#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“আমার স্বামী যখন আমাকে ভালোবেসে স্পর্শ করে তখন মনে হয় আমার শ্বশুর আমাকে স্পর্শ করছে, আমি প্রচন্ড ঘৃণায় কুঁকড়ে যাই।” ভদ্রমহিলা বললেন।
বয়স ৩৭ বছর, ঈর্ষণীয় পেশা, নজরকাড়া সুন্দরী, ৩ সন্তানের জননী। স্বামী একমাত্র সন্তান, সুদর্শন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র। গবেষণাকর্মী হিসেবে দেশের থেকে আন্তর্জাতিক মন্ডলে অধিক সুপরিচিত। শ্বশুর শাশুড়ি দুইজনই দেশের সর্বোচ্চ পদ থেকে রিটায়ার করেছেন। ছিমছাম সাজানো সংসার।
আমি: ” ঘৃণা হয়?”
ভদ্রমহিলা, ” প্রচন্ড! আমি ওকে বুঝতে দেইনা। কিন্তু এখন আর নিতে পারছি না। এমনকি ওর ছায়াও যদি আমার ছায়ার উপর পড়ে, আমার গা গুলায়। অথচ আমাদের প্রেমের বিয়ে।”
আমি, ” কবে থেকে এমন শুরু হচ্ছে? “
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ চিন্তা করে, ” বছরখানেক…. না! বছর দুয়েক… না! না! আমি ঠিক মনে করতে পারছিনা… সম্ভবত আরো আগে থেকেই।”
ফোন বেজে উঠল। সাহেবি কেতায় দুঃখিত বলে ভদ্রমহিলা ফোনটি ধরলেন। অফিসিয়াল কথাবার্তা। আমি খেয়াল করলাম, ভদ্রমহিলা তিন বছর আগের দিনক্ষণ ঠিকঠাকমতো রেফারেন্স দিলেন। বাজেটের কথা বলতে যেয়ে দশমিকের পর ২,৩ ঘরও দিব্যি গটগটিয়ে বললেন। বুঝলাম ডিটেইলস মনে রাখতে উনি পেশাগত দক্ষতায় ওস্তাদ। তাহলে এটা কেন পারলেন না? প্রশ্নটা মাথায় রাখলাম।
আমরা আবার শুরু করলাম।
আমি, ” আপনার স্বামীর সাথে সম্পর্ক কেমন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমাকে খুব ভালোবাসে, বিশ্বাস করে, কিছুটা ভয়ও পায়। কারণ আমি বরাবরই যৌক্তিক প্রতিবাদী। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই সহপাঠি বলে ও জানে।”
আমি, ” আপনি ওনাকে ভালোবাসেন?”
ভদ্রমহিলা এক কথায়, “হ্যাঁ।”
আমি, “আপনি ওনাকে শ্রদ্ধা করেন?”
ভদ্রমহিলা, ” একজন মানুষ হিসেবে বললে অবশ্যই, বাবা হিসেবে অবশ্যই, সন্তান হিসেবে অবশ্যই কিন্তু স্বামী হিসেবে অনেক কিছু বোঝেনা।”
আমি, ” একমাত্র সন্তান হিসেবে ওনার দায়িত্ব ভারটা কি একটু বেশি?”
ভদ্রমহিলা একটু ভেবে বললেন, ” আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি খুবই ইন্ডিপেন্ডেন্ট। ওনাদের অর্থনৈতিক বা শারীরিক সাহায্যর প্রয়োজন নেই। আমার স্বামী দায়িত্ব পালনের চেয়েও বাবার সামনে ব্যক্তিত্বহীন হয়ে যায়। তার কথাগুলোই তোতা পাখির মতন আওড়াতে থাকে।”
আমি, ” সেই কথাগুলো কি?”
ভদ্রমহিলা, ” তিনি প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক।”
আমি, ” শাশুড়ির সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?”
ভদ্রমহিলা,” মজার ব্যাপার হলো সম্পর্ক খুবই ভালো। আমাদের একটা অসম বয়সের বন্ধুত্ব আছে।”
আমি, “আপনার শ্বশুর-শাশুড়ির আন্তঃসম্পর্ক কেমন?”
ভদ্রমহিলা, ” সামাজিক পরিমণ্ডলে তারা চরম পপুলার, অতিথির আপ্যায়ন, দান ধ্যান, ঘোরাঘুরি সবকিছুতেই পাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমার শাশুড়ির একটা জায়গা টোটালি আমার শ্বশুর নিতে পারেন না। সেটা আমার শাশুড়ির স্বাধীনতা । ওনাকে রীতিমতো জবাবদিহি করতে হয়, এমনকি কোথায় মিটিং করছেন সেটাও মাঝে মাঝে ছবি তুলে পাঠাতে হতো আমি দেখতাম বিয়ের পর পর। আমার শাশুড়ি সবকিছু করার স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেটা আমার শ্বশুরের অনুমতি সাপেক্ষে।”
আমি, ” আপনার শাশুড়ি বিষয়টা কিভাবে দেখেন?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি যতটুকু বুঝি, পছন্দ করেন না, কিন্তু এখন কম্প্রোমাইজ করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। আমার শ্বশুর কিন্তু মানুষ হিসেবে এক কথায় চমৎকার।”
আমি, ” আপনি ওনাকে এক কথায় কি বলবেন?”
ভদ্রমহিলা, ” বুঝতে পারছি না।”
আমি, ” আমি দুটি শব্দ বলি আপনি এর মধ্য থেকে একটি বেছে নিন। গোষ্ঠপতি নাকি আধিপত্যবাদী?”
ভদ্রমহিলা, ” আধিপত্যবাদী।”
তারপর সেই কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প।
শ্বশুরের এই মানসিকতা এসেছে তাঁর বাবার থেকে। ভদ্রমহিলার দাদাশ্বশুর ছিলেন ব্রিটিশ আমলের এমএ পাস। স্ত্রী নিরক্ষর। বয়সে ২০ বছরের ছোট। ভদ্রমহিলার শ্বশুর নিজের বাবাকে দেখে দেখে নিজের অজান্তেই নিজের স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। সেই পারিবারিক ঐতিহ্য নিজের অজান্তে ছেলেও ধারণ করেছে। শাশুড়ির মেনে নেয়া নিজের অজান্তেই শ্বশুরকে এই আচরণ করতে রিইনফোর্স করেছে। এদিকে ছেলে আশৈশব বাবা-মার সামাজিক আচরণ থেকে এই মেসেজটাই পেয়েছে যে এরকম করা যায়। তাই সে বাবার এই আচরণের কোন দোষ দেখে না।
সমস্যাটা বাঁধলো তখনই যখন অন্য পারিবারিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা আরেকটি মানুষ এই সংসারে আসলেন। কারণ পুত্রবধূ দেখে এসেছেন তার বাবা-মার মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক। যেখানে আধিপত্যবাদী জবাবদিহিতা একান্তই অনুপস্থিত।
ফলে পুত্রবধূ ধীরে ধীরে যত শাশুড়ির প্রতি সহমর্মী হতে লাগলেন অবচেতনভাবে শ্বশুরকে অপছন্দ করা শুরু করলেন। এদিকে শ্বশুর দেখলেন, তাঁর নিজের উচ্চশিক্ষিতা স্ত্রীও যদি তাঁকে মান্য করেন, তাহলে সেদিনকার এই পিচ্চি মেয়েটি, যে কিনা তাঁর ছেলের থেকেও বয়সে ছোট, তাঁকে মানছে না, অর্থাৎ তাঁর বিশ্বাস ( বিলিভ সিস্টেমকে) মানছে না তার মানে মেয়েটি ভুল। তবে নিঃসন্দেহে এই মেয়ে বেয়াদব।
ফলে গোপনে শুরু হলো পুত্রবধূ এবং শ্বশুরের মনসামাজিক দ্বন্দ্ব। এই ধরনের কমিউনিকেশনকে বলে আল্টেরিওর কমিউনিকেশন। এখনে সোশ্যাল লেভেলে মেসেজ থাকে একটা যেটা সবাই এক অর্থ ধরে কিন্তু মনস্তাত্বিক লেভেলে মেসেজ থাকে ভিন্ন। সেটা যার সাথে দ্বন্দ্ব শুধুই তাকেই খোঁচা মারা। অন্য কেউ বুঝে না। এই কনসেপ্টকে বলে সাইকোলজিকাল গেম। শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষই ৯৯ ভাগ সময় এই গেম খেলেন অসচেতন ভাবে। এর বিভিন্ন মাত্রা আছে।
এই , অসচেতনভাবে খেলেন বলেই ভদ্রমহিলা আমার কবে থেকে এমন শুরু হচ্ছে , প্রশ্নের উত্তরের ডিটেইলস মনে রাখতে পারেন নাই।
এখানে বউ এবং শ্বশুরের এই মনস্তাত্বিক গেমের বলি হচ্ছে নিরীহ পুত্র। তিনি বুঝতেও পারছেন না যে তাঁর স্ত্রী কি ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন। অন্য দিকে শ্বশুরের মনের অবস্থা খোঁজ নিলেও দেখা যাবে যে তিনি ভালো নেই। কারণ পুত্রবধূ প্রতিনিয়ত ওনাকে অদৃশ্য অঙ্গুলি তুলে যাচ্ছেন।
আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে, দাম্পত্য কলহের চারভাগের তিনভাগই আমি তুমি নিয়ে হয় না। আমার বাড়ি তোমার বাড়ি নিয়ে লাগে। কারণ এখনো আমাদের দেশে যৌথ পরিবারের কিছুটা অস্তিত্ব আছে। বাংলাদেশে দুটো ছেলেমেয়ের বিয়ে হয় না, বিয়ে হয় দুটো পরিবারের। এর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটো প্রভাবই আছে। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিছু কিছু অভিভাবক যখন শ্বশুর-শাশুড়ি হন, তখন অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য অনেকেই পুরনো অভ্যস্থতা ছাড়তে পারেন না। মা মনে করেন সন্তান বিয়ের কি বোঝে? কাজেই সন্তান না চাইতেও অনেক ক্ষেত্রেই বাবা-মা আগবাড়িয়ে উপদেশ দেন। এই উপদেশের পটভূমি হয় বাবা-মা নিজেরা তার জীবনে যেটা ফেস করেছেন সেটা। কিন্তু সেই আমল এই আমল হতে আলাদা। হতেই পারে সেই আমলে আমার শাশুড়ি আমাকে জ্বালিয়েছেন। কিন্তু তার মানে যে বউ শাশুড়ির সম্পর্ক নেতিবাচক হতেই হবে এমন কথা নেই। কাজেই আমি যদি আমার পুরনো নেতিবাচক অভিজ্ঞতা দিয়ে বর্তমানকে বিচার করতে চাই, সেই ক্ষেত্রে আমি আমার সন্তানের বর্তমান জীবনে অশান্তি টেনে আনব।
ধরুন আমার ছেলে বা মেয়ে বা ভাই বা বোন তারা দাম্পত্য সমস্যায় পড়েছে। সেই ক্ষেত্রে বৃহত্তর পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে পরিবারের এই ক্ষত সারাতে আমি অবশই ভূমিকা নেব। সাথে এটাও ভাববো, এই সমস্যা তৈরিতে আমার ভুমিকা কি? আমি কি সহানুভূতিশীল হয়ে নিজের frame of reference থেকে বুদ্ধি দিচ্ছি? তাহলে এটা কাজে নাও লাগতে পারে। কারন কাপলটিও অ্যাডাল্ট। ওদের মতামত এবং চাহিদা আলাদা।
যারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো সম্পর্কের আত্মীয়তার দাবি থাকলেও ঢোকেন না তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।