#কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প
“Our life script is an unconscious pathway created in childhood, reinforced by our parents, and strengthened with evidence sought throughout life ensuring our beliefs are justified.” Eric Berne.
” আমি ক্লাস কন্ট্রোল করতে পারি না।” ভদ্রলোক বললেন। বয়স ৩৫ বছর, অতীব মার্জিত। প্রথম শ্রেণীর এক বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করে দেশে ফিরে অধ্যাপনায় যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই ক্লাসের ছাত্রদের হ্যান্ডেল করতে পারছেন না। সেই কারনেই কাউন্সেলিং এ আসা।
আমি, ” কি হয় ক্লাসে?”
ভদ্রলোক, ” কি কি হয় না? বোর্ডে আমাকে উদ্দেশ্য করে ছবি আঁকা থেকে শুরু করে ঢিল ছোড়াছুড়ি সবই হয় প্রকাশ্যে।”
আমি, “ আপনি তখন কি করেন?”
ভদ্রলোক, ” চুপ করে থাকি।“
আমি, “ বিষয়টা কি এমন যে ছাত্ররা ক্লাসে অভদ্রতা করছে আর আপনি তার যুতসই জবাব দিতে পারছেন না?”
ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে , ” জী।“
পারিবারিক জীবনের খোঁজ নিতে যেয়ে দেখা গেল ভদ্রলোকের বিবাহিত জীবন ৩ বছরের এবং তিনি সন্তান নিতে অনাগ্রহী। এক পর্যায়ে বলেও ফেললেন, ” আমার স্ত্রী আমাকে নিয়ে প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্থ আমি আদৌ জানিনা কতদিন এই সংসার টিকবে!” ভদ্রমহিলার ছবি দেখলাম। পরীর মত সুন্দর। তিনি উচ্চশিক্ষিত, ঈর্ষণীয় পেশাগত সাফল্য আছে তাঁর ঝুলিতেও। আপাতদৃষ্টিতে রাজযোটক।
ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বললেন, ” আমরা পারিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে দুর্দান্ত কাপল। কিন্তু জানেন একই ছাদের তলে যখন শুধু আমরা দুজন থাকি, তখন আমাদের যোজন যোজন দুরত্ব। সপ্তাহ পার হয়ে যায় আমারা কথা বলি না। কিন্তু বাইরে কেউ বুঝবেনা।”
আমি, ” আপনি সেশেনে আসছেন কিভাবে ক্লাসে ছাত্ররা আপনার কথা শুনবে শুধু কি সেই উদ্দেশ্যে?”
ভদ্রলোক আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাকালেন , ” জী। অন্তত পেশাগত জীবনটা টিকুক।”
আমরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম দীর্ঘক্ষণ। মানুষের চোখে কখনো কখনো হাল ছেড়ে দেওয়া হতাশার না বলা ভাষা ঝিলিক দেয়। আমি স্পষ্ট দেখলাম, ভদ্রলোক কি নিদারুণভাবে নিজেকে পরিত্যক্ত বোধ করছেন।
বেড়ে ওঠার ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে দেখি ভদ্রলোকের ৭ বছর বয়সে বাবা মারা যান একটা অ্যাকসিডেন্টে। সংসারে ছোট ছোট আরো ভাইবোন ছিল। মা সারাদিন কাজ করতেন অফিসে তবুও উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবেশ থেকে তাদের স্থুল পতন ঘটে নিম্নবিত্তে। কেউ তেমনটা সহায়তার হাত বাড়ায় নাই। ৭ বছরের বাচ্চাটার কাজ ছিল স্কুল থেকে ফিরে ছোট ভাইবোনদের খাওয়ানো, থালা বাটি ধোয়া, ঘরের কাজ গুছিয়ে রাখা। কারন মা’র যৎসামান্য বেতনে কোন গৃহকর্মী রাখবার উপায় ছিল না। আমার হঠাৎ করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্রনাথের শিশু ভোলানাথ কবিতাটা মনে পড়ল,
” তোমার কাছে আমিই দুষ্টু, ভালো যে আর সবাই!
মিত্তিরদের কালু নীলু ভারি ঠান্ডা ক’ভাই!
………………………………….
বাবা আমার চেয়ে ভালো? সত্যি বলো তুমি,
তোমার কাছে করেননি কি একটুও দুষ্টুমি?
যা বলো সব শোনেন তিনি, কিচ্ছু ভোলেন নাকো?
খেলা ছেড়ে আসেন চ’লে যেম্নি তুমি ডাকো?”
ভদ্রলোক ঋজু ভঙ্গিতে বসেছিলেন। আমি প্রশ্ন করলাম, ” কেমন ফিল করতেন তখন?”
হঠাৎ করে এতক্ষণ ধরে রাখা ব্যাক্তিত্বের মুখোশটি সরে গেলো। ভদ্রলোক কান্নায় ভেঙে পড়লেন।
তারপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ছোটবেলা থেকে বাবা না থাকায় ভদ্রলোকের শৈশব অকালে হারিয়ে যায়। আর এই শৈশবহীনতার অবিরাম বেদনার ভার বহন করতে যেয়ে ভদ্রলোক অবচেতন মনে সিদ্ধান্ত নেন, ” আমি কখনো আমার বাচ্চাদেরকে এভাবে হুট করে রেখে চলে যাব না।” পরবর্তীতে জীবনের চাকা যত এগিয়েছে, সাফল্যের আশীর্বাদ কন্ঠে ছুঁয়েছে, এই অবচেতন মনের সিদ্ধান্ত ঠেকেছে, ” আমি বাবা হবো না” তে। কারণ বাবা হতে গেলে দায়িত্ব নিতে হয়। প্রয়োজনে শাসন করতে হয়, আদর করতে হয়। ভদ্রলোকের অবচেতন মন সেই শিশু কালে তো আর এত কিছু বুঝতো না। তাই সে চিন্তা করেছে একান্ত অনুভূতিগুলা আর প্রকাশই করবে না কোন দিন কারো কাছে। রোবট হয়ে যাবে। কারণ রোবটের কোন অনুভূতি নাই। উপরন্তু মা ছিলেন দারুন সুন্দরী। মার প্রতি বাবার বন্ধুদের অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ শিশু মনে ভয়ংকর নেতিবাচক দাগ কাটে। ভয় ছিল মা যদি হারিয়ে যান বাবার মত না বলে ! তখন তাদের ভাইবোনদের কি হবে? কিন্তু কোনদিন কারো সামনে সেটা উচ্চারণ করতে পারেননি। তিনি কোনদিন বাবার জন্য প্রকাশ্যে শোক করেন নাই। এমনকি মা’র কাছেও না।
আমাদের জীবনটা কেমন হবে সেই সিদ্ধান্ত আমরা শৈশবেই নিয়ে ফেলি অবচেতন ভাবে। একে লাইফ স্ক্রিপ্ট বলে। বড় হয়ে ভদ্রলোক নিজের অজান্তেই সেই সিদ্ধান্ত অনুকরণ করতে চেয়ে ক্লাসে যেখানে কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রনের কথা সেখানে সেই ভূমিকা নিচ্ছেন না। পারিবারিক জীবনে বাবা হতে অরাজি।
কাউন্সেলিং মানে উপদেশ দেয়া নয়। কাউন্সেলিং মানে কোথায় আমার ভাবনার জায়গায় জট লেগেছে সেই জিনিসটা ধরিয়ে দেয়া।
ভদ্রলোককে শৈশবের অবচেতন মনের এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন কিনা যে বাবা হবেন না জিজ্ঞেস করলাম। তিনি স্থির চোখ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আমরা আবার দীর্ঘ সময় চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকলাম। অনেকক্ষণ মূর্তির মতো বসে থেকে ভদ্রলোক খুব স্পষ্ট করে বললেন তিনি বুঝতে পারছেন। কাউন্সেলিং এ আমরা প্রায়ই দেখি, উপস্থাপিত সমস্যাটা বা যেই ইস্যু নিয়ে আসা হয় মূল সমস্যার শেকড় অন্যখানে।
আমি ভদ্রলোককে বললাম, ” ৭ বছরের বাচ্চার সিদ্ধান্ত ছিল আমি আমার বাচ্চাদেরকে রেখে কোথাও যাবো না। কারণ সে বাবাকে প্রচন্ড ভাবে মিস করে। কারন সে অ্যাক্সিডেন্ট বুঝেনা, পরিবারের অভাব বুঝেনা, শুধু একদিন দেখলো বাবা নেই তাই জীবন আমূল পাল্টে গেল। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতন পর্যাপ্ত তথ্য শিশু মনে ছিল না। কিন্তু একজন ৩৫ বছরের সক্ষম পুরুষের সিদ্ধান্ত কি তাই থাকবে নাকি পরিবর্তিত হবে? শিশুর যা যা সীমাবদ্ধতা ছিল, অসহায়ত্ব ছিল একজন প্রাপ্তবয়স্কের কি তাই আছে?”
এরপর আর বহুদিন যোগাযোগ নেই। আজ ফোন করেছিলেন তাঁর বাবা হওয়ার সুখবর জানিয়ে। ভদ্রলোক ধীরে ধীরে তাঁর বদলে যাওয়ার গল্পটা বললেন; কিভাবে ছাত্রদের সাথে চমৎকার সম্ভ্রমপূর্ণ বন্ধুত্ব তৈরি করেছেন। কিছু কিছু মুহূর্ত থাকে জীবনে যখন তৃপ্তি ছুঁয়ে যায় মনকে। ভদ্রলোকের এই ফোনটা ঠিক সেরকমই একটা অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ আমার ‘ভেতরের আমি’র কাছে।
আমরা শৈশবে অবচেতন মনে অনেক সিদ্ধান্ত নেই এবং পরবর্তীতে বাকি জীবন সেই চিত্রনাট্যে চলতে থাকি নিজের অজান্তে। তাই প্রত্যেকটা মানুষ সচেতনতার সাথে চাইলে বদলে যেতে পারে স্বেচ্ছায়, জীবনের যেকোনো ধাপে, যেকোনো বয়েসে।
যারা ‘মানুষ চাইলে বদলায়’ এই বোধ ধারন করে ক্ষোভ পুষে না রেখে অন্য আরেকজন মানুষকে সসম্মানে, সচেতনভাবে, ইতিবাচক বদলে যাওয়াতে উৎসাহিত করেন তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার