#ইশরাত_জাহান_জেরিন
#পর্ব_৪
‘আমি তো শাড়ি পরতে জানি না। কী করে শাড়িটা পরব? মানে, একটু-আধটু জানি,তবে নিজে পরলে ৯৯% খুলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।’ চিত্রা বিনা দ্বিধায় বলল।
‘তুমি কি আশা করছো, আমি সিনেমার নায়কদের মতো তোমাকে শাড়ি পরিয়ে দেব? সিরিয়াসলি বউ?’ফারাজ ওয়াশরুমের দিকে গোসলের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েও থমকে যায়।পেছন ঘুরে পাথরের মতো থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা চিত্রাকে চোখ মেরে বলে,
‘চলো একসঙ্গে গোসলটা আদায় করে আসি বউ।’ফারাজ থামল।জিহ্বায় মৃদু কামড় দিয়ে বলল,
‘ওমা! ভুলেই গিয়েছিলাম।আমি তো এখনও শুদ্ধতম, পবিত্র পুরুষ। তবে তুমি চাইলে… এখনই এই পবিত্রতা বিসর্জন দিতে পারি। কী বলো?দেবো নাকি?’
চিত্রা ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো,
‘আমার নামাজে হয়তো কোনো ঘাটতি ছিল তা না হলে কি আপনার মতো অসভ্য পুরুষ জুটত?’
‘ধ্যাত আমার মুডের একেবারে আম্মা আব্বা করে দিয়েছো।এখন কিছু বললাম না।তবে পরে শুধু বলবোই না বরং অনেক কিছু দেখবো, দেখাবো আর…
ফারাজ থেমে বাঁকা হাসলো।তারপর গুনগুন করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেলো।চিত্রা নির্বাক চোখে চেয়ে রইলো তার যাওয়ার পথে।লোকটাকে বোঝা চিত্রার জন্য দায়।তবে দায় তো হবেই।এতগুলো বছরে সে আজও নিজেকেই ঠিক করে চিনতে পারলো না,বুঝতে পারলো না।সেখানে হুট করে জীবনে ঝামেলার মতো চলে আসা পুরুষটাকে কি করে বুঝবে সে?
ফারাজ তৈরি হয়ে নেয়।নীল রঙা শার্টে লোকটাকে আকাশের মতোই অন্তহীন সুন্দর দেখাচ্ছে।চোখ মুখে আভিজাত্যের জৌলুস।লোকটাকে কোনোদিক থেকে বাঙালি খুব একটা লাগে না।বিদেশী কালচারটা তার র*ক্তে একেবারে খাপ খাইয়ে গেছে নিদারুণ ভাবে।চিত্রার গায়েও নীল রঙের একটা জামদানী শাড়ি।সকালে যেই মেয়েটাকে চিত্রা দেখেছিল সেই পড়িয়ে দিয়ে গেছে।চিত্রার ঘোমটা মাথায় দেওয়া।ভেজা চুলগুলো খোঁপা করা।গোসল করেছে সে।ঠান্ডা পানি মাথায় ঢালার পর শরীরটা হালকা লাগছে।তবে হৃদয়ে শোক,দুঃখ হালকা হয় নি।আচ্ছা ডাক্তাররা এতসব ঔষধ আবিষ্কার করেছে তবে মনের দুঃখ নিরাময়ের ঔষধটা তারা কেন আবিষ্কার করলো না?টাকার বিনিময়ে মানুষ দুঃখ নিবারণের ঔষধ কিনতো। বিষয়টাতো মন্দ হতো না।ফারাজের সঙ্গে সিঁড়ি দিয়ে নামার জন্য পা বাড়ায় চিত্রা।ফারাজ থমকে একবার চিত্রাকে উপর নীচ ভালো করে পরখ করে বলল,
‘ভেজা চুল খোঁপা করেছো?বুঝাও তো যাচ্ছে না তুমি যে গোসল করেছো।মানুষ তো পড়ে আমার পুরুষত্ব নিয়ে গালমন্দ করবে।যদিও আসল কাজটা এখনো করা বাকি।তবুও ভাব তো আর ছাড়া যাবে না।অলওয়েজ ভাব নিয়ে থাকতে হবে।তা না হলে নিজেকে ছোটলোক মনে হয়।’
চিত্রার চোখমুখে রাগের ঝলক স্পষ্ট। এমন ঠোঁটকাটা পুরুষ সে বাপের জন্মেও দেখে নি।এ তো ভাঙা রেডিওর মতো যেখানে সেখানে শুরু হয়ে যায়।ফারাজ হুট করে চিত্রার হাতে হাত রেখে বলল,
‘এই যে, হাতে হাত রাখলাম। মনে রেখো, মৃ*ত্যুর আগ অব্দি এই হাত ছাড়ছি না। তবে আমার নয়,তোমার মৃ*ত্যুর কথা বলছি।’ফারাজ হেসে চিত্রার হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল। সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামার জন্য পা বাড়ালো।চিত্রার চোখে মুখে অস্পষ্ট একটা ভয়।তবে সে প্রকাশ করতে পারছে না কিংবা প্রকাশ করার মতো সাহস হচ্ছে না তা খোদা ভালো জানেন।
বাহিরে থেকে বাড়িটিকে পুরোনো ধাচের লাগলেও ভেতরটা একেবারে অন্যরকম।আধুনিক আসবাবপত্রে সাজানো।পুরোনো জমিদারি ভোজনকক্ষে আধুনিকতায় মুড়িয়ে নাম দেওয়া হয়েছে ডাইনিং হল।তবে খারাপ লাগছে না।চারদিকে ভালো করে লক্ষ করলে এখনো পুরোনো আভিজাত্যের অসংখ্য প্রমান পাওয়া যায়।চিত্রাকে দেখা মাত্রই একটা মেয়ে দৌড়ে এসে বলল,
‘তার মানে তুমিই আমার মিষ্টি ভাবী?দেখি দেখি একটু তাকাও।ভা….’ আরো কিছু বলতে গিয়েও মেয়েটি থামলো।থামার যদিও একটা কারন আছে।আর সেই কারনটা ফারাজের শীতল চাউনি।কি এমন ছিল ওই কোমল চাউনিতে যে মেয়েটা এমন থমকে গেলো?চেহারায় ভয় ফুটে উঠল? ফারিয়া মুখটা ছোট করে একটু দূরে সরে দাঁড়ালো।ফারাজের ছোট বোন ফারিয়া।স্বামী নিয়ে এইবাড়িতেই থাকে।বয়স যদিও খুব একটা না।
ফারাজ বাড়ির সদস্যের সঙ্গে চিত্রার পরিচয় করিয়ে দেয়।এই বাড়ির আসল কর্তা সুলেমান এলাহী।ফারাজের পিতা তিনি।এখানকার চেয়ারম্যানও।মানুষ তাকে মান্য করে চলে।নেহাত লোকটি ভালো মানুষ। ফারাজের বড় ভাইয়েরা আপাতত বাড়িতে নেই।মাছের আড়তে গিয়েছে। এলাহী পরিবারের মাছের ব্যবসা।তবে ছোটখাটো নয় অনেক বড়।দেশে বিদেশে তাদের মাছের কারবার চলে।ফারাজের বড় ভাই রাজন এলাহী এবং মেজো ভাই রোশান এলাহী রাতেই কাজে বাহিরে গিয়েছিল তবে এখনো ফিরে নি।ফারাজের মা রুমানা এলাহীর সঙ্গে চিত্রার প্রথম সাক্ষাৎ বেশ ভালো হয়।রুমানা চিত্রার মতো বউই ছেলের জন্য চেয়েছিলেন।তবে ফারাজের চাচাতো বোন নিরুপমা কে কেমন যেন গায়েপড়া লেগেছে।খানিকটা আবার অভিমানীও।খাবার টেবিলে নিরু ফারাজের গা ঘেঁষেই দাঁড়িয়ে ছিল।তবে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলে নি।এমনকি চিত্রার সঙ্গেও নয়।তাতে আবার চিত্রার কিছু যায় আসে না।তবুও চিত্রা সকলের মাঝে প্রথম সাক্ষাৎ এ খুব একটা অস্বস্তি বোধ করে নি।এ বাড়ির মানুষগুলো আসলেই বেশ মিশুক। কথায় কথায় তারা চিত্রাকে এমন ভাবে আপন করে নিয়েছে যেন তাদের সম্পর্ক বেশ পুরোনো।একেবারে সবাই ফারাজ এলাহীর বিপরীত।
বাড়ির পুরুষেরা খাবার টেবিলে বসেছে।পুরুষ বলতে আপাতত সুলেমান এলাহী আর ফারাজই এখানে উপস্থিত।খাবার টেবিল খাবারে ভরপুর। গরম গরম ঘিয়ে ভাজা পরোটা করা হয়েছে। ফারাজের খুব পছন্দ।চিত্রা কাচুমাচু হয়ে ফারাজের পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সে কাজ করতে চেয়েছিল তবে সবার এক কথা নতুন বউ যেনো কাজ না করে।বাড়িতে কাজের মানুষের অভাব আছে নাকি?
‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন?বসো।তোমার স্বামীর পাশে বসেই খাবে তুমি।’ফারাজ চিত্রাকে তার পাশে বসতে ইশারা করল।বাড়ির সবাই তাতে একটু চোখমুখ কেমন করে তাকালো।পরক্ষণে সবাই স্বাভাবিক হয়ে যার যার কাজে মন দিলো।চিত্রা অস্বস্তিতে পড়ে যায়।বাড়িতে এত গুলো মহিলা মানুষ আছে তাদেরকে রেখে সে কি করে বেহায়ার মতো খাবার খেতে বসে পড়বে?তাছাড়া রাজনের স্ত্রী নদী এইতো কিছুক্ষণ আগেই চিত্রাকে বলেছিল এই বাড়িতে পুরুষেরা খাওয়ার পরই নারীরা খাবার খায়।
‘ বসো।’গলা ভারী করে ফারাজ বলল।এ যেন শান্ত ভাবে হুমকি দেওয়া।
‘আরে আম্মাজান বসো বসো।ফারাজের পাশেই বসো।এই কে কই আছোত?আমার বউমারে খাবার দে।ঘরের লক্ষী যেন অসন্তুষ্ট না হয়।’ সুলেমান এলাহীর বিনয়ী কন্ঠে চিত্রার বুকে ফাটল ধরল।তাকে কেউ এভাবে আম্মাজান বলে কখনো ডাকেনি।বাবারা বুঝি মেয়ের এতটাই আপন হয়?এভাবেই তারা আদরের রাজকন্যার সঙ্গে বুঝি কথা বলে?
চিত্রা ফারাজের পাশে বসল।নদী ফারাজকে পরোটা দিতে গেলে ফারাজ নিষেধ করল।
‘ভাত দেন ভাবী।ভাতের ক্ষুধা পেয়েছে।ঘিয়ে ভাজা পরোটাটি মিসেস ফারাজ এলাহীকে দেন।’
নদী অবাক হলো।
‘বাপরে দেবর আমার পুরোই বদলে গেছে।’
ফারাজ জবাব দেয় না।তার সামনে ভাত তরকারি সাজানো।ফারাজ খাবারের প্রতিটি পদকে একবার দেখল।বলল,
‘কলিজা ভুনা কই ভাবী?সকালে যেই কলিজাটা এনেছিলাম ওইটা ভুনা করতে বলেছিলাম না?করেন নি?’
নদী কিছু বলার আগেই মোহনা কলিজাভুনার বাটিটা টেবিলের ওপর রাখল।বড় এক চামচ করে ভুনা তুলে দিলো ফারাজের পাতে।
‘আজকে আমি রান্না করেছি।খেয়ে মতামত কিন্তু অবশ্যই জানাবে।’
ফারাজ মোহনার দিকে তাকায়।স্লিভলেস একটা ব্লাউজ দিয়ে ফিনফিনে পাতলা একটা শাড়ি পড়া।কোমড় অব্দি ছেড়ে রাখা কোঁকড়া চুলগুলো বেয়ে টুপটুপ করে জল পড়ছে। ডাগর আঁখির নিচটা কালো কাজলে রাঙানো। ঠোঁটে রোজকার মতো মেরুন রংঙের লিপস্টিক।কপালে টিপ।ফারাজ মুহুর্তেই চোখ নামিয়ে ভাত মাখতে শুরু করল।অনুভূতিহীন চেহারা তার।সে নিঃশব্দে বড় বড় লোকমা মুখে দিয়ে গিলেছে।দেখে মনে হচ্ছিলো বিশাল কোনো কাজ করে এসে সে ক্ষুধার্ত কিংবা বহুদিন ধরে খাওয়া হয়নি।চিত্রা নিজের খাওয়া রেখে ফারাজের দিকে তাকিয়ে থাকে।হাতের ব্যান্ডেজটা গোসলে যাওয়ার আগেই খুলেছিল।ক্ষত বেশ গভীর।সেই ক্ষত নিয়েই অনায়াসে ভাত খাচ্ছে।মোটেও যন্ত্রণা হচ্ছে না তার।মনে হচ্ছে এসবে সে অভস্ত্য।চিত্রা খাবার গিলতে গিয়ে আঁড়চোখে আরো একবার মোহনাকে দেখার চেষ্টা করলো।অপরুপ সুন্দরী মহিলা। চোখধাঁধানো রুপ।এনিই তাহলে রোশান এলাহীর স্ত্রী?
–
পুরোটা ভাত শেষ করতে পারল না ফারাজ।ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ভাতে পানি দিয়ে চলে গেলো।তবে যাওয়ার আগে রুম থেকে একটা ঔষধ এনে চিত্রার হাতে দিয়ে কড়া করে বলল,
‘ব্যাথার ঔষধ এটা।বলেছিলাম না আসার সময় এটা নিয়ে আসবো।তোমার শরীরে ক্ষতচিহ্নর অভাব নেই।যন্ত্রণা হয় তাই না?এটা খেয়ে নিও।ব্যাথা সেরে যাবে।’
চিত্রা আরো একবার অবাক হলো।মানুষটার মধ্যে কি এমন আছে?তাকে নিয়ে এত কৌতুহল কেনো জাগছে?এই মনে হয় লোকটার লজ্জা সরম নেই, আবার এই মনে হয় লোকটা একটা নরপিশাচ, তবে এখন মনে হচ্ছে লোকটার ভেতরে কিছু তো একটা আছেই।
চিত্রা বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সেই পুকুরের কালো জলের দিকে তাকিয়ে আছে।চোখে তার জল টলমল করছে।যে করেই হোক তাকে একবার হলেও বাজিতপুর যেতে হবে।সোহাগের মুখোমুখি হতে হবে।কেনো সোহাগ সেদিন তাকে বাঁচাতে আসলো না জবাব চাই চিত্রার।
‘কার কথা ভাবছো?’
চিত্রা ঘাবড়ে যায়। ঘাড় ফিরিয়ে মোহনাকে দেখতে পায়।
‘ভাবী আপনি?’
‘তোমার স্বামীর ঘর… না মানে তোমার ঘরে আসা মানা বুঝি?’
‘ছি ছি কি বলছেন ভাবী এসব?’
মোহনা কালো জলের দিকে তাকিয়ে নিশ্বাস নিংড়ে দিয়ে বলে,
‘এই বাড়িতে বিড়ালের অভাব নেই। মাছ দেখলেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওসব বিড়াল থেকে তুমিও সাবধানে থাকবে। বুঝোই তো বুনো বিড়াল,কখন আবার মাছ ভেবে তোমার ওপর আক্রমণ করে বসে। তখন বাঁচা মুশকিল হয়ে যাবে।’
চলবে?
(পড়া শেষ করে লিখতে বসেছিলাম।আরো অনেকটা লিখতে চেয়েছিলাম তবে লিখিনি।আপনাদের আজকে এমনিতেই অনেক অপেক্ষা করিয়ে ফেলেছি।বানান ভুল থাকতে পারে।ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ।)