খালাতো ভাই মিজানের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মিজান ভাই আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতো, সেইটা সে আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু আমার কখনো তাঁর হাতে হাত রাখার সাহস হয়নি,বা চেষ্টা ও করিনি।
কিন্তু সময় তো আর কারো জন্য থেমে থাকে না।
বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে তবুও বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি দিচ্ছিলাম না কারণ আমার বিয়ে হয়ে গেলে বাবাকে দেখার মতো কেউ নাই। তাই বাবা ঠিক করেছে মিজান যেহেতু আমাকে পছন্দ করে তাই তাঁর সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়ে ছেলে বানিয়ে নিজের বাড়িতেই রেখে দেবে। মামাবাড়িতে বসেই এসব আলাপ আলোচনা করেছে বাবা,যেটা আমি ও জানতাম না। কিন্তু হঠাৎ করে আমার চার ভাইবোন ও তাদের ছেলেমেয়েরা সবাই একত্রিত হয়ে বাড়িতে হাজির। বাবা নাকি সব সম্পদ আমাকে দিয়ে দিচ্ছে সেই খবর শুনে তাঁরা ছুটে এসেছে তাদের ভাগটা বুঝে নেয়ার জন্যে।
এগুলো শুনার পর আমি বাবার দিকে তাকিয়ে আছি বাবার মানুষিকতা বুঝার জন্য, দেখলাম বাবা খুবই স্বাভাবিক। আর স্বাভাবিকভাবেই তাদেরকে বলছে, তোমরা এসেছো আমি খুশি হয়েছি। কিন্তু তোমরা যে উপলক্ষে এসেছো ওই বিষয়ে কথা হবে আমার একমাত্র সন্তান রিনার বিয়ের পর।
বড়আপা বললো, তুমি কি বললে বাবা? তোমার একমাত্র সন্তান রিনা! তাহলে আমরা কারা বাবা?
বাবা কোন উত্তর না দিয়ে ঘরের থেকে বেরিয়ে গেল,আর এদিকে চারজন মিলে রাগে গজগজ করতে লাগলো।
যাক নিশ্চিন্ত হলাম। বাবাকে নিয়েই আমার যত ভয়। কারণ মায়ের মৃত্যুর পর বাবা মানুষিক ভাবে অনেক ভেংগে পড়েছে তারপর আবার আমার ভাইবোনেরা যেটা করেছে তাতেও অনেকটা মর্মাহত। আজ তিন বছর ধরে বাবাকে ছোট বাচ্চাদের মতো আগলে রেখেছি যেন কোনভাবেই বাবা অসুস্থ হয়ে না পড়ে। মা চলে গেছে,বাবাও যদি চলে যায় আমি কার আশ্রয়ে থাকবো। অন্যদের তো আর বাবাকে নিয়ে চিন্তা নাই, স্বার্থপর গুলো এখন এসেছে সম্পদের উপর ভাগ বসাতে!
––আমরা পাঁচ ভাইবোন, তিন বোন আর দুই ভাই। বাবা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। একজন শিক্ষক ও পিতা হিসেবে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে সন্তানদের মাঝে,যেন তারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। তাতে ওনার অনেক কষ্ট হয়েছে কারণ মাসিক যে মাসোহারা পেতো তা দিয়ে সন্তানদের পড়াশোনার খরচ, এক্সট্রা খরচ চালিয়ে সংসারের জন্য অবশিষ্ট তেমন একটা থাকত না। সংসার চলতো ধানি জমির ফসলের উপর নির্ভর করে। কিন্তু বাবার পাশাপাশি মা ও ছিল বেশ হিসেবি। যে টাকাটা বাবা মায়ের কাছে দিতো সেইটা দিয়েই মাস চালিয়ে নিতো। এককথায় অতি সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেই আমাদের বেড়ে উঠা।
+++++++++++
বড়ভাই ঢাকাতে একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে আর মেজভাই বড় কম্পানিতে ভালো পোষ্টে আছে। দুইজনেই নিজেদের ফ্লাটে সংসার ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। ছেলে মেয়েরা প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করে। আর বড় দুইবোনের বিয়ে হয়েছে একই পরিবারে। বড়ো আপার দেবরের সঙ্গে মেজ আপার প্রেমের সম্পর্কের মাধ্যমে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়। প্রথমে দুজনের মধ্যে সম্পর্ক ভালোই ছিল কিন্তু কয়েকমাস পেরুতেই দুইবোনের সম্পর্ক হয় তিক্ততার, যাকে বলে দা কুমড়োর সম্পর্ক। ওদের কোন্দল মেটাতে আমার মা বাবা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। অথচ আজ স্বার্থের জন্য সেই দুইবোন ও একত্রিত হয়ে এসেছে।
বাবা অবসরে চলে আসলো। ভাইরা তখন টুকটাক খরচাপাতি দিতো, বাবা কখনো তাদের কাছে ডিমান্ড করতো না কে কতো টাকা দিবে,বলতো ওদের যা মনে হয় তাই দিবে। প্রতি কুরবানীর ঈদের সময় ভাইবোনেরা সবাই আসতো, তখন পুরো বাড়িটাতে হৈচৈ পড়ে যেতো। কি যে সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো।
হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে গেল। বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার দেখিয়ে কোনো ফলাফল পাওয়া গেলো না অবশেষে মা’কে ইন্ডিয়া তে নেওয়া হলো, ওখানে নেয়ার পর ধরা পড়লো মায়ের ব্রেইন ক্যান্সার। লাস্ট স্টেজে আছে, তবে ডাক্তারের নির্দেশমতো চিকিৎসা চললে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারবে।
মা’র শারীরিক সমস্যা গুলো কয়েক মাস আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল, কিন্তু মা কাউকে কিছু বলেনি ভেবেছিল ঠিক হয়ে যাবে তাই শুধু শুধু টাকা খরচ করতে চায়নি।
মায়ের চিকিৎসার জন্য যখন টাকার প্রয়োজন হলো ভাইরা সামান্য কিছু দিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিলো। বললো তাদের ফ্লাটের মাসিক কিস্তি আছে বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ তারপর সংসার তাই আর বাড়তি টাকা দেওয়া সম্ভব নয় তাদের পক্ষে।
তখন বাবা নিরুপায় হয়ে পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে মা’র চিকিৎসা চালিয়ে গেলো। ডাক্তার বলেছিল নিয়ম অনুযায়ী চললে উনি পাচ-ছয় মাস বেঁচে থাকতে পারে? হ্যা সাতমাস বেঁচে ছিল মা। তারপর একদিন চলে গেল না ফেরার দেশে। তখন এই ভাইবোনেরা এসে হাউমাউ করে কেঁদে কেটে মা’কে বিদায় জানিয়ে চলে গেল,আবার আসলো চল্লিশার সময়ে।
তারপর থেকে গত তিনটি বছরে ওঁরা আমাদের কোনো খোঁজ খবর নেয়নি। প্রথম প্রথম ঈদের সময়টাতে বাবা পথের দিকে তাকিয়ে থাকতো ওঁরা কেউ যদি আসে,যখন সময় পেরিয়ে যেতো তখন নিজেই বুঝে যেতো না তাঁরা আর আসবে না।
ঘরে আমরা দুজন মানুষ তবুও খরচ তো আছেই। বাবা শারীরিক সমস্যার জন্য কিছু ওষুধ নিয়মিত খেতে হয়।পেনশনের গুনা টাকায় সংসার চললে ও বাড়তি খরচ করা সম্ভব হয় না। তাছাড়া আবাদি জমি থেকে তো এখন আর ফসল পাইনা, সেগুলো বিক্রি করেই তো মা’র চিকিৎসা করা হয়েছে। কিছুটা আর্থিক টানাপোড়নে সমস্যা দেখা দেয়।
তখন মিজান ভাইয়ের চেষ্টায় বাবার চাকরিটা আমি পাই। মিজান ভাই ও ওই স্কুলের শিক্ষক। তারপর থেকে স্কুলের শিক্ষকতা করি আর দিন শেষে বাবাকে সঙ্গ দেই। আমার বিয়ে নিয়ে বাবা অনেক টেনশন করে, ওনার কথা আমি বেঁচে থাকতেই যেন আমার দায়িত্ব আমি পালন করে যেতে পারি। তখন আমার খুব রাগ হয়,বলি আমি চলে গেলে তোমাকে দেখবে কে ?
বাবা বললো, আমাকে যেন তোর ছেড়ে যেতে না হয় সেই ব্যবস্থাই করতেছি। মিজান ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে তো বাবাকে ছেড়ে যেতে হবে না। আবার দুজনের কর্মস্থান ও একই জায়গায়। মিজান ভাই আমার চার-পাঁচ বছরের বড়ো হলেও আমাদের একই সঙ্গে বেড়ে উঠা। মিজান ভাই ছোট থাকতেই রোড এক্সিডেন্টে খালুর মৃত্যুর হয়, তারপর খালামনি মামাবাড়িতে চলে আসে। কয়েক বছর পর খালামনিও রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মামাবাড়ি পাশাপাশি হওয়ায় আমাদের যাতায়াত ছিল অনেক। আর মা তো মিজান ভাই কে নিজের ছেলে হিসেবেই দেখতো।
__আমাদের বিয়ে হয়েছে আজ চারদিন। বাবা সবাইকে ডেকে পাশাপাশি বসতে বললো।
তারপর ভাইবোনদের উদ্দেশ্য করে বললো, তোমরা যে উপলক্ষে এসেছো আমি সেই বিষয় টা তোমাদের কাছে পরিষ্কার করে বলতে চাই।
তোমাদের মাকে ইন্ডিয়া থেকে আনার পরে তোমরা কত টাকা দিয়েছিলে বাবারা?
আচ্ছা আমি বলছি শাহিন (বড়ছেলে) দিয়েছে কুড়িহাজার।
আর তুহিন (মেজছেলে) দিয়েছে পনের হাজার।
তারপর কি তোমরা একবারও জানতে চেয়েছো তোমাদের মায়ের চিকিৎসা করানো হচ্ছে কিভাবে? না তোমরা কেউ জানতে চাওনি।
আমি আমার বাপ-দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি করে আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করেছি। এখন এই বাড়িটা ছাড়া আমার আর অবশিষ্ট কিছুই নেই। রিনাকে নিয়ে আমার চিন্তা ছিল, কারন আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওঁর একটা ব্যবস্তা না করে আমি যদি মারা যাই মেয়েটা আমার সাগরে ভাসবে। সৃষ্টি কর্তার কাছে অনেক শুকরিয়া বেঁচে থাকতেই আমি তার ব্যবস্থা করতে পারছি। এতিম মিজান কে আমার স্ত্রী ও সন্তানের চোখে দেখে গেছে, অনেক ভেবে চিন্তে দুই এতিম কে আমি একত্রিত করেছি। আর বসবাসের এই বাড়িটা আমি মিজান ও রিনার নামে ঊইল করে দিয়ে যেতে চাই।
চারিদিকে শুনশান নীরবতা সবাই বুঝি বোধহীন হয়ে গিয়েছে।
***সমাপ্ত***
#গল্প__সন্তান
#Rozina Rose