# সুখের কান্না
বিয়ের প্রথম দেড় বছর আমরা বেশ সুখে শান্তিতে ছিলাম। জীবন যেন হাওয়ায় ভাসছিল। সৈকতের ভালোবাসা আমাকে স্বর্গের মতো সুখ এনে দিয়েছিল। সারাটা জীবন না পাওয়ার যন্ত্রনা এক নিমেষে উধাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো তখন যখন থেকে আমি প্রেগনেন্ট হলাম। সৈকত নিজেও খুব এক্সাইটেড ছিল কিন্তু কিছুদিন পর লক্ষ্য করলাম আমার প্রতি ওর তেমন নজর নেই। যে সময়টাতে ওকে আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই সময়টাতেই ও কেমন যেন দূরে দূরে থাকে। বাড়িতে থাকলেও সারাক্ষণ ফোন অথবা ল্যাপটপ। আমিও প্রথম প্রথম কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রেগনেন্সি, চাকরি, সংসার সবকিছু সামলে এতকিছু আমলে নেয়ার মত সময় পাই নি কিন্তু পরে যতদিনে বুঝলাম ততদিনে সংসারটা একটা ভাঙ্গা পিলারের উপর এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার পেটের রাজকন্যা বা রাজপুত্রের বয়স তখন আট মাস আর কিছুদিন পর সে আমার কোল জুড়ে আসবে। এই সময়টাতে সৈকত ছাড়া আমার পাশে দাঁড়ানোর মতো আর কেউ নেই। নিজের কাজ করতেই সমস্যা হয় তাই ভাবলাম মাতৃত্বকালীন ছুটি একটু আগেভাগেই নিবো। আমি এখানে কাজ করছি প্রায় ছয় বছর ধরে । সবাই খুব বন্ধুত্ব পরায়ণ আর আমাকে অনেক ভালোওবাসে সাধারণত কাজের জায়গা এমন হয় না । কাজের জায়গা থাকে কম্পিটিশনে ভর্তি, এখানকার পরিবেশট এমন না।
এই সময়টাতে সাধারণত মেয়েরা বাবার বাড়িতেই থাকে। মায়েরা তাদের যত্নআত্তি করে কিন্তু আমার ভাগ্য বরাবরই খারাপ। আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো আমার জন্মের কিছুদিন পরপরই। বাবার চেহারা মনে নেই আসলে দেখিনি কখনো। মা নিজেও আবার বিয়ে কবে আমাকে নানা নানুর কাছে রেখে নিজের সংসার গুছিয়ে নিয়েছিলেন, তখন আমার বয়স আট। যদিও উনি প্রতি সপ্তাহে আসতেন, আমার ভরণপোষণ দিতেন। কিন্তু একটু বড়ো হবার পরে আমার প্রতি তার এই বৈষম্য আমি আর মানতে পারিনি। মা বাড়িতে এলেই আমি দরজা বন্ধ করে দিতাম, ওপাশ থেকে ভদ্রমহিলা নাটক করে অনেক কান্না করতো। ওই মহিলার চেহারা দেখার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না, যে তার নিজের সন্তানকে ছেড়ে চলে যায় । আমি নানা নানুর কাছেই বড় হয়েছি। নানাভাই মারা যায় আমার বয়স যখন পনেরো। তার পর থেকে নানুমণিই সব।
যথাসময়ে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো পরীর মতো দেখতে এক রাজকন্যা এসেছে আমার কোল জুড়ে । নাম রাখলাম পুতুল। সৈকত উচ্ছ্বসিত হবার ভান করছে আমি বুঝতে পারছি। অফিসের সবাই আমাকে দেখতে এসেছিলেন। বস নিজেই আমাকে বলেছেন, আমাকে ছাড়া তাদের কাজ করতে একটু সমস্যা হচ্ছে বটে কিন্তু মাতৃত্ব অন্য জিনিস আমি যেন ঐসব নিয়ে চাপ না নেই।
তারপর থেকে রোজকার মত মাতৃত্ব যেন আমার ডিউটি হয়ে গেল আচ্ছা এখানে বাবার কি কোনো ভূমিকা নেই বাচ্চার খাওয়া, ঘুম, গোসল, দেখে রাখা সবকিছুই আমার দায়িত্ব। আমি কত রাত ঘুমাই না সৈকত কি তা জানে?জানবে কি করে ওতো ব্যস্ত ওর অফিস আর ল্যাপটপ নিয়ে । ইদানিং অনেক রাত করে বাসায় ফিরে আসে।
এক রাতে ভাত বেড়ে বসে আছি কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দিলাম।
-দিনা, আমি খেয়ে এসেছি । তুমি খেয়ে নাও, তোমাকে কতবার বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করবে না।
-ঠিক আছে আর কখনো করবোনা কিন্তু তুমি একটু বোসো তোমার সাথে আমার কথা আছে
-খুব টায়ার্ড লাগছে, কাল শুনি
-না আজকেই শুনতে হবে, জরুরি কথা
-বলো। সৈকত খুব বিরক্ত মুখে বসলো
-আমার তো অফিসে যাওয়ার সময় চলে এসেছে। আগামী মাস থেকেই অফিসে জয়েন করতে হবে। এখন পুতুলকে কোথায় রেখে যাবো, কে সামলাবে ওকে?
-এক কাজ করো তুমি বরং চাকরিটা ছেড়ে দাও
-এসব কি বলছো চাকরি ছেড়ে দেবো মানে?
-তাহলে আর কি করবে, হাই তুলতে তুলতে সৈকত বললো যেন অনিচ্ছাসত্বে কথা বলছে
-একটা কাজের মেয়ে রাখলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আর তাছাড়াও আমিতো আগেও অনেকবার বলেছি গ্রাম থেকে তোমার মা আর বোনকে নিয়ে আসতে। উনারা থাকলে আমি একটু ভরসা পাবো। কাজের মেয়ে বাড়ির সব কাজ করলো আর ওনারা আমার পুতুল কে দেখে রাখবেন।
-দেখো দিনা আমি এসব ঝামেলা পছন্দ করিনা। ওরা ওখানেই ঠিক আছে আমি চাইনা বাসায় বেশি মানুষ জনের হৈ-হুল্লোড়।
-সারা জীবন দেখে এসেছি মেয়েরা আলাদা সংসার করতে চাই তোমার বেলায় উল্টো দেখছি
-আমি এতকিছু জানি না, আমি কাউকে আনতে পারবো না, তুমি পারলে কাজের মেয়ে জোগাড় করো, আমার পক্ষে সম্ভব না।
সৈকত উঠে চলে গেল যদিও সে বলেছিল যে সে অসম্ভব টায়ার্ড কিন্তু একটু পরে লক্ষ্য করলাম সৈকত ল্যাপটপ খুলে নিয়ে বসেছে। আমি যথারিতি পুতুলকে নিয়ে শুয়ে পরলাম। রাত প্রায় দুটো, সৈকত কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত, ঘুম ভেঙে গেল আমার। আড়ি পেতে শুনলাম, মনে হচ্ছে সদ্য প্রেমে পড়া কিশোর-কিশোরীর ফোনালাপ। আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠলো সৈকত কি তবে অন্য সম্পর্কে জড়িয়ে আছে যদিও এতদিন ধরে আমি এরকমটাই ভেবেছিলাম অবচেতন মনে কিন্তু আমার সচেতন মন তা কখনোই গ্রহণ করতে চায়নি। পরদিন সৈকত যখন গোসলে, ওর ল্যাপটপ খুলে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। একটা মেয়ের সাথে এতগুলো অন্তরঙ্গ ছবি যা গুনে শেষ করা যাবে না।
আমি আর অপেক্ষা করতে পারলাম না । পরদিন সকালেই পুতুলকে নিয়ে নানুবাড়ি চলে আসলাম , উকিলের সাথে আলোচনা করলাম আর ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিলাম ওই দুশ্চরিত্র মানুষের সাথে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব না।
আমি শিক্ষিত, কর্মজীবী নারী কাজেই পুতুলের দায়িত্ব বহন করা আমার পক্ষে কঠিন কিছু না কিন্তু সমাজের এমন এক বেড়াজালে বন্দি আমি যেখানে আমি ডিভোর্সি বলে মানুষজন আড়চোখে তাকায়, অনেকেই মনে করে আমি খুব সহজলভ্য। অনেকেই ঘুরিয়ে পেচিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। আর সহ্য হচ্ছিলো না। একরাতে অফিস থেকে বাসায় ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। পেছন থেকে নানুমণি এসে বললেন,
-কি হয়েছে দিনা?
-কিছুনা নানুমণি
-গল্প শুনবি একটা?
-কি যে বলোনা নানুমণি, এখন কি আমার গল্প শোনার বয়স? এখন তুমি আমার পুতুলকে গল্প শোনাও
-না তুই শোন
-এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলো না তো, তুমি বোধহয় কিছু বলবে বলো
-রিনা ছিল আমার একমাত্র মেয়ে, তোর মা। এসএসসি পাস করার পর তোর মাকে বিয়ে দিলাম। একবছর পরেই ঘর আলো করে তুই এলি কিন্তু তার পরপরই তোর বাবার কি জানি কি হলো প্রতিদিন তোর মায়ের উপর অকথ্য নির্যাতন, গালাগালি এমন কি মারধর। আমার মেয়েটা তোর মত এতটা শিক্ষিত ছিলনা তাই সব মেনে নিয়ে সংসার করতে লাগলো। কিন্তু কতদিন আর এটা সম্ভব। তোর বাবা মাঝে মাঝেই তার পছন্দের মেয়েটিকে বাড়িতে নিয়ে আসতো। এটা যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেল তখনো তোর মা চুপ করে থাকতো।
-এসব কি বলছো তুমি নানুমণি মানে হাসবেন্ড তার গার্লফ্রেন্ডকে বাড়িতে নিয়ে আসতো আর বউ চুপ করে থাকতো!
-হ্যাঁ কারণ সে তো তোর মত শিক্ষিত ছিলনা তাই ভাবতো চুপ করে থাকাটাই বোধহয় নিরাপদ কিন্তু একদিন তোর বাবা লাথি মেরে তোর মাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় জানিস আমার মেয়েটা তোর বাবার পায়ে ধরে তখন কাঁদছিল তার কয়েকদিন পর তালাকের নোটিশ আসে। তোর মা কিন্তু তোর মত ডিভোর্স দেয়ার মত সাহস পায়নি । সেই নোটিশ পেয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলো আমার মেয়েটা, তুই তখন দশ মাসের কোলে। আমি আর তোর নানা ভাই মিলে তাকে কোন রকম ভাবে আটকে ছিলাম তোর দোহাই দিয়ে। তারপর থেকে তোর দেখাশোনাই একমাত্র দায়িত্ব ছিল তার। আমার মেয়ের প্রাণ ভোমরা ছিলি তুই। তোর জন্য দ্বিতীয় বিয়েতে রাজি ছিল না কিন্তু চারপাশের মানুষের গুঞ্জন, চোখের চাহনি সব মিলিয়ে আমরা আমাদের মেয়েটার সুখের জন্য আবার বিয়ে দেই। আলহামদুলিল্লাহ আমার মেয়ে ভালো আছে কিন্তু সমস্যা কি জানিস যার জন্য জীবনের আটটা বছর সে এত সমস্যা হাসিমুখে সহ্য করেছে সেই তার মুখ দেখে না, কথা বলে না, ঘেন্না করে।
আমি মাথা নিচু করে থাকলাম চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগলো। বুঝতে পারছিলাম নানুমণি আমার কথাই বলছেন। আজকে যদি আমি এই অবস্থায় না থাকতাম তাহলে কখনই আমার মায়ের দুঃখটা বুঝতে পারতাম না। মা আমাকে ত্যাগ করেননি বরং সমাজ আমাদের মধ্যে একটা বিভেদ তৈরি করেছিল তার পরেও মা চেষ্টা করেছেন, প্রতি সপ্তাহে এসেছেন আমাকে দেখার জন্য, আমাকে ভালবাসতে চেয়েছেন, কিছুটা সময়ের জন্য হলেও কাছে রাখতে চেয়েছেন আর আমি বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আজ এত বছর পরেও একজন ডিভোর্সি মেয়ে হয়ে আমি যে সমস্যাগুলো সম্মুখীন হচ্ছি বুঝতে পারছি বত্রিশ বছর আগে সেই সমস্যাগুলো আরো কত বড় ছিল। আমি অঝোর ধারায় কাঁদছি।
যা আমি কোনদিন করি নি, আজ তাই করলাম রাত দুটোর সময় একটা নাম্বারে ফোন করলাম
ওপাশ থেকে ঘুমহীন একটা কন্ঠ উদগ্রীব স্বরে বললেন
-দিনা, মা আমার, কি হয়েছে এত রাতে তুই?
-তুমি কি ফ্রি আছো মা?
এতদিন পর আমার মুখে মা ডাক শুনে মা যেন চমকে উঠলেন ।অনেকক্ষণ ধরে কথা বলতে পারলেন না।
-কি হয়েছে মা? কথা বলবে না আমার সাথে?
-বল মা, কি হয়েছে তোর, তোর নানু আমাকে তোর সমস্যার কথা বলেছে
-আমার কোন সমস্যা নেই মা। মা আমি কি তোমার কাছে কিছু দিনের জন্য আসতে পারি? তোমার নাতনিকে দেখবে, আমি তোমাকে একটু জড়িয়ে ধরবো, প্লিজ মা
-অবশ্যই আসবি মা, কালকেই চলে আয়। আমি জানি তুই কি কি খেতে পছন্দ করিস, আমি সব রান্না করে রাখবো, তুই চলে আয়। মা কাঁদতে লাগলেন।
-মামনি দিনা আমি জানি তুমি আমাকে বাবা বলে মেনে নাও নি , আমাকে বাবা ডাকতে হবে না কিন্তু আমার বাড়ির দরজা সবসময় তোমার জন্য খোলা আর এই বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘরটা তোমার জন্য বরাদ্দ তুমি কি জানো মা? ফোনটা মায়ের কাছ থেকে নিয়ে একজন পুরুষ কন্ঠ বললেন।
-কে বলেছে তুমি আমার বাবা নও? তুমি যেভাবে আমার মাকে ছায়া দিয়ে রেখেছো আর কেউ কি তা করেছে? তুমিই আমার বাবা। বাবা আমি কাল সকালেই আসছি তোমাদের নাতনি কে নিয়ে।
-আয় মা, তাড়াতাড়ি আয়। তখন তোকে পরিবারের চাপে, সমাজের ভয়ে, আত্মীয় স্বজনের কথায় কাছে রাখতে পারিনি এখন থেকে বুকে আগলে রাখবো।
ফোনের দুই প্রান্তে আমরা তিনটি মানুষ তখন কেঁদে চলেছি। মানুষ সুখেও কাঁদে।