#কাউন্সিলিং টেবিলের গল্প
” আমাকে কেউই পছন্দ করেনা, কিছু বলতে গেলে এখন ভয় লাগে।” ভদ্রমহিলা বললেন।
ভদ্রমহিলা একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। পোস্ট ডক্টরেট, আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং নারীবাদী খেতাব সবই তার ঝুলিতে আছে। তীব্র কট্টর ভাষী, ডাকসাইটে সুন্দরী এবং পুরুষ বিদ্বেষী বলে তিনি নিজ পরিমণ্ডলে স্বমহিমায় খ্যাত।
যে মানুষটি অঙ্গুলি হেলনে আন্তর্জাতিক কর্মযজ্ঞ চালিয়ে অভ্যস্ত, এহেন কথন আসলেই তার মুখে বিস্ময়কর। ব্যক্তিজীবনে ও তার প্রচন্ড দূরত্ব তৈরি হয়েছে জীবনসঙ্গী এবং সন্তানের সাথে।
তিনি বললেন, “সানজিদা আমার জীবনে নাম, যশ, অর্থ, খ্যাতি সবই আছে কিন্তু হারিয়ে গেছে বেঁচে থাকার আনন্দ; আমি নিজেকে কোথাও ফিট করতে পারিনা, এমনকি রক্তের সম্পর্কের মানুষগুলোর কাছেও আমার গ্রহণযোগ্যতা নেই। আর কত? এখন এই মধ্য পঞ্চাশে আর নিতে পারিনা।”
প্রচন্ড সফল একজন মানুষ যখন তার ঈর্ষণীয় সাফল্যকে অগ্রাহ্য করে নিজের এই কষ্টের কথা তুলে ধরেন, তখন এটা বলাই বাহুল্য তিনি কতটুকু নিরুপায় বোধ করেন।
এরপর সেই কাউন্সেলিং টেবিলের গল্প।
ভদ্রমহিলা ছোটবেলা থেকেই যুদ্ধ করে আসছেন নিজের অবস্থান ঠিক করতে। কারণ তিনি ছিলেন মেজো। ফলে তাকে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়তে হয়েছিল। কারণ বড় বোনের প্রথম সন্তান হিসেবে একটা অবস্থান ছিল। এরপর ছোট ভাইয়ের পরিবারের একমাত্র ছেলে হিসেবে একটা স্ট্যাটাস ছিল। আশৈশব ভদ্রমহিলার অবস্থান ছিল ফ্লোটিং। বাবা-মা তাকে কম দেন নাই, কিন্তু তিনি সেটা সেভাবে ফিল করতে পারেননি। বাবা-মা বুঝতেও পারেননি তাদের ছোট্ট মেয়েটি কতটা কষ্ট পেয়েছে সবকিছু দেওয়ার পরেও।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ…. গোলাপকে বললাম সুন্দর, সুন্দর হলো সে।” অর্থাৎ আমি যে ভাবে বুঝবো, আমার পৃথিবীটা সেরকমই হবে। আমি যদি মনে করি গোলাপ সুন্দর ফুল, তাহলে গোলাপ সুন্দর। আমি যদি মনে করি বেলি সুন্দর, গোলাপের সৌন্দর্য বেলির কাছে বিমর্ষ হয়ে যাবে। কাউন্সেলিং এর ভাষায় এটাকেই আমরা বলি, “There is nothing call right and wrong. Life is a matter of choice either you choose to suffer or choose to enjoy.” সেই ছোট্ট মেয়েটির এখানে উপলব্ধি ছিল ” choose to suffer.”
ভদ্রমহিলা শৈশবে উপলব্ধি করেছিলেন সবকিছু হয় তাকে বড় বোনের থেকে কেড়ে অথবা ছোট ভাই এর কাছ থেকে থেকে ঝগড়া করে নিতে হবে। অধিকার আদায়ে ঝগড়া ছাড়া, সেই ছোট্ট বাচ্চাটির মনোজগতে অন্য কোন অপশন জানা ছিল না।
সবাইকে রাগ দেখানোর পেছনে ভেতরে ভেতরে তিনি আসলে চাচ্ছিলেন যে তাকে গ্রহন করা হোক তিনি যেমন আছেন ঠিক সেভাবেই। মা বাবা কখনোই বুঝেননি যে সিবলিং রাইভালের ভয়ংকর বিষবাষ্পে মেজ মেয়েটার নিঃশ্বাস নেওয়াও কষ্টকর হয়ে গিয়েছিল।
আমাদের সমাজের একটা প্রচলিত ধারণা যে কারো বাচ্চা হলে শুধু সেই বাচ্চাটাকে গিফট দেয়া। অথচ তার বড় ভাই বোনগুলো আছে। ওরাও তো ছোট মানুষ, ওরা গিফট আশা করতেই পারে এটা আমরা ভুলে যাই। কারণ আমরা প্রত্যেকটা মানুষ চাই অন্যের কাছে এক্সেপ্টেড হতে।
এই ভদ্রমহিলার ছোট ভাই হওয়ার পর সবাই যেভাবে ভাইকে গিফট দিয়েছিল সেটা ভদ্রমহিলা সেই শৈশবে কিছুতেই মানতে পারতেন না। সেখান থেকেই শুরু। পরবর্তীতে সম্পত্তি বন্টনে পুত্র সন্তানের অগ্রাধিকার বোঝাই যায় ভদ্রমহিলাকে কতটুকু প্রভাবিত করেছে। তিনি নারী-পুরুষের বৈষম্য নিয়ে কথা বলেছেন।
একদম শৈশবে তার মনে হয়েছিল নিশ্চয়ই আমি খারাপ তাই আমাকে মা ভালোবাসে না। তাই ভাই কে বেশি যত্ন নিচ্ছে। তারপর থেকে সে চেষ্টা করত ভাল মেয়ে হতে। তখন মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় তার লাইফ পজিশন ছিল ‘I am not ok, you are ok.’ এক পর্যায়ে বড় হতে হতে ছোট্ট মেয়েটি এই not ok’ness এর কষ্টটা আর অনুভব করতে চাইল না। তখন সে নতুন ভাবে নিজের মনস্তত্ত্বকে অভিযোজিত করল অবচেতনভাবে। এবং তার এই পরিবর্তিত অভিযোজিত life position হল ‘I am ok, you are not ok’. এরপর থেকে অবচেতনভাবে কোনো বিতর্কে ভদ্রমহিলা হেরে যান নাই। মানুষের একটা কথা মাটিতে পড়তে দেন না। যেকোনো তর্কেই তাকে জিততে হয়। মেধা, বুদ্ধিমত্তা এবং সৌন্দর্য থাকায় যত দিন যেতে লাগল তিনি নিজেকে যেকোনো আসরের মধ্যমনি হিসেবে আবিষ্কার করতে লাগলেন। যেখানেই এর ব্যত্যয় হলো সেখানেই তীব্রভাবে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়লেন নিজের পরিবর্তিত লাইফ পজিশন রিকনফার্ম করতে। কাজেই ঝগড়া তো লাগতোই। সেটা পারিবারিক হোক, অফিশিয়াল ব্যাপার হোক, অথবা ফেসবুকে। এই ঝগড়াগুলোকে আসলে তিনি অবচেতনভাবে দেখতেন তার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম হিসেবে। অজান্তেই উল্টাদিকের মানুষটিকে আঘাত করতেন। কারণ তার সেই, ‘I am not ok’, চিন্তার কষ্টগুলো তিনি আর কিছুতেই নিজেকে দেবেন না অবচেতনভাবে এই সিদ্ধান্ত নেন নতুন অভিযোজিত লাইফ পজিশনে।
এখানে ক্রমাগত দূরত্ব তৈরি হয়, পারিবারিক, পেশাগত জীবনে। ফলে সামাজিকভাবে তিনি যতই ঝগড়াটে হিসেবে নাম কিনেন না কেন, বাইরে তার রাগী ও জেদি চেহারাটাই যতই প্রতীয়মান হোক না কেন, তার ভেতরের রিয়েল ফিলিং ছিল, দুঃখ। এক্সেপ্টেড হওয়ার তীব্র বাসনায় কাতর সেই ছোট্ট মেয়েটি, যে নিজেকে শেকড় উপড়ানো উদ্বাস্তু ভাবছে বাবা-মা আর দুই ভাই-বোনের ভিড়ে।
ভদ্রমহিলা সারাজীবন এক্সেপ্টেড হওয়ার এই স্বীকৃতি খুঁজেছেন অন্যের কাছ থেকে। এবং যখনই এটা পাননি, তখনই তার নতুন করে অ্যাডাপ্ট করা life position, I am ok, you are not ok reinforced হয়েছে।
যেকোনো সম্পর্কের হেলদি লাইফ পজিশন হলো, I am ok, you are ok। অন্যের সাথে মতামত এর পার্থক্য থাকবে এটা জেনেও নিজের স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে তাকে অসম্মান না করা ক্ষেত্রবিশেষে নিজের মতামত কার উপর চাপিয়ে না দেওয়াটাই I am ok you are ok.
এখানে একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যদি আমার নিজের মধ্যে হিংসা থাকে অন্যের প্রতি, তবে একটু খেয়াল করে দেখতে হবে, আমি I am ok you’re ok থেকে কতটুকু দূরে?
যারা নিজের স্বকীয়তা রক্ষা করেন এবং অন্যের বৈপরীত্যকে সম্মান করেন তাদের জন্য সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া চিকিৎসক,
কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্রাকটিশনার।