গল্প# ইটস্ মাই লাইফ
“অর্চি, তুমি দুই মাসে পঁচিশ কেজি ওজন কমাতে পারবে না?”
অর্চি হাসপাতালের কেবিনে বসে আছে।দুইদিন আগে ও ছেলে সন্তানের মা হয়েছে।একটু আগে বাচ্চা কোলে নিয়ে হাসিমুখে ছবি তোলার জন্য পোজ দিচ্ছিল।ওর ছোট বোন অবনী মোবাইল সামনে নিয়ে ওকে যখন ছবিগুলো দেখাচ্ছিল ও তখন হাসতে হাসতে বলছিল,
“ওহ্ গড! আমি কি মোটা হয়েছি!আমাকে একটা হাতীর মত লাগছে।”
অর্চির কথার রেশ ধরে ওর স্বামী আদনান লঘু স্বরে বোকার মত এই প্রশ্নটা করেই প্রমাদ গুনল।
স্বামীর এমন প্রশ্নে অর্চি বড় বড় চোখ মেলে আদনানের দিকে তাকাল। সে চোখে রাগ, ক্ষোভ,অভিমান এবং বিস্ময় ঝরে পড়ছে।
“মাত্র দুইদিন আগে বাচ্চা হলো, আর তুমি এখনই ওয়েট কমানোর কথা বলছ!তাও আবার দুই মাসে পচিশ কেজি!তোমার মাথায় এসব চিন্তা কীভাবে আসে?”
অর্চির পরিবর্তিত মুখের দিকে তাকিয়ে আদনান তাড়াতাড়ি বলে উঠল,
“ আয়াম সরি!ওজন কমাতে হবে না!একটুও কমাতে হবে না।ইউ আর জাস্ট পারফেক্ট।তুমি একদম ঠিক আছো। “
অর্চি জানে ও মোটেই পারফেক্ট বা একদম ঠিক নেই।একবছর আগে ওর ওজন ছিল পঞ্চান্ন কেজি।এই একবছরে চক্রবৃদ্ধি হারে সেটা বাড়তে বাড়তে আশি কেজিতে এসে পৌঁছেছে।
অর্চির থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে ওর ছোটবোন অবনী বলল,
“ আপু, তুমি ওয়েট নিয়ে ভেবো না তো।বড় আপু,ভাবী-সবাইকে দেখেছো না! প্রেগনেন্সির সময় কেমন মোটা হয়েছিল।বছর না ঘুরতেই আবার আগের শেইপে চলে এসেছিল।আফটার ওয়ান ইয়ার ইউ উইল অলসো বিকাম স্লিম অ্যান্ড হটি।”
অবনীর কথা বলার ধরনে সবাই হেসে উঠল।আদনান কিছু বলার আগেই ওর ফোন বেজে উঠল।কেবিনে ভালো নেটওয়ার্ক না থাকায় ও কথা বলতে বলতে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।আদনানের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে অর্চি বলল,
“ নারে ওয়েট না।আমার এইমুহূর্তে অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে বেশি টেনশন হচ্ছে।বাচ্চা নিয়ে হাসপাতাল থেকে সোজা আম্মুর বাসায় চলে যেতে পারলে আমার এত টেনশন হতো না।আমার শ্বশুর বাড়ি থেকো তো এখন আম্মুর ওখানে যেতে দিবে না।শ্বশুর বাড়িতে আমি একা কীভাবে বাচ্চা সামলাব সেই চিন্তায় আমার অস্থির লাগছে।আম্মু কত সুন্দর করে বাচ্চা হ্যান্ডেল করতে পারে!ভাবী ছিল,তুই ছিলি,আলো বুয়া ছিল।”
“কি আর করবে বলো! এটা হচ্ছে একমাত্র বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলের বউ হওয়ার প্যারা।তারউপর আবার ছেলে বাচ্চার মা হয়েছো। তাই ডাবল প্যারা, হিহিহি।এনি ওয়ে,আন্টি নিশ্চয়ই আয়ানের দিকে খেয়াল রাখবেন।প্রেগনেন্সির সময়ও তো তোমার দিকে অনেক খেয়াল রেখেছেন।তুমি টেনশন করো না।”
অবনীর কথায় “কী জানি“ বলে অর্চি ঠোঁট ওলটায়।
ওর মনে দোলাচলের অনুরণন।
চারদিনের ছোট্ট একরত্তি আয়ানকে কোলে নিয়ে হাসপাতাল থেকে সোজা শ্বশুরের ছয়হাজার স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে উঠল অর্চি যেখানে পরম ভালোবাসা দিয়ে একটা ঘর সাজানো হয়েছে চৌধুরী বাড়ির প্রথম সন্তানের জন্য।
প্রেগনেন্সির পাঁচ মাসের সময় আলট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট যখন পুত্র সন্তানের অস্তিত্ব জানান দিল তখন থেকেই থৈথৈ আনন্দে ভাসছে পুরো পরিবার।অর্চির প্রতি সবার ভালোবাসা, যত্ন কয়েক হাজারগুণ বেড়ে গেল।পাঁচ বেডরুমের সবচাইতে বড় রুমটা ইন্টেরিয়র ডেকোরেটরের সাহায্যে সেজে উঠল আকাশী নীলে।
অর্চি তখনই বুঝে ফেলেছিল বাচ্চা হবার পর মা’র কাছে চল্লিশ দিন থাকার ব্যাপারটা এরা কিছুতেই মেনে নেবে না।তারপরও ক্ষীণকন্ঠে একবার বলেছিল।শাশুড়ি তৎক্ষণাৎ নাকচ করে দিয়েছে অর্চির প্রস্তাব।ওর কাঁধে হাত রেখে মৃদু্ হেসে বলেছেন,
“ আমি থাকতে মা’র কাছে কেন?আমি মা’র মতই আগলে রাখব তোমাকে,তোমার ছেলেকে।আমার একমাত্র ছেলের বাচ্চাকে আমি তুলায় মুড়ে রাখব।”
শাশুড়ির এই আশ্বাস যে স্রেফ ফাঁকা আওয়াজ এটা বাচ্চা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসার সাতদিনের মধ্যেই অর্চি হাড়ে হাড়ে টের পেল।ওনার ভালোবাসা শুধু বাচ্চা কোলে নিয়ে আহ্লাদি গলায় “ আমার জান, আমার কলিজা, আমার পাখী,আমার সোনা-মানিক, সাত রাজার ধন-এরকম অনেক মিষ্টি সম্ভাষনে আনন্দঘন একটি পরিবেশ তৈরী করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।বাচ্চা কাঁদলে উনি অসহায় ভঙ্গী করে তাড়াতাড়ি অর্চির কোলে দিয়ে দেন।রাতে বাচ্চা কাঁদলেও উনি অর্চির রুমের ধারে কাছে আসেন না।
অর্চি যখন বলল,
“মা, আয়ানকে গোসল করানোর সময় আপনি যদি একটু দেখিয়ে দিতেন? প্রথম গোসল করাবো, তাই ভয় লাগছে ,যদি কানে-টানে পানি চলে যায়!”
উনি শঙ্কিত হওয়ার অভিনয় করে হাসতে হাসতে বললেন,
“ ওরে বাবা!এত ছোট বাচ্চা আমি কখনো গোসল করাইনি।আমার আদনান, আমরিনকে ওর নানীই পেলে-পুষে বড় করেছেন।”
বাড়ির গৃহকর্মীদের ওপরও ভরসা করতে না পেরে আদনানের বড় খালাকে ডেকে আনা হলো।
বড় খালা দক্ষ হাতে গোসল করাতে করাতে বললেন,
“ভালো করে দেখে রাখো।তোমার শাশুড়ির ভরসায় থেকো না।তোমার শাশুড়ি হচ্ছে আহ্লাদের ঢিপি,ও তো বাচ্চা হওয়ার পর প্রথম পাঁচ মাস বাপের বাড়ি ছিল।কিচ্ছু করে নাই।শ্বশুর বাড়িতেও কিচ্ছু করা লাগে নাই।শাশুড়ি, দাদী শাশুড়ি সব করত।”
খালার কথা বলার ধরনে অর্চি হাসতে লাগলো।খালাও হাসলেন।
“ তোমার জামাইর কি অবস্থা?তাকেও যেমন তুলু তুলু করে বড় করেছে ,সেতো নিজেকে এখনো বাচ্চাই ভাবে।তা আমাদের আদনান, আমাদের আদু কী করে?”
খালার গলায় ঠাট্টার সুর।অর্চি একগাল হেসে কৌতুকপূর্ণ গলায় বলল,
“ও তো কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।অফিস থেকে ফিরে কিছুক্ষণ দোলনায় দোল দিয়ে বাচ্চার সাথে খেলে।মাই বয়,আমার জান বাচ্চা, কবে বড় হবে,ফুটবল খেলবে আমার সাথে-এরকম আগডুম বাগডুম কথা বলে রাত এগারটায় ঘুমাতে চলে যায়।ওর ঘুম গভীর। পাশের রুম থেকে বাচ্চা কাঁদলেও ও কিছু টের পায় না।”
“হুম, সব তোমাকে একা হাতে করতে হবে।বুঝতে পারছো?”
“ভালোই বুঝতে পারছি।”
হাসিমুখে খালাকে এই কথাটা বললেও কিছুদিনের মধ্যেই ওর সব হাসি মিলিয়ে গেল।সারাক্ষণ মগজ দখল করে রাখে একটা চিন্তা ;ছোট্ট একটা শিশুকে একা হাতে বড় করার চিন্তা।সাথে আছে ভালো মা হওয়ার চ্যালেঞ্জ।
নতুন জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করতে করতে নিজেকে ভুলে গেল অর্চি।
তবে রাতে বাচ্চাকে ঘুম পাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে কখনো দীর্ঘশ্বাস ফেলে অর্চি ভাবে তার ফেলে আসা স্বাধীন জীবনের কথা, ক্যারিয়ারের আনন্দময় এক বছরের কথা।নীল ডিম লাইটের আলো ছড়ানো রুমে যখন ঢুকে পড়ে নীলাভ জোছনা তখন এক টুকরো নীল বিষাদও ঢুকে পড়ে ওর মনের কোণে।
ভোরের আলো ফোটার পর যখন বাচ্চা ঘুমায় তখন ও ঘুমাতে যায়।মধ্যদুপুরে ঘুম থেকে ওঠে।বাচ্চাকে কখনো শাশুড়ির কাছে, কখনো গৃহকর্মীর কাছে দিয়ে বাচ্চার সামনে বসে হুড়ুস-ধাড়ুস করে খায়।বাথরুমে যাওয়ার সময়টুকু ছাড়া বাচ্চাকে চোখের আড়াল করে না।
এইভাবে দিন বয়ে যেতে লাগল আরেকটা দিনের দিকে।ক্যালেন্ডার বদলে গেল।দুই বছরের দুরন্ত, লিকলিকে স্বাস্থের আয়ান এখন ঘরময় ছুটে বেড়ায়।কিন্ত ভীষণ মা নেওটা বলে কিছুক্ষণ পরেই অর্চির কাছে ছুটে আসে।এদিক ওদিক তাকিয়ে অর্চিকে না দেখলে ‘মাম্মা,মাম্মা ‘ বলে ভ্যা করে কান্না জুড়ে দেয়।অর্চি যখন কিচেনে আয়ানের জন্য এটা ওটা বানাতে ব্যস্ত থাকে তখনো আয়ান অর্চির পায়ে পায়ে ঘোরে, ও যখন শাওয়ার নিতে বাথরুমে ঢোকে তখন আয়ান দরজার সামনে খেলনা নিয়ে বসে থাকে।একটু পর পর দরজায় ধাক্কা দেয়।অর্চি ভেতর থেকে বলে ওঠে,
“ আসছি আব্বু, আর পাঁচ মিনিট।”
অতন্দ্র প্রহরীর মত এমনভাবে ও আয়ানকে পাহারা দিয়ে রাখে যেন আয়ানের থেকে এক মুহূর্তের জন্য দূরে গেলে ভয়ানক কোন দূর্ঘটনা ঘটে যাবে।
মা-ছেলের কান্ড-কারখানা দেখে বেড়াতে আসা বড় খালা বলেই ফেললেন,
“ছেলে তো মা ছাড়া কাউকে চেনে না।কেউ তাকালেও কাঁদে।আদুর ছেলে গেদু হয়েছে।”
“খালা, ওতো এখনো ছোট।আরেকটু বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
আত্মপক্ষ সর্মথনের ভঙ্গীতে হেসে বলে অর্চি।
“তোমার ছেলে এখন যথেষ্ট বড়।ওকে তোমার শ্বাশুড়ির কাছে দিয়ে সেজে-গুঁজে আদনানের সাথে ঘুরতে যাবে।আদনানকে সময় দিবে।সারাক্ষণ এত মা মা ভাব নিয়ে থাকলে চলবে? একটু নিজের দিকে তাকাও।নইলে কিন্ত আদু অন্যদিকে চলে যাবে।”
“আপনাদের আদু সেরকম মানুষ নয়।”
“আদনান খুব ভালো ছেলে।তোমাকে খুব ভালোবাসে। সবই বুঝলাম,কিন্ত
পুরুষ মানুষের কোন বিশ্বাস নেই।”
খালার কথায় অর্চির মনে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে। সে ছায়া গাঢ় হয় দিন দুয়েক পরে বাবার বাসায় বেড়াতে গিয়ে ।
চলবে…………
গল্প# ইটস্ মাই লাইফ
( ২য় পর্ব)
দু’দিন পর বাবার বাড়িতে অর্চির
পা পড়তেই সবাই হৈচৈ করে উঠলো।
অবনী হাত নেড়ে বলল,
“হাই আয়ান!”
ভাবী আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“হ্যালো কিউটি পাই!”
আয়ান যথারীতি অর্চির বুকে মুখ লুকালো।
“তোমার খালা শাশুড়ি ঠিকই বলেছে আদুর ছেলে গেদু, হি হি হি।”
অবনীর কথা বলার ভঙ্গীতে অর্চিও হাসতে লাগলো।
অর্চির বড় বোন অপলা আয়ানের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছিলো।অর্চির দিকে চোখ পড়তেই ওর কপালে ভাঁজ পড়লো।মা হওয়ার দুই বছরেও কেন যে মেয়েটা নিজেকে গুঁছিয়ে নিতে পারলো না!এখনো স্থূল শরীর,অবিন্যস্ত চুল, প্রসাধনহীন বিবর্ণ মুখ।অর্চির দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক গলায় বললো,
“এই যে গেদুর মা, এবার একটু নিজের দিকে তাকা।নইলে গেদুর বাপকে অন্য কেউ হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে।একটু পার্লারে যাওয়া শুরু কর।হেয়ার স্টাইল চেইঞ্জ কর,ফেসিয়াল-টেসিয়াল কর।বাচ্চা হলে নিজের লাইফের সব আনন্দ স্যাক্রিফাইস করে ফেলতে হবে-এমন কথা কোথাও লেখা নেই।”
“অপলা ঠিকই বলেছে।ব্যালেন্স করে চলতে হয় অর্চি।”
ভাবী এ কথা বলতে বলতে চা-নাস্তার জোগাড়-যন্ত্র করতে উঠে গেল।
অর্চি কিছু বলার আগেই অপলা আবার বললো,
“ আর দুই বছরেও তুই ওজন কমাতে পারলি না! এখনো কীরকম ধুমসি হয়ে আছিস।তোকে তো আদনানের পাশে এখন ওর চাইতে বয়স্ক লাগে।”
“আই অবজেক্ট, এখানে ভয়ানক রকম বডিশেমিং করা হচ্ছে।”
অবনী তর্জনী উঁচু করে হাসতে হাসতে বললো।
অর্চিও হাসছে।বড় আপার স্ট্রেট ফরোয়ার্ড কথায় ও ছোটবেলা থেকেই অভ্যস্ত।রুঢ় সত্য কথা কী নির্বিকারভাবে বলে ফেলে! আয়ানের জন্মের পর অর্চির শাশুড়ির আদিখ্যেতা নিয়ে ও কথা তুলতেই ঝংকার দিয়ে অপলা বলে উঠেছিলো,
“উনি কোলে নিয়ে যে সোনা, যাদু,মানিক বলে আদর করেন সেটাই কম নাকি!তোর ছেলে যে দাদা-দাদীর আদর পাচ্ছে তার জন্য শুকরিয়া আদায় কর।আমার বাচ্চারা তো দাদা-দাদীকে দেখে নাই, দাদা-দাদীর আদর কী জিনিষ জানেও না।”
এবারও অবনীকে ধমক দিয়ে বলে উঠলো,
“তুই চুপ কর।বেশী পাকামি করবি না।কীসের বডিশেমিং!এরকম ওজন নিয়ে থাকলে অল্প বয়সে অসুখ-বিসুখে ধরবে।আমি যা বলছি ওর ভালোর জন্যই বলছি।ওর সংসারেও ঝামেলা চলছে ,এটা দেখে তো চুপ থাকতে পারি না।”
“আমার সংসারে আবার কীসের ঝামেলা?”
অর্চি বিস্মিত হয়ে বললো।
অপলা একটু চুপ থেকে নিচু গলায় বললো,
“কয়েকদিন আগে তানিশ বুটিকসে গিয়েছিলাম।সেলসম্যান বিপ্লব বললো অর্চি আপুর হাজবেন্ড এসেছিলো।পনের হাজার টাকা দিয়ে একটা হালকা গোলাপি রঙয়ের জামদানি কাজের মসলিন শাড়ি কিনে নিয়ে গেছে।”
“ ওহ্! এই জন্যই সেদিন ফোনে জানতে চাইছিলে আদনান আমাকে কোনো শাড়ি গিফট করেছে কী না।সেদিন তো এসব কিছু বলোনি।”
“তুই যখন ‘না’ বললি তখনই বুঝেছিলাম ডাল মে কুচ কালা হ্যায়।তারপরও তোকে কিছু বলতে চাইনি।কিন্ত এখন মনে হচ্ছে তোর জানা দরকার।খোঁজ নিয়ে দ্যাখ কার জন্য শাড়ি কিনেছে।”
অর্চির মুখ গম্ভীর হয়ে গেল।ও কী বলবে ভেবে পেল না।
ওর অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে
অবনী বললো,
“ আদনান ভাইয়া হয়ত তোমাকে সারপ্রাইজড করতে শাড়ি কিনেছেন।”
অবনীর কথায় অর্চির মুখে স্বাভাবিক হাসি ফিরে এলো।
“ আমারও তেমনই মনে হয়।আদনানকে তো আমি জানি।আই ক্যান রিড হিম লাইক আ্যান ওপেন বুক।ও কোনও ডিপ্লোম্যাসি জানে না, ইমোশন হাইড করতে পারে না।যখন যা মনে হয় অবলীলায় বলে ফেলে।ওর কোথাও কোনও কিছু থাকলে আমি এতদিনে জেনে যেতাম।শাড়িটা নিশ্চয়ই আমার জন্যই কিনেছে।পাঁচদিন পরই তো আমার বার্থ ডে।”
“ এটাই যেন সত্যি হয়। তবে এবার একটু নিজের দিকে তাকা বনু।একটু ব্যালেন্স করে চলতে শিখ।বাচ্চা, বাচ্চা করে নিজের জীবন কুরবান করে দিস না।বাচ্চা বড় হলে তোর স্যাক্রিফাইসের এক কানা কড়ি দামও দেবে না।দিন শেষে যার যার লাইফ তার তার।”
অর্চি সেদিন বাড়ি ফিরে আদনানের ওয়ারড্রোব তন্নতন্ন করে খুঁজেও শাড়িটা না পেয়ে প্রচন্ড হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো।পরদিন সকালে তানিশ বুটিকসের সেলসম্যান বিপ্লবকে ফোন করতেই ও অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন করলো,
“আপা, শাড়ি পছন্দ হইছে?”
“ পছন্দ হয়েছে।খুব সুন্দর শাড়ি।”
অর্চি শুকনো মুখে বললো।
ওপাশ থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল।
“আমি জানতাম আপনার পছন্দ হবে।ভাই যখন বললো আপনার প্রিয় লাইট পিংক কালারের শাড়ি দিতে তখন আমি এই শাড়িটা দিছি।আপা সামনের সপ্তাহে আমাদের নতুন কালেকশন আসবে।আইসেন।”
অর্চি ফোন রেখে ঝিম মেরে বসে রইল।
মনের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে সন্দেহের কালো মেঘ।তবুও কেন যেন হিসাবটা মিলছে না।শুধু মনে হচ্ছে কোথাও ভুল হচ্ছে।আদনান এখনো অফিস থেকে ফিরে অর্চির কাছ ঘেঁষে বসে,গল্প করে,সারাদিনের কাজের ফিরিস্তি দিতে দিতে উচ্চস্বরে হাসে।অর্চির প্রতি ওর তীব্র আকর্ষণ, ভালোবাসাটা ও টের পায়।
অর্চির জন্মদিনের আগের রাতেও আদনান ওর পাশে বসে গল্প করছে, অর্চি ভেতরে ভেতরে অপেক্ষা আর টান টান উত্তেজনা নিয়ে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে ওর গল্প শুনছে,ঘড়ি দেখছে।বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করছে হৃদপিন্ডটা।
এগারোটা বাজতেই লজ্জিত ভঙ্গীতে ‘একটু আসছি, এক মিনিট’ বলে বেরিয়ে গেল আদনান।
কয়েক মিনিট পর এক হাতে একগুচ্ছ রজনীগন্ধা আর এক হাতে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের একটা ব্যাগ নিয়ে রুমে ঢুকলো।অর্চির দিকে তাকিয়ে হুড়মুড় করে বললো,
“হ্যাপি বার্থ ডে! ঘুম পাচ্ছে তো।তাই বারোটা বাজার আগেই দিয়ে দিলাম।”
আদনানের বাড়িয়ে দেওয়া হাত থেকে গিফট নিতে নিতে মুখ ফসকে অর্চি বলে ফেললো,
“শাড়িটা কোথায়?”
“ওহ্ হো! শাড়ির কথাতো ভুলে গিয়েছিলাম।গাড়িতেই রয়ে গেছে।আসছি।ওয়েট আ সেকেন্ড।”
বলে ঝড়ের গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
কয়েক মিনিট পর শাড়ির প্যাকেট হাতে আবার ঝড়ের গতিতে ফিরে এলো।
অর্চি ব্যস্ত ভঙ্গীতে শাড়ির প্যাকেট খুললো,হালকা গোলাপী রঙয়ের জামদানী কাজের মসলিন শাড়িটার দিকে হাত বুলিয়ে আনন্দের আবেগে বলে উঠলো,
“কী সুন্দর শাড়ি! থ্যাঙ্ক ইউ।”
অস্ফুট স্বরে বললো,
“জানতাম।”
“কি জানতে? আচ্ছা.. শাড়ির কথা তুমি কীভাবে জানলে?”
অর্চি হাসতে হাসতে শাড়ির নেপথ্যের কাহিনী বললো।আদনান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
“আস্তে!আয়ানের ঘুম ভেঙে যাবে।”
“চলো বারান্দায় গিয়ে বসি।আজকে কিন্ত ফুল মুন।”
আদনান ফিসফিস করে বললো।
“এই না বললে ঘুম পাচ্ছে!”
অর্চির কথায়
আদনান
আবারো হাসলো।
জোস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর।সে জোস্না ভালোবাসার ঘোর তৈরী করে।ভালোবাসার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে মুখোমুখি বসে আছে দু’জন।
“দাঁড়াও,একটা জিনিষ দেওয়া হয়নি।”
“আবার কী?”
“আসছি,আসছি।”
একটু পর হাতে একটা কার্ড নিয়ে ঢুকলো আদনান।লাজুক,বোকা-বোকা হেসে বললো,
“সাজিয়ে-গুছিয়ে ,কথা-টথা তো আমার আসে না।এই কার্ডে কিছু কথা লিখেছি।”
কার্ডে গোটা গোটা হরফে লেখা,
“আয়ানের আম্মু,আই লাভ ইউ কথাটা তো অনেক বার বলেছি।কিন্ত কখনো বলা হয়নি যে তুমি যা করেছো তার জন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ।তুমি কী অসীম ধৈর্য্য, একাগ্রতা নিয়ে একা হাতে বাচ্চা সামলাচ্ছো!আমাকে সামলাচ্ছো।আমি তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নিজের দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে গেলাম।থ্যাঙ্কস ফর এভরিথিং।”
অর্চি আদনানের দিকে চোখ তুলে তাকালো।সে চোখে খেলা করছে ভালোবাসার প্রগাঢ় ছায়া।হাত বাড়িয়ে আদনানের হাত ধরে গাঢ় স্বরে বললো,
“আই লাভ ইউ।”
“ আই লাভ ইউ টু গেদুর মা।অপলা আপুকে বলবা গেদুর মা’র ওজন নিয়ে গেদুর বাপের কোন সমস্যা নাই।হুরপরী নেমে আসলেও গেদুর বাপকে কেউ গেদুর মা’র থেকে হাইজ্যাক করে নিতে পারবেনা।”
আদনানের কথায় অর্চি খিলখিল করে হাসে।
গল্প# ইটস্ মাই লাইফ
(শেষ পর্ব)
অর্চি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে সুন্দর করে সেজেছে।জন্মদিনে আদনানের উপহার দেওয়া হালকা গোলাপী রঙয়ের মসলিন শাড়িটা পরেছে।গলার সোনার চেইনে পরেছে আদনানের দেওয়া হিরের পেনডেন্ট,কানে পরেছে একই ডিজাইনের হিরের দুল।আলো পড়তেই সেখান থেকে ঠিকরে বের হচ্ছে হিরকদ্যুতি।
আদনানের সাথে ও এসেছে আদনানের বন্ধু ফরহাদের ছেলের জন্মদিনে।বাড়ির ছাদে বেশ জমকালো আয়োজন।ওদেরকে দেখে ফরহাদ ও ফরহাদের স্ত্রী এগিয়ে এলো।ফরহাদের স্ত্রী কানিজ অর্চিকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক ভঙ্গীতে বললো,
“কতদিন পর ভাবীকে দেখলাম!বাচ্চা হওয়ার পর ভাবী সব জায়গায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন।”
আয়ানের রুগ্ন স্বাস্থ্যের দিকে ইঙ্গিত করে ফরহাদ ঠাট্টার সুরে বললো,
“বাচ্চার স্বাস্থ্যের এই অবস্থা কেন?বাচ্চার মায়ের স্বাস্থ্য দেখে মনে হচ্ছে বাচ্চার সব খাওয়া বাচ্চার মা একাই খেয়ে ফেলে।হা হা হা।”
জবাবটা যেন অর্চির ঠোঁটের ওপর বসেছিলো।একটুও অপ্রতিভ না হয়ে ও বললো,
“আল্লাহ!আপনি কি করে জানলেন! বাচ্চার সব খাওয়া আসলেই আমি একা খেয়ে ফেলি।”
নিজের রসিকতায় নিজেই হাসলো।
এরপরও আদনানের সাথে অনেক জায়গায় গিয়েছে।সবজায়গাতেই ইনিয়ে-বিনিয়ে অর্চির ওজন নিয়ে প্রশ্ন।ওর ওজন নিয়ে সবার কেন এত মাথা ব্যথা এটা ওর মাথায় আসে না।
এভাবেই মাস গেল, অতিক্রান্ত হলো আরেকটি বছর।
ঘনিয়ে এলো তিনবছরের আয়ানের স্কুলে যাবার দিন।আগের রাতে টেনশনে অর্চির ঘুম এলো না।ওর সব আশংকাকে সত্যি প্রমান করে স্কুলের গেটের সামনে আয়ান গলা ফাটিয়ে চীৎকার করে কাঁদতে লাগলো।ও কিছুতেই স্কুলে যাবে না।বারবার বলছে,”মাম্মা, তুমি সাথে চলো।”ভয়ে অনেক বাচ্চাই কাঁদছে।কিন্ত হাত-পা ছুঁড়ে আয়ানের বিকট চীৎকারের কান্না সব বাচ্চার কান্নাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে।স্কুলের চারজন আয়া আয়ানকে চ্যাংদোলা করে ভেতরে নিয়ে গেল।
স্কুলের বাইরে কোনো বসার জায়গা নেই, কোনো ছাউনি নেই।গাছের ছায়ার নিচে ভয়ার্ত মুখে অনেক বাচ্চার মা’র সাথে অর্চিও দাঁড়িয়ে থাকে।
প্রতিদিন সকালে স্কুল গেটের সামনে একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে।আয়ানের মত প্লে-গ্রপের কিছু বাচ্চা গেটের সামনে হাউমাউ করে কাঁদে, জোর করে তাদের ভেতরে নেওয়া হয়।তবে অনেক মায়েরা ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হয়ে গেল।স্কুলে বাচ্চাকে নামিয়ে দিয়ে তারা দল বেঁধে এদিক ওদিক ঘুরতে চলে যায়।অর্চি কোথাও নড়ে না।গেটের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।প্রচন্ড গরমে গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়িয়েও ঘামতে থাকে।তার মত আরো কয়েকজন মাকেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।অনেকের সাথেই পরিচয় হয়।চশমা পরা রাইফের আম্মু একদিন ওকে জিজ্ঞেস করলো,
“ আপনার কি লেট ম্যারেজ নাকি বেশী বয়সে বাচ্চা নিয়েছেন?
“আয় হায়! এটা কী বললেন ভাবী?”আমাকে কী অনেক বয়স্ক মনে হয়?”
আয়াম টুয়েন্টি এইট,পঁচিশ বছরে বাচ্চার মা হয়েছি।”
“সরি, বুঝতে পারিনি। আমি ভেবেছি চল্লিশ-টল্লিশ হবে।”
অপ্রস্তত গলায় বললেন মহিলা।
অর্চি ম্লান হাসে।
দেড়মাস পর আয়ানের কান্নাকাটি বন্ধ হলো।স্কুলের সামনে গাড়ি থামলে কান্নার বদলে ওর মুখ আনন্দে ঝলমল করে ওঠে।গাড়ি থেকে নেমে একছুটে স্কুলের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
অর্চি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।স্কুলের ভাবীদের একটা দলে অর্চিও ঢুকে পড়লো।আয়ানকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে ও কখনো শপিং মলে যায়,কখনো ফাস্টফুড শপে বসে গল্প করে,কখনো লেকের পাড়ে বসে চা খায়।অনেকদিন পর ও যেন পেল স্বাধীনতার আনন্দময় শিহরন।তবে ভালো লাগার আমেজ মাস খানেকের মধ্যে মিলিয়ে গেল ভাবীদের পরচর্চা ও ফুটানির গল্প শুনতে শুনতে।
স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ‘দ্য শেপস ইউ ওয়ান্ট’ নামে ঝা-চকচকে ফিটনেস ক্লাবটাকে প্রতিদিন দেখে অর্চি।একদিন আয়ানকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সেখানে ঢুকে পড়লো।রিসেপশনিস্ট মেয়েটা মধুর হাসি হেসে ওর সাথে কথা বললো, ওর সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে একপর্যায়ে বললো,
“আসুন, আপনাকে আমাদের জিমটা দেখাই।”
অর্চি ঘুরে ঘুরে দেখলো।বিশাল বড় জিমটা খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো।সবজায়গায় ছড়িয়ে আছে এয়ার ফ্রেশনারের আলট্রা ফ্রেশ সৌরভ।এ্যারোবিকস রুমে চল্লিশ/পঞ্চাশ জনের একটা দল ‘ড্যান্স অন দ্যা’ ফ্লোর গানের সাথে স্বতঃস্ফুর্তভাবে নাচছে।পাশের রুম থেকেও হাই ভল্যুমে ভেসে আসছে গান, অর্চি মুখ বাড়িয়ে দেখে মেদহীন শরীরে ছন্দ তুলে মেয়েদের একটা দল ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে, ঝর্নার মত কলকল করে হাসতে হাসতে সাইক্লিং করছে আরেক দল মেয়ে।জীবনের সজীব, টাটকা হাওয়া ঝাপটা দিয়ে যায় ওর মনে।অর্চির খুব ভালো লেগে যায় জিমের পরিবেশ।আগামী মাসে জিমে জয়েন করার ফাইনাল কথা বলে ও চলে এলো।
পরের মাসে চাপা একটা রোমাঞ্চ নিয়ে জিমে আসে অর্চি। একটা অস্বস্তিও ওকে ঘিরে রেখেছে।জিমের বেশিরভাগ মেয়ে যেন ভিনাসের প্রতিমূর্তি,ধনুকের মত টানটান তাদের শরীর।জিম রুমে ঢুকতে ঢুকতে ও জিম ইন্সট্রাক্টর শিলাকে বললো,
“এখানে আমি মনে হয় সবচেয়ে মোটা।”
“কী যে বলেন আপু!আপনার ওয়েট তো আশি কেজি। অনেক আপু আছে যাদের ওয়েট একশো কেজির ওপরে।কয়েকদিন আসলেই দেখতে পাবেন।আপনাকে যে ডায়েট চার্টটা দেওয়া হয়েছে, ওটা ঠিকমত ফলো করলে ছয়মাসে আগের শেইপে চলে যাবেন।”
বেশিরভাগ মেয়ে কানে হেডফোন গুঁজে শরীরচর্চায় ব্যস্ত।অর্চি ওয়ার্মআপ করে ট্রেডমিলে ওঠে।ওর পাশের ট্রেডমিলের মেয়েটির সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতে খুব সপ্রতিভ ভাবে মেয়েটি বলে ওঠে,
“হাই!”
মেয়েটির শাণিত চেহারা,অসাধারণ দেহবল্লরী।খুব কথা বলে, খলবল করে হাসে।অর্চির মনে হলো ওর চাইতে হয়ত তিন/চার বছরের বড় হবে।মেয়েটির নাম কবিতা। খুব অল্প সময়েই অর্চির সাথে কবিতার বন্ধুত্ব হয়ে গেল।ও অর্চিকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কিছু করো?”
এ প্রশ্নে অর্চির মুখে ছায়া জমলো।
নিস্প্রভ গলায় বললো,
“না, এখন তো কিছু করি না।একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে এক বছর কাজ করেছিলাম।প্রেগনেন্সির সময় কিছু কমপ্লিকেসি দেখা দিয়েছিল।ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়ে দিয়েছিলো।তাই জবটাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।”
“ তাতে এতো মন খারাপের কী আছে? আবার জব করবে।”
উৎসাহী গলায় বললো কবিতা।
“আপনি কিছু করেন?”
“আমাদের ফ্যামিলি বিজনেস দেখি, হাজবেন্ডের সাথে ওর অফিসে বসি।জিম থেকে শাওয়ার নিয়ে সোজা অফিসে চলে যাবো।”
“বাচ্চা কোন স্কুলে পড়ে?”
অর্চির এ প্রশ্নে কবিতা যে উত্তর দিল তাতে অর্চির মুখ হাঁ হয়ে গেল।বিস্ময় গোপন করতে না পেরে ও বলেই ফেললো,
“ আপনাকে দেখে তো কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই যে আপনার মেয়ের বিবিএ কমপ্লিট হয়ে গেছে।বিয়ের কথা চলছে।ছেলে বুয়েটে পড়ে।ইউ লুক সো ইয়াং!কীভাবে নিজেকে ধরে রেখেছেন? রহস্য কী?”
এ কথায় কবিতা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে বলে,
“রহস্য কিছু নেই।জিম,ডায়েট-এসব তো আছেই।তবে সবচাইতে যেটা ইর্ম্পটেন্ট সেটা হচ্ছে আমি জীবন ভালোবাসি,চারপাশের মানুষগুলোকে ভালোবাসি।খুব হাসি এবং হাসাই।তবে কারো কাছ থেকে কিছু এক্সপেক্ট করি না।এই পয়তাল্লিশ বছরে আমি কখনো স্ট্রেস নেইনি।ডিপ্রেসনের ভূতকেও কখনো মনের ভেতর ঢুকতে দিইনা,ঢোকার পায়তারা করলে স্বামী,পুত্রকন্যা সাথে নিয়ে ডিএসএলআর ক্যামেরা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি।Nature is the best healer.”
অর্চির বিস্ময় ফুটে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে আরো যোগ করলো,
“আমাদের দেশের বেশীরভাগ মেয়েরা নিজের সাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছেগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে।আমি কখনোই তা করিনি।জীবনটা খুব ছোট।আমি প্রতিটা দিন,প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করি।”
একটু পর জিম ইনস্ট্রাক্টর শিলা পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
“কবিতা আপু, আপনার প্রিয় গান কী এখনই বাজাবো?”
কবিতা চনমনে গলায় বললো,
“অবশ্যই।কী সব গান এতক্ষণ বাজাচ্ছিলে!গান শুনে ঝিমুনি আসছে।”
একটু পর হাই ভল্যুমে বেজে উঠলো জন বন জোভির ইটস্ মাই লাইফ।
অর্চি ট্রেড মিলের গতি কমিয়ে ওয়াটার পট থেকে পানি খেতে খেতে বললো,
“এটা আপনার খুব প্রিয় গান?”
“খুউব।প্রতিদিন একবার আমি শুনি।একেবারে রির্চাজড হয়ে যাই।এই গানটা খুব এর্নাজাইড করে বুঝলে।বিশেষ করে গানের চারটা লাইন শুনলে অন্য রকম ফিলিংস হয়,I got goosebumps.”
“আমি তো আপনার কথা শুনেই এর্নারাইজড হচ্ছি।এই গান আগে কতবার শুনেছি, এমন ফিলিংস আগে হয়নি।”
একবছর পরের কথা।
অর্চি আয়ানের স্কুলে টিচার হিসেবে জয়েন করেছে।পঁচিশ কেজি ওজন কমিয়ে ও এখন আগের মত ছিপছিপে,ধারালো।সকালে সম্ভব হয় না ,তাই বিকেলে জিমে যায়।কবিতা আপুর সাথে ছুটির দিন ছাড়া জিমে দেখা হয় না।দেখা হলেই অর্চির মন ভালো হয়ে যায়।একজন মানুষ তার উচ্ছাস, হাসি, পজিটিভি,জীবনবোধ কী দারুণভাবেই না ছড়িয়ে দেন অন্য মানুষের মাঝে!
অর্চিও একবার পাওয়া ছোট্ট জীবনের প্রতিটি মুহর্ত, প্রতিটি দিন উপভোগ করার মন্ত্রটা এখন জানে।
উদ্দাম সঙ্গীতে যখন গমগম করে ওঠে ‘দ্য শেপস ইউ ওয়ান্ট’জিমের পুরো রুম,তখন ভীষণ উদ্দীপ্ত অর্চির চোখেমুখে খেলে যায় প্রাণের স্ফুরণ।গুনগুন করে ও গেয়ে ওঠে,
“It’s my life
And it’s now or never
I ain’t gonna live forever
I just want to live while I’m alive.”
“””””””””””””””””””””””””””””””””
END