#চেম্বার কথন পর্ব ৩৪
ভদ্রলোক, ” আমার স্ত্রী কিছুতেই আমাকে বুঝতে চায় না, আমি আপনার কাছে আগে এসেছি ওর সম্পর্কে বলতে, যাতে আপনি বুঝতে পারেন ওর সমস্যাগুলি কি কি। আমি চাই ও নিজেকে বদলাক। আপনি ওর কাউন্সেলিং করে দিন।”
আমি, ” আপনার স্ত্রী বদলে যাক, এটা কি আপনি একাই চান? নাকি তিনিও চান?”
ভদ্রলোক, ” ও’তো চায়না! ওর স্ত্রীর কর্তব্য পালনে তীব্র অনীহা!” আমি, ” সব থেকে বড় অভিযোগ কি আপনার এই প্রসঙ্গে ওনার সম্পর্কে?”
ভদ্রলোক, ” ও আমার মর্জি মতো চলে না। সব কিছুতে মতামত দিতে চায়। জানতে চায়! বুঝতে চায়। আমি বলি তোমার এতো বুঝাবুঝির কি আছে! তুমি কি জজ ব্যারিস্টার হবা! তুমি আমার স্ত্রী, আমার কথা মানবা! তোমার ভরণপোষণ আমার। এতো কথা কিসের! ”
আমি, ” আপনি বাংলা সিনেমা দেখেন?”
ভদ্রলোক একটু অস্বস্তির সাথে আমার দিকে তাকালেন। থতমত খেলেন! কথার মধ্যে কোন প্যাচ আছে কিনা বোঝার জন্য চোখ সরু সরু করে তাকালেন। আমি, ” বেয়াদবি নিবেন না! আপনার প্রিয় নায়িকা কে?” ভদ্রলোক, ” শাবানা!”
আমি, ” সিনেমার প্রিয় গান কি?” ভদ্রলোক, ” আমি তোমার বধূ, তুমি আমার স্বামী.. ! আপনি বাংলা গান শোনেন?”
আমি, ” জ্বী! একটা জিনিষ কি কখনো ভেবেছেন, ‘স্ত্রীর কর্তব্য কি হবে’ সেটা সম্পর্কে আপনার মনে যেই ধারণাটা তৈরি হয়েছে, সেটাকে কিন্তু ছোটবেলা থেকেই আশেপাশের মুরুব্বীদের কথা, সিনেমা ইত্যাদি একটা রূপ দিয়েছে?”
ভদ্রলোক চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন। বুঝতে পারছি ভাবছেন। আমি, ” আপনাকে যদি ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়, ‘খোদার পরে তোমায় আমি বড়ো বলে জানি’, আপনি সেটাই বিশ্বাস করবেন তাই না? আপনার বিলিভ সিস্টেম এভাবেই গড়ে উঠেছে অবচেতন ভাবে। আপনার দোষ নেই। ছোটো বেলা থেকে এভাবেই ভাবতে শেখানো হয়েছে আপনাকে! যেভাবে বংশরক্ষার , সংসার চালানোর, কাঁদতে নেই, ভয় পেতে নেই এমন কিছু আইডিয়া আপনার মাথায় ঢুকানো হয়েছে। আপনার দুঃখ, ভয় এই দুই অনুভূতি প্রকাশের অধিকার দেয়নি সমাজ। আপনার হাতে শুধু রাগ তুলে দিয়েছে। কাজেই এখন যখন আপনার স্ত্রী মতামত প্রকাশ করতে চান, তখন এটা আপনার আশৈশব বেড়ে ওঠা বিশ্বাসের জায়গা / বিলিভ সিস্টেমের সাথে বিরোধিতা করে। স্ত্রী কেন নিঃশর্তে আপনাকে মেনে নেয় না এই যাতনায় আপনি ক্রমাগত রাগ করতে থাকেন। আপনারও কিন্ত কষ্ট হয় তাই না?”
ভদ্রলোকের চোখে সম্মতির দৃষ্টি।
ভদ্রলোক, ” আমার কষ্ট হয়! কিন্তু কিভাবে বলে বোঝাবো?”
আমি, ” এক্সাক্টলী! আপনি তো শেখেন নাই, দেখেন নাই কিভাবে আলোচনার ভাষায় কথা বলতে হয় জীবন সঙ্গীর সাথে। কারণ আপনাকে অবচেতন ভাবে শেখানো হয়েছে খোদার পরেই আপনার অবস্থান। ফলে সেই অবস্থান ধরে রাখতে যেয়ে দিনে দিনে আপনি নিঃসঙ্গ থেকে নিঃসঙ্গতর হচ্ছেন। পৌরুষ বহন করা কিন্তু খুব কঠিন। কারণ আমাদের সমাজ কাপুরুষকে খুব নির্মমভাবে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। স্ত্রৈন, মেনিমুখো এই ট্যাগ লাইনগুলো ভয়ঙ্কর আঘাত পুরুষ চরিত্রের। তাই না?” ভদ্রলোক নির্মিশেষে তাকিয়ে থাকলেন।
আমি, ” তাই আপনি ভাবতে শিখেননি, যে সম্পর্ক তৈরী হয় দুজন মানুষের মধ্যে। একজন মানুষ যদি তার সর্বস্ব দিয়ে দেন, তারপরও তিনি সম্পর্কে মাত্র ৫০ শতাংশ অবদান রাখবেন। সম্পর্কে পরিবর্তন আনতে হলে দু’জনকেই দায়িত্ব নিতে হবে। দু’জনকেই বদলাতে হবে। আমি খুব কম বুঝি ইদানিং মনে হয়। শুধু একটা জিনিস স্পষ্ট করে খেয়াল করা দরকার। আমি কি নিজের চোখে নিজের আয়নাটা ধরতে পারি? এই সম্পর্কের অবনতিতে আমার ভূমিকা কোথায়? আমি কি আত্মকেন্দ্রিকভাবে শুধু প্রত্যাশা করব জীবনসঙ্গী বদলাবেন আর আমি বদলাবো না? আত্মকেন্দ্রিকতা কি আমার অবচেতন মনের প্রতিচ্ছবি? শুধু চাইলেই হবে না। এই সম্পর্ককে আমি কি দিচ্ছি সেটাও বুঝতে হবে। আর যদি সম্পর্ক টক্সিক হয় তাহলে পরস্পরের দিকে কাঁদা ছোড়াছুড়ি না করে পারস্পারিক মর্যাদা অক্ষুন্ন রেখে সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসাটাই সবার জন্য মঙ্গল। পরস্পরকে অশ্রদ্ধা করে সম্পর্ক টেকানোর আদৌ কি দরকার আছে? সিদ্ধান্ত একান্তই আপনার।”
( কথোপকথনের অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা মানুষটির অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি বজায় রেখে প্রকাশ করা হলো!
পুনশ্চ: এখানে ভদ্রলোক কি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা মুখ্য নয়। আমি নিজের চোখে নিজের চেহারা নিরপেক্ষ ভাবে দেখতে কতটুকু আয়না ধরতে পারি সেটাই মূখ্য!) অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া, চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।