শাম্মী ভাবী ছিলেন ভীষণ অমিশুক। সুন্দরী, চুপচাপ। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন। যেকোন সময় ইচ্ছা করলেই তিনি আমাদের বাসায় আসতে পারতেন। আম্মার সাথে গল্প করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তেমন আসতেন না। বরং তিনি থাকতেন তার বড়, নির্জন, অন্ধকার ফ্ল্যাটটাতে। একদম একা।
শাম্মী ভাবীর হাজবেন্ড টুটুল ভাই থাকতেন দুবাইতে।সেখানে একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির সুপারভাইজার হিসেবে ছিলেন। বছরে দুবার দেশে আসতেন। তিনি আবার শাম্মী ভাবীর ঠিক উল্টো, দারুন মিশুক। দেশে এসেই দেখা করতে আসতেন আব্বার সাথে। কথা বলতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। তাদের কথার মধ্যে রাজনীতি অর্থনীতি সমাজতন্ত্র সব বিষয়ই চলে আসতো। কথা তাদের শেষই হতো না। শেষ পর্যন্ত মা-ই বাবাকে ধমকাতো, ‘ছেলেটা দেশে এসেছে, এখন বউকে একটু সময় দেবে কি, তুমি বকর বকর করে ওকে আটকে রেখেছে। উঠো তো! আক্কেল জ্ঞান যদি হতো তোমার! টুটুল বাবা যাও, শাম্মীকে একটু সময় দাও। মেয়েটা তোমার জন্য সবটা সময় মন খারাপ করে বসে থাকে।’
শাম্মী ভাবী আর টুটুল ভাইকে আমি কিন্তু পারফেক্ট কাপল বলতে পারবো না কোনোদিন। তাদের মধ্যে কখনোই আমি তেমন মিল-মিশ দেখিনি। একসাথে যখন থাকতো দুজন, বেশ চুপচাপ হয়েই থাকতো। স্বামীকে অনেকদিন পর কাছে পেলে স্ত্রীদের যেমন একটা আহ্লাদিপনা কাজ করে, শাম্মী ভাবীর মাঝে তার ছিটেফোঁটাও থাকতো না। তার উপর, তাদের অন্য কষ্ট ছিলো। বাচ্চা হচ্ছিলো না তাদের। দুজন এজন্য বেশ কয়েকবার ডাক্তার দেখিয়েছেন আমরা জানতাম, কিন্তু তার ফলাফল কি কখনো জানতে পারিনি। জানতেও চাইনি। ওসব তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাতে আমাদের নাক গলানো একদমই ঠিক না।
এবার টুটুল ভাই বিদেশ যাবার পর শাম্মী ভাবী কেমন যেন আরো চুপচাপ হয়ে গেলেন। আমাদের বাড়িতে আগে যা একটু আসতেন, এবারে আসা একদম বন্ধই করে দিলেন। তারপর দেখলাম তার চালচলনেও বেশ পরিবর্তন চলে আসলো। বাইরে যখনই যেতেন, শরীর মুখ সব ঢেকেই বাইরে যেতেন। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। মানুষ যখন তার কোনো সমস্যার বাহ্যিক সমাধান পায় না, তখন তার শেষ ভরসা হিসেবে সৃষ্টিকর্তার দিকে ঝুঁকে যান। শাম্মী ভাবীও সেই পথে হাঁটছেন।
একদিন ভাবী আম্মুকে জানালো, ‘আন্টি, একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়ে নিলাম। বাসায় একা থাকতে একদমই ভালো লাগে না। কিছু করে তো সময়টা কাটানো যাবে।’
মা হেসে বললেন, ‘খুবই ভালো করেছ। বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে থাকলে সময়টা ভালো লাগবে।’
শাম্মী ভাবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মা তখনই বুঝতে পেরেছিলেন, কথাটা বলে তিনি ঠিক করেননি। সন্তান না হবার যে হাহাকার, ভাবীর দীর্ঘশ্বাসে তা কি করুণ ভাবেই না ফুটে উঠেছিলো!
ভাবী সকাল বিকাল কিন্ডারগার্টেনে যেতে লাগলেন।ফিরতেন সন্ধ্যার পর। এরপর তার বাসায় নির্জীব নিরবতা। সেই বাসায় যে কেউ আছে, কখনো বোঝা যেত না।
সেই নিরালা নির্জন ফ্ল্যাটের সামনেই একদিন আমরা দেখলাম মানুষ। অনেক মানুষ। সবাই শাম্মী ভাবীদের আত্মীয়।
শাম্মী ভাবী তখন বাসায় নেই, তার বোনের বাড়ি গেছেন। মাঝে মাঝেই যেতেন। তার বোনের বাড়ি চট্টগ্রামে, সেখানে গিয়ে বেড়িয়ে আসতেন তিন-চার দিনের জন্য। মা একবার বলেছিলেন, ‘তোমার বোনের বাসাতেই তো গিয়ে থাকতে পারো তুমি, টুটুল যেহেতু এখানে থাকে না, এই ঢাকায় একা পড়ে থাকার তো কোনো দরকার নেই।’
শাম্মী ভাবী বললেন, ‘আন্টি, একটু সমস্যা আছে।’
‘কি সমস্যা?’
‘আমার বোনের তো নিজের বাড়ি না আন্টি, শ্বশুড়বাড়ি। ওই বাড়িতে তো আর বেশিদিন থাকা যায় না।’
শাম্মী ভাবীর মা-বাবা মারা গিয়েছিলেন, টুটুল ভাইয়েরও একই অবস্থা। তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কেউই শাম্মী ভাবীকে নিজের বাসায় রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না, শুনেছিলাম তাদের বিয়েটা হয়েছিলো দুই পরিবারের অমতে, তাই এসব ব্যাপারে পরিবারের মধ্যে একটু রেষারেষি ছিলো। এ কারণেই বেচারিকে এভাবে একা একা ঢাকা শহরে পড়ে থাকতে হচ্ছিলো।
যেই শাম্মী ভাবী বাসায় একা থাকতে তার পরিবারের একটা মানুষ কুটো ফেলতেও আসতো না, সেইখানে তিনি বোনের বাড়ি যেতেই এতো এতো আত্মীয়-স্বজন এসে ভীড় করেছেন বাড়ির সামনে, ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই লাগে। আমরা গেলাম খবর নিতে। হইহট্টগোলে ততক্ষণে ফ্ল্যাটের অন্যান্য মানুষেরাও চলে এসেছেন। আব্বুই গিয়ে লোকগুলোর সাথে কথা বললেন, ‘আপনারা শাম্মীর আত্মীয়।’
‘জ্বি।’
‘এখানে যে এসেছেন, শাম্মী তো নেই। আসার আগে একটু খোঁজ নিয়ে আসবেন না?’
‘খোঁজ নিতেই তো এসেছি। ওর ফোন বন্ধ।’
‘তাহলে তার বোনকে ফোন দেন। ও ওর বোনের বাড়িতে আছে।’
মোচওয়ালা একটু রাগী রাগী ধরনের এক লোক সামনে এসে বললেন, ‘কার বাড়িতে আছেন বললেন?’
‘বোনের বাড়িতে।’
‘কোন বোন?’
‘আমি কি আর তার সব বোনকে চিনি। এই তুমি বলোতো কোন বোন, তোমাকেই তো বলতো সব।’
বাবা শেষ কথাটা মাকে বললেন। মা উত্তর দিলেন, ‘ঐ যে, ওর যে বোন চট্টগ্রাম থাকে।’
‘কবে গেছে ও বোনের বাড়িতে?’
‘তিন-চারদিন হলো।’
মোচওয়ালা লোকটা বললো, ‘আমি ওর সেই বোনের জামাই। ও আমাদের বাড়িতে কেন, কোনো বোনের বাড়িতেই যায় নাই।’
আমরা ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। তবে? কোথায় গেলো মেয়েটা? কোন দুর্ঘটনা ঘটলো না তো?
শাম্মী ভাবীর বোনের জামাই বলেই চললো, ‘টুটুল দুবাই থেকে আমাদের কল দিয়ে বললো সে শাম্মীকে ফোনে পাচ্ছে না। এমনটা কখনো হয় না। গত দুইদিন তার নম্বর বন্ধ। আমরাও ফোন দিলাম, কোনো খবর নেই। পরে একদম ঢাকাতেই চলে এলাম কি হয়েছে জানতে। এখানে এসে আপনাদের দারোয়ানের কাছে শুনলাম সে নাকি চট্টগ্রাম গেছে। চট্রগ্রামে গেলে সে কি আমাদের বাড়িতে যেত না? তাহলে ও গেলো কোথায়?’
আমরাও ব্যাপারটা ভাবলাম। নিশ্চয়ই খারাপ কিছু হয়েছে। নইলে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাবে না কেন?
ভাবীর দুলাভাই চলে গেলেন। বললেন, তিনি আরো খোঁজখবর করবেন। এরমধ্যে ভাবী যদি ফিরে আসে, আমরা যেন তাকে জানাই। আমরা বললাম, ‘আচ্ছা।’
এরমধ্যে তিনচারদিন কেটে গেছে। শাম্মী ভাবীর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নাই। উনার দুলাভাই মাঝে একবার ফোন দিয়েছিলো ভাবী ফিরেছে কিনা জানতে, আমরা জানিয়ে দিয়েছি ফেরেননি। তিনি এরপর জানতে চেয়েছিলেন, শাম্মী ভাবী যে চট্টগ্রামে যাবেন, এটা তিনি কাকে বলে গিয়েছিলেন। আমরাও জানালাম, ভাবী চট্টগ্রাম গেলে কাউকে জানিয়ে যেতেন না। যাওয়ার সময় কেবল দারোয়ানকে বলে যেতেন। এবারও তেমনি দারোয়ানকে বলেই চলে গিয়েছিলেন।
এরমধ্যে আবার আরেক গ্যাঞ্জাম শুরু হয়েছে। আমাদের পাশের বিল্ডিংটা একদম আমাদের বিল্ডিং ঘেঁষেই করা। এরকম করার নাকি নিয়ম নেই, সরকারি নিয়ম অনুসারে কয়েক ফিট ফাঁকা রাখতে হয় দুই বিল্ডিংয়ের মধ্যে। তারা এই নিয়মের তোয়াক্কাই করেননি। একদম আমাদের বিল্ডিং ঘেঁষে বাড়ি তুলে ফেলেছেন।এর উপর, ঐ বিল্ডিংয়ের মানুষজন চূড়ান্ত অভদ্র। তাদের যতো ময়লা দুই বিল্ডিংয়ের চিপার মাঝে ফেলে দেন। ঐ ময়লা পচে প্রচন্ড দুর্গন্ধ হয়।আর এই দুর্গন্ধের জন্য ওরা দায়ী করে আমাদের। আমরাই নাকি বিল্ডিং নোংরা করে দুর্গন্ধ করে রাখি।
এবারও তাই হলো। কয়েকদিন থেকেই বিল্ডিংয়ে কেমন দুর্গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ওরা যথারীতি তেড়ে এসেছে, আমাদের জন্যই নাকি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমরাও এবার কোমড় বেঁধে নেমেছি। এবার ময়লা ওদের দিয়েই পরিষ্কার করাবো। না হলে দরকার হলে প্রচুর মারামারি হবে। তবুও এবার ওদের এতো সহজে ছেড়ে দিবো না।
এরকম ঝামেলার মাঝেই একদিন পুলিশ এলো বাসায়। সাথে শাম্মী ভাবীর দুলাভাই। তিনি মুখ কঠিন করে বলতে লাগলেন, ‘শাম্মীকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা সত্যি করে বলেন তো ও কোথায়? সত্যি কি ও চট্টগ্রাম গেছে? নাকি অন্য কোথাও পালিয়ে গেছে?’
বাবা বললেন, ‘আজব ব্যাপার। এটা আমরা কেমনে বলবো? সে তো আমাদেরও কিছু বলে যায়নি। দারোয়ানকে যা বলেছে, আপনাদেরও তাই বললাম।’
‘ধুর মিয়া, দারোয়ানের কথা ধরে বসে আছেন। একটা বড় মেয়ে কি এমনি এমনি হারায় যেতে পারে? আপনারা সত্যি কিছু জানলে বলে দেন দয়া করে। আমাদের ঝামেলাটাও কমুক।’
বাবা মুখ শক্ত করে বললো, ‘বললাম তো জানি না।’
‘বুঝছি। এখন ওর ঘরে ঢোকা ছাড়া উপায় নাই। দেখি ঢুকে মালসামাল কিছু আছে, না সব নিয়েই পালায় গেছে।’ বলেই তিনি কাকে যেন ফোন দিলেন। তারপর ফোনটা বাবাকে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘নেন, কথা বলেন।’
ফোনে ছিলো টুটুল ভাই। বাবা শাম্মী ভাবীর দুলাভাইকে যা বলেছিলেন, টুটুল ভাইকেও তাই বললেন। এরপর দুলাভাই ফোনটা ফেরত নিয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে টুটুল। তোমাদের দরজা ভাঙছি তাহলে। ওসি সাব, দরজা ভেঙে ফেলেন। আমি শাম্মীর দুলাভাই, আমি পারমিশন দিলাম। কিছু হলে দায়-দায়িত্ব আমার।’
ফ্ল্যাটের সামনে মানুষের ভীড় লেগে গেছে।সবাই চরম আনন্দ নিয়ে দেখছে পুলিশের দরজা ভাঙা। এই ভীড়ের মাঝে আমি একজনকে দেখলাম।আর দশটা সাধারণ ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছরের বাঙালি যুবকের মতোই তার চেহারা, কেবল চোখটা অন্যরকম। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। একদৃষ্টিতে তিনি দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। পুলিশের লোকজন উনাকে দেখে একজন আরেকজনকে ইশারা করে হাসাহাসি শুরু করেছেন, ভাবটা এমন যে, দেখ , পাগলটা চলে এসেছে। উনি বিষয়টা দেখলেন, কিন্তু পাত্তা দিলেন না। তার সব মনোযোগ দরজার দিকে।
তবে উনাকে দেখে আমি চিনতে পেরেছি। আমার বন্ধু সাকিবের মামাতো ভাই উনি। শুধু পুলিশের মধ্যে না, শুনেছি উনার পরিবারের মধ্যেও উনার একটু পাগল বলে সুখ্যাতি আছে। সাকিব বলেছিলো উনার কথা। ভালো ছাত্র ছিলেন, ডিপার্টমেন্ট ফার্স্ট, ভার্সিটিতে টিচার হিসেবে ডাক পেয়েছিলেন, বিসিএসে ভাইভাতেও নাকি উতরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুই করেননি। এখানে ওখানে কেবল রহস্য খুঁজে বেড়ান।
ভাইয়ার নাম মনে হয় কিংশুক।
পুলিশ দরজা ভেঙে ফেললো। তখনই ভীষণ বাজে একটা গন্ধ এসে যেন ঘুষি মারলো আমাদের নাকের ভেতর। এই গন্ধ নিয়েই এতোদিন গ্যাঞ্জাম লাগছিলো আমাদের দুই বিল্ডিংয়ের মাঝে, আজকে তার উৎস জানা গেল। পুলিশ সবাইকে দাঁড়াতে বলে নিজেরা চলে গেলেন ভেতরে। কিছুক্ষণ পরই তারা ফিরে এলেন। মুখ কেমন শুকনো। এসেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘শাম্মীকে চিনতো কে?’
সবাই শাম্মীকে চিনতো, কিন্তু ভয়ে তখন কেউ কথা বলে না। শাম্মীর দুলাভাই বললেন, ‘আমিই তো চিনি।’
‘আসুন আমার সাথে। আর ফ্ল্যাটের দুই একজন এলেও হয়।’
বাবা ঢুকলেন। সাথে আমি। আমার পেছন পেছন ঢুকলেন কিংশুক ভাই। ওসি সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি এখানে কি করেন?’
কিংশুক ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘আপনারা যা করছেন, তাই করি। শাম্মীর খোঁজ করি।’
‘আপনাকে কি খোঁজার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে?’
শাম্মী ভাবীর মোচওয়ালা দুলাভাই বলে উঠলেন, ‘জি, জি। আমিই দায়িত্ব দিয়েছি।’
ওসি সাহেব প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে বললো, ‘আচ্ছা, আসেন।’
আমরা তিনজন ভিতরে ঢুকলাম। মেইন দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই ড্রয়িংরুম, সেটা পেরিয়ে ভেতরের ঘরে যেতে হয়। আমরা ড্রয়িংরুম পেরিয়ে ভাবীদের বেডরুমের দিকে যাচ্ছিলাম। যেতে যেতে সেই দুর্গন্ধ আরো তীব্র হচ্ছিলো। বেডরুমের দরজায় পর্দা। পর্দা সরিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকলাম।
খুব সাধারণ একটা রুম। একটা ওয়ারড্রব, একটা আলমারি, একটা ড্রেসিংটেবিল, একটা বিছানা, আর বিছানার পাশে বেডসাইড টেবিল। ঘরের সাথে বারান্দা। বারান্দার ওপাশে পাশের বিল্ডিংয়ের দেয়াল। বারান্দার দরজা আর জানালা বন্ধ। জানালার পর্দা টানা। বাইরের কোনো আলো ঘরে ঢোকার কথা নয়। রুমটা অন্ধকার হয়ে থাকতো, যদি না পুলিশরা আগে এসে রুমের লাইট জ্বালিয়ে না রাখতেন।
তবে এগুলো কিছুই না। ঘরের ভেতর যে ভয়ংকর বিভৎসতা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো, সেটা ছিলো বিছানার ওপর।
আমরা দেখলাম, একটা মানুষ। তাকে দেখে চেনা যাচ্ছে না। ফুলে ঢোল হয়ে আছে শরীর। শরীরের জামা শক্ত করে চেপে আছে শরীরের সাথে। ওর চোখ বন্ধ, মুখটা খোলা। এই আটকানো বদ্ধ পরিবেশেও কিছু পিঁপড়া আর মাছির দল ভীড় করেছে শরীরটার চারপাশে।
মানুষটা যে শাম্মী ভাবী, সেটা বুঝতে আমাদের বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো।
আমি তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে এলাম। খারাপ লাগছিলো। কেমন বমি বমি পাচ্ছিলো। বাইরে এসে লোকদের ভীড় ঠেলে একদম নিচে চলে গেলাম। বিল্ডিংয়ের বাইরে। বাইরের আবহাওয়া ঠান্ডা, বৃষ্টি হয়েছে একটু আগে। ঠান্ডা হাওয়ায় মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো, কিন্তু চোখ থেকে শাম্মী ভাবীর ছবিটা সরাতে পারছিলাম না।
তখনই আমার ঘাড়ে একটা হাত পড়লো, ‘তুমি ঠিক আছো?’
আমি তাকিয়ে দেখি, কিংশুক ভাই। বললেন, ‘বমি করলে করে ফেলো।’
আমি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিলাম, না।
‘গুড। তোমার সাহস আছে। এমন বাজে জিনিস দেখেও এতো তাড়াতাড়ি সব সামলে নিয়েছে।’
‘আপনি কি আমাকে চেনেন?’
‘না তো। চেনার কথা নাকি?’
‘ভাই, আমি সাকিবের বন্ধু।’
‘ওহ আচ্ছা। তুমি কি উপরে যাবে এখন?’
‘জি।’
আমি কিংশুক ভাইয়ের সাথে উপরে উঠতে লাগলাম। সাকিবের বন্ধু শুনেও উনি আমার দিকে বেশি আগ্রহ দেখালেন না, নামটাও জিজ্ঞেস করলেন না। কি যেন গভীর চিন্তায় মগ্ন তিনি।
বাইরে এসে দেখলাম, আব্বা আর ভাবীর দুলাভাই দুজনেই বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনের মুখই শুকনো। মনে হচ্ছে বমি-টমিও করে এসেছেন এর মধ্যেই।
ওসি সাহেব বাইরে এসেই হম্বিতম্বি শুরু করলেন, ‘কে জানি দেখেছিলো এই মহিলাকে বাইরে যেতে? কে?’
‘দারোয়ান দেখেছিলো।’
‘দারোয়ান কই?’
দারোয়ান চাচা ভীড়ের এককোণায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তার নাম উঠতেই তিনি ধুম করে কেঁদে দিলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘আমি কিছু জানি না স্যার।’
‘তোরে কিছু জানতে বলছি? তুই খালি বল ঐ মহিলাকে বের হতে দেখছোস কিনা?’
‘জি।’
‘কবে দেখছোস।’
‘এই এক সপ্তাহ আগে।’
‘এরপর আর তারে বাড়ি আসতে দেখোস নাই?’
‘না।’
‘সত্যি করে বল?’
‘না।’
‘সে কি আসলেই বাইরে গেছিলো?’
‘জি।’
‘প্রমাণ কি?’
‘সিসিটিভি তো আছে স্যার।’
আমরা সবাই নিচে গেলাম। নিচে দারোয়ানের রুমে সিসিটিভির মনিটর রাখা। সেখানে আমরা এক সপ্তাহ আগের ভিডিও প্লে করলাম। ২৮ জুলাই, ২০২২, সকাল নয়টা। মানুষ ঢুকছে, বেড়োচ্ছে। শাম্মী ভাবীর কোনো চিহ্নই দেখতে পেলাম না।
হঠাৎ, সকাল দশটা দশ মিনিটে আমরা একজনকে লিফট থেকে নেমে সদর দরজার দিকে যেতে দেখলাম। তার শরীর মুখ সব ঢাকা। তবুও তাকে চিনতে আমাদের অসুবিধা হলো না। সেইরকম উচ্চতা, সেরকম গড়ন, সেরকম চলার ভঙ্গি।
আমরা সবাই আতংক, বিস্ময় আর ভয় নিয়ে দেখলাম, যে শাম্মী ভাবির লাশ আমরা দেখে এসেছি বদ্ধ ঘরে, তিনি দরজা দিয়ে হেঁটে বাইরে চলে যাচ্ছেন। চুপচাপ। একা।
তাহলে, আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে, বিশাল নিরব নিশ্চুপ নিস্তব্ধ বিরাট ফ্ল্যাটটায়, এই সাতদিন আলো আঁধারির মধ্যে নির্জনে যে লাশটা পড়ে ছিলো, সে লাশটা কার?
(চলবে)
গল্প- অদ্ভুত আঁধার এক
১ম পর্ব
লেখা- সোয়েব বাশার
অদ্ভুত আঁধার এক
২য় পর্ব
শাম্মী ভাবীকে বাইরে বেরিয়ে যেতে দেখলাম আমরা সিসিটিভি ফুটেজে। তাকে না চেনার একদমই কোনো উপায় নেই। সেই রকম উচ্চতা, সেই গড়ন, তিনি যে পোশাক পরে বাইরে যান, সেই পোশাকই তার পরনে।
ওসি সাহেব দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই সেই মহিলা?’
‘জি।’
‘স্ট্রেঞ্জ। এরপর আর সে বাড়ি ফেরেনি?’
‘না।’
‘এখানে কি তুমি একাই ডিউটি করো?’
‘না স্যার। শিফটিং আছে।’
‘তোমার পরে যে আসে, সে কোথায়?’
‘সিড়ির পিছনে একটা ঘর আছে, সেইখানে ঘুমায়।’
‘তোমার ডিউটি শেষ হলে তুমিও কি সেখানে ঘুমাও?’
‘জি স্যার।’
‘ডিউটি করার মাঝে তোমরা কি একটুও বাইরে যাও না?’
‘না স্যার।’
‘ব্যাটা, সত্যি কথা বল।’
দারোয়ান চাচা আমতা আমতা করে বললো, ‘মাঝে মাঝে চা খাইতে বাইরে যাই।’
ওসি সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসলেন। ফিরতে যাবেন, দেখলেন কিংশুক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। ওসি সাহেবের হাসিও পাল্টে গেলো, এবার ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘কি ফেলুদা সাহেব, কোনো প্রশ্ন করা বাদ রাখলাম নাকি?’
‘না, সবই ঠিক আছে। আমি কেবল সিসিটিভি ফুটেজটা আরেকবার দেখবো।’
‘দেখেন।’
কিংশুক ভাই চোখ সরু করে ফুটেজটা আবার দেখলেন। তার মুখেও দেখলাম ওসি সাহেবের মতো তৃপ্তির হাসি। তিনি হাসিমুখেই বললেন, ‘আমার আর দেখার কিছু নেই। চলেন, একটু ভিক্টিমের ঘরটা দেখে আসি।’
তারা দুজনেই ওপরে শাম্মী ভাবীর ফ্ল্যাটে গেলেন। আমি গেলাম তাদের পিছু পিছু। এর আগে অবশ্য ওসি সাহেব তার একজন কনস্টেবলকে বললেন সিসিটিভির হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে যেতে। কেউ যেন কোনো ফুটেজ আর ডিলিট করতে না পারে।
লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন করা হয়ে গেছে। লাশটা আবার কিংশুক ভাই ভালো মতো দেখলেন। এরপর পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে তল্লাশি করতে লাগলেন। তার তল্লাশির ধরন বেশ অদ্ভুত। আমি শার্লক হোমসের পাড় ভক্ত, শার্লক হোমসের সব গল্প পড়া শেষ করেছি ক্লাস টেনে ওঠার আগেই। জেরেমি ব্র্যাটের শার্লক হোমস সিরিজ দেখেছি বেশ কয়েকবার। কিংশুক ভাইয়ের অনুসন্ধান করার সাথে আমি শার্লক হোমসের মিল পেলাম। তিনি ঘরের প্রত্যেকটা কোণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছেন, টিভি কেবিনেট, জুতার কাবার্ড কিছুই বাদ দিচ্ছেন না। তিনি জুতার কাবার্ড খুলে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাচ্ছেন, ড্রেসিং টেবিলের আয়না দেখে মুচকি হাসছেন, বিছানার চাদর, আলনায় ঝোলানো কাপড় সব শুঁকে দেখছেন, একদম হৈ চৈ অবস্থা।
ওসি সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আপনি কি এভাবেই তদন্ত করেন নাকি ভাই?’
কিংশুক ভাই হেসে বললেন, ‘জি। আমি চাই না কোনো ক্লু আমার হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাক।’
‘ওহ আচ্ছা। কিছু পেলেন?’
‘পেয়েছি তো। আপনি পাননি?’
‘খুঁজছি। পেয়ে যাবো। এখন বলেন, আপনার কি মনে হচ্ছে।’
‘জটিল বিষয়। সহজে জট খুলবে না মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়?’
‘আমার কাছে তো ব্যাপারটা পরিষ্কার। শাম্মী বিল্ডিংয়ের বাইরে গেলেন তার বোনের বাড়ি যাওয়ার জন্য। এরমধ্যেই কোনো এক কারণে তিনি আবার বাড়ি ফিরে আসলেন। সেসময় দারোয়ান তাকে দেখতে পেলো না, কারণ সে তখন বাইরের দোকানে গেছে চা খেতে। শাম্মী ঘরে চলে এলেন। আর সেসময়েই তাকে খু*ন করা হলো।’
‘খু*ন। খু*ন কেন হবে?’
‘তবে আর কি হতে পারে?’
‘তাহলে খু*নি পালালো কিভাবে? ঘরের দরজা জানালা তো সব বন্ধ।’
‘মেইন দরজার লক তো বাইরে থেকে বন্ধ ছিলো। খু*নি খু*ন করে দরজা বাইরে দিয়ে লক করে চলে গেছে।’
‘ওটা তো ভেতর থেকেও লক করা যেতে পারে, তাই না? ভেতর থেকে লক না বাইরে থেকে লক, বোঝার তো উপায় নেই।’
‘তাহলে কি বলছেন, এটা আত্ম*হত্যা?’
‘একটা সম্ভাবনার কথা বললাম। আরেকটা ব্যাপার, খু*নি খু*ন করে চলে গেলো, দারোয়ান দেখলো না কেন? সে তো আর ঘন্টার পর ঘন্টা বাইরে দাঁড়িয়ে চা খাবে না, তাই না? খু*নি ঢুকতে বা বেড়োতে গেলে যেকোন সময় তার সামনে পড়তে পারে।’
‘একটা ব্যাপার হলে পড়বে না।’
‘কোন ব্যাপার?’
‘যদি খুনি বিল্ডিংয়ের ভেতরের কেউ হন।’
কিংশুক ভাই চোখ সরু করে বললেন, ‘আপনি কি কাউকে সন্দেহ করছেন?’
‘আপনার মতো আমিও একটা সম্ভাবনার কথা বললাম। তবে একজনের ওপর আমার একটা সন্দেহ পড়েছে শুরু থেকেই। আমি একটু পরেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।’
ওসি সাহেব আমাকে আর বাবাকে আলাদা ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।
আব্বা চিরকালই পুলিশে ভয় পান। এই ঘটনায় তার মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছেন। তার সারা শরীর ভিজে গেছে ঘামে। আমার রাশভারী বাবাকে এমন চুপসে যেতে দেখে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিলো।
ওসি সাহেব বললেন, ‘বুঝতেই পারছেন আপনাদের ওপর আমার প্রবল সন্দেহ হচ্ছে। নইলে এভাবে এখানে ডাকতাম না। এবার বলেন, আপনাদের পাশের বাসাতেই এতো বড় একটা ঘটনা ঘটে গেলো, আর আপনারা কিছু টেরই পেলেন না?’
বাবা বললেন, ‘না। টের পেলে তো আমিই আপনাদের আগে খবর দিতাম।’
‘না, দিতেন না। যদি আপনারা নিজেরা খু*ন করতেন।’
‘এসব কি বলেন। আমারা খু*ন করতে যাবো কেন? দেখেন, আমি একটা হাইস্কুলের শিক্ষক। আমাদের ফ্যামিলি খুবই রেস্পেক্টেবল ফ্যামিলি। আপনি যেসব কথা বলছেন, তা চিন্তা করাও আমাদের জন্য অসম্ভব।’
‘অসম্ভবকে সম্ভব করাই মানুষের কাজ।রেস্পেক্টেবল ফ্যামিলির মধ্যে থেকেও প্রচুর জঘন্য ক্রিমিনালদের বের হতে দেখেছি। যাই হোক, আপনারা শুরু থেকেই বলছিলেন শাম্মী চট্টগ্রামে ওর বোনের বাসায় গেছেন। এতো কনফিডেন্সের সাথে কিভাবে বললেন আপনারা?’
‘ওকে তো আর কোথাও যেতে দেখতাম না। শুধু মাসে একবার ঐ বোনের বাসাতেই যেত।’
‘তবু এতো শিওরলি বললেন কিভাবে?’
‘দারোয়ানকে বলে গিয়েছিলো, তাই।’
‘তাই এতো শিওর হয়ে গেলেন।’
‘শিওর না হয়ে কি করবো?’
পুলিশের জেরা চলতে থাকলো। একঘন্টা পর আমরা ছাড়া পেলাম। বাবাকে দেখে মনে হচ্ছে বয়স দশবছর বেড়ে গেছে। তিনি ছাড়া পেয়েই ছুটলেন তার জয়েন্ট সেক্রেটারি বন্ধুকে ফোন করতে।
আমি দরজার বাইরে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম কিংশুক ভাই তখনো দাঁড়িয়ে আছেন। আপনমনে গভীরভাবে কি যেন চিন্তা করছেন। আমি গিয়ে ডাকলাম, ‘কিংশুক ভাই।’
তার ধ্যানভঙ্গ হলো। আমার দিকে বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘কি?’
‘ভাই, সাকিব আমার খুব ভালো বন্ধু। আমাকে আর আমার পুরো ফ্যামিলিকে ও খুব ভালোভাবে চেনে। আপনি ওকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। ওই বলবে খু*নের মতো কাজ আমাদের ফ্যামিলির কেউ করতে পারে না।’
‘কি হয়েছে? পুলিশ কি তোমাদের সন্দেহ করছে?’
‘জি ভাই। আপনি একটু ওদের বোঝান না প্লিজ।’
‘আচ্ছা দেখি।’
কিংশুক ভাই ওসির কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিছু পেলেন?’
‘পেলে কি আপনাকে বলবো গোপন কথা? তবে আমার ধারণা আগে যা ছিলো, তাই। শাম্মী কোনো কারণে তার ফ্ল্যাটে ফিরে এসেছিলেন, দারোয়ানরা দেখতে পায়নি। পরে বিল্ডিংয়ের কেউ তাকে হ*ত্যা করে। আমি এখন বিল্ডিংয়ের সবার সাক্ষাৎকার নিবো। আশা করি এরমধ্যেই কিছু বেরিয়ে আসবে। আর পোস্টমর্টেম রিপোর্ট দিলে তো আরো অনেক কিছুই জানা যাবে। এর মধ্যে সিসিটিভির ফুটেজগুলাও চেক করা হয়ে যাবে, শাম্মী কখন ফিরেছিলো দেখার জন্য।’
‘আচ্ছা, আপনি দেখতে থাকুন। তবে আমার মনে হচ্ছে ওদের পাশের বাসার লোকেরা দোষী না। ওদের সন্দেহ করা বাদ দিতে পারেন।’
‘কি যে বলেন। ওদের পাশের বাসায় খু*ন হলো, আর ওরা নাকি টের পায়নি। ওদের ওপরই তো সবচেয়ে বেশি সন্দেহ।’
‘ভিক্টিমের বাড়ির দরজা জানালা যেভাবে শক্ত করে বন্ধ, এখানে গুলি চালালেও পাশের বাসার মানুষ টের পেতো কিনা সন্দেহ। আর আমার মনে হচ্ছে খু*নটা হয়েছে ভিক্টিমের ঘুমের মধ্যে, তাই চেঁচামেচির সুযোগ পায়নি। তাই পাশের বাসার মানুষও জানতে পারেনি।’
‘ঘুমের মধ্যে খু*ন, কিভাবে বুঝলেন?’
‘চুলের খোঁপা খুলে বেডসাইড টেবিলে রেখেছে, এখনো খোঁপাটা চাইলে গিয়ে দেখে আসতে পারেন, ঐ জায়গাতেই আছে। সাথে কানের দুল।’
‘এটা থেকে কিছুই প্রমাণিত হয় না। ওদের ওপর থেকে আমার সন্দেহ যাচ্ছে না। ওরা, নইলে এই বিল্ডিংয়ের কেউ এ কাজ করেছে।’
‘হতে পারে। ঠিক আছে ভাই, আজ চলি। প্রচুর ঘুম পাচ্ছে, বাসায় গিয়ে ঘুমাতে হবে। আরেকটা ব্যাপার, শাম্মীর মোবাইলটা তো মনে হয় পাওয়া যায়নি।’
‘না।’
‘আচ্ছা। যাই।’
কিংশুক ভাই চলে গেলেন। পুলিশ বিল্ডিংয়ের সকলকে জেরা করলেন। তিনতলায় যে কামাল সাহেবদের বুড়ো মা থাকেন, তাকেও ছাড়লেন না। কেবল চারতলার হানিফ আংকেল রেহাই পেলেন।তিনি অফিসের কাজে সপ্তাহখানেক আগে রাজশাহী গেছেন, তার স্ত্রীও সন্তানসম্ভবা বলে দু’মাস ধরে মায়ের বাড়িতে। তাই বাসায় কেউ নেই। পুলিশ বলে গেলো হানিফ আংকেল রাজশাহী থেকে ফিরলে যেন খবর দেয়া হয়, তারও জেরা নেয়া হবে।
পরেরদিনটা খুব ঝামেলার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো। বাসার সামনে খালি সাংবাদিক আর উৎসুক জনতার ভিড়। কেউ বিল্ডিংয়ের বাইরে বেরুলেও ডজনখানেক লোক তাকে মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরছে। প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে যাচ্ছে না।
এরমধ্যে বিল্ডিংয়ের সবার মধ্যে কেমন একটা আতংক বিরাজ করছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সন্ধ্যার পর কেউ ফ্ল্যাট থেকে বের হলো না। শাম্মী ভাবীদের ঠিক নিচের ফ্লোরে থাকা বেনু আন্টিরা ঐদিন বললেন, তাদের নাকি মনে হয়েছে মাঝরাতে উপরের ফ্লোরে কেউ হাঁটাহাঁটি করছে। তারা আর এই বিল্ডিংয়ে থাকবেন না। খুব দ্রুত বিল্ডিং ছেড়ে দিবেন।
তার পরেরদিন, একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এলো আমার কাছে। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে বললো, ‘চট্টগ্রাম যেতে পারবে এখন?’
‘কে বলছেন?’
‘কে বলছে, জানা জরুরী না।জরুরী হলো, চট্টগ্রাম যেতে পারবে কিনা?’
‘পারবো।’
‘আধাঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে বাসার নিচে দাঁড়াও।’
আধঘন্টার মধ্যেই রেডি হয়ে নিচে নামলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম কিংশুক ভাই রিকশা নিয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘চিনতে পেরেছিলা ফোনে?’
‘প্রথমে পারিনি। পরে পেরেছিলাম।’
‘প্রথমেই পারা উচিত ছিলো। হতাশ হলাম।’
দুঘন্টা পর। আমার বাসে। বাস দ্রুত গতিতে চট্টগ্রাম যাচ্ছে। কিংশুক ভাই গভীর মনোযোগ দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছেন। আমিও চুপচাপ বসেছিলাম এতোক্ষণ, কিন্তু বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘ভাই, আমাকে কেন নিলেন আপনার সাথে?’
কিংশুক ভাই প্রথমে কথাটা শোনেননি। পরে আবার প্রশ্নটা করতেই গম্ভীরমুখে বললেন, ‘সাকিব বললো তুমি নাকি ডিটেক্টিভ গল্পের পোকা। তাই সাথে নিলাম, কাজে লাগবে তোমাকে।’
‘আচ্ছা ভাই, ঠিক আছে। কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’
‘করো।’
‘আপনি দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়েছেন। বাইরে যাওয়ার অফার পেয়েছেন। সরকারী চাকরীও পেয়েছিলেন। সব ছেড়েছুড়ে রহস্যের খোঁজ করা শুরু করলেন কেন?’
‘এমনি। আর কিছু করতে ভালো লাগছিলো না।’
বুঝলাম, লোকটার মাথায় হয়তো আসলেই একটু সমস্যা। সাকিব ভুল বলে নাই।
কিছুক্ষণ পর আবার জিজ্ঞেস করলাম,’আচ্ছা ভাই, শাম্মী ভাবীর ব্যাপারটা কিছু ধরতে পেরেছেন?’
‘কি জানি। একবার মনে হয় পেরেছি, আরেকবার মনে হয় পারিনি। ভালো কথা, তোমার কাছে শাম্মীর কোনো ছবি আছে?’
‘আছে।’
আমার মোবাইলে গত বছরের বিল্ডিংয়ের রিইউনিয়নের কতোগুলো ছবি ছিলো। সেগুলো ভাইকে দেখালাম। সেসময় টুটুল ভাইও দেশে ছিলেন। কিংশুক ভাই উনার ছবি দেখে বললো, ‘উনার তো দাঁড়ি আছে। বেশ ধার্মিক ফ্যামিলি মনে হয়, উনার ওয়াইফও তো বাইরে যাওয়ার আগে মুখ ঢাকেন।’
‘টুটুল ভাই ধার্মিক, কিন্তু উনার বউ কিন্তু অতো ধার্মিক নন। উনি মুখ ঢাকা শুরু করেছিলেন এই একমাস আগে।’
‘উনাদের বাসায় বুয়া ছিলো না।’
‘ছিলো। একমাস আগে শাম্মী ভাবী বুয়াকে বাদ দেন।’
‘সবই তো দেখি একমাস আগে শুরু হয়েছে। একমাস আগে কি স্পেশাল কিছু হয়েছিলো?’
‘জানি না তো। উনি কিন্ডারগার্টেনে একটা চাকরি পেলেন একমাস আগে, এরপর থেকেই উনার পরিবর্তন।’
কিংশুক ভাই হঠাৎ করে হেসে ফেললেন। উনার হাসিটা সুন্দর। বুঝলাম, কিছু একটা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু কি যে বুঝতে পেরেছেন, একটুও বুঝতে দিলেন না আমাকে।
বাকি পুরোটা সময় আমরা বাইরের প্রকৃতি দেখতে দেখতে আর হাবিজাবি গল্প করতে করতে কাটিয়ে দিলাম।
বাস চট্টগ্রাম পৌঁছালো। বাস থেকে নেমে রিকশায় করে আমরা হালিশহর গেলাম। এখানেই ভাবীর বোনের শ্বশুরবাড়ি। ওরা আবার কিংশুক ভাইকে খুব ভালোমত চেনেন, ভাবীর বোনের দেবর কিংশুক ভাইয়ের বন্ধু। সেই দেবরই কিংশুক ভাইকে অনুরোধ করেছিলো শাম্মী ভাবীকে খুঁজে দিতে।
আমরা বাসায় পৌঁছে উনাদের ড্রয়িংরুমে বসলাম। সেই মোচওয়ালা দুলাভাই এসে কিছুক্ষণ গল্প করলেন আমাদের সাথে। এরপর শাম্মী ভাবীর বোন এলেন। তাকে দেখে আমি ভীষণ অবাক হলাম। বোন মারা যাওয়াতে তার মাঝে যেমন দুঃখী দুঃখী ভাব দেখবো ভেবেছিলাম, তেমনটা দেখলাম না। তবে এটা আমার অবাক হবার কারণ নয়। আমার অবাক হবার কারণ অন্য।
আমি দেখলাম, আমার সামনে যেন ঠিক শাম্মী ভাবীই এসে দাঁড়িয়েছেন।
(পরের পর্বে সমাপ্য)
লেখা- সোয়েব বাশার
অদ্ভুত আঁধার এক
৩য় পর্ব (শেষ পর্ব)
কিংশুক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কি ট্যুইন?’
নিম্নি আপু হাসলেন। মিষ্টি হাসি। তিনিই শাম্মী ভাবীর বোন। তবে তার হাসিটা শাম্মী ভাবীর মতো কিনা ঠিক বলতে পারবো না। শাম্মী ভাবীকে কখনো হাসতে দেখিনি।
হাসি থামিয়ে নিম্নি আপু বললেন, ‘না। আমরা ট্যুইন না। দেড় বছরের ছোটবড়।’
‘কতোটা ক্লোজ ছিলেন আপনারা?’
‘একদমই ক্লোজ ছিলাম না। ও আর আমি, দুইজন একদম দুই মেরুর। দুজনের কোনো কিছুতেই মিলতো না।’
‘কিন্তু তবুও তো সে শুধু আপনার বাসাতেই আসতো।’
‘আর কি করবে বলেন? অন্য কেউ তো ওকে দেখতে পারতো না। বাবা মা মারা যাবার পর আমার চাচারা সবাই মিলে আমাদের মানুষ করলেন। অথচ ওর বিয়ের আগে একবার কাউকে জানালোও না।’
নিম্নি আপু এরপর শাম্মী ভাবীর বিয়ের গল্প করলেন।কিভাবে হঠাৎ করেই একদিন বিয়ে করে ফেললেন, তারপর রাত তিনটায় ফোন দিয়ে নিম্নি আপুকে জানালেন বিয়ের কথা।
কিংশুক ভাই বললেন, ‘আপনার সাথেই কি তবে সব ব্যাপার শেয়ার করতো?’
‘না। কিছুই শেয়ার করতো না। মাঝেমাঝে তো মনে হতো আমাকে বোনই মনে করতো না ও।’
‘তবুও, কিছু ব্যাপার তো থাকে। ইদানিং কারো সাথে কথা বলতো কিনা, বা এসব ব্যাপার…’
‘না। আমাকে ও কিছু জানায়নি।’
‘উনার ফেসবুক আইডি কি?’
‘ওর ফেসবুক নাই। হোয়াটসঅ্যাপ চালাতো, ঐটা দিয়েই টুটুলের সাথে কথা বলতো।’
‘ওহ। আচ্ছা, এখানে এলে সে কি শুধু আপনাদের বাড়িতেই থাকতো, নাকি অন্য কোথাও যেত?’
‘আমাদের বাড়িতেই থাকতো। মাঝেমাঝে আমার চাচা শ্বশুড়ের বাড়িতেও যেত। আমাদের বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা একতলা সাদা বাড়ি দেখলেন না, ঐটাই আমার চাচাশ্বশুড়ের বাড়ি। আমার চাচাতো ননদ শিল্পীর সাথে খুব ভাব ছিলো ওর।’
‘ভালো।তবে শিল্পীর সাথেও একবার কথা বলা দরকার। ঐ বাড়িতে কে কে থাকেন?’
‘এখন তো কেবল আমার চাচীশাশুড়ি আর শিল্পীই থাকে, চাচাশ্বশুড় মারা গেছেন দুইবছর হলো। তার বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে এখন কানাডায়, আর একটা ছেলে ঢাকায় চাকরি করে, মাসে একবার শুধু বেড়াতে আসে।’
‘আচ্ছা। আরেকটা ব্যাপার, রিসেন্টলি আপনার বোনের মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন দেখেছিলেন?’
‘রিসেন্টলি বলতে, গত একমাস তো সে আমাদের বাড়িতে আসেই নাই। কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছিলো বলে নাকি আসার সময় পাচ্ছিলো না। আমিই ঠিক করেছিলাম কয়েকদিনের মধ্যে ওর বাড়ি যাবো, কোন কিন্ডারগার্টেনে চাকরি নিয়েছিলো দেখতে। ও যে কখনো বাচ্চা পড়াতে পারে, আমি ভাবতেই পারি না। ভীষণ মুখচোরা ও।’
‘আচ্ছা। এখন তাহলে চলুন, আপনার চাচীশাশুড়ির বাড়িতে যাই। সোয়েব, তুমি একটা কাজ করো। শাম্মী এ বাড়িতে আসলে যে রুমটায় থাকতো, সে রুমটা একটু খুঁজে দেখো। দেখো সন্দেহ করার মতো কিছু পাও কিনা।’
ঘন্টাখানেক আমি রুমে অনুসন্ধান চালালাম। শার্লক বা ব্যোমকেশ থেকে জানা সকল বিদ্যাই কাজে লাগালাম, কিন্তু সন্দেহ করবার মতো কিছু পেলাম না। শুধু টেবিলের এক কোণায় একটা চিরকুট পড়ে ছিলো। সেখানে একটা ওষুধের নাম লেখা।
তবে একটা জিনিস কেবল আমার মনে বাজছিলো।
নিম্নি আপুর চেহারা ঠিক শাম্মী ভাবীর মতো। আমাদের বিল্ডিং থেকে যে বেরিয়ে যায়, সেও শাম্মী ভাবীর মতো। তাহলে? নিম্নি আপু কি সেদিন আমাদের বিল্ডিংয়ে ছিলেন?
কিংশুক ভাইরা ফিরে আসলে আমি চিরকুটটা তার হাতে দিলাম। ভাই চিরকুটটা দেখে মুচকি হেসে নিম্নি আপুকে বললো, ‘আপনাদের পরিবারে কারো গ্যাসের সমস্যা আছে?’
আপু বললো, ‘আমার জামাইয়েরই তো আছে।’
‘আচ্ছা, আজকে চলি। কাল সকালের মধ্যেই ঢাকায় পৌঁছাতে হবে।’
‘সেকি। থাকবেন না আজকে? আপনার ইনভেস্টিগেশন শেষ?’
‘প্রায় শেষ। এখন ঢাকায় গিয়ে বাকিটা বুঝতে হবে। চলি এখন, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।’
বের হবার সময় একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। বোনের মৃত্যুতে যে নিম্নি আপুকে নির্লিপ্ত মনে হচ্ছিলো, তিনি হঠাৎ করে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘ওর সাথে আমার সম্পর্ক ভালো ছিলো না ঠিক, কিন্তু তবুও ও আমার বোন। আমার রক্তের বোন। আমার আপন রক্তের সম্পর্কের বলতে আর কেউ রইলো না পৃথিবীতে। যে আমার বোনের সাথে এমন করলো, তাকে আপনি ছাড়বেন না। তাকে খুঁজে বের করবেন, এরপর কঠিন শাস্তি দিবেন। বলেন, পারবেন না?’
কিংশুক ভাই কিছু বললেন না। চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন।
বাসে ফেরার পথে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘নিম্নি আপুর চাচাশ্বশুড় বাড়িতে কি কোনো ক্লু পেয়েছেন?’
কিংশুক ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ’
‘হেয়ালি করেন কেন ভাই? বলে দিলেই তো হয়।’
‘কালকে বিকেলে বলবো। এখন একটু ঘুমানো দরকার।’
‘আচ্ছা, ভাই, আপনার কি মনে হয় নিম্নি আপু কোনোভাবে এই খু*নের সাথে জড়িত?’
‘বললাম তো, কালকে বলবো। এখন ঘুমাও। টেনশন করার কিচ্ছু নাই।’
বলেই তিনি বাসের সিটে হেলান দিয়ে ঘুম দিলেন। একটু পর আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম। বাস থামার আগ পর্যন্ত আমাদের ঘুম ভাঙলো না।
সকাল ন’টায় আমরা ঢাকা পৌঁছালাম। মনে করলাম ভাইয়া আমাকে বাসায় রেখে আসবেন। কিন্তু না। ভাইয়া আমাকে নিয়ে চললেন থানায়।
ওসি সাহেব তখন থানায় ছিলেন। আমাকে কিংশুক ভাইয়ের সাথে দেখে বললেন, ‘কি ব্যাপার? সাসপেক্টকে সাথে নিয়েই ঘুরছেন?’
‘কি করবো বলেন। একটু শিখাচ্ছি কিভাবে পারফেক্ট ক্রাইম করতে হয়। পরেরবার যাতে আরো ভালো করতে পারে। এবার তো সব কেঁচেগন্ডূষ করে দিয়েছে।’
ওসি সাহেব আগের মতোই ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘মনে হয় খু*নিকে পেয়ে গেছেন।’
‘মনে হচ্ছে তো পেয়েছি। তবে বিকেলের আগে বলতে পারছি না।’
‘কিছু জানলে বলে দেন তো ভাই। এই ঝামেলা আর ভালো লাগছে না। শুরুতে যতোটা সহজ ভেবেছিলাম, এখন দেখছি কেস তার চেয়ে বেশি জটিল।’
‘কিরকম?’
‘প্রথমে তো ভাবলাম ভিক্টিম চট্টগ্রাম যেতে না পেরে বাসায় চলে আসে, এরপর কেউ তাকে খু*ন করে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখলেই ভিক্টিমের বাড়ি আসার সময়টা জানা যাবে। বিশ্বাস করেন, দু’তিনবার চেক করা হয়েছে। ভিক্টিমের বাড়ি ফেরার কোনো ফুটেজ নেই।’
‘কি বলেন?’
‘হ্যাঁ, সত্যি। ফুটেজ খুব ভালোমতো দেখেছি আমি, এমনকি ডেট আর টাইমও মিলিয়েছি। কোনো ফুটেজ ডিলেট করা হয়নি। ভিকটিম কখনো বাড়িই ফেরেননি। তাহলে বাড়িতে ভিকটিমের লাশ কিভাবে পাওয়া গেলো? আর ভিকটিমের মতো দেখতে ওটা বেরিয়েই বা গেলো কে?’
‘হু, জটিল প্রশ্ন। আর কিছু?’
‘আরো আছে। ভিক্টিম যে কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতো বলে জানিয়েছে, সেই কিন্ডারগার্টেনের খোঁজ করছিলাম। ঐ নামে কোনো কিন্ডারগার্টেনই নেই।’
‘এটা অবশ্য জানি। আমি আপনার আগেই খোঁজ নিয়েছিলাম।’
‘তাহলে? সে এমন মিথ্যা কথা সবাইকে বলতো কেন?’
‘কেন বলতো সেটা খুঁজে বের করাই তো আমাদের কাজ। বুঝতেই পারছেন তার দেয়া মিথ্যা তথ্যের সাথেই তার খু*নের একটা যোগাযোগ আছে। একটা কাজ করুন না। আজকে বিকেলে আমার সাথে এক জায়গায় চলুন। সিভিল ড্রেসেই যাবেন, পুলিশের ইউনিফর্ম পরার দরকার নেই। ওখানে এমনি বেড়ানোর মুড নিয়েই আমরা যাবো, এরপর যদি কিছু পেয়ে যাই সেটা বোনাস।’
‘আপনাকে একটা সত্যি কথা বলি ভাই। আপনাকে আমি একদম পছন্দ করি না। আমার কাজে কেউ নাক গলাক, এটা আমি একদমই সহ্য করতে পারিনা। আপনি যে রহস্য এখনই সমাধান করতে পেরেছেন, সেটা আমিও পারবো। কিন্তু আমার কিছুদিন সময় লাগবে। তার কারণও আছে। আপনি একটা কেস নিয়ে পড়ে আছেন। আর এরকম বিশ-পঁচিশটা কেস নিয়ে আমার নাড়াচাড়া করা লাগে প্রতিদিন।কিন্তু তবুও আপনাকে আমি স্পেস দিচ্ছি। কেন দিচ্ছি, জানেন? আমাদের ডিপার্টমেন্টের অনেকেই আপনাকে খুব পছন্দ করে। এসপি স্যার আপনাকে অসম্ভব পছন্দ করেন। কেন করেন জানিনা।তিনি এমনি এমনি কাউকে পছন্দ করার মতো মানুষ নন। নিশ্চয়ই আপনার মধ্যে কিছু আছে, নাহলে তারা আপনাকে এতো ভালো জানবে কেন?’
‘আচ্ছা, বুঝলাম। আপনি কি যাবেন বিকেলে?’
‘যাবো, নিশ্চয়ই যাবো। সিভিল ড্রেসেই যাবো। আশা করি আপনি আমাকে হতাশ করবেন না।’
আমরা থানা থেকে বের হলাম। কিংশুক ভাই আমাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিকেলে কখন বের হবেন?’
‘তুমি যাবে নাকি?’
‘অবশ্যই। এমন কাছ থেকে রহস্যের সমাধান দেখার সুযোগ ছাড়বো কেন?’
‘ঠিক আছে। তিনটার দিকে রেডি থাকবে।’
বিকেল তিনটা যতো এগিয়ে আসতে লাগলো, আমার বুকের ধুকপুকানি তত বাড়তে লাগলো। আমার শুধু মনে হচ্ছিলো আজ হবে, কিছু একটা হবে।
তিনটা বাজলো। কিংশুক ভাই যথারীতি চলে এলেন। আমি তার সাথে রওনা দিলাম।
আমি ভেবেছিলাম ভাই আমাকে নিয়ে রহস্যময় কোনো জায়গায় যাবেন, অর্ধেক তৈরি কোনো বিল্ডিং নইলে কোনো পরিত্যক্ত কারখানায়, সন্ত্রাসীরা যেখানে আস্তানা গেড়ে থাকেন। তার বদলে তিনি আমাকে নিয়ে হাজির হলেন গুলশানের ছিমছাম এক অফিসের সামনে। একটা ডেভেলাপার কোম্পানির অফিস। নাম ব্লু ক্রিসেন্ট মুন বিল্ডার্স।
আমরা যাওয়ার দশ মিনিটের মধ্যেই ওসি সাহেবও চলে এলেন। ক্যাজুয়াল ড্রেসে। কিংশুক ভাইকে দেখে বললেন, ‘এইখানে আনলেন কেন? ফ্ল্যাট-ট্যাট কিনবেন নাকি?’
‘জি, কিনবো ভবিষ্যতে। তাই ভাবলাম এখনই একটু কথা বলে যাই।’
‘আপনার কেসের কি হবে?’
‘ঐটা পরে দেখবো।’
আমরা অফিসে ঢুকলাম। রিসেপশনে গিয়ে কিংশুক ভাই জিজ্ঞেস করলেন, ‘আরিফ রেজা কোথায় বসেন?’
‘সামনে গিয়ে বামের রুমটায়।’
আমরা রুমটায় গেলাম। ছোট্ট একটা রুম। একটা টেবিল, একটা ফাইল কেবিনেট। টেবিলের ওপাশে একজন ছেলে বসে আছেন। ছেলেটা খুব ফর্সা, আমি এমন ফর্সা ছেলে খুব কম দেখেছি। চুল আরেকটু বড় রাখলে অনেক ছেলের মা-ই তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসতো।
ছেলেটা পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টের অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার। কাস্টমার হ্যান্ডেল করেন।
টেবিলের এপাশে দুটো চেয়ার। কিংশুক ভাই আর ওসি সাহেব চেয়ারে বসলেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ছেলেটা জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই কিংশুক ভাই হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমি কিংশুক। আমার সাথেই আপনার ফোনে কথা হয়েছিলো সকালবেলা। মোহাম্মদপুরে একটা ফ্ল্যাট কেনার ব্যাপারে।’
ছেলেটা হাসিমুখে ভাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো, ‘জি জি। মনে পড়েছে। মোহাম্মদপুরে আমাদের বেশ কিছু সুন্দর অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আপনার রিকোয়ারমেন্ট কি?’
কিংশুক ভাই ফ্ল্যাট নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। ওসি সাহেব তার সাথে যোগ দিয়েছেন। মনে হচ্ছে তারও ফ্ল্যাট কেনার ইচ্ছা আছে। আমি হচ্ছি বিরক্ত। এমন বিরক্তিকর কাজে আসতে হবে জানলে কখনোই আসতাম না।
কথা বলতে বলতে কিংশুক ভাই হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি তো বনানীতে থাকেন, তাই না?’
ছেলেটা, মানে আরিফ রেজা হাসিমুখে বললো, ‘জি জি। আপনি কি করে জানলেন?’
‘আমার এক কাজিন থাকে আপনার বাড়ির পাশে। সেই বললো।’
‘ওহ আচ্ছা। কে?’
‘চিনবেন না হয়তো। সে আরো বললো গত একমাস নাকি আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন না। অন্য কোথাও ছিলেন।’
আরিফের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। সে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে কিংশুক ভাইয়ার দিকে। মুখ শক্ত করে সে জিজ্ঞেস করলো, ‘আপনি কে, বলুন তো।’
‘জি। সেটা তো অবশ্যই বলবো। তার আগে আমার কাজিনের কাছ থেকে শোনা গল্পটা আপনাকে শোনাই। গল্পটা আপনার ভালো লাগবে আশা করি। তবে গল্পে কোনো ভুল হলে আপনি শুধরে দিয়েন।
গল্পের প্রধান চরিত্রটা একজন ছেলে, বাড়ি চট্টগ্রামে। তাদের এবং তাদের চাচাতো ভাইদের বাড়ি পাশাপাশি। চাচাতো ভাই বিবাহিত। তার বউ আছে। একদিন বউয়ের বোন আসলো বেড়াতে। তার সাথে পরিচয় হলো। এক সপ্তাহের মতো বোনটা থাকলো চট্টগ্রামে, এই এক সপ্তাহে তাদের মধ্যে বেশ ভালো জানাশোনা হয়ে উঠলো। ছেলেটা জানতে পারলো, মেয়েটা বিবাহিত, কিন্তু স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। স্বামী আবার বাইরে থাকেন। সব মিলিয়ে মেয়েটা খুব একটা একাকিত্বের মধ্যে যাচ্ছে। এমন একাকী একটা মেয়ের মনের কাছাকাছি যাওয়া বেশ সহজ। ছেলেটা চলেও গেলো। কিন্তু সেবার বেশিদূর এগোলো না তাদের সম্পর্ক। ছেলেটার অফিসের ছুটি শেষ, তাকে ফিরতে হলো ঢাকায়।
তার তিনমাস পর ছেলেটা আবার ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে দেখে, এবার মেয়েটাও এসেছে। এই তিনমাস তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিলো না, কিন্তু তাদের থেমে যাওয়া সম্পর্ক আবার চালু হতে বেশি সময় লাগলো না। পরিবারের সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তারা দেখা করতে লাগলো। কিন্তু এভাবে তো বেশিদিন চলতে পারে না। ছেলেটার ঢাকায় ফেরা লাগবে, মেয়েটারও একই অবস্থা। এখন ঢাকায় গিয়ে মেয়েটা কিন্তু ছেলেটার কাছে চলে যেতে পারত। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। ছেলেটা বেশ কয়েকজন ব্যাচেলর বন্ধুর সাথে ফ্ল্যাট শেয়ার করে থাকে। সুতরাং একটা মেয়েকে এনে সেখানে তোলা যাবে না। আবার ছেলেটা আর মেয়েটার সম্পর্ক পরিবার মেনে নিবে না, সুতরাং জানাজানির একটা ভয় আছে। মেয়েটা বরকে ডিভোর্স দিয়ে ছেলেটার কাছেও যেতে পারছে না একই কারণে।
এখন এর সমাধান কি? চট্টগ্রামে থাকতে থাকতেই তারা একটা প্ল্যান করে ফেলেছিলো। ঢাকায় গিয়ে ছেলেটা তার বন্ধুদের জানালো, সে অন্য জায়গায় শিফট হবে, ফ্ল্যাটের ভাড়ায় তার পোষাচ্ছে না। এরমধ্যে ঐ মেয়েটাও ফ্ল্যাটের সবার কাছে গল্প শুনিয়ে দেয় যে সে একটা কিন্ডারগার্টেনে চাকরি পেয়েছে, প্রতিদিন কিন্ডারগার্টেনে যাওয়া লাগবে। সে শরীর মুখ ঢেকে প্রতিদিন বাইরে যাওয়া শুরু করলো। বিল্ডিংয়ের মানুষজনও ব্যাপারটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়লো। মেয়েটার মতো পোশাক পরে কেউ বাইরে গেলেও তাই আর কারো সন্দেহ করবার কিছু থাকলো না, সবাই ধরে নিতো সেটা ঐ মেয়েটাই, কিন্ডারগার্টেনে যাচ্ছে। ছেলে আর মেয়েটার প্ল্যানের প্রথম ধাপ সফল হলো।
এবার দ্বিতীয় ধাপ। ছেলেটা মেয়েদের মতো পোশাক পরে শরীর মুখ ঢেকে মেয়েটার বাড়িতে গিয়ে উঠলো। ছেলেটার হাইট, স্বাস্থ্য আর গায়ের রঙ মেয়েটার মতোই, তাই শরীর মুখ ঢেকে যাওয়ায় বাড়ির দারোয়ান বা অন্য কেউ সন্দেহ করলো না। এখানে আমার একটু খটকা লেগেছিলো, যেমন ছেলেটা ঐ বাড়িতে ওঠার কিছুদিন আগে থেকেই মেয়েটা বাইরে বের হওয়া শুরু করেছে, ও যে কিন্ডারগার্টেনে চাকরি করতে যাচ্ছে এটা সবাইকে বোঝানোর জন্য। যেদিন ছেলেটা ঐ বিল্ডিংয়ে এসেছিলো সেদিন মেয়েটাকেও বাড়ির বাইরে যেতে হয়েছিলো আবার বাড়ির ভেতর আসতে হয়েছিলো, একই মানুষের দুবার বিল্ডিংয়ে আসার মতো ব্যাপার হয়ে যায় তা। দারোয়ানদের চোখে পড়ার কথা। আমার ধারণা, ওখানে যেহেতু দুজন দারোয়ান কাজ করে দুই শিফটে, তাই ছেলেটা আর মেয়েটা ভিন্ন ভিন্ন শিফটে বিল্ডিংয়ে ঢোকে। দুজন যেহেতু আলাদা দারোয়ানের চোখে পড়েছিলো, তাই দারোয়ানরা ব্যাপারটা ধরতে পারেনি।
এবার শুরু হলো ছেলেটা আর মেয়েটার লিভ-ইন জীবন। মেয়েটা সারাদিন বাসাতেই থাকে চুপচাপ, ছেলেটা সকালে উঠে মেয়েটার পোশাক পরে শরীর মুখ ঢেকে অফিসে চলে যায়। ছেলেটা থিয়েটার করতো একসময়, মেয়েটার অঙ্গভঙ্গি আর কথা বলার ধরন রপ্ত করতে ছেলেটার খুব একটা বেগ পেতে হলো না। বিল্ডিংয়ের অন্য কেউ তাই ব্যাপারটা ধরতে পারলো না। আর মেয়েটা বিল্ডিংয়ের অন্যান্য লোকদের সাথে খুব কম মিশতো, তাই মেয়েটার দিকে কারো ইন্টারেস্টও ছিলো না, তাই ছেলেটার ছদ্মবেশ কেউ ধরতেও পারেনি। ছেলেটা মেয়েদের ছদ্মবেশ পরে বাইরে যেত, বাইরের কোনো এক জায়গায় পোশাক চেঞ্জ করে এরপর অফিসে চলে যেত, অফিস শেষ করে আবার পোশাক চেঞ্জ করে বাড়ি ফিরে আসতো। মানুষ মনে করতো মেয়েটা কিন্ডারগার্টেন থেকে ফিরছে।
মেয়েটাও সেসময় বাড়িতে একাই থাকতো। ওর বাড়িতে কারো যাতায়াত ছিলো না, বাড়িতে বুয়াও ছিলো না, তাই সারাদিন মেয়েটার বাড়িতে থাকার ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারেনি।
তবে সারাদিন তো এভাবে ঘরে থাকা যায় না। আমার ধারণা ঐ দারোয়ানদের শিফটিংয়ের সুযোগ নিয়ে মেয়েটাও হয়তো বাইরে যেত কখনো কখনো। দারোয়ানরা ব্যাপারটা ধরতে পারেনি, বা খেয়াল করেনি।
এভাবে চলছিলো একমাস। সব ঠিক চলছিলো। কিন্তু হঠাৎ একদিন কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। ছেলেটা বুঝতে পারে এখনই না থামালে মেয়েটা হয়তো সব ফাঁস করে দিবে, বিপদে পড়ে যাবে ছেলেটা। তাই একরাতে, মেয়েটা যখন গভীর ঘুমে, ছেলেটা তখন মেয়েটাকে খু*ন করে।
খু*ন করে ঠান্ডা মাথায় ছেলেটা প্ল্যান বানায়। মেয়েটার সাথে তার সম্পর্কের কথা যেহেতু কেউ জানে না, তাই সেখান থেকে পালিয়ে গেলে কেউ ছেলেটাকে ধরতেও পারবে না। ছেলেটা তার সব জিনিসপত্র স্যুটকেসে ভরে ফেলে। এরপর সকাল হতেই ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে মেয়েটার পোশাক পরে বাইরে বেরিয়ে যায়। দারোয়ানকে বের হওয়ার পথে মেয়েলি কণ্ঠে চট্টগ্রাম যাচ্ছে বলে যায়, দারোয়ানও তাই সন্দেহ করে না। সে আরেকটা কাজ করে, মেয়েটার মোবাইলটাও নিয়ে যায়। মোবাইলে যদিও কিছু ছিলো না, তারা কখনো ফোনে কথাও বলেনি, তবুও সাবধানেরর মার নেই। তাই মোবাইলটা নিয়ে গিয়ে সে নষ্ট করে ফেলে। সেদিনই আগে যেই বাড়িতে থাকতো, সেই বাড়িতেই গিয়ে ওঠে, বন্ধুদের জানায় বাড়ির মালিক বাড়ি বিক্রি করে হঠাৎ করে বিদেশ চলে যাওয়ায় সে বাড়ি থেকে চলে এসেছে। তাকে কিছুদিন থাকতে দিতে হবে। বন্ধুরা সানন্দে তাকে থাকতে দেয়। এভাবেই একটা খু*ন করার পরও সে দিব্যি নিশ্চিন্তে থাকে।’
কিংশুক ভাই থামলেন। আরিফ রেজা শুনছিলেন চুপচাপ। তার মুখ ঘামে ভিজে গেছে। তিনি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘আপনার গল্প সুন্দর, কিন্তু এই গল্প আমাকে শোনালেন কেন?’
‘গল্পটা আপনাকে শুনিয়েছি, কারণ গল্পটা আপনার জানা। তার উপর গল্পের একটা ব্যাপার আমি এখনো ধরতে পারিনি। ছেলেটা মেয়েটাকে খু*ন করলো কেন?’
‘আমি কিভাবে বলবো?’
কিংশুক ভাই মুচকি হেসে বললেন, ‘রেজা ভাই, আপনি কি মনে করেছেন সব কিছু না জেনে আর সব তথ্য প্রমাণ না নিয়েই আপনার কাছে এমনি এমনি আমরা চলে এসেছি। আপনি কি এখনো বুঝতে পারেন নাই যে আমরা পুলিশের লোক। এখন যেটা জানতে চাচ্ছি, সেটা সুন্দর করে বলে দেন। নাইলে কিন্তু বিপদে পড়বেন।’
আরিফ মুখের ঘাম মুছলেন। এরপর মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘সব যখন জেনেই গেছেন, তাহলে আর লুকানোর কিই বা দরকার। শাম্মীকে আমি ভালোবাসতাম না। শুধু ওর শরীরটার প্রতি একটু আকর্ষণ হয়েছিলো।ওর বাসায় গিয়ে থাকার প্ল্যানটাও আমার। জীবনে আমি শুধু ডেয়ারিং কাজ করতে চেয়েছি, থ্রিল ছাড়া জীবনে কিছু ভালো লাগতো না। ওর সাথে এভাবে লুকিয়ে লিভ-ইন করার যে চরম নিষিদ্ধ আকর্ষণ, এই আকর্ষণের বশেই ওর বাড়িতে গিয়ে থাকার রিস্কটা নিয়ে ফেলি।
কিন্তু বুঝলেন ভাই, মেয়েটা প্রেগন্যান্ট হয়ে গেলো। কোন কুক্ষণে অসাবধানতায় যে এই কাজটা হলো, বুঝতেই পারলাম না। আমি বললাম বেবিটা নষ্ট করে ফেলতে। ও রাজি হলো না। ওর জামাই সন্তান জন্মদানে অক্ষম, মনে হয় জানেন। ওর খুব বাচ্চার শখ, ও বেবিটা রাখবেই। আর বেবি রাখলে সব জানাজানি হয়ে যাবে। আমি সেটা চাচ্ছিলাম না। ওর সাথে সারাজীবন কাটানোর কোনো ইচ্ছাই ছিলো না আমার। কথাটা ওকে বলতেই পাগলের মতো শুরু করলো মেয়েটা। চিৎকার করা শুরু করলো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, বাইরের মানুষরা জেনে যাবে। তাই ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলাম। সেসময়েই এটাও ঠিক করে ফেললাম যে, ওকে আর বাঁচতে দেয়া যাবে না। ওর আর আমার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে কেউ জানতো না। ওর জামাই ওর কললিস্ট চেক করে, এমন একটা সন্দেহ ওর ছিলো। তাই জীবনে আমার নিজের সিম দিয়ে ওকে কলও করিনি। ভুয়া দুই নাম্বার একটা সিম দিয়ে ওকে কল করতাম। ওকে মেরে ফেললেও তাই কেউ আমার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না, এই বিশ্বাস আমার ছিলো। ওকে মারার প্ল্যানও করে ফেললাম।
আমি জানতাম জেগে থাকলে ওকে মারা যাবে না, চিৎকার করে করে ব্যাপারটা পন্ড করে দিবে। তাই ও সেইরাতে ঘুমিয়ে পড়লে বালিশচাপা দিয়ে ওকে খু*ন করে ফেললাম। তারপর আমার সব জিনিসপাতি নিয়ে সকালেই ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। আমার ধারণা ছিলো সব ঠিক মতোই হয়েছে, কেউ আমাকে ধরতে পারবে না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি নিশ্চয়ই কিছু ভুল করেছিলাম। নাহলে আমার পর্যন্ত তো পৌঁছানোর কথা না আপনাদের।’
সে আর কিছু বললো না। মাথা নিচু করে বসে রইলো। অত্যন্ত নিরীহ লাগছিলো তাকে দেখতে। তখন তাকে দেখলে কে বলবে, যে এই নিরীহ মানুষটার আড়ালে কি ভয়ংকর হিংস্র এক পশু লুকিয়ে রয়েছে?
***
সন্ধ্যা। ব্যস্ত নগরের মানুষগুলো ঘরে ফিরছে ধীরে ধীরে। রাস্তায় যানবাহনের মেলা। নগরের শত বাতি জ্বলে উঠেছে জোনাক পোকার মতো।
আমরা একটা কফি শপে বসে আছি। একটু আগেই থানা থেকে বেরোলাম। পুলিশের এফআইআরের সাক্ষি হয়ে এসেছি। আরিফ রেজাকে কাস্টডিতে নেয়া হয়েছে। শাম্মী ভাবীর বোন আর দুলাভাইকে খবর দেয়া হয়েছে। তারা রওনা দিয়েছেন চট্টগ্রাম থেকে।
আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে কিংশুক ভাইয়ের দিকে তাকাই। তিনি রাস্তায় তাকিয়ে গাড়ির ছুটে চলা দেখেন। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ভাই, আপনি কি করে বুঝলেন, যে আরিফ রেজাই দোষী?’
কিংশুক ভাই মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকান। এরপর বলেন, ‘কিভাবে আর। ক্লু মিলিয়ে খুঁজতে খুঁজতে ওকে পেয়ে গেলাম।’
‘কোন ক্লু?’
‘বলছি। তার আগে একটা কাজ করে দিতে হবে তোমাকে। আমার রহস্য সমাধানের কোনো রিপোর্ট আমার কাছে থাকে না। তুমি তো গল্প পড়ো। ফেসবুকেও নাকি লেখালেখি করো। আমার এই কেসের পুরোটা রিপোর্ট আকারে লিখে দিতে পারবে?’
‘সানন্দে।’
‘থ্যাংক ইউ। আচ্ছা, তাহলে প্রথম থেকেই বলি। যেদিন তোমাদের বাসায় গিয়ে প্রথম সিসিটিভি ফুটেজটি দেখছিলাম, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিলো। তোমার হয়তো মনে আছে, আমি শাম্মীর বেরিয়ে যাবার অংশটা দুবার দেখেছিলাম। এর কারণ হলো, ওর পা। আরিফ রেজা যদিও ঠান্ডা মাথায় সবকিছু করতে চাইছিলেন, কিন্তু আমার মনে হয় শেষ পর্যন্ত উনি মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেননি। একটা লাশের সাথে একই বাড়িতে থাকতে উনি ভয় পাচ্ছিলেন। তাই তাড়াহুড়ো করেই বেরিয়ে যান। তবে এই তাড়াহুড়োতে তিনি বেশ কিছু ভুল করে ফেলেন। প্রথম ভুল, তিনি পায়ে শাম্মীর জুতোর বদলে নিজের জুতো পরে যান। অবশ্য এটা ভুল নাও হতে পারে। শাম্মীর পায়ের মাপ আর তার পায়ের মাপ এক নয়। তিনি হয়তো পায়ে সবসময় মেয়েদের জুতো না পরে নিজের জুতোই পরতেন। শাম্মীর লম্বা পোশাকে পা’টা ঢাকা থাকতো, তাই হয়তো কেউ খেয়াল করতো না। আমিও দেখতে পেতাম না যদি না গেটের উঁচু অংশ পার হতে গিয়ে সে পা’টা না উঠাতো। সিসিটিভিতে তখনই আমি ছেলেদের জুতার সোল দেখলাম। জানিনা ওটা সকলের চোখ এড়িয়ে গেল কেন। আমি তখনই বুঝে ফেললাম, শাম্মীর ছদ্মবেশে যে যাচ্ছে, সে আসলে ছেলে, এবং অতি অবশ্যই শাম্মীর খু*নি।
তখন পর্যন্ত আমি মনে করেছিলাম শাম্মীর খু*নি কেবলমাত্র শাম্মীকে খু*ন করে তার ছদ্মবেশ নিয়ে পালিয়ে গেছে। সে যে শাম্মীর সাথে শাম্মীর বাড়িতেই থাকছিলো, এটা তখনও আমার মাথায় আসেনি। কিন্তু তার বাড়িতে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু ক্লু আমি পেয়ে যাই, যার জন্য এই ধারণাটা আমার মাথায় আসে।
প্রথমে, তাদের জুতোর কাবার্ডে ধুলোর মধ্যে একটা জুতোর ছাপ ছিলো। যেন এখানে একটা জুতো থাকতো, সেটা কিছুদিন আগে সরানো হয়েছে। জুতোর ছাপের সাইজ শাম্মীর অন্যান্য জুতোর থেকে বড়। তখনই বুঝলাম এটা শাম্মীর জুতো ছিলো না। তার হাজব্যান্ডের জুতোও না, যেহেতু তিনি তিনমাস দেশের বাইরে। তাহলে এটা নিশ্চয়ই খু*নির। এখন কথা হলো, কেউ খু*ন করতে এসে তো তার জুতা সুন্দর মতো কাবার্ডে সাজিয়ে রাখবে না। তারমানে, এখানে বিল্ডিংয়ের সবার অজান্তে কেউ কিছুদিন ছিলো।
দুই নাম্বার, আমি তাদের পোশাকগুলো শুঁকে দেখছিলাম, মনে হয় দেখেছো। আয়নায় কতোগুলো ছেলেমানুষের ঘরে পরা গেঞ্জি ছিলো। ধরলাম গেঞ্জিগুলো শাম্মীর বর টুটুলের। কিন্তু গেঞ্জিগুলো থেকে টাটকা ঘামের গন্ধ আসছিলো। টুটুল তো বাড়িতে নেই,আবার এমন না যে শাম্মী টুটুল যাওয়ার পর গেঞ্জি না ধুয়ে রেখে দিয়েছে। ওর ওয়ারড্রবটা খুলেই বোঝা যায় সে অত্যন্ত গোছানো মেয়ে। সব জামাকাপড় সুন্দর মতো ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রেখেছে। তাহলে কিছু গেঞ্জি আধোঁয়া অবস্থায় রাখবে কেন? তার মানে অন্য কেউ বাড়িতে থাকতো, যে গেঞ্জিগুলো পরতো।
তিন, বাথরুমে বেসিনের ওপরের র্যাকে আমি একটা ইউজ করা আফটার শেভ লোশন পেয়েছিলাম। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ওটা টুটুলের। কিন্তু চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে তোমার কাছ থেকে টুটুলের ছবি দেখার পর নিশ্চিত হলাম ওটা টুটুলের না। টুটুল তো দাঁড়ি রাখছিলো, ওর তো আফটার শেভ লোশন ব্যবহারের দরকার নেই। তারমানে, শেভিং ক্রিমটা অন্য কোনো পুরুষ মানুষের।
এসব ক্লু থেকে আমি মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম শাম্মীর খু*নি বেশ কিছুদিন লুকিয়ে লুকিয়ে শাম্মীর সাথে একই বাড়িতে থাকছিলো। কিন্তু কতোদিন? এ ব্যাপারটাও আমি ধরে ফেলি, যখন তুমি বললে, শাম্মী তার মুখ ঢেকে বের হওয়া শুরু করেছে একমাস হলো। সে তার কিন্ডারগার্টেনে চাকরিও পেয়েছে একমাস আগে, তার বাড়ির বুয়াকেও বিদায় করেছে একমাস আগে। সবকিছু মিলিয়ে বুঝতে পারলাম, একমাস ধরেই খু*নি শাম্মীর সাথে থাকছিলো। তাহলে এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, খু*নি কে?
শাম্মীর পরিচিত মানুষ বেশ কম। তার জামাই টুটুল রয়েছে, খোঁজ নিয়ে জেনেছিলাম তিনি আসলেই দুবাইতে আছেন, এই একমাসে দেশে আসেননি। তার মানে, তার এখানে এসে লুকিয়ে থাকার কথা না। এরপর শাম্মীর বন্ধু-বান্ধব। তার ছেলে বন্ধুর সংখ্যা কম, তারাও ফ্যামিলি ম্যান, একমাস তারা এদিক ওদিক কোথাও যাননি। সুতরাং তারাও বাদ।
বিল্ডিংয়ের লোকদেরও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দেয়া যায়। কারণ একই বিল্ডিংয়ে থেকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে শাম্মীর বাসায় তো থাকার দরকার নেই। তারা এমনিতেই তাদের অ্যাফেয়ার চালিয়ে নিতে পারতো, কেউ জানতেও পারতো না।
এবার সন্দেহের তালিকায় থাকলো তার ফেসবুক ফ্রেন্ড। শাম্মীর বোন বললো তার ফেসবুক আইডি ছিলো না। ফেইক আইডি থাকতে পারে, কিন্তু সেটা বের করা একটু সময়ের ব্যাপার। তার আগেই খু*নি কে এই ব্যাপারে আমি একটা ধারণা পেয়ে গেলাম।
চট্রগ্রামে পৌঁছে শাম্মীর বোনের চাচা-শ্বশুড়ের বাড়িতে গেলাম, জানোই তো। সেখানে গিয়েই তাদের ঢাকায় থাকা ছেলের ছবি দেখলাম দেয়ালে টাঙ্গানো একটা গ্রুপ ফটোতে। গ্রুপ ফটোতে ছেলেটার মা আর বোনের পাশে ছেলেটাকে দেখে ওর হাইট সম্বন্ধে একটা ধারণা হলো। হাইট দেখলাম শাম্মীর মতোই। ছেলেটা দেখতেও মনে হলো ফর্সা। তখনই একটু সন্দেহ হলো। এরপর বাড়ির মানুষের সাথে কথা বললাম। একটা সুবিধা হলো, আমি যে অনুসন্ধানে এসেছি এ কথাটা নিম্নি ওদের বললো না। তাই ওরা খোলামেলাভাবেই অনেক কথা বলে দিলো। ওর বোন শিল্পীর কাছেই জানতে পারলাম, একবার তার ভাই মানে আরিফ বাড়িতে আসার পর শাম্মীও বেড়াতে এসেছিলো বোনের বাড়ি। তখন তাদের পরিচয় হয়। গতমাসেও আরিফ বাসায় আসার পর শাম্মী এসেছিলো বোনের বাড়িতে। তখন তাদেরকে একবার কথাও বলতে দেখেছে ও। এবার আমার সন্দেহ পুরোপুরি আরিফের উপর পড়লো। ওর ঢাকার ঠিকানা আর কোথায় চাকরি করে জেনে নিলাম। ঢাকায় ফিরেই তোমাকে বাড়িতে রেখে এসে আমি গিয়েছিলাম বনানীর বাসায় খোঁজ নিতে। ওখানে গিয়েই শুনেছিলাম ও গত একমাস বাড়িতে ছিলো না, কয়েকদিন আগে আবার বাড়িতে এসে উঠেছে। ব্যস, আমার কালপ্রিটকেও আমি পেয়ে গেলাম।’
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে তখন নগরে। অদ্ভুত এক আঁধার। ক্লান্ত মানুষের চলাফেরা একটু কমে এসেছে রাস্তায়। আমাদেরও ওঠার সময় হয়েছে। আমি বললাম, ‘এমন জঘন্য কাজ কেন করতে গেলো তারা? একটু চেষ্টা করলেই কি জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারতো না?’
কিংশুক ভাই মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘পারতো। কিন্তু নিষিদ্ধ আকর্ষণ। তবে একটা কথা মনে রাখবা। দিজ ভায়োলেন্ট ডিলাইটস হ্যাভ ভায়োলেন্ট এন্ডস।’
সত্যিই তো। এই ভায়োলেন্ট ডিলাইটের জন্যই একটা প্রাণ ঝরে গেলো। আর দুটো প্রাণ হলো নষ্ট। একটা আরিফের, আরেকটা টুটুল ভাইয়ার। এই গল্পে কোনো ভূমিকাই যার ছিলো না।
(শেষ)
লেখা- সোয়েব বাশার