ক্যারিয়ার টিপস
বাঙালী কেন বিশ্বের দরবারে নিজেদের রিপ্রেজেন্ট করতে গিয়ে ধরা খায় জানেন? অনেকে বলবে বাঙালীর আইকিউ কম, কিন্তু মূল বিষয় সেটা না। সমস্যা হচ্ছে, বাঙালী কমন কার্টেসী জানে না।
কমন কার্টেসী সকলের জন্যই এক। এখানে কোনো বিভেদ নেই। আর সেই কমন কার্টেসী বা সাধারণ ভদ্রতাবোধ আমাদের নেই। উদাহরণ দেই এমন কয়েকটি ভদ্রতাবোধের। পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষেরই বেচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। এখানে কি বাঙালী ব্যতিক্রম? না, উন্নত দেশের মানুষও খাদ্য গ্রহণ করেই বেচে থাকে। কিন্তু, মুখভর্তি খাবার নিয়ে কথা না বলাটা একটা ভদ্রতা। এমন আরেকটি ভদ্রতাবোধ হচ্ছে কথা বলার সময় কী বলা উচিত বা কী করা উচিত। এই বিষয়ে সত্যিকারঅর্থেই বাঙালীর জ্ঞান কম। তাইতো, কারও সাথে কথা বলার সময় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকাটা যে কথা বলতে থাকা ব্যক্তির জন্য অস্বস্তিকর সেটা তাহসান খানের কাছ থেকে শিখতে হয়। বাঙালী জানে না কিভাবে কমিউনিকেট করতে হয় এবং এটা প্রত্যেক সভ্য মানুষেরই শেখা উচিত।
না, একটু ভুল বললাম। আমি মনে করি এটা শিখে প্রত্যেকটি মানুষেরই সভ্য হওয়া উচিত। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি। তবে একইসাথে এটাও মনে রাখা উচিত যে, শেখার মাঝে লজ্জার কিছু নাই। কিন্তু ইচ্ছেটা তো থাকতে হবে!
সম্প্রতি, নুহাশ হুমায়ুনকে নিয়ে যে ঘটনাটা ঘটলো সেটার পিছনেও মূল কারণ হচ্ছে এই জ্ঞানের অভাব। ঔচিত্যবোধের জ্ঞান না থাকার ফলেই এইটা ফাঁস করার কথা কেবল কেউ চিন্তা করতে পারে। অন্যান্য সকল কিছু যেমন; এক্সপোজ করা, ভাইরাল হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলো এই বোধের সাথেই জড়িত। মানুষকে বুঝতে হবে কোন বিষয়টি এক্সপোজ করা উচিত এবং কোনটি এক্সপোজ করা উচিত নয়। নুহাশ হুমায়ুনের স্ক্রিনশটগুলো কি আদৌ এক্সপোজ হওয়ার দাবী রাখে?
চলুন, একটু বিশ্লেষণ করা যাক। একথা ভুল না যে নুহাশ হুমায়ুন ফ্লার্ট করেছে। কিন্তু, তার ফ্লার্ট করাটা কি এক্সপোজ করার পর্যায়ে ছিলো? নুহাশ হুমায়ুনের জায়গায় যদি অন্য কোনো ছেলে থাকতো তাহলে কি তাকে এই কারণে এক্সপোজ করা হতো? এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই বিবেচনার বিষয়। এছাড়াও, একটা স্ক্রিনশটে দেখলাম একজন বলছে যে নুহাশকে যখন বলেছে যে সে ফ্লার্ট করার জন্য এভেইলেবল না, তখন নুহাশ বলেছে যে সে-ও এভেইলেবল না অথচ নুহাশ নাকি তার সাথে ফ্লার্ট করেছে। কিন্তু এই কথার ভিত্তি কী? কোনো স্ক্রিনশটে তো দেখা যাচ্ছে না যে নুহাশ এমন কিছু বলেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, যতোটা ঘটেছে বলা হচ্ছে ঠিক ততোটাই ঘটেছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যদি সত্যিকার অর্থেই, নুহাশের বিরুদ্ধে কোনো পাকাপোক্ত অভিযোগ থাকতো তবে সেটাকে গুছিয়ে প্রকাশ করা হলো না কেন? কেন এখান থেকে একটা আর ওখান থেকে দুটো স্ক্রিনশট শেয়ার করা হলো? বাদবাকি স্ক্রিনশটগুলো কোথায়?
এসবের পিছনে মূল কারণ ঔচিত্যবোধের অভাব। উচিত-অনুচিতের জ্ঞান থাকলে, কমন কার্টেসী থাকলে এটা বোঝা কঠিন হতো না যে কোন বিষয়টি এক্সপোজ করার মতো এবং কোনটি নয়। অথবা, এটা বোঝাও কষ্টকর হতো না যে কার সাথে ফ্লার্ট করা উচিত এবং কার সাথে অনুচিত। কমন কার্টেসী, ঔচিত্যবোধ, কমিউকেশন এগুলো প্রত্যেকটিই একে অপরের সাথে সম্পর্কিত।
সপ্তাহ তিনেক আগে আমার কাছে একজন তেইশ বছরের যুবক তার ব্যক্তিগত জীবনের একটা সমস্যা নিয়ে এসেছিলো। তার সমস্যা ছিলো যে বন্ধুরা তাকে এড়িয়ে চলে, আত্মীয়রা তার সাথে তেমন কথা বলে না। সমস্যাটা কী সেটা জানার জন্যই মূলত আমার কাছে এসেছিলো।
আমি লক্ষ্য করেছিলাম, ছেলেটা আমি বয়সে বড় হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সালাম দেয়নি। ব্যক্তিগতভাবে, সালাম পাওয়া নিয়ে মাথা না ঘামালেও, আমাদের সমাজে একটা কমন কালচার বয়সে বড়দের সালাম দেয়া। তখন আমি তাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গেলাম। যেহেতু লাঞ্চ টাইম ছিলো দুজনেই বেশ ভারী খাবার-দাবার অর্ডার করলাম। আমি নিলাম বার্গার, ফ্রেঞ্চফ্রাই আর কোক এবং সে নিলো পিৎজা, গার্লিক ব্রেড আর ফান্টা। খাবার আসার পরে আমরা কথা বলতে বলতে খেতে লাগলাম। ছেলেটা বেশ দ্রুত খায়। তার যখন খাওয়া শেষ হলো তখনো আমার অর্ধেক খাবার বাকি। আমি তাকে সাধতে যাচ্ছিলাম কিন্তু তার আগেই সে আমার প্লেট থেকে ফ্রেঞ্চফ্রাই নিয়ে খাওয়া শুরু করলো। আমার খানিকটা কোক বাকি ছিলো, সেটাও খেয়ে ফেললো। তখন আমি বিষয়টি বুঝতে পারলাম।
আমি তার কাছে বন্ধুদের সাথে তার আচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলাম। সে স্বীকার করলো যে বন্ধুদেরকে সে প্রায়শই অপ্রীতিকর কথা বলে ফেলে। মুরুব্বি আত্মীয়দের সামনে পা তুলে বসে থাকে এবং সে কারণে বাসা থেকে তাকে বেশ কয়েকবার সতর্কও করা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু ছোটখাটো বিষয় ছিলো। অতঃপর আমি তার সমস্যাটা তাকে বললাম এবং সে অনুযায়ী কাউনসেলিং করালাম। সে বুঝলো যে তার প্রধান সমস্যা ঔচিত্যবোধের অভাব। বাবা-মা বলুন বা আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধব, সকলের সাথেই আমরা একটা পর্যায় পর্যন্ত হাসিঠাট্টা করতে পারি। সেই পর্যায় অতিক্রম করলে তখন সেটা খারাপ দেখায়।
যাই হোক, বর্তমানে ছেলেটি তার এই স্বভাব থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছে। আমার পক্ষ থেকে তাকে সে জন্য আন্তরিক অভিনন্দন এবং ধন্যবাদ তার ঘটনাটি শেয়ার করার অনুমতি প্রদানের জন্য।
বর্তমানে পৃথিবী একটা অস্থির সময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছে। সামনে পরিস্থিতি আরও অস্থির হবে। আমরা বাস করছি একটি অস্থির যুগে। কিন্তু সেই অস্থিরতার মাঝেই আমাদেরকে স্থির থাকতে হবে। সেটার জন্য প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হবে। সেই লড়াইয়ে জিতলেই কেবল আমরা ব্যক্তিসুখ নিশ্চিত করতে পারবো।
একজন অজ্ঞাতনামা দার্শনিক বলেছেন, “Common sense is so rare these days, it should be classified as a super power.” এই সুপার পাওয়ারটা বাঙালীর আয়ত্ত্ব করতে হবে এবং কাজে লাগাতে হবে। তাহলেই কেবল বাঙলী বুঝতে পারবে কার সাথে ফ্লার্ট করা উচিত এবং কাকে এক্সপোজ করা উচিত।
বি.দ্র.: আমি পোস্টে স্ক্রিনশট শেয়ার করার পক্ষপাতী নই। কিন্তু ফেসবুকে একটু খুজলেই পাবেন।
ক্যারিয়ার নিয়ে কিছু কথা
ক্যারিয়ার সিলেকশন নিয়ে কিছু কথা।
আমার খুব ইচ্ছা ছিল সাহিত্য বা দর্শন পড়বো। বাজারে চাহিদা নেই দেখে আর সাহস করা হয়নি। কাঠখোট্টা হিসাব বিজ্ঞান পড়লাম সিএ হবো এই ভেবে। ব্যক্তিগত কিছু কারনে সেটা শুরু করেও বাদ দিলাম।
প্যানপ্যান করে সহজে টাকা উপার্জন করা যায় দেখে চলে এলাম শিক্ষকতায়। এখানেও হতাশা। মাস শেষে ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে হতাশা, ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের ঘুমাতে দেখে হতাশা, পরীক্ষার খাতা দেখে হতাশা, সাদা রঙ ও নীল রঙের হতাশা, দেশ সেরা মেধাবীদের দৌড়ে থেকেও বিসিএস কেন দিলাম না এই হতাশা।
অন্যদিকে সিএ কোয়ালিফাইড বন্ধুরাও দেখি হতাশার কথা বলে। বিসিএস এ প্রথম হওয়া বন্ধুরাও হতাশার কথা বলে। এম এন সি তে হাই-পেইড জব করা স্মার্ট বন্ধুরাও হতাশার কথা বলে। যেই সব বন্ধুরা বিয়ে করলো তারাও হতাশার কথা বলে। আর যারা এখনো করতে পারেনি তারাও হতাশার কথা বলে।
দিন শেষে যেটা আবিষ্কার করলাম সেটা হলো, ভালো বেতন হতাশা কমায় না, সুন্দর বউও হতাশা কমায় না। হতাশা একটা প্রক্রিয়া যেখানে আমরা রোজ রুটিন করে ইনপুট ঢেলে দেই। চাইলেও ঢালি, না চাইলেও ঢালি। হাত-মন-চোখ সব কিছু চব্বিশ ঘন্টা তুলনা খুজে নিজের সাথে অন্যের। এটাই ইনপুট হতাশা প্রক্রিয়ার।
আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি হলো – মা-বাবা- ফ্যামিলি হলো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। শুধুমাত্র ক্যারিয়ারের কথা ভেবে এইসব থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত নয়। এমন ক্যারিয়ার বেছে নেয়া উচিত যেখানে নিজের বেস্ট ক্রিয়েটিভিটি দেখানো যায় পাশাপাশি ফ্যামিলিকে সময় দেয়া যায়। এই প্রসেসে শুরুর দিকে নিজেকে লুজার মনে হতে পারে। কিন্তু ১০ বছর পরে নিজের ভেতর কোন অনুশোচনা কাজ করবে না যেমনটা বড় বড় সফল মানুষের মধ্যে করে।
সফল না হয়ে সুখি হবার জন্য কাজ করা উচিত। এতে টেইক আউটে রোজ চেক ইন দেয়া হবে না হয়তো কিন্তু ঘুমটা অনেক শান্তির হবে। মা-বাবা বেচে থাকলে তাদের সাথে একবেলা অন্তত হেসে-খেলে সময় কাটানো উচিত, ভাই-বোন-বন্ধু-বান্ধব ও স্ত্রী কে বুঝতে দেয়া উচিত যে তোমার কাছে তারা গুরুত্বপূর্ণ।
সব মিলিয়ে আড়ম্বরময় জীবন না চেয়ে একটা সহজ জীবন কামনা করা উচিত। যেই ক্যারিয়ারে শান্তিমত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়া যায়, তিন বেলা খাবার আরাম করে খাওয়া যায় এবং ফ্যামিলিকে সময় দেয়া যায় – সেটাই বেস্ট ক্যারিয়ার। টাকা দিয়ে নয়, মানসম্মত সময় কাটানোর মানদন্ডে ক্যারিয়ার বেছে নেয়া উচিত।
টাকাকে টাকশালে ছাপানো যায়, সময় ও সম্পর্ককে যায় না। তাই সময় ও সম্পর্ককে গুরুত্ব দিন, টাকাকে নয়। এইসব একবার চলে গেলে টাকশাল ও আর ফিরিয়ে দিতে পারবেনা। শুভ কামনা।
ক্যারিয়ার এবং সন্তানের নিরাপত্তা
পড়ালেখা শিখেছি বলেই চাকরি করতে হবে ব্যাপারটা এমন ছিল না। আমি বরাবর চেয়েছি বিসিএস এ প্রশাসন ক্যাডারে যাবো। যে পরিমাণ পড়ালেখা বা শ্রম দরকার ছিল তা হয়তো আমি দিইনি! আমি মাস্টার্সের রেজাল্টের আগেই হাইস্কুলের শিক্ষক পদে নিয়োগ পাই। এখন আমি আমার এই পেশাকে প্রচন্ড ভালবাসি,সম্মান করি। আমার চাকরির কারণে পায়ের নিচের মাটি শক্ত মনে হয়। আমার বর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। উনি যে অর্থ উপার্জন করেন তাতে আমার এবং পরিবারের আলহামদুলিল্লাহ ভালো চলে। উনি আমাকে বরাবর সম্মান করেন। সংসার এবং চাকরি জীবনে আমরা দুজন দুজনকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছি। আমার প্রতিটা পদক্ষেপে উনাকে আমি পেয়েছি একজন চমৎকার বন্ধু হিসেবে।
আমি চাকরি করি আরো কিছুটা ভালো জীবনযাপনের জন্য। বিভিন্ন অকেশনে আত্মীয়স্বজনদের আমরা এটা সেটা দিতে ভালবাসি। আপনজনদের আর্থিক সহায়তা করি। হয়তো একজন চাকরি করলে ননদের সন্তান বা আমার বোনের সন্তানকে জামা-কাপড় কিনে দিতাম। কিন্তু যখন দুজন আয় করি তখন বছরব্যাপী বহুবহু কিছু দিতে পারি। আমার বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন সময় আড্ডা অথবা ইচ্ছেমতো নিজের কেনাকাটা অথবা হুট করেই কোন একজন অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করার সময় আরেকজনের দিকে তাকিয়ে থাকা লাগেনা। আমার বরকেও তো তাই। আর্থিক ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে নিজের সাপোর্টটুকু বিশাল হয়ে দাঁড়ায়।
এবার একটা অন্য প্রসঙ্গ রিলেট করি। আমাদের সন্তান একটি। মেয়ের ছয়মাস বয়স থেকে আমি অফিস করি। ওর একবছর বয়স পর্যন্ত আমি রোজ রাস্তায় বের হয়েই কেঁদেছি। বহু রিকশাচালক,অটোড্রাইভার,আমার কলিগরা আমায় কাঁদতে দেখেছে। মেয়ে আমার আপনজনদের কাছেই বেড়ে উঠেছে। ওর বাবা অনেক সময় দিয়েছে। ওর দাদা,দাদী,ছোটফুপী সদাসর্বদা ওর পাশে থেকেছে। এখনো আছে। বাসায় পার্মানেন্ট হেল্পিং পারসন থাকা স্বত্তেও আমরা আজ অব্দি কখনোই ওকে শুধুমাত্র উনার সাহচর্যে রেখে যাবার সাহস পাইনি।
নিত্যনতুন আমার বাচ্চা গল্প শিখছে,গান শিখছে,কবিতা শিখছে। অফিস থেকে এসেই দেখি নতুন কিছু শিখেছে। কে শিখিয়েছে? আজ হয়তো দাদু,কাল দাদী অথবা ছোটফুপী। বড় পরিবারে বাচ্চা মানুষ হয় মহানন্দে। আমি চাকরি করছি আনন্দের সাথে। প্রথম প্রথম মনে হতো গৃহিণী মায়েরা খুব সুখী। আমি দুইবেলা মেয়েকে খাওয়াতে পারছি। কিন্তু গৃহিণী মায়েরা প্রতিবেলায় পারে। পরে বুঝেছি। আমি ভুল। চাকরির বাইরে পুরোটা সময় আমি মেয়েকেই দিই। আরো বেশিই হয়তো দিই। আমার হাতে মেয়ে যেটা খায়না, ওর দাদী ঠিক এই সেই গল্প শুনিয়ে খাইয়ে দেয়।
তবে সব পরিবারের মতো এই পরিবারেও কিছু গল্প আছে। সবসময় দাদা,দাদী ওদের বাড়ি ছেড়ে থাকতে চাননা। উনাদের নিজের হাতে গড়া বাড়িই যে ওদের প্রিয়। যে ক’দিন উনারা থাকেন না, তখন আমরা সময় ম্যানেজ করি দুজনই। তবুও একা রাখি না মেয়েকে। মা’কে,আম্মুকে,বাবাকে,ওর ফুপীদের,খালাদের বুঝাই, খুব বেশিদিন না। আমাকে ওর কিছুটা বড় হওয়া পর্যন্ত হেল্প করো। একটা সময় পরে ও নিজেই নিজের হেল্প করতে পারবে।
সন্তান আমাদের সবচেয়ে প্রিয়। তার সিকিউরিটি,তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করেই তাকে পৃথিবীতে আনা উচিত। আপনজনদের ভালবাসা দিয়ে,ওদের সাপোর্ট নিয়েই নিজের কাজটুকু করা উচিত বলে আমি মনে করি। প্রতিটা নারী সাবলম্বী হোক,নিজের আর্থিক সাপোর্ট নিজেই হোক। তবে সন্তানকে ভালবেসে,সময় দিয়ে বড় হওয়ার সুযোগটুকুও তৈরি করে দিক।
মেয়েরা অনেক ঠকেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ছেলেরা নিজেদের ক্যারিয়ার সন্তানের জন্য খুব কমই বিসর্জন বা ক্ষতিগ্রস্ত করে। তবে এটা ঠিক,কাজে মনোযোগ নষ্ট করে সন্তানের ভালো থাকা হচ্ছে কিনা এটা ভাবে নিশ্চিত। আমি বা আমার সন্তানের বাবা দুজনই বাইরে থাকা অবস্থায় চিন্তা করি মেয়ে ব্যথা পায়নি তো! ঠিক মতো খেয়েছে তো! কোন রুম লক যেনো না করতে পারে সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করে এসেছি তো! ছুরি,কাঁচি,ব্লেড সব দূরে রেখেছি তো! দুজনই ফোন করে করে জিজ্ঞেস করি বাথরুমের টাবে বা বালতিতে পানি জমিয়ে রেখে আসিনি তো! পড়ে যাওয়ার ভয়ে বলি। কিচেনে যায়নি তো! ভয়, ভয় আর ভয়। এতো ভয় নিয়ে আদৌ কি ১০০ ভাগ কাজে মন দেওয়া সম্ভব?
এই একটা সুরাহার অভাবে কত মেয়ে চাকরি করেনি! চাকরি ছেড়ে দিয়েছে! কোন উপায় নেই? আছে তো। প্রতিটা কর্মক্ষেত্রে মা-বাবার কাছাকাছি কোথাও সন্তানকে রাখার ব্যবস্থা করলেই ১০০ ভাগ মনোযোগ পাবে প্রতিষ্ঠান। যখন আমি জানবো আমার সন্তান পাশেই আছে। খেলছে,খাচ্ছে। আমি আরামে উদ্যমী হয়ে আরো বেশি কাজ করবো। লাঞ্চ আওয়ারে আমি তাকে দেখে শান্তির শ্বাস ফেলবো। যারা আপনজন পায়না তাদের জন্য এর চেয়ে চমৎকার ব্যবস্থা আর কি হতে পারে? রাষ্ট্র এবং সমাজপতিরা কি একটু ভাববেন বিষয়টা নিয়ে?
বাংলাদেশের বেশিরভাগ ফ্যামিলির বাবা-মায়েরা সন্তানকে এমনভাবে মানুষ করেন যে সন্তানের ভেতর প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়- ‘তার জীবনের লক্ষ্য হলো, টাকা কামানো, স্ট্যাটাস বানানো, ক্যারিয়ার বানানো।’
ছোটবেলা থেকে এভাবেই বড় করার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। তাকে বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয়, তোমাকে কিন্তু ওর মতো হতেই হবে। ঐ উপরে যেতেই হবে। না যেতে পারলে আমাদের মুখ উজ্জ্বল হবে না। আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে তোমাকেই হতে হবে সবচেয়ে সেরা!
ছেলে মেয়েও শুরু করে দৌড়। ক্যারিয়ারের জন্য দৌড়, স্ট্যাটাসের জন্য দৌড়, এর মতো হওয়ার জন্য দৌড়, ওর মতো হওয়ার জন্য দৌড়, বাপ মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার জন্য দৌড়। এই দৌড় আর শেষ হয় না।
দিন যায়…বছর যায়…
একসময় বাবা মায়ের বয়স হয়। তখন তারা চায়, সন্তানরা এবার একটু থামুক, একটু পাশে বসুক, একটু ভালোবাসুক।
কিন্তু ততদিনে সেই সন্তান একলা চলতে শিখে যায়। শিখে যায় ক্যারিয়ার, স্ট্যাটাস আর টাকার পেছনে আরো জোরে দৌড়াতে!
বাপ মায়ের ভালোবাসা আর মায়া মাখানো কথাবার্তা তখন ঐ দৌড়ানো সন্তানটি আর বুঝতেই পারে না। সেই কথাগুলো তাদের কাছে তখন দুর্বোধ্য মনে হয়। তাদের জগতে তখন আর ইমোশন থাকে না, থাকে শুধু প্রোমোশন!
এমন হবেই বা না কেন! তাকে তো ছোটবেলা থেকে শুধু পাঠ্যপুস্তক আর ক্যারিয়ারের পেছনেই দৌড়াতে শেখানো হয়েছে, ভালোবাসতে তো শেখানো হয় নি!
এইসব সন্তানেরা কখনো গান শোনে না…কবিতা লিখে না.. তারা গল্পের বই পড়েও সময় নষ্ট করে না। তারা কখনো বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে না, বৃষ্টিতে তাদের মন খারাপ হয় না…
তারা থাকে ভীষণ ব্যস্ত! বাবা-মায়ের খবর নেয়ারও বা সময় কই? বাবা মাকে তারা ভালোবাসে। তবে সেটা শুধুই ফেসবুকের কোনো এক আবেগঘন স্ট্যাটাসে …
এভাবে শেষ বয়সে প্রচণ্ড অবহেলার শিকার হন বাবা-মা। একটা পর্যায়ে বাবা-মা বুঝেন, বিরাট ক্যারিয়ারিস্ট সন্তানের গর্ব করার চেয়ে সন্তানের সাথে বসে এক কাপ চা খাওয়াটা বেশি সুখের! সন্তানকে একটু ছুঁয়ে দেখাটা বেশি আনন্দের!
একসময় মা মৃত্যুশয্যায় চলে যান, বাড়ী ভর্তি লোকজন। কিন্তু প্রিয় সন্তানরা কেউই কাছে নেই। মা হয়তো নিরবে অপেক্ষা করতে থাকেন কখন আসবে তার কলিজার ধন?
কিন্তু তার কলিজার ধন তখন হয়তো কোনো ফ্লাইটে ….. অথবা অফিসে জরুরি কোনো মিটিং এ…
ক্যারিয়ারিস্ট সন্তানের মা তখন সন্তানের মুখ না দেখেই শেষ বারের মতো চোখ বুঁজেন…
অসুস্থ বাবা বারান্দায় চেয়ারে বসে থাকেন শূন্য চোখে…
গোটা বাড়ীতে অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা!
অথচ যে বাড়িতে একসময় ছিলো সন্তানদের হৈ-হুল্লোড়, লাফালাফি, চিৎকার-চেঁচামেঁচি, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি!
এতো আদরে লালন করা সন্তানদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকার পরও বাবা-মায়ের এমন নিঃসঙ্গ করুণ মৃত্যুটা কি মেনে নেয়া যায়?
শুধু ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে নয় বরং সন্তানকে ভালোবাসতে শেখান। সন্তানের প্রতি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করুন। তাকে ভালোবাসছেন অথচ তা প্রকাশ করছেন না, এমনটা যেন না হয়। বিশ্বাস করুন! ভালোবাসতে শিখলে সে বিশ্বসেরা বিজ্ঞানী না হলেও বা সফলতার হিমালয় জয় করতে না পারলেও প্রচণ্ড অসহায়ত্বে আপনার হাতটা ধরবে। এটা নিশ্চিত!
——————————
প্যারেন্টিং ভাবনা
সাজেদা হোমায়রা