১.দাম্পত্য জীবন নিয়ে স্ট্যাটাস
আমি কখনো আমার বাবা ভাই কে ছেঁড়া লুঙ্গি পড়তে দেখিনি।
কিন্তু আমার স্বামীকে দেখেছি ছেঁড়া লুঙ্গি কিভাবে পেঁচিয়ে আড়াল করে পড়তে হয়।
সেইদিন গুলোতে আত্মীয়রা সবাই হারিয়ে গিয়েছিলো। চিরচেনা মুখগুলো ঝাপসা হয়েছিলো।
যেদিন ঘরে রান্না করার মতো কিছু থাকতো না, সেদিন কাঁচা মরিচ আর পেয়াজ ভেজে ভর্তা করে গরম ভাত মাখিয়ে খেতাম।
আমার ভাইয়েরা তখন খোঁজ নিতে ভয় পেতো।
মাস্টার্স শেষ করা ছেলেটা যখন চাকরি না পেয়ে গার্মেন্টসে অল্প বেতনের চাকরিতে ঝুঁকেছিলো, আমার বাবার বাড়ির আত্মীয়রা তার জন্য লজ্জায় কুঁকড়ে যেতো।
সেবার ঈদের পরদিন বাবার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমার স্বামীর অবহেলা পরিমাণে এতটায় বেশি ছিলো যে সে বাড়িতে এক বছরের মতো আর পা রাখিনি।
আমার তিন বছরের ছেলেটা ভাসুরের ছেলের সাথে খেলতে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে বাম পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছিলো। আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ডাক্তার, ঔষুধ ভালো চিকিৎসা করার মতো সামর্থ্য ছিলো না। বাধ্য হয়ে আমার স্বামী ভাসুরের কাছে হাত পেতেছিলো। কিন্তু কিঞ্চিৎ সাহায্যও কেউ করেনি। নিরুপায় হয়ে অবশিষ্ট কানের দুল জোড়া বিক্রি করেছিলাম।
.
আলহামদুলিল্লাহ আজ আমাদের সব আছে। দূর্দিন কাটিয়ে উঠেছি। প্রিয় থেকে প্রিয় মানুষগুলোর মুখ চিনে রেখেছি।
গত সপ্তাহে আমার ভাই এক জোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে বাসায় এসেছিলো। ভাইয়ের বউ প্রায়শই কল দিয়ে বলে কবে যাবো বেড়াতে।
ভাসুরের শরীরে নানা ধরনের রোগের উৎপাত। চিকিৎসার জন্য গত মাসেও টাকা পাঠানো হয়েছে।
সৃষ্টিকর্তার রহমতে আমার স্বামীর ব্যবসাটাও বেশ বড়-সড় হয়েছে। সাথে মান-মর্যাদা, প্রতিপত্তির বুঝি কমতি নেই। আত্মীয়রা আমাদের নিয়ে এখনও কানাঘুঁষা করে তবে হয়ত ইতিবাচক কিছু।
আমার স্বামীর সেই ছেঁড়া লুঙ্গিটা আজও আমি আলমারিতে অনেক যত্নে তুলে রেখেছি৷ সেদিনও লুঙ্গিটা দেখলে যতটা কষ্ট হতো আজও ঠিক ততোটাই কষ্ট হয়।
ব্যবধানটা শুধু দুর্দিন আর সুদিনের।
collected
২.দাম্পত্য জীবনে অসুখী
# গল্প – দাম্পত্য
মমর ধারণা, স্বাগত এখন অনেক বেশি বদলে গেছে। স্বামীর এই পরিবর্তন তার পছন্দ না হলেও মেনে নিতে হচ্ছে। বিয়ে হয়ে গেলে কি মানুষ এতটাই বদলে যায়?
ভার্সিটিতে পড়ার সময় স্বাগত মমর একটু হাত ধরার জন্য কী যে ভীষণ আকুতি করতো। রিক্সায় গায়ের সাথে একটু গা ঘেঁষে বসতে পারলে সে ধন্য হয়ে যেত। প্রথমবার যেদিন মমর ঠোঁটে চুমু খেয়েছিল, সেদিন যেন সে এভারেস্ট জয় করে ফেলেছে!
অথচ এখন মমকে ছোঁয়ার সেই আগ্রহ ওর আর নেই। তবে মম কিন্তু বদলায়নি। এখনও আগের মতই স্বাগতকে ওর যখন-তখন জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। গা ঘেঁষে বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোছনা দেখতে ইচ্ছা করে। এখনও বাসে, ট্রেনে বা রিক্সায় কোথাও যাবার সময় ওর ইচ্ছা করে, স্বাগতর হাত ধরে থাকতে। প্রথম প্রথম স্বাগত কিছু বলতো না। কিন্তু এখন ও মমর হাত সরিয়ে দেয়। তাই মমও এখন আর ওর হাত ধরেনা।
– তোমাকে বলেছিলাম আসার সময় টকদই আর পিনাট বাটার আনতে।
– সরি! ভুলে গেছি। কাল আনবো। সত্যি।
– কালও তাই বলেছিলে।
মম রাগ করে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আগে মমর সবকিছু ওর মনে থাকতো। বিয়ের ছয় মাস পরেই ও মমর জন্মদিন ভুলে গেল। কী অদ্ভুত! অথচ আগে সে সেলিব্রেট করার জন্য যেকোন একটা বিশেষ দিনের ছুতা খুঁজতো। কোন বিশেষ দিনেই সে মমকে নিয়ে বেড়ানো মিস করতো না।
– এই শোন, কোথায় যাচ্ছ?
– আমি বাসায় নাই।
– বাসায় তো আছ। আরে শুনে যাও। এই মম।
– না নাই।
আগে স্বাগত প্রতিবার ফোন রাখার আগে “লাভ ইউ সোনা” বলতো। প্রতিবার শেষ মেসেজও হত “লাভ ইউ”। বিয়ের পরেও অল্প কিছুদিন লাভ ইউ, সোনা, বেবি – এগুলো চালু ছিল। এখন স্বাগত আর ওসব বলেনা। এখন সে আর সবার মতই তাকে মম বলে ডাকে।
বিয়ে হয়ে গেলে বৌকে ভালবাসার কথা বলা অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া বৌয়ের সাথে সেক্স তো সে করেই। তাই অযথা লাভ ইউ বলে, জড়িয়ে ধরে বা হাত ধরে অত আদিখ্যেতা দেখানোর কী দরকার? একবার বিয়ে হয়ে গেলে মেয়েরা তো আর স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারেনা। তাই তাকে আর অযথা অত তোয়াজ করবে কেন?
মাঝে মাঝে মম ফোন রাখার আগে লাভ ইউ বলে। শুধুমাত্র এটা দেখার জন্য যে স্বাগতর রিপ্লাই কী হয়। অদ্ভুত কাণ্ড! সে কোন রিপ্লাই না দিয়েই ফোন কেটে দেয়। অথচ আগে কোন কোনদিন মম ইচ্ছে করে যখন লাভ ইউ বলতো না, তখন স্বাগত অপেক্ষা করতো শোনার জন্য। মম লাভ ইউ না বলা পর্যন্ত সে কথা শেষ করতো না।
বিদেশে স্বামী-স্ত্রীরা থুত্থুড়ে বুড়োবুড়ি হয়ে গেলেও ওদের লাভ ইউ থামেনা। আর আমাদের স্বামীদের মুখে হাজার কথা ফোটে। কিন্তু লাভ ইউ-এর বেলায় তাদের মুখে কুলুপ এঁটে যায়। প্রেমিকাকে লাভ ইউ বলতে বলতে ছেলেদের মুখে ফেনা উঠে যায়। আর পরকীয়ার প্রেমিকা হলে তো ফেনার সমুদ্র। অথচ বৌকে বলবে না।
– তুমি আমাকে আর আগের মত ভালোবাসোনা কেন?
– আজব কথা বলছ! ভালোবাসবোনা কেন? তোমার এরকম কেন মনে হল?
– কারণ তুমি আমাকে এখন আর মিস করনা। কোন কোনদিন সারাদিনেও তুমি আমাকে একটা ফোন করনা।
বিয়ের পর কিছুদিন স্বাগত মমকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে তারপর অফিসের জন্য বেরিয়ে যেত। আর এখন সকালে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে অমনি সে চলে যায়। আগে অফিস থেকে অনেকবার ফোন করতো। কি করছ? কি খেলে? আর এখন খুব জরুরি দরকার না হলে ফোন করেনা। মম ফোন করলেও বিরক্ত হয়। দায়সারাভাবে কথা বলে।
আগে যখন তখন স্বাগতর মেসেজ আসতো- মিস ইউ। দু’ঘন্টা কথা বলে হলে ফিরে গিয়ে আবার ফোন করতো, তোমার গলা শুনতে খুব ইচ্ছা করতেছিল। তাই ফোন করলাম। প্রেমিকারা বৌ হয়ে গেলে কি লোকে আর তাকে মিস করেনা?
– আমি তোমার মত বাড়িতে বসে বসে টিভি দেখে সময় কাটাই না। আমি অফিসে কাজ করি মম। আমি ব্যস্ত থাকি। তাই সবসময় ফোন করতে পারিনা।
– ও আচ্ছা! আমি সারাদিন টিভি দেখে সময় কাটাই, তাইনা? তোমার অফিসের কাজ কাজ, আর আমার বাড়ির কাজ কাজ না, কেমন? ঘরবাড়ি পরিষ্কার, রান্না, কাচাধোয়া- এগুলো অফিসের কাজের চেয়ে সহজ? তোমাকে একদিন এককেজি ছোটমাছ কুটতে দিলে তুমি বুঝতে, হাউ ধানে হাউ চাল!
– তোমার তো বুয়া আছে। সে তোমাকে হেল্প করে।
– অফিসে তো তোমারও অধীনস্থ লোক আছে। তারা তোমাকে হেল্প করেনা?
– করে। তবে মূল কাজটা আমাকেই করতে হয়।
– আমাকেও।
এখন স্বাগত মমর দিকে আর মুগ্ধ চোখে তাকায় না। আগে মমর সামান্য পরিবর্তনও ওর চোখে পড়তো। রাতে খাওনি নাকি? তোমার মুখটা অমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন? আজকে তুমি চোখের পাপড়িতে মাসকারা দাওনি। আজ তোমার মন খারাপ। তোমার হাসিতে প্রাণ নেই। সেই মানুষটাই এখন আর তার কোন পরিবর্তন টের পায়না। নাকি পাওয়ার চেষ্টা করেনা?
কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা থাকলে স্বাগত আগেই বলে দিত, নীল শাড়ী পরবে। সাথে বড় নীল টিপ। সাজুগুজু করা প্রেমিকাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে ওর তখন গর্ব হতো। আর এখন? পারলে সে মমর চুলটাও না আঁচড়িয়েই ওকে নিয়ে বেরিয়ে চায়।
আগে একটু সন্ধ্যা হলেই স্বাগত তাকে হলের গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিত। আর এখন মম রাতে একা বাজারে গেলেও স্বাগতর কোন ভাবনা হয়না। আগে স্বাগত ওকে প্রায়ই গল্প-কবিতার বই কিনে দিত। গত দেড় বছরে স্বাগত তাকে শাড়ি ছাড়া আর কিছুই কিনে দেয়নি। একটা গোলাপ কিংবা একজোড়া মাটির কানের দুলও না।
মম নিজের মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন টের পায়না। সে আগের মতই স্বাগতর সবকিছু খেয়াল করে। সকালে উঠে মম ওর পছন্দের নাস্তা বানায়। হলে থাকাকালীন মাঝে মাঝেই মম গরুর মাংস ভুনা আর খিচুড়ি রান্না করে বক্সে ভরে নিয়ে যেত। কোন একটা নিরিবিলি জায়গায় বসে যত্ন করে স্বাগতকে খাওয়াতো। এখনও প্রতিবার রান্নার আগে মম ওর পছন্দের খাবারগুলোই রান্না করার কথা ভাবে। বিকেলের নাস্তায় স্বাগত কী খাবে, ছুটির দিনে কী খেতে ওর ভালো লাগবে, মম শুধু তাই ভাবে। তার নিজের পছন্দের কথা তেমন ভাবেইনা। টয়লেট, বিছানা পরিষ্কার আছে কীনা, ওর কাপড় নোংরা হল কীনা, রাতে ওর ভালো ঘুম হল কীনা – সারাক্ষণ শুধু ওর চিন্তা। অফিস থেকে আসার সাথে সাথে ওর কী কী দরকার, কীভাবে ওকে একটু আরাম দেবে, তাই ভেবে মম ওর পিছে পিছে ঘোরে। স্বাগত কী এরকম ভাবে?
আগে স্বাগত ওর রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল। আর এখন সে তার রান্নার খুঁত ধরে। লবণ কম হয়েছে। ঝাল বেশি দিয়েছ। আমার মায়ের হাতের মাছ রান্না? আহ্, অপূর্ব! তুমি ওরকম পারনা। পারবে কেন? মা আর বৌ তো এক ব্যক্তি নয়। মায়ের বয়স বেশি। রান্নার অভিজ্ঞতাও বেশি। তাছাড়া সারাজীবন যে রান্না আমরা খেয়ে অভ্যস্ত, সেটা তো ভালো লাগবেই।
স্বাগত অবসরে দীর্ঘ সময় ফেসবুক চালায়। অথচ মম চালালে রাগ করে। বিরক্ত হয়। কেন? মেয়ে বলে কি সারাদিন সে শুধু ঘরের কাজ আর স্বামীর সেবা করবে?
মমর মনে হয়, তার মত সবার দাম্পত্যে এভাবেই রোমান্টিকতা ধীরে ধীরে কমে যাবার ফলে এক সময় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক একঘেঁয়ে হয়ে যায়। তখন দাম্পত্যে ভালবাসার পরিবর্তে স্বার্থ, দায়িত্ব, প্রয়োজন, যোগ্যতা – এই বিষয়গুলো বড় হয়ে সামনে আসে। ফলে খুব সহজে দু’জনার মধ্যে ঝগড়া, মনোমালিন্য হতে থাকে। পানসে দাম্পত্যে একটু বাড়তি স্বাদ আনার জন্য তখন বাচ্চার দরকার পড়ে।
সকালে স্বাগত অফিসে বেরিয়ে যাবার পর মম একটু ফ্রি থাকে। সে সময়ে সে আরাম করে বড় মগে এক মগ কফি বানিয়ে খায়। আজও সে কফির মগ হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আবোলতাবোল ভাবছে।
স্বাগত যদি অন্য কোন মেয়ের প্রেমে পড়ে, তাহলে কি সে তাকে আবার লাভ ইউ বলবে? আবার কথা শেষ করার আগে লাভ ইউ শোনার জন্য অপেক্ষা করবে? একঘণ্টা পর পর ‘মিস ইউ’ মেসেজ দিবে? দিনে অনেক বার ফোন করবে? যখন তখন তার হাত ধরতে বা তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে চাইবে? মম ঠিক করলো, সে বিষয়টা পরীক্ষা করে দেখবে।
সে একটা ফেক আইডি খুললো। নাম দিল শারমিনা সামস। তাতে মমর এক বান্ধবীর সুন্দরী ছোটবোনের কিছু ছবি পোস্ট করলো। পরিচিতিতে লিখল, সে কলেজে পড়ে। যে কলেজটা স্বাগতর অফিসের কাছে। আর রোজ সে রোমান্টিক কবিতা, গান – এগুলো পোস্ট করতে লাগলো। স্বাগত টুকটাক কবিতা লেখে। গান তার খুবই পছন্দ। মাসখানেক পর সে স্বাগতকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠালো। মেসেজ রিকুয়েস্টসহ।
– আপনার লেখার হাত অসাধারণ! এমন সহজ কথায় এত সুন্দর ব্যঞ্জনা আমি সচরাচর দেখিনা। আমাকে আপনার বন্ধু তালিকায় জায়গা দিলে ধন্য হব। না দিলেও সমস্যা নেই। ভালো থাকুন।
স্বাগত রিকুয়েস্ট এক্সেপ্ট করলো। শুরু হলো কথোপকথন। টুকটাক কথা চলতে চলতে ওদের সম্পর্ক অনেক কাছাকাছি চলে এলো। খুব কাছের বন্ধুর মত। শারমিনা থেকে মম স্বাগতর কবিতায় সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে। স্বাগতর ‘বার্ধক্য’ কবিতায় কমেন্ট করলো।
– ছোটবেলায় বাবামা যেভাবে আমাদেরকে দেখাশোনা করেন, সেভাবে বাবামায়ের সেবা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। ছোট বাচ্চাকে একাই নাড়াচাড়া করা যায়। একজন বয়স্ক মা বা বাবাকে তুলতে দুই-তিনজন মানুষ লাগে। তাছাড়া ছোট বাচ্চার কোমল শরীর পরকেও কাছে টানে। বয়স্ক মানুষদের বেলায় সেটা ঘটেনা। তাদের টয়লেট ক্লিন করার কষ্ট আপনজনকেও বিরক্তিতে ফেলে। তবে আমাদের উচিত, কৃতজ্ঞচিত্তে ভালবেসে আমৃত্যু তাদের দেখাশোনা করা। কারণ আমরাও এক সময় বুড়ো হব। কবিতার থিম অনবদ্য। অনেক ধন্যবাদ।
মম খেয়াল করলো, এখন স্বাগতর মুড ভালো থাকে। সে গুনগুন করে গান গায়। মেসেজ পড়ে প্রায়ই একা একা হাসে। দ্রুত রিপ্লাই দেয়। তবে মমর প্রতি তার আচরণ আগের মতই শীতল।
– পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক হলো বন্ধুত্বের। কারণ এই একটিমাত্র সম্পর্কে কোন স্বার্থ কাজ করেনা। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে কিছু ভালো বন্ধু থাকা দরকার, যার সাথে সে সবকিছু শেয়ার করতে পারে। আমাদের দূর্ভাগ্য যে একটা সময় পর আমরা নারী-পুরুষ বৈষম্য করে বন্ধুত্বের মধ্যে সীমারেখা টানি। এ কারণে আমরা আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কিছু সম্পর্ককে হেলায় হারাই।
তার ‘বন্ধু’ কবিতায় শারমিনার কমেন্ট পড়ে স্বাগত অবাক হয়ে গেল। এত কম বয়সী একটা মেয়ে কত গভীরভাবে ভাবে কী করে?
কিছুদিন পর স্বাগত শারমিনার সাথে মেসেঞ্জারে ভিডিও কলে কথা বলতে চাইলো। শারমিনা রাজী না হওয়ায় ওর ফোন নাম্বার চাইলো। ওর সাথে দেখা করতে চাইলো। এর কিছুদিন পর মম ইচ্ছে করে স্বাগতকে কিছুই না বলে শারমিনের আইডি ডিএ্যাক্টিভ করে দিল। এটা দেখার জন্য যে স্বাগতর অবস্থা কী হয়।
মম স্বাগতর মধ্যে অস্থিরতা দেখতে পেল। সে বেশ হতাশ। টেনশনে আছে। সে শারমিনাকে মিস করছে। দিন দশেক পর শারমিনাকে অনলাইন দেখতে পেয়ে স্বাগতর মনে স্বস্তি ফিরে এলো।
– গায়ের হয়ে গেছিলে কেন?
– আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাচ্ছি। তুমি ম্যারেড। এটা ঠিক হচ্ছে না। তাই সরে যেতে চাই। সত্যি বলছি, আই লাভ ইউ।
– বলতে অস্বস্তি হচ্ছে। আমার নিজেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। তবে এটাই সত্যি কথা। লাভ ইউ ঠু।
মম মেসেজটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে আছে। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ব্যাপারটা তার কাছে জটিল মনে হচ্ছে।
অনেকক্ষণ শারমিনা অনলাইনে আসেনি। দুপুরের মেসেজের রিপ্লাইও দেয়নি। স্বাগত অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। রাতের রান্না চুলায় বসিয়ে রেখে এসে মম খাটে স্বামীর পাশে বসলো। তার হাতে মোবাইল। মমকে ফেসবুক চালাতে দেখে স্বাগত বিরক্ত হল।
– বললাম না খিদে পেয়েছে? রান্না ফেলে আবার তুমি ফেসবুক নিয়ে বসলে?
– সে কি! আমি ফেসবুক নিয়ে না বসলে তুমি তোমার শারমিনা সামসের সাথে চ্যাট করবে কীভাবে?
স্বাগত হা করে বৌয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মম তার এই হতভম্ব চেহারা দেখে ভীষণ আনন্দ পাচ্ছে।
সমাপ্ত
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
৩.দাম্পত্য জীবনের সমস্যা
ভালো স্বামী
বর্নকে আমার আর ভালো লাগে না। আমাদের সম্পর্ক কিছুটা নির্লিপ্ত ধরনের। ব্যপারটা আমার শ্বশুরবাড়ির সবার চোখে পড়ে। আমার শ্বাশুড়ি সব সময়ই কোনো না ছুতায় আমার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করে পুরুষ মানুষকে সংসারী করায় স্ত্রীর ভুমিকার মহাকাব্য শোনায়। মাঝে মাঝে আমি ভাবি আমি চিতকার করে বলি সবাইকে আমার এভাবে থাকতে ভালো লাগছে না, বর্নকে আমার আর ভালো লাগছেনা।
একবার আমার মাকে বলেছিলাম। মা চোখ পাকিয়ে বলেছিলেন, এমন ভালো স্বামী লাখে মেলেনা। আর যেনো কখনো এমন অনাসৃষ্টি কথা না শুনি। মা’র কথা শুনে ভাবিও বলেছিলো এসব আদিখ্যেতা মার্কা চিন্তা ভাবনায় আগুন দিয়ে সংসারে মনোযোগী হতে।
চার বছরের বিবাহিত স্বামীকে ভালো না লাগাটা একটা সমস্যা বটে। আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটে জটিল এবং নোংরা ধরনের সমস্যা; বিশেষত স্বামীর যদি চরিত্রহীনতা, বৌ পেটানো, বা মদ গাজা খাওয়া স্বভাব না থাকে। না, বর্নের কোনো দোষ নেই তেমন। সে দেখতে গড়পড়তা বাংগালী পুরুষদের মতো। লম্বায়ও গড়পড়তা বাংগালী পুরুষদের মতো। স্বভাবও গড়পড়তা বাংগালী পুরুষদের মতো। খুব ভালো না, খারাপও না। ন’টা পাচটা অফিস করে। ফেরার সময় সংসারের টুকিটাকি জিনিস নিয়ে আসে। সেই লিসটে থাকে আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির ওষুধের পাতা, হরলিক্সের বোতল, মৌসুমী ফল, আমার ভাসুর দেবরের বাচ্চাদের জন্য কিটক্যাট বা কিনডার জয়, আবার কখোনো গরম গরম সবার পছন্দের কোনো রেসটুরেনটের খাবার। বাসায় ফিরে শ্বশুরবাড়ির যৌথ পরিবারের সবার সাথে গল্প করে সে। রাতের খাবার একসাথে খায়। আমার সাথে টুকটাক গৃহস্থালি কথাবার্তা বলে ঘুমানোর আগে। এরপর বেশিরভাগ দিন পাশ ফিরে ঘুমায়, কোনো কোনোদিন সে আমাকে কাছে টানে। আমার দাম্পত্যও নির্লিপ্ত ধরনের স্বাভাবিক। যদিও বাচ্চা কেনো হচ্ছেনা এ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে বিস্তর গালমন্দ শুনতে হয়। আমি শুনি, জবাব দেই না। বাচ্চা হচ্ছেনা না, বাচ্চা নিচ্ছিনা। বর্ন নিজেও বাচ্চা নিতে চায় না এখনি। আমার জন্য সেটা শাপে বর, আমিও বর্নর বাচ্চার মা হতে চাই না। লোকটা নিরামিষ ধরনের ভালো মানুষ। তার কোনো দোষ খুজে পাওয়া যায় না মানুষ হিসেবে, কিন্তু স্বামী হিসেবে তাকে পছন্দ করার গুনও খুজে পাই না আমি।
অথচ প্রথম দেখায় বর্নকে কিন্তু আমার ভালোই লেগেছিলো বেশ। কালো ফর্মাল প্যানট আর সাদা শার্ট পরা সাধারন একটা ছেলে, মাথাভর্তি এলোমেলো চুল, চৌকো ধরনের মুখ, চোখে রিমলেস গ্লাস আর বুদ্ধিদীপ্ত একজোড়া চোখ৷ ওর সাথে ওর পুরো পরিবার এসেছিলো আমাকে দেখতে। দুই পরিবারের মধ্যে সব কিছু ঠিক থাকায় আমাদের বিয়েটা খুব তারাতারি হয়ে যায়। বিয়ের আগে একবার কফি শপে দেখা করেছি আমরা মুরব্বিদের কথামতো, বর্ন পারফেক্ট জেনটলম্যানের মতো ঠিক সময়মতো এসে আমাকে নিয়ে গেছে, রেস্টুরেনটে গিয়ে আমার চেয়ার টেনে দিয়েছে, আমার পছন্দ জেনে খাবার অরডার করেছে। এতো দারুন মান্যার্সের একজন মানুষের সাথে আমার জীবন কাটবে ভেবে আমার ভালো লেগেছে। বিয়ের রাতে বর্ন সারারাত গল্প করলো আমার সাথে, খুটিয়ে খুটিয়ে শুনলো আমার স্কুল কলেজ ভার্সিটির গল্প, আমার ক্যারিয়ার প্লান। আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম এমবিএ শেষ করে আমার কর্পোরেট জব করার ইচ্ছের কথা। সে আমার শখের কথা জানতে চাইলো, বললাম আমি ফটোগ্রাফি ভালোবাসি আর নাচ। সে রাতে দুজন গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম। আমি ঘুমাতে ঘুমাতে স্বপ্ন দেখলাম আমরা পাহাড়, সমুদ্রের কোল ঘেষা একটা অজানা দেশে ঘুরতে গিয়েছি। শুরুটা আমাদের কিন্তু ভালোই ছিলো। বিয়ের প্রথম কয়েকদিন ভালোলাগার ঘোরেই কাটলো আমার। কিন্তু ক’দিন যেতেই কোথায় যেন তালকেটে গেলো যখন বর্নর নির্লিপ্ত স্বভাব খেয়াল করলাম আমি। সে হানিমুনে যাবার ছুটি ম্যানেজ করতে পারলো না, তবে খুব আগ্রহের সাথে আমাকে এমবিএ ভর্তি কোচিংএ ভর্তি করে দিলো, ভালো একটা ডানস একাডেমিতে নিয়ে গেলো যেখানে আমি নাচ প্রাকটিস করতে পারবো, আর একটা ফটোগ্রাফি কোর্সেও ভর্তি করে দিলো। বাসররাতে নাকি স্বামীরা স্ত্রীদের উপহার দেয়, বর্ন আমার জন্য স্পেশাল কিছু কেনেনি, রহস্যময় হেসে বলেছিল সেটা আমার পাওনা রইলো। এক বিকেলে আমাকে নিয়ে ক্যামেরার শপে গিয়ে খুব ভালো মানের এক্সপেন্সিভ একটা ক্যামেরা কিনে দিলো ফটোগ্রাফির জন্য, বললো এটা আমার সেই গিফট। আমি আনন্দে আটখানা হয়ে গেলাম এমন কেয়ারিং সাপোর্টিভ স্বামী পেয়ে। কিন্তু বর্নের আমার জন্য কেয়ার এই পর্যন্তই ছিলো। এরপর সে ব্যস্ত হয়ে গেলো, সকালে যায়, রাত বারোটায় ফেরে। কিছু বললেই বলে অফিসে কাজের চাপ। অথচ ওর অফিস ন’টা পাচটা, কোনোভাবেই ফিরতে এগারোটা বারোটা বাজার কথা না। আবার ছুটির দিনেও তার মিটিং থাকে। প্রতি তিনচার মাসে অফিস ট্যুর থাকে সসপ্তাহখানেকের জন। প্রথমে আমার খুব অভিমান হতো, মাঝে মাঝে ঝগড়া করতাম ওর কাছে সময় চেয়ে। কিন্তু বর্ন নির্লিপ্ত স্বরে সেই একই কথা বলতো, অফিসে কাজের চাপ। মাঝে মাঝে বলতো, “তোমার খুব বোর লাগলে কোনো সেলফ ডেভেলপমেন্ট কোর্সে ভর্তি হও, কতোকিছু করার আছে। আমাদের ঘোরাঘুরির সময় তো চলে যাচ্ছেনা। এখন ক্যারিয়ার স্ট্রং করার সময়।” আমি আর কী বলবো, স্বামীর কথামতো কখোনো ডিবেট, কখোনো ইংলিশ, কখোনো আইটির বিভিন্ন কোর্স করতাম। দেখতে দেখতে এমবিএ শেষ হলো। বেশ ভালো বেতনে চাকরি করছি তাও দু’বছর হবে। গাদা গাদা কোর্স করে আমি অফিসে ইফিসিয়েনট আর পপিউলার এমপ্লয়ীদের একজন। ফটোগ্রাফির একটা স্টুডিও আছে, বেশ নাম হয়েছে সেটার। একটা ইউটিউব চ্যানেল আছে আমার, মন খারাপ লাগলে নাচি আমি, সেই ভিডিও আপলোড করি ওটাতে। হু হু করে জনপ্রিয়তা বাড়ছে সেই চ্যানেলের। সবই হচ্ছে, কেবল আমার সংসারটাই ফাঁকি। আগে বর্নের সাথে ঝগড়া করতাম এসব নিয়ে, একদিন হঠাত খেয়াল করলাম আমি নিজেও আর ওর সাথে সময় কাটানোর জন্য এতো উতলা নই। অনেকদিন হলো এগুলো নিয়ে কথা হয় না, আমরা থাকি যে যার মতো। কেমন যেন যন্ত্রের মতো নিয়মে বাধা সংসার। এভাবে একদিন আবিষ্কার করলাম বর্নকে আমার আর ভালোও লাগে না।
এই ভালো না লাগার মধ্যেই মাতাল হাওয়া হয়ে এলো সামির। সামির বর্নের বন্ধু। আমেরিকায় সেটলড হয়েছে কয়েকবছর হয়, নানা ঝামেলায় বিয়েটা হয়ে ওঠেনি। এখন সে দেশে এসেছে বিয়ে করে বৌ নিয়ে যাবার জন্য। পুরুষ হিসেবে সামির অত্যন্ত সুদর্শন, বর্নর চেয়ে ইঞ্চি তিনেক লম্বা, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ, ঝড়ঝড়ে স্বাস্থ্য। ক্লাসিক টল, ডার্ক, হ্যানডসাম। দারুন সেন্স অভ হিউমার। তাছাড়া সাফল্য পুরুষ মানুষকে এক ধরনের আলাদা আআত্মবিশ্বাস দেয় যেটা সামিরের পুরোপুরিই আছে। সামির পেশাগত ভাবে সফল। সামিরের পুরো পরিবারই আমেরিকা প্রবাসী। আর প্রবাসজীবনে সবাই ব্যস্ত। কনে দেখার মত কাজে পুরো পরিবার আসা সম্ভব না, তাই ও একাই এসেছে। বর্নের অনুরোধে পাত্রী দেখাদেখির কাজে আমাকে যেতে হলো সামিরের সাথে। সামিরের একটা গুন হচ্ছে প্রথম দেখাতেই সে যে কোনো মানুষকে একটা কমফোর্ট যোনে নিয়ে যায়, এতটাই যে মানুষটির মনে হবে কতকাল ধরে যেনো তাদের চেনা জানা। তাই সামিরের সাথে পাত্রী দেখতে যেতে আমার খারাপ লাগতোনা একদম। সামিরের অবশ্য কোনো পাত্রীই পছন্দ হলো না। আমাদের রুটিন হয়ে দাড়ালো মেয়ে দেখা পর্ব শেষ করে কোনো কফি শপে ঢুকে পাত্রীর প্রস এনড কন আলোচনা করা। সামির পাত্রীদের খুঁত খুঁজে বের করতো একটা একটা, আর আমি পাত্রীর গুনগান করে ওকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতাম। সত্যি বলতে পাত্রী আমার সবাইকেই ভালো লেগেছে, কিন্তু পাত্র তো আর আমি না। সামিরের কেউকেই মনে ধরে নি। একদিন তাই বিরক্ত হয়ে বলেই বসলাম, আপনার উদ্দেশ্যটা কি? সত্যি বিয়ে করতে চান, না বাড়ির লোকের কথা রাখতেই পাত্রী দেখে বেড়াচ্ছেন?
সামির নিজের চুলে হাত চালাতে চালাতে সিরিয়াস ভংগীতে বললো, বিয়ে করতে চাই তো।
: তো এতো পাত্রীর কেউকে পছন্দ হচ্ছে না?
সামির আমার চোখে চোখ রেখে বললো, আপনাকে পছন্দ হয়েছে, তাই পাত্রী পছন্দ হচ্ছে না।
এবার আমার খাবি খাওয়ার পালা। সত্যি বলতে আমি এভাবে ভাবিনি। যদিও আমার ফিকে জীবনে গতো তিন সপ্তাহ সামিরের সঙ্গ একটা খোলা জানালার মতো, যেমন অনেক দিন পর বদ্ধ কোনো ঘরে ছোট্ট একটা জানালা খুলে দিলে রোদ হাওয়া উকি দেয়, তেমন। এই তিন সপ্তাহ সামির রোজ সকালে সিম্পল কোনো টেক্সট পাঠাতো, আমার ভালো লাগতো। রাতে ঘুমোবার আগে গুড নাইট। সারাদিন টুকটাক টেক্সট চালাচালি চলতো আমাদের, পাত্রী দেখা নিয়ে। এই যে বাইরে এলে আমার পছন্দের কফি বা আইস্ক্রীমের কোন কোন ফ্লেভার আমার পছন্দ সেটা মনে রেখে অরডার করা, বা ফেরার সময় গাড়িতে আমার পছন্দের গান দেয়া এসব আমার ভালো লেগেছে। সামিরের মতো সুূদর্শন, ইন্টারেস্টিং পুরুষের সঙ্গও আমার ভালো লেগেছে। এসব সত্যি। আবার এটাও সত্যি যে আমি এভাবে ভাবিনি।
আমি চুপ করে ছিলাম।
একটু পরে সামির বললো, আপনি জানেন বর্নর একটা গার্লফ্রেনড আছে যার সাথে ও গতো সাত বছর ধরে লিভ ইন করে? আমরা বন্ধুরা কিন্তু সবাই জানি। আই গেস, ওর মা বাবাও জানে।
আমার হয়তো অবাক হওয়া উচিত, দু:খ পাওয়া উচিত। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছিলাম না, কেন যেনো দু:খও হয়নি। ভোতা গলায় বললাম, তো তাকে বিয়ে করলো না কেনো?
: তাপসী বর্নর চেয়ে পাচ বছরের বড়, তাছাড়া হিন্দু। দু’জনের কারো বাসায়ই মেনে নেবে না। বর্নর মা বাবা ভেবেছিলো সুন্দরী বৌ এনে দিলে ছেলের মন ঘুরবে।
আমার মাথা ভার ভার লাগছিলো। আমি বললাম আমি বাসায় যাবো। সামির আমাকে বাসায় পৌছে দিলো। গাড়ি থেকে নামার আগে বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি সিমি। তুমি চাইলে বর্নর সাথে কথা বলবো। আমি সব সামলে নেবো তুমি যদি চাও।
আমি সামিরের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম আমি আসলে কী চাই। কি মনে করে ওকে বলে দিলাম বর্নর সাথে কথা বলতে। সেটা কতটুকু সামিরের প্রতি আকর্ষন থেকে আর কতটুকু আমার ভালো মানুষ স্বামীর প্রেমিকার খবর শোনার প্রতিক্রিয়া ছিলো আমি তখনও জানতাম না, এখনও জানি না।
এরপরের ঘটনা দ্রুত ঘটে গেলো। সামির বর্নকে কি বলেছে জানিনা, বর্ন পরেরদিনই সামির সহ আমাকে কোর্টে নিয়ে গেলো, গোটা কয়েক সাইন করে আমাদের মিউচুয়াল ডিভোর্স হয়ে গেলো। পরের তিন মাস আমি বর্নর বাসায়ই ছিলাম। বর্ন ছিলো না। বাসায় অফিস টুরের কথা বলে তাপসীকে নিয়ে থাইল্যানড, দুবাই আরও কই কই যেনো ঘুরে বেড়িয়েছে। আমি আর সামির জানতাম। ওহ, আমার ভালো মানুষ স্বামী ওইদিনই আইনত তাপসীকে বিয়ে করেছে। আমি বর্নকে কিছু জিগেস করিনি। এ বিষয়ে কোনো কথাও বলিনি। তিন মাস কেটে গেলে বর্ন বাসায় ফিরে ডিভোর্সের কথা খোলাসা করেছে, তাপসীর সাথে বিয়ের কথাও। আমার শ্বাশুড়ি আমাকে বিস্তর গালমন্দ করলেন নিজের স্বামীকে সুপথে রাখতে না পারার দোষে। সামিরের ভাই ভাবি আর মা এসেছিলো ততোদিনে। সামির যেমন বর্নকে রাজি করিয়েছে, তেমন নিজের পরিবারকেও ম্যানেজ করে নিয়েছিলো।তাদের কোনো আপত্তি ছিলো না আমাকে নিয়ে। বর্ন ফেরার পরদিনই সামির আর আমার বিয়ে হলো সামিরদের বাড়িতে ঘরোয়া ভাবে। যদিও ডিভোর্সি মেয়ের স্বামীর বন্ধুর সাথে বিয়ে কেউ খুব ভালভাবে নেয়নি। এমনকি আমার নিজের পরিবারের কাছ থেকেই অনেক কুতসিত কথা আমাকে শুনতে হয়েছে, কিন্তু আমেরিকা ফেরার আগ পর্যন্ত সামির পুরোটা সময় আমাকে আগলে রেখেছে।
আমি সুখী হয়েছি। সামির আসলেই ভালো স্বামী, বর্নর মতো টেকনিকালি সহীহ ভালো স্বামী না। সে রোজ সকালে আমার চুলে হাত বুলিয়ে ঘুম থেকে ওঠায়, আমরা একসাথে মুভি দেখি, ঘুরতে যাই। প্রতি বছর একবার লম্বা টুরে যাই আমরা, সামির বলে ইয়ারলি হানিমুন। সে সময়গুলো আমার হানিমুনের মতোই কাটে। চার বছরের প্রতারনা আর অপমান ভুলে গেছি আমি। কিন্তু এতোসব সুখের মাঝেও মাঝে মাঝে আমার চোখ জ্বালা করে যখন বর্নর প্রোফাইলে বর্ন আর তাপসীর নানা রঙের টুকরো টুকরো সুখী জীবন দেখি। শুনেছি বর্ন এখন আলাদা থাকে তাপসীকে নিয়ে। এখন সে নাকি অফিস শেষ করে পাচটায়ই বাসায় ঢোকে। সে নাকি তাপসীকে সারপ্রাইয দেয়ার জন্য নানারকম প্লানও করে। সামিরের কাছেই শুনি এসব, বর্নর সাথে ওর সাথে এখনও দারুন বন্ধুত্ব। সামির যখন এসব গল্প বলে তখন মাঝে মাঝে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে বর্ন কী একমুহূর্তের জন্যও ভালোবেসেছিলো? আমি তো খুব চেয়েছিলাম তাকে নিয়ে ভালো থাকতে।
যদিও আমি জানি এসব আমার অযাচিত দু:খ বিলাস ছাড়া কিছুই না। তবু কেন জানি ঘর ভরা ছড়ানো ছিটানো এতো সুখের মাঝেও আমার মন খারাপ হয় আমার ফেলে আসা সেই চার বছরের জন্য। আরো বেশি মন খারাপ হয় যখন চেনা পরিচিত সবার মুখেই শুনি বর্ন কতো ভালো স্বামী!
৪.দাম্পত্য জীবন কিভাবে মধুর হয়
নতুন বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে ড্রইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। আর সোফার পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিলো দশ এগারো বছরের কাজের মেয়েটি। ওর নাম শেফালি। দরিদ্র ঘরের মেয়ে। বাবা নেই। মা আছে। আমাদের গ্রামে ওদের বাড়ি। সেই সূত্রেই আমাদের চেনে। ওর মা একদিন মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মাকে বললো, মেয়েটিকে যেনো আমরা রেখে দিই। আমাদের এখানে থাকবে, কাজ করবে। মা রেখে দিলেন। তারপর থেকে মেয়েটি আমাদের বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে ওর মা এসে মেয়েকে দেখে যায়।
আমার স্ত্রী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি নিচে কেনো বসেছো? সোফায় বসো।”
মেয়েটি আমাদের এখানে আছে দু বছর হলো। সে সব সময় নিচে বসে টিভি দেখে। তাকে কখনো আমরা সোফায় বসে টিভি দেখার কথা বলি নি।
মেয়েটি তাই অবাক এবং কিছুটা ভয় নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে?
স্ত্রী তখন উঠে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসালো।
এবং হেসে বললো,”এখন থেকে সোফায় বসে টিভি দেখবে। কখনো নিচে বসবে না।”
মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলো।
কিছুটা দূর থেকে মা দৃশ্যটি দেখলেন।
পরে মা আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন,”আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা খুব ভালো একটা বউ পেয়েছি।”
আর বাবা বললেন,”বউটার যত্ন নিবি। আমি নিশ্চিত এই মেয়ে আমাদের জীবন বদলে দেবে। ঠিক যেমন তোর মা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছিলো।”
বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো। শহরের আমাদের এক খণ্ড জমি নিয়ে বারো বছর ধরে মামলা চলছিলো। জমিটির বর্তমান মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। জমিটি এক প্রভাবশালী লোক জোর করে দখল করে রেখেছিলো। কিছুদিন পর ঐ মামলার রায় হলো। এবং আমরা জিতলাম।
বাবা সেদিন আদালত কক্ষে আমাকে আবারো বললেন,”বউটার যত্ন নিবি।”
কিন্তু বাবার কথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলাম না।
একদিন রান্নায় লবণ একটু বেশি হয়েছিলো বলে গলা চড়িয়ে স্ত্রীকে বললাম,”কী রেঁধেছো এসব! মুখেই তো দেয়া যাচ্ছে না।”
আরো বেশ কিছু কথা বললাম।
বাবা তখন ছুটে এসে ধমকে আমাকে বললেন,”ঐ খাবার তো আমরাও খেয়েছি। কই আমাদের তো সমস্যা হয় নি।”
আর মা বললেন,”কথা ভদ্র ভাবে বলবি। বেয়াদবের মতো কথা সহ্য করবো না।”
আমি আর কিছু না বলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।
পরদিন অফিসে গিয়ে জানলাম, বড়ো অংকের টাকার হিসেব গণ্ডগোল হয়েছে। আর অফিসের টাকার দায়িত্ব যেহেতু আমার, তাই দোষটা আমার ওপর পড়লো।
বস আমাকে শান্ত গলায় বললেন, টাকার হিসেব যদি না মেলে তাহলে পুলিশকে জানাবেন এবং চাকরিও যাবে।
শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পুরো অফিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও ঐ টাকাগুলোর সন্ধান পেলাম না। অফিসের বাইরে অন্য কোথাও রেখেছি কিনা তাও মনে পড়লো না। দু:সংবাদের এখানেই শেষ নয়। সেদিনই জানতে পারলাম, ঐ প্রভাবশালী লোক, যে আমাদের জমি দখল করে রেখেছিলো, উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। তার মানে, আবারো দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলবে। অর্থাৎ আরো খাটুনি এবং টাকা খরচ হবে।
বিধ্বস্ত মনে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কাজটা করলাম, তা হলো, স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলাম।
সেই সাথে বললাম,”জীবনে আর কখনো তোমার সাথে বাজে আচরণ করবো না। কথা দিচ্ছি।”
স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”শেফালিকে স্কুলে ভর্তি করাতে চাই। আমি নিজে ওকে পড়াবো।”
অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে খানিক সময় ওর দিকে চেয়ে রইলাম।
তারপর বললাম,”তাহলে ঘরের কাজ করবে কে?”
“আমি শুনেছি ওর মা গ্রামে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। তুমি তাকে এখানে নিয়ে আসো। উনি আমাদের বাড়িতে কাজ করবেন। আর মা মেয়ে এক সাথে থাকলে তাদেরও ভালো লাগবে।”
তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেলাম। এবং বাবা মাকে বলাতে তারাও রাজি হয়ে গেলেন।
তারপরের ঘটনা অবিশ্বাস্য! অফিসের টাকাগুলো অফিসেরই এক ড্রয়ারে খুঁজে পেলাম। অথচ সেদিন এতো খোঁজার পরও কেনো পাই নি কে জানে! আর দ্বিতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, ঐ প্রভাবশালী লোকটি আচমকা মামলা তুলে নিলো। লোকটির হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ হলো, লোকটির একমাত্র ছেলের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো।
সেদিন দু হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন বাবা পুনরায় আমাকে বললেন,”বউটার যত্ন নিবি।”
বাবাকে তখন বললাম,”আপনি সব সময় বউয়ের যত্নের কথা কেনো বলেন?”
বাবা উত্তরে বললেন,”একটা মেয়ে যখন বাবা মা’র বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক বাড়িতে আসে, তখন আল্লাহ ঐ মেয়েটার মধ্যে সৌভাগ্য দিয়ে পাঠান। যারা ঐ সৌভাগ্যের যত্ন নেয়, তাদের জীবন আলোতে ভরে ওঠে। আর যারা অযত্ন করে, তাদের জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এটা আমার মুখের কথা নয়। নবীজীর কথা। নবীজী বলেছেন, মেয়েরা হলো বরকত এবং কল্যাণের প্রতীক।”
আমি তখন বুঝতে পারলাম, বাবা কেনো কোনোদিন মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করেন নি। আর সেজন্যই হয়তো শূন্য হাতে জীবন শুরু করে আজ উপরে উঠে এসেছেন।
স্টাডি রুমে স্ত্রী তখন শেফালিকে পড়াচ্ছিলো। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো করছে। আমি দরোজায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালাম। সে আমাকে দেখে হাসলো। তখন আমার মনে হলো, চাকরি এবং কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, তারচেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম স্ত্রীর হাসি মুখ দেখে।
“সৌভাগ্য”
– রুদ্র আজাদ