে নিজের পরিকল্পনা।তাকে তার মতোন এগিয়ে যেতে দেওয়াটাই শ্রেয়।তবে নিরাপত্তার ব্যাপারে কোনো ত্রুটি রাখা যাবে না।
“স্যার আসবো?”
“জি আসুন।”
“মিস শিকদারের সম্পর্কে কিছু কথা ছিল।”
এমিলির দিকে মুখ তুলে তাকালো মাশহুদ। ভ্রু-কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কী ব্যাপারে?”
“আগামীকাল থেকে সে ক্লাস শুরু করবে কিন্তু কথা হচ্ছে যে বাকি সময়টা কী করবে?”
“মানে?”
“আসলে মিস শিকদারের উপর নজর রাখা প্রয়োজন ছিল।তাই বলছিলাম!”
“স্পষ্ট ভাষায় বলুন।প্যাঁচানোত প্রয়োজন নেই।”
“অফিসে যদি তাকে কোনো জব দেওয়া যায় তবে সে সব সময় আমাদের আশেপাশে থাকবে।আর তার প্রতি নজর রাখতেও সাহায্য হবে।”
“মিস এমেলি,আমাদের কোম্পানির নাম কী?”
“রয়েল’স মুন।”
“এখানে চাকরি করতে হলে অবশ্যই নূন্যতম যোগ্যতা লাগে। এট জানেন?”
“জি স্যার।যেখানে কর্মদক্ষতা অধিক প্রয়োজনীয় সেখানে মিস শিকদার একজন স্টুডেন্ট মাত্র। সে বাকী সবার সাথে মিশতে পারবে?”
“আমি শুধু….
” বুঝতে পেরেছি।তাকে তার যোগ্যতা অনুসারে অফার করবেন।নিজ থেকে নয়, যদি সে বলে তবে। আমাদের এখানে অনেক পার্ট টাইমার আছে। তাদের মতোন করেই তাকে হ্যান্ডেল করবেন।”
“মিস জাফরিন করবেন এমন কিছু?”
“সে বুদ্ধিমতি। সে জানে এখানে একা, আহ্লাদ করার মতোন কেউ নেই তার।যদি প্রয়োজন মনে করে করবে। না হলে নিজ থেকে তাকে কিছু বলবেন না।”
এমিলি দুঃখিত বলে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে।সে ভেবেছিল স্বপ্নের নায়কের মতোন জাফরিন পাবে তার বস কে।কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার পরেই তার বস তার প্রেমে হাবুডুবু খাবে।একটা প্রেজেন্টেশন এ সবাই হতাশ, জাফরিন কিছু একটা করে তাক লাগিয়ে দিবে।এরপর?
এরপর তারা দুজন বিভিন্ন সময় ডেটে যাবে, কন্ট্রোভার্সি তৈরী হবে।অফিসে সবার সামনে মাশহুদ এলান করবে জাফরিন তার বাগদত্তা।এমনটা হবে এটাই ভেবেছিল এমেলি।সে মনে করেছিল হয়তো এমনটা ভেবেই তাকে নিয়ে এসেছিল মাশহুদ।কিন্তু মাশহুদের কথায় তার ভুল ভেঙে গেল।সে আরো একবার বুঝলো এই মানুষটাকে সে চিনে না।জানে না,তাকে দূর থেকে ভালোবাসতে জানলেও তাকে বিন্দু মাত্র জানতে শিখেনি সে।
(৫৩)
ফিরে এসে জাফরিন মায়ের সাথে কথা বলছিল। তার মা গ্রামে ফিরেছে এটা শুনে কিছুটা আপত্তি করলো সে। মা কীভাবে একা থাকবে ওখানে?
“আম্মা শহরে থাকলে কি হতো?”
“মারে দম বন্ধ লাগে।”
“আর বাড়ির মানুষগুলো?তারা শান্তি দিবে?”
“তোমার আব্বার কবরটা দেখতে তো পারি।বাঁচবোই আর কয় দিন?এই কয়েক দিন তোমার আব্বার সাথেই থাকতে চাই।”
“আম্মা!”
“বলো।”
“খুব ভালোবাসেন আমার আব্বারে?”
“তারে ভালোবাসি নারে মা।জানো একবার আমার গায়ে বসন্ত উঠলো। বিয়ের বছরেই। তখন তোমরা ভাই বোন কেউ জন্ম নাওনি।সে কী অবস্থা আমার। বাড়ির সবাই তোমার আব্বারে বললো”
“তুমি কাছে যেও না বৌয়ের।তোমার বসন্ত উঠবো।”
কিন্তু কে শুনে কার কথা? সে আমার যত্ন করে গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়, যে বসন্ত গলে যায় তার মধ্যে বাতাস করে।রাত চারটের সময় ভাত খাইয়ে দেয়। এসব কেউ দেখে না মা।বদ্ধ ঘরে সে আমার যত্ন করে আবার দিনে ঘরের কাজ।একদিন বলেছিলাম,
“ভালোই তো হয় আমি মরলে, আপনি নতুন স্ত্রী পাবেন।”
সে আমার মাথায় হাত রেখে কী বলছিল জানো?
“কী?”
“আমার শরীরে তোমার গন্ধ লেগে আছে।এই গন্ধটা নিয়েই আমি মরতে চাই।তুমি শুধু আমার খেয়াল রেখো, আমার সাথে থেকো।আমি তোমার পায়ে পৃথিবীর সব সুখ এনে দিবো।”
অথচ আমি তাকে একটা পুত্র সন্তান দিতে পারিনি বলে তার ভাইয়েরা তাকে আবার বিয়ে দিতে চাইলো।সে কী আমাদের ছেড়েছে?ছাড়েনি তো মা।তাই আমি তোমার আব্বাকে ভালোবাসি না।আমি তোমার আব্বার জন্যই বেঁচে আছি।”
জাফরিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ফোনের অপর পাশ থেকে।বরাবর মা-বাবার ভালোবাসা, তাদের খুনসুটি দেখে আহ্লাদী হতো সে।বাবা দেশে এলে রাত-বিরেতে লুকিয়ে মায়ের জন্য ফুল আনতো কিংবা অন্য কিছু। জাফরিন দেখতো,স্মিত হাসতো তবে প্রকাশ করতো না।এত ভালোবাসার মানুষের বিচ্ছেদে বুঝি বেঁচে থাকা যায়?
মৃত্যুসম যন্ত্রণা নিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে তার মা?
কথা শেষ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় জাফরিন।আগামীকাল থেকে তার ক্লাস শুরু হবে।বিষয় হিসেবে সে বেছে নিয়েছে কম্পিউটার সাইন্স।তবে কোডিং টা আয়ত্তে আনা তার বেশি প্রয়োজন। কারণ একমাত্র কোডিং শেখার মাধ্যমেই সে তার বাবার সকল রহস্যের সমাধান করতে পারবে।নিজ হাতে থাকা হাত ঘড়ির দিকে তাকায় জাফরিন।এটার মাঝেই লুকিয়ে আছে তার বাবার মৃত্যু রহস্য।
শুধু তাই নয় লুকিয়ে আছে আরো অনেক তথ্য। যার জন্য জীবন দিতে হয়েছে তার বাবাকে।বাবার লাশ দাফনের তিন দিনের দিন রাতে তার ফোনে একটা নোটিফিকেশন আসে। কোনো ঘড়ি এক্টিভেট হওয়ার। জাফরিন বুঝতে পারে তার বাবার জিনিসপত্রের মাঝে এমন কিছু রয়েছে। সব জিনিসপত্র ঘেটেও তেমন কিছু পায়নি সে।অবশেষে হতাশ হয়ে তার বিয়ের উপহার গুলো দেখছিল।বাবা তার জন্য ঘড়ি কিনেছিলেন।সেটার কাছে যেতেই জিপিএস অন হয়ে যায় ফোনের।টুকটাক নিজের জ্ঞান থেকে জাফরিন বুঝতে পারে এটাই কাঙ্ক্ষিত বস্তু।
তাইতো সেদিন পুরো সময় নিজ ঘরে ছিল সে যখন বাকী সবাই ব্যস্ত ছিল তার বাইরে অনুষ্ঠানে। ঘড়ির মাঝে থাকা পেনড্রাইভ ঘেটেও সে খুব একটা বুঝতে পারেনি।তবে যেটা বুঝেছে সেটা হলো তার বাবা দুই মন দুই দশা করেছে তাকে এসবে জড়ানোর জন্য।একবার সে ভেবেছে মেয়েকে এসবের মাঝে জড়াবে না,কিন্তু মাশহুদ নামের ব্যক্তির জন্য তাকে এখানে আসতে বলেছে।
পেন ড্রাইভে থাকা প্রথম ফাইলটা অন করার পর জাফরিন ম্যাসেজ পায়,
“মা, ও আমার মা। তুমি যদি এটা পেয়ে থাকো তবে আমি আর নেই।আমাকে হয়তো ওরা মেরে ফেলবে।সিদ্ধান্ত তোমার হাতে, তুমি আসবে কি না।যদি তোমার বিয়েটা হয়ে যায় তবে তুমি সাবধানে থেকো।ঈশান ছেলেটা লোভ বেশি, তুমি সামলে চলো।বাকীটা তোমার সুখেই সুখী আমি।আর যদি বিয়েটা না করো তবে মাশহুদের জন্য হলেও এখানে একটা বার এসো।মনে রেখো মা,
” পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে ভালোবাসা।”
এরপর জাফরিন আর কিছুই বুঝেনি।তবে সে জানে না মাশহুদ কে?কী তার পরিচয় কিন্তু তাকে খুঁজতেই এসেছে সে নিজেকে হারিয়ে।
চলবে….