- বড়দের রোমান্টিক গল্প আড়ালে কে সম্পূর্ণ গল্প
- শারীরিক প্রেমের গল্প
- বড়দের জন্য গল্প
- ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প
- অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প
১.বড়দের রোমান্টিক গল্প আড়ালে কে
ফিল্টার ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখলাম তানভির অহনাফ নামের একটা আইডি থেকে আমার বউয়ের কিছু নুড পাঠানো হয়েছে। ছবিগুলোতে রিতুর মুখ স্পষ্ট। আমি আরো সিওর হওয়ার জন্য ছবিগুলো ভালোভাবে জুম করে দেখলাম। না এটা রিতুই। বামপাশে বুকের উপরে তিলটাও স্পষ্ট। এডিট করা হলে তিল থাকতোনা নিশ্চয়। আইডিটা থেকে আমাকে টেক্সটটা দিয়েই ডিএক্টিভেট করে রাখা হয়েছে।
মুহূর্তেই আমার হাত কাপতে লাগলো। এইতো একটু আগেও আমি রিতুর সাথে দুষ্টুমি করে এলাম। অফ ডে বলে আজকে বাসাতেই আছি। রিতু কিচেনে আমার জন্য মালাই চা আর সিঙারা বানাচ্ছে। আমি রিতুকে পিছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। রিতু হাসিহাসি মুখ করে আমাকে রুমে এসে ওয়েট করতে বললো।
রুমে এসে আমি ফেসবুকে ঢুকতেই এ কি জিনিস দেখলাম। রিতুর সাথে যদিওবা আমার এরেঞ্জ ম্যারেজ বাট আমাদের আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালো। একজন আরেকজনকে অনেক ভালোবাসি। বিয়ের আগে আমার কোন পছন্দ ছিলনা তাই বাবা মায়ের পছন্দেই রিতুকে বিয়ে করা। রিতু আমাকে কখনো বলেনি যে ওর আগে কারো সাথে রিলেশন ছিল বা আমি কখনো শুনিওনি কারো কাছে। হঠাৎ করেই আমার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো যেন। রিতু কি তাহলে অন্য কারো সাথে কিন্তু ওর কোন আচরনে তো মনে হয় না। আমার ভাবনার মাঝেই রিতু এসে ডাক দিলো,
-কি হলো মশাই। কি এত ভাবছেন শুনি?
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। বিষয়টা রিতুর চোখ না এড়ালেও ও যেন পাত্তা দিলো না। চায়ের কাপটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো
-এই নাও চা আর দুপুরের রান্না কম্পিলিট না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ডিস্টার্ব করবেনা একদম। আজকে তোমার জন্য স্পেশাল ডিস বানাবো।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। একটা মেয়ের কত রূপ হতে পারে। রিতু আমাকে তাগাদা দিলো। কি হলো আমার মুখের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? চা টা খাও। খেয়ে বলো কেমন হয়েছে?
অনিচ্ছা সত্ত্বেও চায়ে চুমুক দিলাম। স্বাদ কিরকম হলো বুঝতে পারলাম না। রিতু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভালো হয়েছে বলতেই রিতু আমার দিকে চেয়ে ফিক করে হেসে দিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকলো। রিতুর রান্নার হাত খুব ভালো।
কিন্তু এই চা এই মুহূর্তে আমার কাছে পানসে লাগছে। যেই রিতু এক কাপ গরম পানি দিলেও আমার কাছে অমৃত মনে হত এখন এত সুন্দর করে বানানো মালাইচা ও আমার কাছে বিস্বাদ লাগছে। সিঙারা তো মুখেই দিতে ইচ্ছে করছে না অথচ রিতুর হাতের বানানো মালাই চা এর সঙ্গে সিঙারা ডুবিয়ে খেতে আমি সবথেকে পছন্দ করি। আমি উঠে আস্তে আস্তে হেটে গিয়ে কিচেনে উকি দিলাম।
রিতু গুনগুন করে গান গাইছে আর রান্না করছে। বাবা মা বাসায় থাকলে মা নিজেই সবসময় রান্না করে। রিতু টুকিটাকি হেল্প করে তখন। তিনচারদিন হল তারা দেশের বাড়ি গিয়েছে। আরো সপ্তাহখানিক থেকে তবে আসবে। আমি ভাবতে লাগলাম রিতুকে কি সরাসরি জিজ্ঞেস করবো।
ছবিগুলো দেখাবো। না নিশ্চিত না হয়ে রিতুকে কিছু বলা ঠিক হবে না। আমি অন্য একটা আইডি খুলে তানভির অহনাফ লিখে সার্চ দিলাম। এ নামে বেশ কয়েকটাই আইডি পেলাম। কিন্তু কোন আইডি কিভাবে বুঝবো। ওই আইডির প্রোফাইল তো দেখিনি। কিভাবে কি করবো বুঝতে পারছি না।
রিতু যদি কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায় আমাকে তো অন্তত বলতে পারতো। আমি তো কখনোই ওকে আটকে রাখতাম না। আমাদের বিয়ে হয়েছে ছয় মাস হবে কিন্তু রিতু কখনই বলেনি যে আমাকে ওর পছন্দ না বা রিতুর কোন আচরনে মনেও হয়নি। রিতু আমার প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং। তাহলে কি রিতুর আগে কোথাও সম্পর্ক ছিলো। হয়তো আমি জানিনা। আর আমাকে এভাবে এসব ছবি পাঠানোর মানে কি। আমাকে বিষয়টা আরো ভালোভাবে ক্লিয়ার হতে হবে।
বিকেলে রিতু বায়না ধরলো চলনা বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
আমার একটুও যেতে ইচ্ছে করলোনা তাই রিতুকে বুললাম শরীরটা খারাপ লাগছে। রিতু আমার কপালে হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো জ্বর টর এসেছে কিনা। কি আশ্চর্য শরীর খারাপ হলে কি খালি হাত দিলেই বোঝা যাবে। রিতু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, তুমি কি কোন ব্যাপার নিয়ে টেনশন করছো। চোখমুখ এরকম শুকনো লাগছে কেন?
push up bra
না কি হবে। কিছু হয়নি
আমি স্মিত হেসে বুঝানোর চেষ্টা করলাম কিছু হয়নি। রিতু কি বুঝলো জানিনা আমাকে শুয়ে পড়তে বলে আমার উল্টদিকে ফিরে ও শুয়ে পড়লো। আউলাঝাউলা চিন্তা চিন্তা করতে করতে কখন জানি ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে ঘুমিয়েছি। পাশে রিতুকে দেখতে পেলাম না। উঠে দেখি রিতু বসার ঘরে টিভি দেখছে। আমি ফ্রেশ হয়ে রিতুর পাশে এসে বসলাম। মনটা ভালো লাগছে না। রিতুকে বাসায় রেখেই বাইরে আসলাম। এদিক সেদিক কতক্ষণ হাটাহাটি করলাম। হানিফ মামার দোকানে কড়া করে বেশ কয়েক কাপ চা খেলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ রিতু কল দিলো।
-কই তুমি বাসায় আসতেছো না কেন?
আসছি আমি। আরো প্রায় দেড় ঘন্টা পড় বাসায় গেলাম। রিতু ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুললো।
কই ছিলে এতক্ষণ। এত দেরি হল কেন বাসায় আসতে?
আর বলনা আরিফের সাথে অনেকদিন পড়ে দেখা হল তাই একটু আড্ডা দিলাম।
ফোন করে বলে দিলেই পারতে। আমি তো খাবার টেবিলে অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম।
আমি এই মেয়েটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। রিতুকে টেবিলে বসিয়ে আমি নিজ হাতে খাইয়ে দিলাম। রিতু জিজ্ঞেস করলো তুমি খাবেনা?
আমি বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। আরিফ জোর করলো তাই।
বিছানায় শুতেই রিতু ঘুমিয়ে পড়লো। আমি শুধু ছটফট করছিলাম। আস্তে করে উঠে বেলকুনিতে গিয়ে ইজিচেয়ারটায় বসলাম। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ আমার মনে হল রিতুর ফোনটা একবারও চেক করিনি। আস্তে করে এসে রুম থেকে রিতুর ফোন নিয়ে নিলাম।
ফোন ঘেটে কিছুই পেলাম না। রিতু সেভাবে ফেসবুক চালায় না। পিকচার ও আপ্লোড করে না। খুব কম এক্টিভ থাকে। ম্যাসেঞ্জারে তেমন কিছুই পেলাম না। তানভির অহনাফ লিখে সার্চ কোন আইডির সাথে সংযুক্ততা পেলাম না। কললিস্ট ঘেটেও দেখলাম সব পরিচিত নাম্বার। কিন্তু ফোন বুকে একটা নাম্বারে চোখ আটকে গেল। তানভির লিখে সেভ করা একটা নাম্বার। আমি সাথে সাথেই নাম্বারটা আমার ফোনে তুলে নিলাম এবং কল করলাম। প্রথমবার রিং হলো কেউ পিক করলোনা। সেকেন্ডটাইম পিক হলো। আমি হ্যালো বলতেই চমকে গেলাম।
চলবে…
বড়দের রোমান্টিক গল্প আড়ালে কে পর্ব ২
আমি হ্যালো বলতেই চমকে গেলাম। ওপাশ থেকে মেয়েলি গলায় একজন জিজ্ঞেস করলে কে আপনি। আমি কোন ছেলের কন্ঠ আশা করেছিলাম। সে আবার ধমকের কন্ঠে জিজ্ঞেসা করলো কে আপনি? কাকে চাই?
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেও বললাম তানভীর আছেন? আমি তার কাছে ফোন দিয়েছিলাম।
-ও আচ্ছা দিচ্ছি। ওপাশে হাসির শব্দ। তারপর বেশ শব্দ করে বললো তানভীর দেখতো তোমাকে কে জানি ফোন দিয়েছে।
অল্পসময়টুকুতে কি কি বলবো তানভিরকে তাই মনে মনে আওড়ে নিচ্ছিলাম। ওপাশ থেকে বেশ চওড়া গলায় একটা ছেলে সালাম দিলো। আমি সালামের জবাব দিতেই ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো কে আমি?
আমি আদনান রিতুর হাজবেন্ড। রিতুকে চিনোনা তুমি।
-ও আচ্ছা আপনি আদনান ভাইয়া। ভাইয়া ভালো আছেন রিতু আপু কেমন আছে?
হ্যা ভালো। তোমার কি খবর?
তানভীরের সাথে অনেকক্ষন কথা বললাম। খেয়াল করলাম ছেলেটা জানতে চাইছেনা আমি তাকে কেন কল দিয়েছি। যেহেতু তার সাথে আগে কখনো কথা হয়নি তার উপর এত রাতে ফোন দেয়া অবশ্যই কারনবশত হবে এবং তার বেশ বড়সড় কারন হতে হবে। অবশ্য একবার হলেও তার জানতে চাওয়া উচিত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করলো ভাইয়া কোন সমস্যা হইছে কি রিতু আপুর সাথে? এত রাতে কল দিলেন যে?নাহ আমরা সবাই ভালো আছি। রিতু হঠাৎ করে বললো যে তোমার সাথে কথা বলবে তাই কল দেয়া।
-ও আচ্ছা আচ্ছা রিতু আপু কই?
ও আসলে একটু বাথরুমে গেছে!
-হারামীটা আমার কোন খোঁজ খবর নেয় না। বিয়ে করে তো ছোট ভাইকে পর করে দিয়েছে আর এতদিন পরে কথা বলার কথা বলে এখন বাথরুমে গিয়ে বসে আছে! ঠিক আছে ও আসলে আমাকে কল দিয়েন ভাইয়া।
-আচ্ছা ভালো থাকো। আল্লাহ হাফেজ।
কলটা কেটে দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লাম। না কোন ক্লু পাওয়া গেল না। এ ছেলেটা মনে হচ্ছে রিতুর কোন ছোট ভাই। সে কেন এ কাজ করতে যাবে। এ কাজ যে করেছে সে চায়না রিতুর সাথে আমার সম্পর্ক থাকুক। এবং রিতুর তার সাথে কানেক্ট আছে অথবা ছিলো। হতে পারে রিতুর কোন এক্স বয়ফ্রেন্ড। হয়ত এতদিন আমাদের বিয়ের কথা জানতোনা এখন কারো কাছ থেকে জেনেছে তাই হিংসার বর্শবর্তী হয়ে আমাকে ওর ছবিগুলো দিয়েছে। যাতে আমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়। কিন্তু রিতু ও তো কখনো বলেনি যে ওর কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো।
ও বলেছে আমিই প্রথম। রিতুর কথা এত জোড়ালো ভাবে নেয়ার কারন হলো আমি কখনো রিতুকে মিথ্যে বলতে দেখিনি। আমাদের সম্পর্কটা বন্ধুর মত। আমাকে বললেও যে আমি রিতূকে কিছু বলতামনা তা রিতু ভালোভাবেই জানে। তাই লুকোনোর কোন প্রশ্নই আসেনা।আবার এটাও হতে পারে যে আমাদের বিয়ের পরে ও কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলো পরে তার সাথে কোন ঝামেলা হয়েছে যার জন্য সে আমাকে সবকিছু জানিয়ে দিতে চায়। কিন্তু এত অল্প সময়ে রিতু এত নিচে নেমেছে আমার বিশ্বাস হতে চায় না।
আমার সাথে কি ও তাহলে সুখী না। ও কি ভালো থাকার নাটক করছে। আমি তো ওকে সর্বচ্চো ভালো রাখার চেষ্টা করি। বুঝতে চেষ্টা করি। তারপরেও রিতু এমন কেন করলো। আমার মাথায় কাজ করছিলো না। শুনতে পেলাম ভোরের আজান দিচ্ছে। চিন্তা করতে করতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে সেটাই টের পাইনি। রিতুর পাশে এসে শুয়ে পড়লাম। মেয়েটা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমিও একটু পরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ফোনের প্রচণ্ড শব্দে ঘুম ভাঙলো। রিতুর ফোন বাজছে।
ফোন টা উলটে রাখায় কে ফোন করছে বুঝতে পারলাম না। যেই না ফোনটা দেখতে যাবো অমনি কোথা থেকে যেন রিতু এসে রুমে ঢুকলো। আমার দিকে একবার তাকিয়ে ফোনটা নিয়ে বেল্কুনিতে চলে গেল। আমি ঘুমের ভান ধরে রইলাম। বেশ খানিকক্ষণ পরে রুমে এসে ফোনটা চার্জে লাগিয়ে আবার চলে গেল। আমি উঠে রিতুর ফোনটা চেক করলাম। আম্মা ফোন দিয়েছিলো। আম্মার ফোনটা রিসিভ করতে এত লুকোচুরির কি আছে। আম্মার সাথে সাত মিনিট ছাপ্পান্ন সেকেন্ড কথা বলেছে। নাম্বারটাও চেক করলাম। না আম্মার ই। রিতু আবার রুমে আসলো।
–তুমি উঠে পড়েছো। কটা বাজে খেয়াল আছে। বারোটা।
আমাকে ডেকে দিলেনা কেন? অফিসে যেতে হবেনা।
–শোন আজকে একটা বিশেষ দিন। দেরি যখন করেই ফেলেছো আজ আর অফিসে যাওয়ার দরকার নেই। তোমার বসকে ফোন করে বলে দাও।
রিতুর এরকম আদিখ্যেতা আমার একদম ভালো লাগলো না। বেশ কড়া গলায় বললাম রোজ রোজ অফিস কামাই দেয়া যায় নাকি। চাকরি না থাকলে বিশেষ দিন দিয়ে কি করবো। এখন যেতে হবে।
–ঠিক আছে তাহলে খেয়ে যাও।
আমি বাইরে খেয়ে নেব।
রিতুর মুখটা মলিন হয়ে গেল। যাকগে ও যা করেছে তার তুলনায় এটা কিছুই না। রিতু রুম থেকে চলে গেল।
বাইরে বের হয়ে ভাবলাম আজ আর অফিসে যাবো না। কিছুক্ষণ এলোপাথাড়ি ঘোরাঘুরি করলাম। চায়ের দোকানে আড্ডা দিলাম। হানিফ মামা জিজ্ঞেস করলেন, বাজান তোমার মনটন কি দুইদিন ধইরা খারাপ। মুখটা কেমন শুকাইয়া গেছে।
না চাচা কিছু হয়নি বলে বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম। চাচা মনেহয় বুঝতে পারলেন আমি কিছু বলতে চাচ্ছিনা তাই আর জানতে চাইলো না।
চায়ের দোকানে আরিফের সাথে দেখা হয়ে গেল। বেশ অনেকসময় আড্ডা দিলাম। আরিফ বললো, মামা চল আমার বাসায় কেউ নাই।একলা একলা ভাল্লাগছেনা। রাতে খেয়ে একেবারে যাবি। অনেকদিন তো যাসনা।
আরিফের সাথে তার বাসায় গেলাম। স্কুল কলেজ লাইফে বহুবার আসছি। যখনি আরিফদের বাসায় কেউ না থাকতো দুই বন্ধু মিলে আড্ডা দিতাম। সেইসব দিনগুলো মনে পড়ছে। আরিফের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছি। এই ছেলেটা আবার না জিজ্ঞেস করে বসে। হঠাৎ মনে পড়লো রিতু বললো আজকে বিশেষ দিন। আজকের দিনের বিশেষত্বটা কি। ভাবতেই মনে পড়ে গেল আজ তো রিতুর বার্থডে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সাড়ে দশটা বাজে। ইশ আরেকটু আগে মনে পড়লে রিতুকে নিয়ে বাইরে বের হওয়া যেত। আরিফের বাসা থেকে তড়িঘড়ি বের হয়ে রিতুর জন্য কিছু কেনাকাটা করলাম। একটা কাচা বেলীফুলের মালা, মহাদেব সাহার একটা কবিতার বই আর একবক্স চকোলেট।
বাসায় আসতে আসতে আজও লেট করে ফেললাম। রিতু দরজা খুলে দিলো। রিতুর চোখদুটো লাল আর ফোলাফোলা। মেয়েটা নিশ্চই কান্না করছে। আজকের দিনে এরকম করা উচিত হয়নি আমার। রিতুর হাতে প্যাকেটটা ধরিয়ে দিলাম। রিতু প্যাকেট নিয়ে কোন আগ্রহ দেখালো না শুধু বললো ডাইনিংয়ে খাবার দেয়া আছে খেয়ে নিও। রিতু কাথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো।
আমারো আর ভালোলাগছিলোনা তাই রিতুর পাশেই চুপচাপ শুয়ে পড়লাম এবং একসময় ঘুমিয়ে পড়ালাম। আমি ঘুমিয়ে পড়লে রিতু উঠে বালিসের পাশ থেকে ফোনটা নিলো। ফ্লাশলাইট অন করে ড্রেসিংটেবিল এর উপরে ওর হ্যান্ড ব্যাগটা থেকে একটা কার্ড বের করলো এবং ছিড়ে টুকরোটুকরো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়ে আবার চুপচাপ শুয়ে পড়লো..
চলবে…
© Tasmima Yeasmin
বড়দের রোমান্টিক গল্প আড়ালে কে পর্ব ৩য় ও শেষ
_
পরদিন সকালে হৈ চৈ এর শব্দে ঘুম ভাঙলো। বসার ঘরে গিয়ে দেখলাম বাবা মা চলে এসেছে। মা কে জিজ্ঞেস করলাম মা তোমাদের না আরো পরে আসার কথা। তোমরা এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে।
–আসলে তোদের জন্য মন খারাপ লাগছিলো তো তাই। আর তুই তো জানিস যে তোর মা তোকে না দেখে একদমই থাকতে পারে না। একমাত্র ছেলে বলে কথা। তাছাড়া রিতু মাকে তো ফোন করে বলে দিয়েছিলাম। মায়ের হয়ে বাবা উত্তর দিয়ে দিলেন। কি গো মা আদনানকে বলো নি?
–আসলে বাবা আদনানকে সারপ্রাইজ দিলাম।
যাক রিতু সব সামলে নিলো।
ফ্রেস হয়ে বাবা মায়ের সাথে নাস্তা করলাম। রিতু কচি কলাপাতা কালারের একটা শাড়ি পড়েছে সেই সাথে হাতখোঁপায় দিয়েছে কাল রাতের আনা বেলিফুলের মালা। আর চোখে সামান্য কাজল। এতটুকু সাজেই মেয়েটাকে অপ্সরী লাগছে। তবে ফুলের মালা বাসি হয়ে ফুলগুলো শুকিয়ে গেছে। ঠিক রিতুর মুখের মত কেমন নিষ্প্রান মলিন। নাস্তা করে রুমে এসেছি অফিসের জন্য রেডি হতে রিতুও আমার পিছন পিছন আসলো।
–আদনান তোমার কি কোন কারনে মন খারাপ।
রিতুর কথায় আমি চমকে গেলাম। একবার ভাবছি বিষয়টা বলে দেই। পরে ভাবছি থাক। নেক্সট যদি কিছু হয় তখন বলবো। মনের কথা মনে রেখে রিতুকে বললাম
–কই নাতো। মন খারাপ থাকবে কেন।–তাহলে কি কোন বিষয় নিয়ে তুমি আপসেট। না মানে কয়েকদিন ধরে কেমন যেন চিন্তিত দেখাচ্ছে তোমাকে। আমার কাছে বলতে পারো।
–না। তেমন কিছু না।
–কিছুই না হলে আমাকে এরকম এভয়েড কেন করছো। আমি দুদিন যাবত নোটিশ করছি। কোন প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও বলছোনা।
–কই কে বলেছে। আসলে অফিসে একটা নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব পেয়েছি তো। টু মাচ ক্রিটিক্যাল। সেটা আবার আজকেই বসের সামনে প্রেজেন্টেশন করতে হবে তাই একটু চিন্তিত। সাথে একটু চিন্তিত হবার ভান করলাম। রিতুর সাথে দুদিন যাবত মিথ্যে কথা বলে যাচ্ছি। নিজের কাছেও খুব খারাপ লাগছে।
–ও আচ্ছা। আমিতো ভেবেছিলাম আমার উপরে রাগ করেছো।
রিতুকে আমি কাছে টেনে নিলাম এবং আগের সময়ের মত কপালে একটা চুমু খেলাম। রিতু সাথেসাথেই বললো কাল আর পরশু দুইদিন চুমু দাওনি যাওয়ার সময় সেটাও দিয়ে দাও। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিতুকে আরো কয়েকটা চুমু খেয়ে অফিসে রহনা দিলাম।
অফিসে এসে হাতের কাছের কাজগুলো সেরে নিলাম। কেমন যেন কাজে মন বসাতে পারছিলাম না। বারবার মাথার ভিতর একটাই চিন্তা ঘুরঘুর করছে। তখনি ডেস্কে টোকার শব্দ। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারছি যে বাচাল হাবিব সাহেব এসেছেন এবং এই মূহুর্তে প্যানপ্যান করে আমার মেজাজ না খারাপ করে যাবেন না। ওনার কাজ হচ্ছে ঘুরে ঘুরে সবার ডেস্কে যাওয়া, নিজের কাজ অন্যের উপরে চাপানোর চেষ্টা করা এবং উল্টাপাল্টা কথা বলে মাথা খারাপ করা।ফাঁকিবাজ হলেও সবসময় মুখের ছাপ দেখে মনে হয় মহাব্যাস্ত। ওনার প্রেজেন্ট সাইরেন হচ্ছে টেবিলের উপর টোকা দেয়া।
হাবিব ভাই একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
–কি খবর আদনান সাহেব। কাল অফিসে এলেন না যে?
একটু ব্যাস্ত ছিলাম। তা আপনার কি খবর।
–আমার আর খবর। ঘরে বাইরে সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়। ভীষন ব্যাস্ততায় থাকি।
ঘরের সবকাজও আপনি করেন।
–কষ্টের কথা আর কি বলবো ভাই আপনি আপন দেখেই বলছি বলে আমার দিকে কিছুটা ঝুকেঁ এলেন আসলে ঘরের কাজও আমাকেই করতে হয়। বৌ টা ভালো না। ছেড়ে দিবো।
যে স্বামী বৌয়ের ভয়ে ঘরের কাজ করে সে আর যাই হোক বৌকে ছেড়ে দিতে পারে না। তাও মজা নেওয়ার জন্য বললাম তা কবে ছেড়ে দিচ্ছেন।
–শীঘ্রই। আসলে বৌ হচ্ছে হাতলবিহীন স্যুটকেসের মত। বহন করতেও কষ্ট আবার ফেলে দিতেও মায়া লাগে।
উনি একটা দীর্ঘসময় ভাষন দেয়ার টপিক পেয়ে গেলেন। এড়ানোর জন্য বললাম হাবিব ভাই কফি খাবেন? আমি খাবো।
–ভাই জানেননা কফি খাইনা দেখলেও বমি আসে। আপনি খান আমি গেলাম কাজ আছে। হাবিব ভাই কপাল কুচকে উঠে গেল। মনে মনে বললাম তোর কপালে এর থেকেও খারাও বৌ জোটার দরকার ছিলো।
বাসায় ফিরে বেশ একটা ভালো সময় পার করলাম। সবাই একসাথে ডিনার করলাম। কয়েকদিন বাবা মা ছিলোনা কিন্তু মনে হচ্ছে অনেকদিন যেন ছিলনা। রিতুর সাথেও অনেকটা সহজ হয়ে গেছি। খেয়েদেয়ে রুমে আসলাম। আমি আমার মত করে শুয়ে পড়লাম রিতু অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে অথচ এই মেয়েটা সবসময় আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুমাতো। রিতুকে আমার দিকে ফেরাতে গিয়ে আবার হাত গুটিয়ে আনি। কোথায় যেন একটু আড়ষ্টতা আছে। কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে উঠে বেলকুনিতে আসলাম।
বেলকুনির একপাশে গ্রীনলিফ আর্কিড একপাশে নীল আর্কিড সাথে কোকোপিট ভর্তি ছোটছোট ঝুলন্ত টবে নাম না জানা বীজও রিতুর লাগানো। সবকিছুই সুন্দর ভালো শুধু আমার মনটা ভালো না। আকাশে মেঘ জমেছে। পশ্চিমা বাতাস বইছে। না আমার রিতুকে সবকিছু খুলে বলা উচিত। পিঠে কারো হাতের স্পর্শ পেলাম। তাকিয়ে দেখি রিতু। মেয়েটা হুট করে আমাকে জড়িয় ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো। এই মূহুর্তে আমার কিছু জানতে ইচ্ছে না। রিতুর কান্না থামলেই যেন আমি খুশি।
কি হয়েছে রিতু? এভাবে কাঁদছো কেন?
রিতু আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। এখনো ওর হেচকি উঠছে।
–আদনান তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে। আমি তোমাকে অনেক আগে একটা মিথ্যা কথা বলেছি।
তুমি আগে কান্না থামাও পরে শুনবো।রিতুকে শান্তনা দিচ্ছি। রিতু আমার কথা পাত্তা দিলোনা বলতে শুরু করলো
আদনান তোমার সাথে বিয়ের তিনবছর আগে আমার ইফাদ নামের একটা ছেলের সাথে রিলেশন ছিলো। আমরা দুজন দুজনকে অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু ইফাদ হঠাৎ একদিন আমাকে না জানিয়ে স্কলারশিপ নিয়ে জাপান চলে গেল। ইফাদের সাথে যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি এপর্যন্ত বলেই রিতু চোখের পানি মুছে নিলো।
ছেলেটা তোমার সাথে যোগাযোগ করেনি কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম?
–না। কিন্তু..
কিন্তু কি?
গতসপ্তাহে ওর সাথে শপিংমলে দেখা হয়েছিলো। আমি ওর সাথে কথা বলেছি। ও বলেছে ও এখনো আমাকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায়। ও আমার বিয়ের কথা জানতো না। ও বলেছে তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করতে যদি আমি সত্যি ওকে কখনো ভালোবেসে থাকি। আমিই ফেক আইডি খুলে তোমাকে আমার ছবিগুলো পাঠিয়েছি। রিতু একনিঃশ্বাসে বলে গেল।
আর তাতেই কি আমি তোমাকে ছেড়ে দিবো? সম্পর্ক এত ঠুনকো রিতু।
–ইফাদ আমাকে ওর একটা কার্ড দিয়েছিলো। বলেছিলো আমি যদি রাজি থাকি যেন ওর সাথে যোগাযোগ করি। কিন্তু এখন আমি বুঝেছি তুমি আমাকে কতটুকু ভালোবাসো। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আদনান। তোমার ভালোবাসাই আমাকে আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে শিখিয়েছে। তুমি আমাকে যা শাস্তি দেবে দাও কিন্তু আমি আর নিতে পারছি না। দুদিন নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করেছি। আমি বুঝেছি যে আমি তোমাকেই ভালোবাসি। তোমার সাথেই থাকতে চাই। আসলে অতীত হয়তো ভুলে থাকা যায় কিন্তু বদলানো যায়না। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও আদনান প্লিজ।
কি অদ্ভুত এ দুনিয়া। দুদিন আগে যে মেয়ে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য এতো কাহিনী করলো আজ সে আমার সাথে থাকার জন্য শাস্তিও মাথাপেতে নিতে চাইছে। চাঁদের আলোয় রিতুর চোখের পানি চিকচিক করছে। মেঘ কেটে গিয়ে কখন যে চাঁদ উঠেছে খেয়ালই করিনি। টের পেলাম আমার চোখও ভিজে গেছে। চাঁদ তার পূর্ন যৌবন দিয়ে আলো ছড়াচ্ছে আর সেই আলোতে রিতুকে নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। আমি রিতুকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেছে।
রিতু আল্লাহর কাছে মাফ চাইলে তিনিও মাফ করে দেন আমি তো সাধারন মানুষ। তোমাকে মাফ করে দিয়েছি। সবচেয়ে বড় কথা তোমার ভুল তুমি বুঝতে পেরেছো। রিতু আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
আদনান আর রিতুর চোখের আড়ালে বেলকুনির নিচ থেকে একটা ছায়া সরে গেল। ইফাদ ভাবছে আবার জাপান চলে যাবে। যার জন্য এসেছিলো যেই তো অন্যের হয়ে গেছে। নিজের বামহাতের পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। সমাজে পুরুষদের কাঁদতে নেই। রিতুকে আদনানের বাম পাজর দিয়ে তৈরি করা হয়েছে তার নয়। হঠাৎ ইফাদ থেমে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো হে সৃষ্টিকর্তা আদনান আর রিতুকে তুমি ভালোরেখো। ভীষন ভালো।
*সমাপ্ত*
২.শারীরিক প্রেমের গল্প
#কৃষ্ণবর্ণ_গোধূলি
সতর্কতা: ১৮+
বিয়ের এক মাসের মাথায় জানতে পারলাম আমার স্ত্রী গর্ভবতী। যদিও আমার এত তাড়াতাড়ি বাচ্চা নেবার কোন ইচ্ছে ছিল না কিন্তু দোষটা আমারই। বিয়ের রাতেই ব্যাপারটা ঘটে গেছে তা আর বোঝার বাকি থাকলো না। আমার ইচ্ছে ছিল ওকে নিয়ে ঘুরবো ফিরব বেড়াবো, জীবনটাকে উপভোগ করবো। কিন্তু তা বুঝি হবার নয়, অবশ্য তাকে দোষ দিয়ে তো কোন লাভ নেই ভুল যা করার আমিই করেছি।
জান্নাত মানে আমার স্ত্রী, তাকে আমি দেখেছিলাম কলেজে যাবার সময়। নিষ্পাপ নির্মল চেহারা, অতিরিক্ত পরিমাণ লাজুক। প্রথমে প্রেমের প্রস্তাব দেই কিন্তু সে কোন সাড়া দেয়নি। বুঝলাম এভাবে কাজ হবেনা যে করেই হোক জান্নাতকে আমার চাইই চাই। আমি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি, কাজেই নিজের পায়ের নিচে শক্ত মাটি আছে তা ছাড়াও আমার পরিবার মোটামুটি সচ্ছল। বন্ধু বান্ধবের পরামর্শে ওকে এবার আমি আর প্রেমের প্রস্তাব না দিয়ে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেই। মেয়েটি অপলক দৃষ্টিতে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, তারপর মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বললো,
-এসব কথা আমাকে বলছেন কেন ! আমার পরিবারকে বলুন।
জান্নাত চলে যায়। আমি বুঝতে পারি আমার প্রস্তাবে ও পুরোপুরি সম্মত।
দুই পরিবারের মতামত নিয়ে ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হয়।
এক সকালে দেখি জান্নাত বমি করছে। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
-কি হয়েছে, তোমার শরীর খারাপ লাগছে, উল্টোপাল্টা কিছু খেয়েছিলে?
-না তো
-তাহলে এমন কেন হলো, তোমার কি মাঝে মাঝেই এমন হয়?
-না , আগে কখনো হয়নি
-চলো ডাক্তারের কাছে যাই
জান্নাত চোখ নামিয়ে নিয়ে বললো,
-তুমি কি আমাকে প্রেগনেন্সি কিট এনে দেবে? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, কি বলে এই মেয়ে!
তারপরেও ওর কথা অনুযায়ী কাজ করলাম এবং যথারীতি ফলাফল পজেটিভ।
প্রথমে একটু মন খারাপ হলেও তারপর মনে হলো ক্ষতি কি এক সময় না একসময় তো আমাদের ঘরে অতিথি আসবেই না হয় একটু আগেভাগেই এলো।
জান্নাতকে নিয়ে বের হচ্ছিলাম ডাক্তারের চেম্বারে যাবো
-কিরে বাবা কোথাও যাচ্ছিস? মায়ের কন্ঠস্বর
– হ্যা মা একটু বাইরে যাচ্ছি। আমি ব্যাপারটা চেপে গেলাম আগে ডাক্তারের কাছ থেকে কনফার্ম হয়ে নেই
সিরিয়াল পেতে বেশ বেগ পেতে হলো
এই সময়টাতে আমি জান্নাতকে আঁকড়ে ধরে বসে ছিলাম ওর মধ্যে বাসা বেঁধে আছে আমাদের ছোট্ট প্রাণ
যথা সময়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফির সিরিয়াল এলো, জান্নাত ভেতরে চলে গেল।
ও বেরিয়ে আসার পর আমাদেরকে আরেকটু বসতে বলা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই রিপোর্ট সব দিয়ে দেয়া হবে তারপর আবার রিপোর্ট নিয়ে ডক্টরের সঙ্গে দেখা করতে হবে। মাকে ফোন করে বাসায় জানিয়ে দিলাম ফিরতে দেরি হবে।
-কিরে বাবা তুই না বললি ফিরতে দেরি হবে? বাসায় ফিরতেই মায়ের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর
-সব কৈফিয়ত কি তোমাকে দিতে হবে ?আমি ঝাঁঝালো সুরে উত্তর দিলাম
ছোটবেলা থেকেই মা জানে আমি খানিকটা রগচটা টাইপের তাই মা আর এই বিষয়ে কোনো রকম কথা বাড়ালো না।আমি রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম, জান্নাত বাইরে সোফায় বসে রইল।
বুঝতে পারলাম বাইরে বাবা-মা সহ সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে। মানুষকে আর টেনশন দিয়ে কোন লাভ নেই বের হয়ে এলাম।
-মা বাবা তোমরা ভালো করে শোনো এই মেয়েকে আমি তালাক দেবো
দুজনেই চমকে উঠলেন জান্নাতকে তারা যথেষ্ট পছন্দ করেন
-তোকে এই শিখিয়েছি আমি! এইভাবে কেউ কথা বলে? বাবা চিৎকার করে বললেন
আমি তার চেয়েও জোরে বললাম,
– তার মানে তোমরা বলতে চাচ্ছো যে একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ের সাথে আমাকে সারা জীবন কাটাতে হবে, ওর ইনোসেন্ট চেহারা দেখে ওকে ভালবেসে ছিলাম কিন্তু মনে মনে যে এত প্যাচ সেটা ধরতেই পারিনি
জান্নাত কাঁদছে ইচ্ছে করছিল ওকে ঠাস করে একটা চটকানা মারি।
-কি হয়েছে ব্যাপারটা খুলে বল
-আমাদের বিয়ে হয়েছে এক মাস দুই দিন হয়েছে এর মধ্যে সে প্রেগন্যান্ট
-এটা তো খুশির সংবাদ, সমস্যা কি?
-সমস্যা এটাই বিয়ে এক মাস কিন্তু বাচ্চা ছয় সপ্তাহের উপরে দেখাচ্ছে মানে বুঝতে পারছো দেড় মাসেরও বেশি সময়, এই বাচ্চা কি আমার?
বাবা মা মুখ চাওয়াচাওয়ী করলেন, তাদের কল্পনাতে ওইটা ছিল না।
জান্নাত আমার পায়ে পড়ে গেল
-বিশ্বাস কর আমি এমন মেয়ে নই তাছাড়া এটা তো তুমি বিয়ের রাতেই বুঝতে পেরেছ তারপরও কেন এমন করছো? এই বাচ্চা তোমার। তোমার যদি এতই সন্দেহ থাকে তাহলে না হয় বাচ্চা জন্মদানের পরে ডিএনএ টেস্ট করো কিন্তু আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিও না।
এবার আমার মেজাজ আরো বিগড়ে গেল ওর চুলের মুঠি ধরে সজোরে পেটে একটা লাথি দিলাম ও হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে গিয়ে পড়লো।
– এক বছর বসে বসে তোকে পালি, সুন্দর করে বাচ্চাটা জন্ম দে তারপরে আমি ডিএনএ টেস্ট করাবো তাইনা? এক বছর বসে বসে খাওয়ার ধান্দা। তুই এখন এই মুহূর্তে আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। আমি রাগে ফুসতে ফুসতে ঘরে ঢুকে সেই রাতের মতো দরজা লাগিয়ে দিলাম।
সকালে উঠে দেখি জান্নাত চলে গেছে রাতেই। বাবা মায়ের চোখ মুখ ফুলে আছে সম্ভবত কেঁদেছে
-শোন বাবা আর মা তুমিও শোনো আমি ওকে ডিভোর্স দিব, উকেলের সাথে পরামর্শ করতে যাচ্ছি
-তুই এখানে বস, ডিভোর্স দিতে চাচ্ছিস দিবি। এখানে আমরা তোকে বাধা দিব না কিন্তু একটু সময় নে, রাগের মাথায় হুটহাট কাজ করতে নেই, এমনও তো হতে পারে যে রিপোর্ট গন্ডগোল হয়ে গেছে।
-এইসব সান্তনামূলক বাক্য আমার কাছে ঝেড়ো না
-আমার একটা কথা শোন বাবা এবার মা বলে উঠলেন তুই কয়েকটা দিন সময় নে তারপর যা খুশি করিস।
ঠিক তার দুদিন পর আমরা খালামণি এসে উপস্থিত হলো, আমি তাকে অত্যন্ত পছন্দ করি কিন্তু এবার আমি তাকে দেখে খুব একটা খুশি হলাম না কেননা বুঝতে পারলাম হয়তোবা মা তাকে খবর দিয়ে এনেছেন। উনি পেশায় একজন চিকিৎসক, গতকালই কোন একটা সেমিনার শেষ করে ইন্ডিয়া থেকে ফিরেছেন।
-আশিক তুই আমার সামনে বস, কি কি হয়েছে খুলে বল
-আর খুলে বলার তো কিছু নেই, তুমি সবকিছু জেনেই এসেছ আমি একটু রাগের সুরে উত্তর দিলাম
-তোদের মত ছেলেদেরকে থাপ্পড় মেরে ম্যানার শেখানো দরকার
-মানে তুমি একটা দুশ্চরিত্রা মেয়ের জন্য আমাকে এসব বলছো!
সাথে সাথে আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় পড়লো আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম খালামনির দিকে, এটা কি হলো!
-তুই যত বড় শিক্ষিতই হোস না কেন মেডিকেল সাইন্স সম্পর্কে অনেক কিছুই তোর অজানা। তুই তোর স্ত্রীকে খুব ভালোভাবে জানিস, একটা রিপোর্ট তোকে আমুল বদলে দিয়েছে।
আমি গাল থেকে হাত সরিয়ে বললাম,
– বিয়ে যদি এক মাসের হয় বাচ্চা কি করে দেড় মাসের হতে পারে সেটা তুমি আমাকে বলো? তার মানে অবশ্যই তার অন্য কোন জায়গায় সম্পর্ক ছিল যার কারণে আমি বিয়ের কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি হয়ে গেছে
-চুপ কর বেয়াদব , নির্লজ্জ কোথাকার। যা জানিস না সেটা নিয়ে মন্তব্য করবি না। এবার আমি কিছু কঠিন টার্ম ব্যবহার করব এগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনবি।
বিয়ের রাতে তুই কি জানতে চেয়েছিলি যে ওর শেষ মিনস্ট্রুয়েশন কবে হয়েছিলো?
-না এসব জানার প্রয়োজন বোধ করিনি
-এবং তুই কোন প্রটেকশনও ব্যবহার করিস নি
-না তা করিনি সেজন্যই প্রথমে ভেবেছিলাম বাচ্চাটা আমার
-একটা দম্পতি যখন একান্তে সময় কাটায় সেই হিসেবে অনুযায়ীই শুধু বাচ্চা গর্ভে আসে না
-মানে?
-বাচ্চা গর্ভে আসে মায়ের মাসিকের সাইকেলের উপর নির্ভর করে। ধর তোর বিয়ের ১৫ দিন বা তার আগে মেয়েটির মাসিক হয়েছিল, তখনই তার ওভারি থেকে ওভাম বের হয়ে এসেছে এবং অপেক্ষা করেছে নিষিক্ত হবার জন্য। যখন তোর সাথে বিয়ে হলো তখনই সেটা নিষিক্ত হয়ে গেল এবং জান্নাত মেয়েটা কনসিভ করলো। তার মানে কি দাঁড়ালো, বাচ্চা টা কার? তোর হিসেবে তোদের সম্পর্কটা এক মাসের হলেও ডিম্বাশয় থেকে নিষ্কৃত যে ওভাম সেটা কিন্তু আরো ১৫ দিন আগেই তৈরি ছিল। এই ক্ষেত্রে কোন ভাবেই তুই মেয়েটাকে দোষারোপ করতে পারিস না। মেয়েটা কনফিডেন্ট, যার কারণে সে তোকে ডিএনএ টেস্টের মতো চ্যালেঞ্জ ছুড়েছে কিন্তু তুই অকর্মার ঢেঁকি কারো সাথে পরামর্শ না করে যা তা ব্যবহার করে মেয়েটাকে বাড়িছাড়া করেছিস অন্তত একবার আমার সাথে ফোনে কথা বলতে পারতি। না সেটা তুই করবি না আসলে অধিকাংশ পুরুষ জাতের সমস্যাই হচ্ছে এটা, মিথ্যা সন্দেহ।
আমি খালামনির কথা পুরোটা না বুঝলেও কিছুটা বুঝলাম এবং এটা বুঝলাম হয়তোবা বাচ্চাটা আমারই হয়তোবা বলছি কেন এটা সত্যিই আমার বাচ্চা।
আমি ছুটে গেলাম আমার শ্বশুর বাড়িতে, জান্নাত কে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনতেই হবে।
শাশুড়ি মা কে জিজ্ঞেস করতেই মা আমাকে বললেন যে জান্নাত ছাদে আছে। আমি দ্রুত পায়ে ছাদে উঠে গেলাম
মেয়েটার চোখে মুখে কেমন একটা বিষন্নতা। দুদিনেই চোখের নিচে কালি জমে গেছে, যেন শুকিয়ে গেছে, কেমন পাথরের মত হয়ে আছে।
-আমাকে তুমি মাফ করে দাও জান্নাত প্লিজ
-যে সন্তানের জন্য তুমি আমার সাথে এরকমটা করলে সেই সন্তান এখন দুনিয়াতে নেই। মনে আছে সেই রাতে রাগের মাথায় তুমি আমার পেটে প্রচন্ড একটা লাথি কষিয়েছিলে আমার ছোট্ট সোনা তারপরেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় ভাবতে পারো জন্মের আগেই মৃত্যু, আজ সকালেই হাসপাতাল থেকে এসেছি। জান্নাত প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলো আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে গেলাম
-তোমার সান্তনা আমার চাই না, দয়া করে আমার চোখের সামনে থেকে যাও আর কখনো কোনদিন আমার সামনে আসবে না, যেই সম্পর্কে বিশ্বাস নেই আমি সেই সম্পর্ক রাখতে চাই না।
-তুমি এসব কি বলছো তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না?
-কিন্তু আমি তোমার সাথে থাকতে পারবো না, দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো।
জান্নাত আর একটা কথাও বললো না। পশ্চিমের আকাশে সূর্য হেলে পড়ছে । গোধূলির আলোতে চারপাশে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু আমার এই গোধুনী রঙটাকে কেমন যেন কৃষ্ণকায় লাগছে। জীবনটা যেন অন্ধকারে সমর্পিত হয়ে গেল। একটা ছোট্ট ভুল একটা ছোট্ট সিদ্ধান্ত একটা ছোট্ট সন্দেহ আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।
৩.বড়দের জন্য গল্প
[১৮+ সতর্কীকরণ]
১
ক্লান্ত দেহে বিছানা থেকে নেমে এলাম। সমস্ত শরীর থেকে ঝর্ণার মত ঘাম বয়ে পড়ছে। বিছানার জন্তুটার দিকে কয়েক পলকের জন্য তাকালাম, চোখ বন্ধ করে শুয়ে বড়বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। আমি মৃদু স্বরে ডাকলাম, “স্যার আমার টেকাডা…” মাঝবয়সী মানুষটা হাত উচিয়ে টেবিলের দিকে ইশারা করলো। দেখি টেবিলের উপর পাঁচশ টাকার একটা নোট। আমি সেটা না নিয়ে মানুষটার দিকে তাকিয়ে খেঁকিয়ে উঠলাম।
রুম ভাড়াই লাগে তিনশ টাকা, হোটেলের রিসিপশনিস্টকে দেয়া লাগে দুশ। এর উপর রাখি আম্মার কাছে আবার প্রতি সকালে একশ টাকা জমা করা লাগে। এই পাঁচশ টাকা দিয়ে আমার বালের কাজটাও হবে না। আমি মাঝবয়সী বুড়ার দিকে চোখ তুলে কঠিন গলায় বললাম, ” আপনে বারোশো দিবেন কইসিলেন। এইটা কী দিলেন?”, বুড়া চোখ এখনো খুলে নি, না খুলেই বলল, “যা দিসি বেশিই দিসি, কম কিছু দিই নাই। নিয়া ভাগ এখানতে।”। আমার মেজাজটা হুট করেই খারাপ হয়ে গেল। প্রত্যেকটা সময়ে এমনটা হয়। জানোয়ারগুলা খালি টাকা নিয়া গড়িমসি করে, লাগানোর পরেই খালাস। যত কম পারে তত কম দিয়ে বিদেয় হয়। রোজ রোজ এই দামদর করতে কি ভাল্লাগে, তাও আবার নিজের শরীর নিয়ে! মানুষ আনার সময় দামদর, বিছানার থেকে উঠার সময় দামদর, প্রত্যেকটা মুহূর্ত শুধু দামদর!
আমি এলোপাথাড়ি গালি শুরু করলাম। এমন সব গালি যা ছাপার অক্ষরে ছাপা যায় না। সেক্সের পরে মরদ মানুষের সাহস কিসের জন্য জানি আধা-মাধা হয়ে যায়, আমি প্রত্যেকবার খেয়াল করি। একটু ধমক-ধামক দিলেই কিছু টাকা বাড়িয়ে দেয়। সবাই অবশ্য দেয় না। আমার সাথেই থাকে,সেফালী ওরে একদিন পিটায় হাত ভেঙ্গে দিয়েছিলো এক কুত্তার বাচ্চা। ওর দোষ,ও ঐ মরদের কাছে একটু বেশি টাকা চাইসিলো, এতেই বিছানার কাছে রাখা কাঠের তক্তা দিয়ে পিটিয়ে ওর হাতের কনুইয়ের জয়েন্ট নাড়ায় দিয়েছিলো। ঝাড়া চারসপ্তা কাজে বের হতে পারে নাই বেচারি। অবশ্য, কাজে বের হতে না পারাটা আমাদের কাছে ঈদের মতই।
বুড়া আমার হুমকি ধামকিতে ভয় পেয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে খাটের এক পাশে দলামোচরা হয়ে পড়ে থাকা প্যান্টটা টেনে নিয়ে পড়তে শুরু করলো। বেল্টটা ঠিকঠাক লাগিয়ে, পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে আমার দিকে তাচ্ছিল্যের সাথে দুটা একশ নোট এগিয়ে দিল। আমি কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করে টাকাটা নিলাম।
“বারোশ কইসেন, কমপক্ষে এক হাজার তো দেন।”, আমি হতাশা মাখানো জোর গলায় বলে উঠলাম। আমাদের গলাটা যেন কেমন, ভাঙ্গা কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গমগমে। বুড়া খেঁকিয়ে উঠল, কুৎসিত গলায় বলতে শুরু করলো, ” সর শয়তানের বাচ্চা, এই টাকায় পেট ভরেনা না… তোরে যে এটা দিসি এই তোর ভাগ্য, অন্য কেউ হইলে তো প্রথমে ফালায়া ফালাফালা করতো, তারপর তিনশডা টাকা দিয়া বাইর হইয়া যাইত। দেহি সর সামনের তে, মনে হয় আমি সারারাইত ওর সামনে এমনে দাড়ায়ে থাকবো, এহ, হের রূপ যেন এক্কেরে বায়া বায়া পড়ে, হেরে বেশি টাকা দিতে হইব এখন!”।
মানুষটা আমাকে আস্তে করে একটা ঠেলা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে বেরিয়ে গেল, যেন আমাকে ছুঁতেও ওনার ঘেন্না হচ্ছে। আমি কিছু বললাম না, কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে হাতের একশ টাকার নোট দুটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর টেবিলের ওপরে রাখা পাঁচশ টাকাটা হাতে মুঠি করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
এসব আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।
নীচে নেমে আবার রিসিপ্সনিস্ট মালটাকে এখন দুশ টাকা ধরিয়ে দিতে হবে। কীভাবে সে মালকে দু পয়সা কম দেয়া যায় সে চিন্তা করতে করতে সিড়ি দিয়ে এক তলায় নামতে শুরু করলাম।
২
ঢাকা শহরে হুট করে শীত নেমে যায়। রাস্তায় দাঁড়িয়েই সেটা টের পাচ্ছি। রাতের কনকনে ঠান্ডা বাতাস পরনের মোটা সুতা ওঠা সোয়েটারটার ফুটো দিয়ে ঢুকে হাড্ডি কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। গা মাঝেমাঝেই হুরহুরিয়ে কেঁপে উঠছে। আমি ফুটপাথ ধরে মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আজকে ভালোই কামাই হয়েছে, অন্তত কালকে আর গত পরশুর চেয়ে তো বেশি। হোটেলের খরচ-টরচ মিটিয়ে সাড়ে চারশর টাকা বেঁচে গিয়েছে। বস্তিতে ফিরে আম্মাকে আবার একশ দিতে হবে। তাহলে কত থাকে? সাড়ে তিনশ প্রায়। আমার খাওয়া-থাকার কোনো খরচা নেই, সব রাখি আম্মাই দেখেন। উনি হচ্ছেন আমাদের সবার মাথার ওপরের ছাতার মত, একাকী বটবৃক্ষ। সেই ছোটবেলা থেকে আমার মতোদের খুঁজে খুঁজে নিয়ে এসে তিনি নিজের কাছে ঠাই দিয়েছেন, শিখিয়েছেন কীভাবে বেঁচে থাকতে হবে এই পঙ্গপালের মত মানুষের মাঝে। অসম্পূর্ণ নারী বানানোর পরেও সৃষ্টিকর্তা বোধহয় ওনার মাঝে মাতৃত্বের সবচেয়ে বিশুদ্ধ বীজটাই বুনে দিয়েছিলেন। সেই বুনে দেয়া বীজ আস্তে আস্তে বড় হয়েছে, চারা থেকে গাছ হয়েছে। বৃহন্নলারা বাচ্চা জন্ম দিতে পারে না, তাই সেই মায়ার গাছের ফল এখন আমরা ভোগ করছি। বৃহন্নলা মানে জানেন তো? হিজড়া, বৃহন্নলা শব্দের অর্থ সহজ বাংলায় হিজড়া।
সামনে এক রিকশাওয়ালা সিটে বসে বিড়ি টানছে। দূর থেকে বিড়ির মাথার আগুন, আর উৎকট গন্ধ দুটোই পাওয়া যাচ্ছে। আমি কাছে পৌঁছে গায়ে হাত ছুঁইয়ে বললাম, “ওই যাবি?” রিকশা প্রথমটায় ছিট মেরে উঠলো, সেটা তৃতীয় লিঙ্গধারী কারুর গলার স্বরের কারণে নাকি মাঝরাত্তিরে গায়ে আচমকা কারো ছোঁয়া পাওয়ার কারণে সেটা বোঝা গেল না। বেচারা কিছুক্ষণ আমাকে জরিপ করলো। রাতে যেসব রিকশাওয়ালারা রিকশা চালায়, তারা প্রায় সব ধরণের যাত্রী উঠায় রিকশায়। রিকশাওয়ালার হাতের বিড়িটা শেষ হয়ে আসছিল মনে হয়, ও ওটা ফেলে পা চাপা দিয়ে দিল।
” কই যাবা?”
আমি একমুহূর্ত ভাবলাম, কোথায় যাব? বস্তিতে ফিরব না আর একবার রমনার সামনে যেয়ে দাঁড়াবো? আরেকবার করবো নাকি আজকে? নাহ। শরীর সায় দিচ্ছে না, মন তো কোনোকালেই দিত না। আচ্ছা অনেকদিন তো রোকোন, ছোটনগুলাকে দেখা হয়না। ওদের দেখতে যাব নাকি একবার? মার তো এখন কাঠের লাকড়ি নিয়ে পিঠা বানাতে থাকার কথা। রাতের দিকেই তো ট্রাকগুলা আসে ঐদিক দিয়ে। মাঝরাতের দিকে বেচা কেনাটা বেশি হয়, তার উপর এখন চলছে ভরা শীত। ড্রাইভাররা একবার না একবার পিঠা নেবার জন্যে হেল্পারকে পাঠাবেই। কেউ কেউ নিজেই আসবে। এরকমই তো সবসময় হত, ছোট বেলায় দেখতাম। মা একপাশে আমকে বসিয়ে রেখে পিঠা বানাতো। শীতের মাঝে চুলার আগুনে আরাম আরাম লাগতো। আমি বসে বসে আগুনের কাঁপাকাঁপা আলোয় স্কুলের পড়া করতাম। একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়েছি আমি। তখনও আব্বা বেঁচে ছিলেন, রাতে ট্রাকের হেল্পারি করতেন, অবস্থা মোটামোটি ভালো চলে যেত আমাদের। ফোর পাশ করে ফাইভে উঠলাম, ধরা পড়লো, আমি একটু অন্যরকম, অন্য সবার মত স্বাভাবিক নই। আমার আব্বা তো বিশ্বাস করতে চান নাই। কিন্তু অবিশ্বাস করলে তো আর সত্যি বদলে যায় না, এক সকালে ঠিকই আমার সমগোত্রীয়রা নিতে চলে এলো আমায়। আমি কান্নাকাটি করে একশেষ করলাম, কেউ আটকাতে এলো না। আম্মা মুখ ভার করে বসে থাকলেন, আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন না পর্যন্ত। আব্বা থাকলে হয়তো একটু আটকানোর চেষ্টা করতেন ওদের, কিন্তু তিনি তখন ফেরার স্মাগ্লিং এর কেসে। তারপর? তারপর সেই ছোট্ট পৌঁছে গেলাম রাখি আম্মাদের কাছে।
“কমলাপুর স্টেশন যাবি?”
রিকশাওয়ালা কিছুক্ষণ সময় নিল। লুঙ্গির কোঁচা থেকে আরেকটা বিড়ি আর ম্যাচ বের করে বিড়িটা ধরালো। বিড়ি ধরাতেও বেশ অনেকক্ষণ সময় গেল, উত্তুরে বাতাসে বারবার ম্যাচের কাঠি নিভে যাচ্ছিল। দুই টাকার বিড়ি ধরাতে বেচারার তিনটা কাঠি নষ্ট হলো। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ও বলল,
” কত দিবা?”
আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম, ” ন্যায্য যত ভাড়া।”
আমার হাসির আওয়াজে বেচারা আবারো ছিট খেয়ে উঠলো। আমি রিকশায় চড়ে বসলাম।
সমস্ত প্রাণবন্ত হাসিই সুন্দর, আমাদের হাসিও। তাও কেন যেন লোকেরা ভয় পায় আমাদের হাসিকে। কেন পায়? পায় বোধহয় দূরত্বের কারণেই। আমরা ইচ্ছে করেই একটা দূরত্ব টেনে নিয়েছি নিজেদের মাঝে। সত্যিই আমরা? নাকি আমাদের সমাজ এই দূরত্বের স্থাপত্যশিল্পী? স্বল্পবুদ্ধির মাথায় সেটা ধরতে পারি না। এই যে এত কেতাবি ভাষায় কথা বলছি, সেটা কেন বলছি? কারণ আমাদের মুখের আসল ভাষা শুনলে সভ্য সমাজ সভয়ে, দুহাত উঠিয়ে কান চাপা দিয়ে উঠবে, মুখে ছি ছি করে উঠবে। এমনটা আমি চাচ্ছি না, অন্তত এখনের জন্য।
“কি গো মিয়া, যাইবা না নাকি? চায়া চায়া কী দেখ আমার গতরের দিকে?খাড়ায়াই থাকবা রাইতভর?”
রিকশাওয়ালা রিক্সায় উঠে পড়লো, পেডেল মারা শুরু হল।
৩
শুকনা কাঠ পোড়ার কটু গন্ধ নাকে এসে লাগছে। রিকশাওয়ালার সাথে একচোট খিস্তী-খেঁউড় করে চলে এসেছি। ভাড়া দেইনি, সেই নিয়েই গন্ডোগোলটা বেধেছে। রিকশাওয়ালা ঘাগু লোক, পয়সা ছারা ছাড়তেই চাইছিলো না। আমিও ঝানু মাল, একচোট গালাগালির পরেও যখন কাজ হচ্ছিল না দেখলাম, তখন কাপড় উঠিয়ে দেখাতে গেলাম শালাকে। ব্যাস হয়ে গেল, বেটা আর বেশি কিছু বলল না, জোরে কয়েকটা গালি দিয়ে একবার শুধু বলল,” ভালো মনে কইরা উঠাইসিলাম। এই লাইগাই তোগোরে কেউ উঠায় না। আল্লাহর কসম, বাকি জীবনে যদি হিজড়া উঠাইসি গাড়িত…! ” আমি আরেক ফের বকাবাদ্য করলাম। রিকশাওয়ালা বিড়বিড় করে গালি দিতে দিতে চলে গেল।
আসলে ভাড়া আমি ঠিকই দিতাম ওকে, কিন্তু ওর ওমন উরুমধারুম ভাড়া চাওয়াটা শুনেই মেজাজটা খিচড়ে গেল। চৌধুরীপাড়া থেকে কমলাপুর স্টেশন নাকি আশি টাকা! আরে বেটা, তুই আমারে টানসস না হাতি টানসস? এত টাকা চাস! এত কষ্টের টাকা সব তোর ভাড়ায় দিয়া দেই আমি! শালা!
প্রচণ্ড শীত, ঢাকায় এমন শীত আর কবে পড়েছিল? খেয়ালে আছে, আমি যখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন এক বছর বিষম শীত পড়েছিল। আম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে শীতের গল্প করতাম তখন। আম্মা কখনো-সখনো শুনতো, বেশির ভাগ সময়ই শুনতো না। পিঠা বেচাকেনায় ব্যস্ত থাকতো। শীতের মাঝামাঝিতে যখন তীব্র শীত পড়তো তখন আম্মার বেচাকেনা ভালো হত। একবার পিঠা বানানো, তারপর খরিদ্দার কে পিঠা এগিয়ে দেয়া, এতো সবের মাঝে তার সময় কই আমার বাচ্চা বাচ্চা গল্প শোনার? আমি অবশ্য কারো শোনার পরোয়া করতাম না, কেউ শুনুক বা না শুনুক তাতে কোনো কিছু যাওয়া আসার মতো বয়স আসলে তখন ছিলোও না আমার , শুধু নিজের মনে বকে যেতাম। চোখ বুজলে সেই দিনগুলোর ঝাপসা রূপালী প্রতিচ্ছবি এখনো মনে ভাসে। আমার সব পুরোনো স্মৃতি জীবন থেকে মুছে গেছে, শুধু এই স্মৃতিটা কী করে যেন আধমরা, ঘোলাটে হয়ে এখনো মনের কোণে লুকিয়ে কোনো মতে বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে চেতনাতে এসে ওটা মনও খারাপ করে দিয়ে যায়, আর তখন আমার ভালো লাগে। কী আশ্চর্য! মন খারাপ হওয়াতেও আমার ভালো লাগে!
” আম্মা আম্মা ওয় আসছে।” রোকন ভীত গলায় আম্মাকে গিয়ে বলতে লাগলো। আম্মা পিঠা বানাচ্ছে। ভাপ ওঠা ভাপা পিঠা। আমি মাত্রই এসে পৌঁছেছি এখানে।
রোকনের কথায় আম্মা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখলো আমাকে। আমি এগিয়ে যেয়ে একটা ইট টেনে নিয়ে ওটার উপর বসলাম।
” কেমুন আছ আম্মা?”
” এদিকে কী মনে কইরা?”
” আইলাম। অনেক দিন তো দেখি না তোমাগোরে। রোকনডারেও দেখি না অনেকদিন। “
আম্মা আড়চোখে একবার রোকনের দিকে তাকালো, ভয়ে মুখ সাদা হয়ে আছে বেচারার। হিজড়াদের বিষম ভয় ওর।
” দিন কাল কেমুন চলে তোর? ”
” এই তো চলে কোনোরকম।”
বেশ অনেকক্ষণ নীরব থাকলাম। আম্মা হঠাত একটা চিতই পিঠা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ” নে, পিঠা খা একটা।”
আমি সেটা নামায়ে রেখে বললাম, ” একটা ভাপা পিঠা দেও না আম্মা, অনেকদিন ভাপা পিঠা খাওন হয় না।”
আম্মা মুখ ঝামটা মারলো। আমাকে ভাপা পিঠা দিয়ে তার পোষাবে না। আমি তাকে এক পয়সা খরচা দেই না, ছয়মাসে একবার কী দুইবার দেখতে আসি, আমার প্রতি তার তেমন কোনো দায়িত্বও নাই। দায়িত্ব না থাকলে মমতাও কমতে শুরু করে। তার উপর আম্মার নতুন জামাই, অবশ্য বিয়ে হয়েছে আমার আব্বা মারা যাবার তিন মাসের ভেতরেই, তার আবার একটু বাংলা খাওয়ার অভ্যাস আছে, সেই খরচও তাকেই দিতে হয়।
আমি একটু রসালো গলায় আম্মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ” তোমার ভাতারের মাইয়া -পোলা হওনের কথা হেডার খবর কী আম্মা?” আম্মা ঝট করে আমার দিকে তাকালো।
” মারে এইসব জিগাস, শরম করে না তোর?”
” হিজড়ার আবার শরম! হাসাইলা…”
আম্মা চুপ করে থাকলো। মুখটা দারিদ্র্যের কষাঘাতে শক্ত কিন্তু তাও, সেখানে একপলকের জন্যই কিনা, আমি মায়ার ঝলক দেখতে পেলাম। অবশ্য এটা আমার মনের ভুলও হতে পারে। তবুও আমি ভুলটাকে সত্য মানলাম। তিন সত্য মানলাম।
” তয়, যাই আম্মা। কীরে রোকন যাইগা, এই দিক আয়। বিশটা টেকা নিয়া যা।”
রোকন ভয়ে ভয়ে হাত বাড়িয়ে দিল, আমি বিশ টাকার একটা দলামোচড়া পুরানো নোট ওর হাতে ঠুসে দিলাম। আম্মার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। পেছন হাটতে শুরু করলাম। বেশ অনেকটা দূর এসেছি এমন সময়, পেছন থেকে রোকন দৌড়াতে দৌড়াতে এলো। ওর হাতে একটা কাগজের ঠোঙগা। ও কিছু না বলেই ঠোংগাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল, তারপর যেমনি দৌড়ে এসেছিলো তেমনি দৌড়ে ফিরে গেল।
আমি ঠোঙ্গাটার ভেতরে তাকিয়ে মৃদু হেসে উঠলাম।
ঠোঙ্গাগার ভেতর চারটা ভাপা পিঠা ছিল।
(সমাপ্ত)
অস্পৃশ্য
-রিফু
৪.ভালোবাসার রোমান্টিক গল্প
[১৮+ সতর্কীকরণ ]
১
জৈষ্ঠ্যের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে বউ পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে রমিজ উদ্দিন বাইরে হাওয়া খেতে বেরোলেন৷ ঘণ্টা দুই পর ফেরত এসে দেখলেন তার বছর পাঁচেকের ছেলে আতঙ্কিত চোখে মাটিতে পড়ে থাকা নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। রমিজ উদ্দিন কিছুটা নেশায় ছিলেন, তৎক্ষনাৎ তার মদের নেশা কেটে গেলো৷ স্ত্রীকে পিটিয়ে তিনি এখানেই ফেলে গিয়েছিলেন। পিটুনি কী বেশি হয়ে গেলো? অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে, টুম্পা কী জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নাকি, এখনও উঠছে না!
রাত পেরিয়ে দিন এলো, একুশ বছর বয়সী গৃহিণী টুম্পা বাণু আর মেঝে ছেড়ে উঠতে পারলো না। রমিজ উদ্দিন মদ্যপ হলেও মানুষ হিসেবে সকলের পছন্দের, জনাকয়েক লোককে নিয়ে বউকে মাটি চাপা দিয়ে ফেলে ছেলেকে নিয়ে শহর ছেড়ে চট্টগ্রাম চলে এলেন তিনি৷ তার জীবনের তেমন কোনও পরিবর্তন হলো না। আগে চালাতেন ভ্যান, চট্টগ্রামে চালাতে শুরু করলেন রিকশা। ষোলশহরের টিনের খোপের মতো একটা একটা রুমের বাসা ভাড়া করে তিনি ছেলেকে নিয়ে থাকতে শুরু করলেন। তার নেশা করবার গতিপ্রকৃতিতেও বিশেষ পরিবর্তন দেখা গেলো না। খানিকটা কমলো, তবে সেটা না কমারই সামিল৷
রমিজ উদ্দিনের ছেলে জগলুল উদ্দিনের জীবনের অবশ্য অসামান্য পরিবর্তন ঘটলো৷ আপাতদৃষ্টিতে সেই পরিবর্তন হয়তো চোখে পড়বে না, কিন্তু সামান্য মনোযোগ দিলেই জগলুলের মানসিক অসামঞ্জস্যের রূপটি চোখে উৎকট হয়ে ভেসে উঠবার কথা। সদা মদ্যপ রমিজ উদ্দিনের চোখে ছেলের এই পরিবর্তন ধরা পড়াটা যুক্তিসংগত ছিলো না, এবং তিনি তা ধরতে পারলেনও না৷ ছেলে তার ক্রমশ দূর থেকে দূরে হারিয়ে যেতে শুরু করলো৷ দীর্ঘ ছয়মাস পরে রমিজ উদ্দিন খানিকটা টের পেলেন, তার ছেলেটার আচার আচরণে একটু অসামঞ্জস্যতা এসেছে৷ তার ছেলে তো কখনও এমন ছিলো না! হাসিখুশি, সদা চঞ্চল জগলুল আজকাল এমন স্থবির হয়ে গেছে কী কারণে!
পুরো দুদিন লাগিয়ে রমিজ উদ্দিন মনে মনে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করলেন। মায়ের ওভাবে মৃত্যু যে ছেলেটার ছোট্ট মনের অঙ্গনে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ষোল শহরে ততোদিনে তার বেশ কিছু বন্ধুস্থানীয় মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। এর মাঝে একজন হলো ইমাম মিয়া। ইমাম মিয়া বয়সে রমিজ উদ্দিনের থেকে বয়স পনেরো বড়, ধার্মিক বিশ্বাসী মানুষ। রমিজ উদ্দিনের মতো যুবা পুরুষ স্ত্রী ছাড়া চললে যে জেনা করবেই করবে, এই ব্যাপারে তার পূর্ণ আস্থা ছিলো। নতুন বন্ধু রমিজের জাহান্নামে বিচরণ কী করে ঠেকানো যায় তা নিয়ে চিন্তা করে নিজের বার্ধক্যের অখণ্ড অবসরের বেশ অনেক অংশ তিনি রোজ কাটিয়ে দিতেন। তাই রমিজ উদ্দিন যখন ছেলের ব্যাপারে চিন্তিত হয়ে বন্ধুস্থানীয় মানুষদের সঙ্গে আলাপ করতে গেলেন তখন ইমাম মিয়া ভাবলেন এই তো সুযোগ।
ইমাম মিয়া সুযোগের সদ ব্যবহার করলেন৷ রমিজ উদ্দিন সেদিন রাতে নেশা করে বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলেন, ইমাম মিয়া জ্ঞানী মানুষ, ভালো একটা উপায় বাতলেছে। মা মরা ছেলের মায়ের চাইতে বেশি আর কী-ই বা প্রয়োজন হতে পারে!
মাস খানেক কেটে গেলো। রমিজ উদ্দিনের জন্য পাত্রী খোজা শুরু হয়েছে। জগলুল উদ্দিনকে তাতে তেমন উদ্দীপ্ত হতে দেখা গেলো না। সে নিজের মতোই থেমে রইলো। এতো নীরবে ওর জীবন চলতে থাকলো যে সময়ে সময়ে মাঝে মাঝে ওকে বোবা-বধিরও মনে হতো। মায়ের মৃত্যু ওর জীবনকে বাস্তবিক অর্থেই এক বিন্দুতে থামিয়ে দিয়েছিলো। ও থেমে ছিলো সেই অন্ধকার দমবন্ধ রাতের প্রথম প্রহরেই, মায়ের শরীরের একটু দূরে, মাথাটা হাঁটুর ওপর রেখে স্ফীত চোখে মায়ের শরীরটার দিকে তাকিয়ে।
*
আষাঢ় মাসে রমিজ উদ্দিনের বিয়ে ভাগ্য খুলল। এক মেয়ের সঙ্গে তার ব্যাটে বলে মিলে গেলো। মেয়েটি অতিশয় গরীব ঘরের, বয়স বিশ, তালাক প্রাপ্ত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো মেয়েটি বাঁজা, সন্তান হইয়ে জগলুল উদ্দিনের সুখ উজাড় করবার মতো পরিস্থিতি মেয়েটি কখনওই তৈরি করতে পারবে না। রমিজ যে ছেলের জন্য এতো ভাবেন, এটা সেই প্রথম আসেপাশের মানুষজন টের পেলো।
রমিজ উদ্দিনের সুনাম আরও খানিকটা বেড়ে গেলো।্র
শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় অল্প কিছু লোক নিয়ে পাঞ্জাবী, লুঙ্গি পড়ে রমিজ বিয়ে করতে গেলেন। জগলুল উদ্দিনও দেড়শ টাকার নতুন পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাপের পেছন পেছন পুতুলের মতো গেলো। মানুষ তাকে পুতুলের মতোই দেখলো, কয়েক মুহূর্ত দেখে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো।
রমিজ উদ্দিন, ইমাম মিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফোটালেন। তিন কবুল বলে বিয়ে সেরে ফেললেন। সকলে দু টাকায় বিক্রি হওয়া বাসি লাড্ডু মুখে দিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে শুরু করলো। শুধু যাদের ঘিরে এই সমস্ত আয়োজন, সেই নববিবাহিতা কন্যা আর রমিজ উদ্দিনের উদ্ভ্রান্ত সন্তান নিজেদের অন্ধকার, নিস্তব্ধ মনের আঙিনাতে চুপ করে বসে নিজেদের কোলের দিকে তাকিয়ে রইলো। আনন্দ কিংবা বেদনা, কোনও অনুভূতিই তাদের মনে অনুভূত হলো না।
২
নতুন বউয়ের নাম শাপলা বাণু৷ দেখতে তেমন সুন্দরী নয়, মুখটা ব্রণে ভরা, চুল গুলো শুষ্ক৷ রোজ এদিক ওদিক চেয়ে তেল দেয়ার পরেও চুলের এই অবস্থার কোনও অদল বদল হয় নি।
শাপলা বাণু খাটো মানুষ। এতো খাটো যে আর আধফুট খাটো হলে তাকে বামুনের কাতারে ফেলা যেতো। সন্তান জন্মদানের পর নারীদের দেহে কিছুটা ওজন আসে, শাপলা মানুষ বাঁজা মেয়ে হয়েও ঠিক তেমনই দেখতে। মোদ্দা কথা হচ্ছে শাপলা বাণুর শরীরটায় সুন্দরের ছিটেফোঁটাও নেই, তা হোক মানুষের চোখে কিংবা নিজের চোখে। নিজের অপ্রাপ্তি নিয়ে এক সময় হয়তো আফসোস ছিলো শাপলা বাণুর, কিন্তু জীবনের যাতাকলে সেই আফসোস এখন ফিকে হয়ে গেছে।
শাপলা বাণু এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
প্রথমবার যখন বিয়ে হলো ভাইয়েরা তখন হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো শাপলা বাণুর। যদিও কী করে সেই বিয়েতে তাকে কন্যা হিসেবে পছন্দ করা হয়েছিলো সেটা এখনও রহস্য! কিন্তু বিয়ের দুবছরের মাথাতেই যখন বন্ধ্যা সার্টিফিকেট নিয়ে শাপলা ফেরত এলো, তখন দীর্ঘশ্বাস ভর্তি বিরক্তি ফেলা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখলো না তার ভাইয়েরা নিজেদের চোখের সামনে।
সৃষ্টিকর্তা এক আষাড় মাসে তাদের উপায় করে দিলেন। শাপলার বড় ভাইয়ের মামা শ্বশুর একটা সম্বন্ধ নিয়ে এলো। শ্রাবণ মাসের এক সন্ধ্যায় রমিজ উদ্দিন নামের এক রিকশাওয়ালা শাপলাকে বিয়ে করে নিজের এক রুমের ভাড়া ঘরে এনে জায়গা দিলো।
এই যে জায়গা হলো, এই অসামান্য দানের জন্য শাপলা বাণু নিজের নতুন স্বামীর প্রতি মনে মনে অসম্ভব কৃতজ্ঞ হয়ে রইলো। খুশি অবশ্য সে খুব একটা হতে পারলো না। তার আগে স্বামীর বয়সটা বেশ কম ছিলো, তাকে আদরেও রাখতো শুরুর একটা বছরে বেশ। কিন্তু বাচ্চা যখন হলো না তখন স্বামীর মতি পরিবর্তন হতে শুরু করলো৷ তাকে দোষ দেয়া যায় না, এতো বাহ্যিক দোষের পরেও যে তাকে সে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলো এই-ই তো অনেক!
নতুন ঘরে স্বামীর সঙ্গে সখ্যতা বাণুর তেমন একটা হলো না। স্বামী রমিজ উদ্দিন রোজ রাতে মদ গিলে বাড়ি ফেরেন। প্রায় রোজ রাতেই তাদের মিলন হয়। মাসিকের সময়টায় বলে কয়ে থামাতে হয়৷ মাঝে মাঝে দমবন্ধ করা ব্যথা হলেও শাপলা বাণুর বলতে ভয় হয়, তাকে যদি আর তিনি না ছোঁয়, সেকথা ভেবে। রমিজ উদ্দিন ভয়ের সুযোগ নিয়ে বিরতিহীন ভাবে নিজের স্ত্রীর শরীরকে সুখ দেবার চেষ্টা করেন। নিজের কুৎসিত, যুবতী স্ত্রীকে সুখ বিলোচ্ছেন, এরকম ভেবে মনে মনে কিছুটা মানসিক প্রশান্তিও অনুভব করেন তিনি।
নতুন বউকে যেই কাজে আনা হয়েছিলো সেই কাজে উন্নয়নের বাতাসও আস্তেধীরে লাগতে শুরু করে। শাপলা বাণুর অসংখ্য স্বপ্ন অপূর্ণ হয়ে থাকলেও বাচ্চা কাচ্চা হওয়ানোর কোনও স্বপ্ন কখনও, কোনওকালে ছিলো না। কিন্তু গত বিয়েতে যখন শুনলো সে বাজা মেয়ে তখন আকস্মিকভাবেই তার চিন্তাধারায় পরিবর্তন এলো। হুট করেই একটা বাচ্চার জন্য তার মন বেজায় হা-হুতাশ করতে শুরু করে দিলো। যেখানে যে বয়সী বাচ্চাই দেখুক তার সবাইকেই পছন্দ হয়ে যেতে শুরু করলো। বুকের দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে ভাইদের সন্তানদের সে গভীর মমত্ববোধের সঙ্গে পালতে শুরু করেছিলো। বিয়ের পর সে নিজের জন্য একান্ত একটি সন্তান পেলো। জগলুল উদ্দিনের জন্য দীর্ঘদিন পর বাস্তবিক অর্থেই সৃষ্টিকর্তা একজন অপূর্ণ মা খুঁজে দিলেন। দীর্ঘদিন পরে মাতৃস্নেহ পেয়ে জগলুল উদ্দিনের মনের শক্ত খোলসটায় খানিকটা যেন চিড় ধরতে শুরু করলো, এবং সেই চিড় দিনকে দিন শুধু বড়ই হলো। জগলুলের চিড় যতো বড় হলো ততই শাপলা বাণুর অপূর্ণ মাতৃমন পূর্ণ হলো। সৃষ্টিকর্তা তাদের দুজনকে দেখে মুচকি হাসলেন।
৩
সময় কেটে গেলো৷ জগলুল বেশ অনেকটা বড় হয়ে গেলো। শাপলার খুব ইচ্ছে ছেলেকে সে স্কুলে পড়াবে। স্বামীকে তার খুব একটা বলতে হলো না, বোঝা গেলো মনে মনে রমিজেরও একই ইচ্ছে ছিলো৷
কোনও এক বছরের জানুয়ারি মাসে জগলুল উদ্দিন একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে গেলো। ষোলশহর স্টেশনটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র৷ হরহামেশাই এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা বসে বসে আড্ডা দেয়। এর মাঝে এক দল ছেলে মেয়ে মাঝে মধ্যে স্লেড, অক্ষর বই এসব নিয়ে এসে স্টেশন মাস্টারের ঘরের পাশের খালি জায়গাটায় প্লাস্টিক বিছিয়ে আসেপাশের শিশুদের পড়িয়ে যায়। সপ্তাহান্তে একবার আসে ওরা। জগলুল উদ্দিন এই স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপটির কাছ থেকে অক্ষর জ্ঞানসহ বেশ কিছু কবিতাও শিখেছিলো। দেখা গেলো, ওর স্মৃতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ম৷ যা কয়েকবার দেখে তা খুব বেতাল না হলে আর সহজে ভুলে না৷
সরকারি স্কুলে যেকোনও পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা জগলুলের জন্য আসলাম ভাইয়ের দোকান থেকে বান চুরি করে খাওয়ার মতো বিষয় হয়ে গেলো৷
এদিকে শাপলা বাণু আপাত নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতে থাকলো৷ রমিজ উদ্দিন আগের স্ত্রী টুমপা বাণুকে পেটাতেন কারণ সে কথা শুনতে চাইতো না, শাপলা বাণুর ক্ষেত্রে সে বালাই নেই, পেটানোর তাই প্রশ্নই আসে না। রমিজ উদ্দিন ইদানীং এই ভেবে ইষৎ তৃপ্তও হন যে তিনি অকারণে কোনওদিন কারও গায়ে হাত তোলেন নি।
যতই দিন এগুলো, দেখা গেলো ভালো ফলাফল জগলুলের জন্য ছেলের হাতের মোয়ার মতো বিষয়। বাবা-মা, শিক্ষক, সহপাঠী সকলেই খুশি। জগলুল দুরন্ত ছেলে, বন্ধু বান্ধবদেরও ওর ওপর নিরাশ হবার কোনও অবকাশ ছিলো না। ষোলো শহর স্টেশনের প্রতিটি লোকাল মুখ ওকে দেখে হাসতো৷
কিন্তু তবুও এক রাতে জগলুল হারিয়ে গেলো। এমনভাবে হারালো যেনো সেখানে ছোট্ট জগলুলের কখনও কোনও অস্তিত্বই ছিলো না। কিন্তু এটি অদূর ভবিষ্যতের আলাপ, বর্তমান শেষ করেই সেখানে যাই৷
বর্তমানের দুরন্ত জগলুল নিজের মাকে ভালোবাসতো। প্রতিদিন নিয়ম করে মা ওর কপালে চুমু না খেলে ওর পড়তে বসা হতো না। শাপলা বাণু ছেলের সঙ্গে এই আহ্লাদটা করতে যেয়ে নিজেই আহ্লাদে আটখানা হয়ে যেতো। তার এতো ভালো লাগতো, নামাজে বসে রোজ রাতে সে ছেলের সফলতা কামনা করে চোখ ভেজাতো। হয়তো সে ভাবতো, জীবনের তার যত অপূর্ণতা তার সব এই ছেলেটির ভেতর দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।
বাপের সাথে অবশ্য জগলুল অতটা ঘনিষ্ঠ ছিলো না। বাপের জন্য ছোট্ট জগলুলের মনের বড় একটা অংশ এক অজানা অনুভূতিতে ছেঁয়ে ছিলো। জগলুল সেই অনূভুতির স্বরূপ না চিনলেও যেকোনও অভিজ্ঞ মানুষ ওর মনে ঢু মারলে বলতে পারতো, জগলুল মনে মনে বাপকে ঘৃণা করে। জমিয়ে রাখা একঘর অনূভূতির পুরোটাই ঘৃণায় বিষাক্ত! এই অনুভূতির জন্ম হয়েছিলো যেদিন শাপলা বাণুর উষ্ণ মাতৃস্নেহে জগলুলের মনের শক্ত, শীতল বরফ পিণ্ডটা গলতে শুরু করেছিলো সেদিন। যতোই বরফ গলেছে, ততোই বাপের প্রতি মনের ঘৃণাবোধ ওর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
একটা সময়ে এসে মনে মনে বাপকে জগলুল অস্বীকার করলো৷ না বুঝেই করলো। বাবা ওর জন্য হয়ে গেলো অচেনা, বহুদূরের কোনও মানুষ যে রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফেরে, ফিরে ঘরে পার্টিশন হিসেবে ব্যবহার করা দড়িতে ঝোলানো কাথাটাকে টেনে দিয়ে মায়ের উপর চড়ে বসে। জগলুলের বয়স কম, এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে ইতোমধ্যেই নারী পুরুষের কাম উত্তেজক ভিডিও দেখে ফেললেও নিজের মা-বাবার স্বাভাবিক যৌন জীবনকে মেনে নিতে ওর অস্বস্তি হতো।
ছোট্ট জগলুল জানতো না, তার বাবা-মায়ের যৌন জীবন ঠিক স্বাভাবিক ছিলো না। জানলে সম্ভবত আরও কিছুটা কষ্ট পেতো। বাপের প্রতি ঘৃণাবোধও হয়তো বাড়তো। তারপর এক সময় বুঝতে পারতো, এটা আসলে অস্বাভাবিক কোনও চর্চা নয়। এর জন্য রাগান্বিত হবার সুযোগ থাকলেও বদলানোর সুযোগ ওর হাতে নেই।
*
রমিজ উদ্দীন সচরাচর সন্ধ্যায় বাসায় থাকেন না৷ যেই অল্প কিছুদিন তিনি বাসায় সন্ধ্যা কাটান তার সবগুলোই তিনি ছেলের পেছনে কাটাতে চান। রমিজ উদ্দীন চন্দ্রিমার এক বেশ্যার জারজ সন্তান হিসেবে নিজের শৈশব পার করেছেন, বাবাকে তিনি কখনও দেখেন নি, দেখার প্রয়োজনও অনুভব করেন নি। বস্তুত তার মা তাকে বুঝিয়েছিলো, তার বাপ অনেকগুলো, প্রত্যেকেই তাকে ভালোবাসে, প্রত্যেকেই মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসে। পাঁচ বছর বয়সেই রমিজ উদ্দিনের জ্ঞান হয়, মা তাকে মিথ্যে বুঝিয়েছেন। তিনি মন খারাপ করেন নি। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক হিসেবে নিয়েছেন। শরীর খাটানোর বিষয়টি তখনও তার কাছে পরিষ্কার হয় নি, কিন্তু সেটা যে ভালো কিছু না, সেটা বেশ্যাপল্লীর বাকি মানুষদের কথাবার্তা আচার আচরণে বেশ বুঝতে পারতেন৷ মা একটা খারাপ কাজ করছে খারাপ সময়টাকে পার করবার জন্য, ভালো সময় এলেই তারা এখান থেকে বেরিয়ে যাবে, এভাবেই ভাবতে পছন্দ করতেন তিনি।
তার মা আর কখনও বেশ্যাপাড়ায় বাইরে পা রাখতে পারে নি। জীবনের যৌবন সে নটি পাড়ায় পার করেছে, মধ্য বয়সের শেষ দিকে যখন তাকে মুক্তি দেয়া হলো তখন সমাজ থেকে তাকে নিষেধাজ্ঞা জানানো হলো। মা তার আবারও পুরাতন নীড়ে ফিরে গেলেন। রমিজ উদ্দিন তাতেও মন খারাপ করেন নি। সমাজের রীতিনীতি মানতে হবে, এটাই বাস্তবতা, এতে অখুশি হবার কিছু নেই। মাঝেমাঝে অবশ্য তার আফসোস হয়। আজকাল সময় পালটেছে, বস্তি ভর্তি বেশ্যা থাকলেও এখন লোকে কিছু বলে না, জেনে, বুঝে অদেখা করে। মা আর দশ পনেরো বছর পরে জন্মালে এখন আরামে এরকম কোনও একটা ছোটখাটো জায়গায় ঘর ভাড়া করে তাকে নিয়ে থাকতে পারতো৷
কিন্তু আফসোস, আফসোস পর্যন্তই সীমাবদ্ধ, এই সামান্য আফসোস তার মন খারাপ করতে পারে না। যে বিষয়টা তার মন খারাপ করে সেটা হচ্ছে তার নিজের ছেলে তাকে খুব একটা পছন্দ করে না। সৎ মাকে এতো পছন্দ করে অথচ নিজের বাপকে ছেলেটা পছন্দ করে না!
রমিজ উদ্দিনের নিজের জীবনকে বেকার মনে হয়। ছেলের মন জেতার জন্য মাঝেমাঝেই দিনে অহেতুক খরচ করে এটা সেটা নিয়ে আসেন। ছেলে সেসব আনন্দিত মুখে গ্রহন করে, কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, ছেলের সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও তাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয় না। ছেলে তাকে ঠিক সেই নজরে দেখে যেই নজরে বয়স হবার পর থেকে তিনি নিজের মিথ্যে বাবাদের দেখতেন।
রমিজ উদ্দিনের কষ্ট হয়। রাগও হয়। কিন্তু কাউকে তিনি কিছু বলে উঠবার মন করে উঠতে পারেন না। খুব রাগ হলে মাঝেমাঝে ছেলেকে তিনি বিনা কারণে শাস্তি দেন। ছোট ধরণের শাস্তি৷ বাসায় অল্প সময়ের জন্য আটকে রাখেন কিংবা খেলতে যেতে বাধা দেন। শাপলা ভালো মেয়ে, তার মুখের ওপরে কিছু বলে না৷ ছেলেও কিছু বলে না। ছেলের ভেতরের প্রচ্ছন্ন নির্লিপ্ততাকে তিনি পড়তে পারেন। তার আর ছেলের মধ্যকার ক্ষীণকায়, পাতলা, রক্ষণশীল মানসিক আবরণীটাকে তিনি অনুভব করতে পারেন। কিন্তু সেই আবরণী ভেদ করবার কোনও সাহস তিনি করে উঠতে পারেন না৷ হয়তো তার ভয় হয়, আবরণী ভেদ করলে তিনি নিজের ছায়াকেই দেখতে পাবেন।
*
চৈত্রের এক ভ্যাঁপসানো রাতে রমিজ উদ্দিন বাড়ি পড়ে আছেন। শাপলা বাণু রান্নাঘরে ঘাম ঝড়াচ্ছেন। তার রান্নার হাত অসম্ভব রকমের ভালো৷ আক্ষরিক অর্থেই তিনি যা-ই রাধেন তা-ই অমৃত হয়। স্বামী তাকে রান্নার প্রশংসায় সব সময়ই পঞ্চমুখ করেন। ছেলেও তার রান্না বেশ পছন্দ করে।
রোজার ঈদ চলে এসেছে আজ বাদে কাল, একেবারে ঘরের মুখে। জগলুল উদ্দিন মুখ কালো করে পড়ার টেবিলে বসে আছে। এসময় সাধারণত রমিজ উদ্দিন ঘরে থাকেন না, ও স্টেশনে এদিক ওদিক বসে আড্ডা দেয়৷ কদিন ধরে বাপ ওর ঘরে থাকছেন, সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসাচ্ছেন। জগলুল উদ্দিনের অসহ্য লাগছে। ঈদের আগে মানুষ এভাবে কোনওদিন পড়ে নাকি?
এদিকে রমিজ উদ্দিন অলস সময় কাটাচ্ছেন। তার সময় কাটছেই না। সপ্তাহ দেড়েক আগে মদ্যপ অবস্থায় এক ছোকড়ার সঙ্গে তার কিঞ্চিত বাকবিতন্ডা হয়েছিলো। বাকবিতন্ডা হাতাহাতি পর্যন্ত চলে যেতো কিন্তু তার আগেই আসেপাশের বন্ধুস্থানীয় লোকেরা দুজনকে আলাদা করে এনেছে। তিনি একরাশ গালমন্দ করে তারপর বাড়ির পথ ধরেছিলেন। এখন তিনি কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছেন। জানা গেছে সেই ছোকড়াটি স্থানীয় ছাত্র নেতা রুহুল বাঞ্চোদের প্রিয় মুখ। যে সকল অশ্রাব্য গালি তিনি সেরাতে দিয়েছেন সেসব কিল, ঘুষি, লাথি হয়ে ফিরে আসবার জোড়ালো সম্ভাবনা আছে বলে তিনি আশংকা করছেন। তাই কদিন ধরে রাতে বাড়িতেই আছেন, পান করতে বেরোচ্ছেন না।
নটা পর্যন্ত উঠে পড়বার পর জগলুল যখন উঠতে গেলো তখন হাতে আর কোনও কাজ না পেয়ে রমিজ ছেলেকে ধমক দিয়ে পুনরায় পড়তে বসালেন। জগলুল উদ্দিন বিরক্তিতে ফেটে পড়লো, কিন্তু বাপের মুখের উপর কিছু বলতে পারলো না। গুম হয়ে শুধু সামনের খুলে রাখা বাংলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।
এগারটা নাগাদ ছেলেকে ছুটি দিলেন তিনি। জগলুল উদ্দিনের বেজার মুখ দেখে বোধহয় তার অনুশোচনা হলো। তাছাড়া আটটার দিকে ফেরার পথে জগলুলকে মার্বেল খেলা থেকে উঠিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তিনি ধমকে। তাই সাত পাঁচ ভেবে ছেলেকে বললেন গায়ে জামা চাপাতে, বাপ-বেটা একসাথে কিছু সময় বাইরের হাওয়া খেয়ে আসবেন। ছেলের সঙ্গে একান্তে তার তেমন সময় কাটানো হয় না। এই সুযোগে সেটাও হবে।
শাপলা বাণু ভাত বেড়ে ফেলছিলো, রমিজ উদ্দিন না করলেন। মিনিট ত্রিশেক পরে একেবারে ছেলেকে নিয়ে ফিরে খাবেন। জগলুলকে তাড়া লাগালেন তিনি। অহেতুক তাড়া, তাড়া দেয়ার কোনও প্রয়োজন আসলে নেই। ছেলেকে নিয়ে হাঁটবেন এই কথা চিন্তা করে তিনি সম্ভবত কিছুটা উত্তেজিত। বারে বারে তাড়া লাগালেন ছেলেকে। জগলুল চোখমুখ শক্ত করে জামা গায়ে দিলো। বাপকে ও এমনিতেই পছন্দ করে না, তার উপর আজ তো ধমকে খেলা থেকে উঠিয়ে এনেছে। বাপের উত্তেজনা ওকে না ছোঁয়াটাই স্বাভাবিক।
পিতাপুত্র বাসা ছেড়ে বেরুলো। রাস্তা জনশূন্য। সাধারণত এই সময়ে এতো কম মানুষজন থাকে না, ঈদ কাছিয়ে যাওয়ায় সম্ভবত পথ ভীড়শূন্য হয়ে গেছে৷
পথের পাশের সব দোকান বন্ধ, গলিটা অন্ধকার হয়ে আছে। এই অন্ধকারের মধ্য দিয়ে রমিজ উদ্দিন ও জগলুল উদ্দিন চুপ করে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। রমিজ উদ্দিন হঠাৎ আবিষ্কার করেছেন, ছেলের সঙ্গে গল্প করবার মতো কোনো কথা আসলে নেই। নাকি আছে কিন্তু এখন মনে পড়ছে না?
রমিজ উদ্দিন মনে করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমোদপ্রিয় মানুষ, গল্পের তার অভাব হবার কথা নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে শালার কিছুই মনে পড়ছে না!
ওদিকে জগলুল উদ্দিনের গায়েও দীর্ঘ নীরবতার অস্বস্তিকর হলকা এসে লেগেছে। বাপের সঙ্গে কখনই তেমন করে কথা হয় নি ওর। তাছাড়া ওরা কোথায় যাচ্ছে তাও ও জানে না। হাসনাইনের কাছে শুনেছে, মুরাদপুরের এক মদখোর নিজের দু বয়স বয়সী মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছে কদিন আগে মদের পয়সা না থাকায়। ওর যদিও বয়স বারো, কিন্তু ওকেও যদি সেকারণেই নিয়ে বের হয়ে থাকে বাপ?
স্টেশনের সমস্ত দোকান এগারটার ভেতরেই বন্ধ হয়ে যায়। এখন ঈদের সময়, নটা সাড়ে নটার ভেতরেই দোকান পাঠের ঝাপ সব নামিয়ে ফেলা হয়েছে। রমিজ উদ্দিন হাজার ভেবেও ছেলেকে বলবার মতো কোনও কথা খুঁজে পান নি৷ এখন তিনি কোনও দোকান খোলা আছে কিনা তার আশা করছেন। দোকান খোলা থাকলে ছেলে কিছু কিনে দেয়া যাবে, আইস্ক্রিম কিংবা মিষ্টি জাতীয় কিছু। শাপলার মুখে তিনি শুনেছেন, জগলুল আইসক্রিম বিশেষ পছন্দ করে।
সমস্ত দোকান বন্ধ। জগুলুল আর রমিজ স্টেশন পেরিয়ে মেইন রোডের দিকে এগোলেন৷ জগলুলের একটু ভয় ভয় করতে শুরু করলো। বাপ ওর কদিন ধরে রাতে মদ খেতেও যাচ্ছেন না। এমন একটানা কখনও হয় নি। সে কী তাহলে পয়সার ওভাবে ওকে বিক্রি করে দিতে নিয়ে যাচ্ছে?
মেইনরোডে ধরে একটু সময় হাঁটবার পর একটা দোকান খোলা পাওয়া গেলো। এই দোকানটি চব্বিশ ঘন্টার দোকান। খুব বড় কারণ ছাড়া এই দোকানকে ঝাপ নামানো অবস্থায় কোনওদিন দেখেন নি রমিজ।
বেরুনোর পর জগলুলের সঙ্গে তার প্রথম বাক্য বিনিময় হলো, ” কী খাইবা? “
জগলুল বুঝতে না পেরে তাকিয়ে রইলো৷ রমিজ উদ্দিন আবারও বললেন, ” কী খাইবা? “
জগলুল মিনমিন করে বলল, ” আপনে যা পছন্দ করেন…”
রমিজ উদ্দিন একটা কোন আইসক্রিম পছন্দ করলেন ছেলের জন্য। টাকাটা দেবার সময় ছেলের মুখের দিকে আড়চোখে তাকালেন তিনি। ছোট্ট একটা তৃপ্তির নিশ্বাস তার ভেতর থেকে বেড়িয়ে গেলো৷
ছেলে তার খুশি হয়েছে।
ফেরার পথে ছেলের সঙ্গে টুকটাক কথা শুরু হলো রমিজের। বস্তুত তার ছেলে যে খুশি হবার চাইতে বিস্মিতই বেশি হয়েছে, এটা সে ধরতে পারলো না, পারলে বোধহয় অতটা তৃপ্তি থাকতো না তার নিশ্বাসে৷
সুন্দর, সুখী সুখী একটা সময় যাচ্ছিলো৷ ছেলের সঙ্গে ভালো সময় মাত্র কাটাতে শুরু করেছিলেন তিনি। রমিজ উদ্দিন খুশি ছিলেন। জগলুল উদ্দিন বিস্ময়ে ছিলো। কিন্তু তবুও তাদের দেখে সৃষ্টিকর্তা এবারে মুচকি হাসি হাসতে পারলেন না।
রমিজ উদ্দিনের পিতৃহৃদয় পরিপূর্ণ উষ্ণতা ছড়ানোর আগেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটে গেলো। যে ছেলেটির সঙ্গে তার কুৎসিত বাগবিতণ্ডা হয়েছিলো, দৈবক্রমে তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো রমিজের। ছেলেটি রোডের একটা বন্ধ টং দোকানের পেছনের দিকে বসে মদ গিলছিলো আর কয়েকজনকে নিয়ে। রমিজকে দেখে চিনতে পারে নি প্রথমটায়। রমিজও ছেলেটিকে দেখতে পান নি। ছেলেকে নিয়ে তিনি ধীর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ ছেলেদের মধ্যে কে যেনো একটা ঢিল ছুড়ে মারলো। জগলুল উদ্দিন পায়ের চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়লো ব্যথায়। রমিজ পুত্রের এহেন পরিণতিতে বিষম রেগে উঠে নিজের গলার সমস্ত রগ ফুলিয়ে ছেলেদের দলটিকে উদ্দেশ্যে গালি দিয়ে বসলেন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলবার সুযোগ থাকলে সৃষ্টিকর্তা হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন, কিন্তু তিনি তো এসব অনুভূতির ঊর্ধ্বে, তিনি শুধু তাকিয়েই রইলেন।
ছেলেটি রমিজ উদ্দিনের গলা চিনে ফেলল। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে এগিয়ে এলো সে। রমিজ উদ্দিনের রুদ্রমূর্তি তৎক্ষণাত হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। ছেলেদের দলটি এসে গাল মন্দ শুরু করে প্রথমেই একটা প্রকাণ্ড চড় বসিয়ে দিলো তার গালে৷ চড়ের প্রতিক্রিয়ায় রমিজ উদ্দিন কয়েক মুহূর্তের জন্য চোখের সামনে অন্ধকার দেখলেন। সে অন্ধকার কাটবার আগেই মুখে, পেটে, পিঠে সমানে কিল পড়তে শুরু করলো। কে যেনো তলপেট বরাবর খুব জোরে একটা লাত্থি দিলো। ব্যথায় রমিজ উদ্দিনের মুখটা নীল হয়ে গেলো। মাটিতে লুটিয়ে পড়বার সময় তার মুখ থেকে অদ্ভূত গোঙানির
আওয়াজ বেরুলো।
রাতের নিস্তব্ধতা লাথি আর গালির শব্দের আড়ালে চাপা পড়ে গেলো। ঘটনার ভয়াবহতায় পাশে বসে থাকা কিশোর জগলুলের মুখটা আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে এমন কী ছোট্ট কোনও আর্তচিৎকারও বের হচ্ছে না ওর। বাপকে এখন আর ও দেখতে পাচ্ছে না। মানুষগুলো গোল হয়ে দল বেধে লাথি দিয়ে যাচ্ছে তাকে। জগলুলের হাতের কোণটা এখন আর ওর হাতে নেই।
বাপের কিনে দেয় আইসক্রিমটা বাপের মতই ধুলোর পড়ে খাবি খাচ্ছে এখন৷
জগলুল উদ্দিন বহুকষ্টে উঠে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় করলো।
ছেলেগুলোর ওর দিকে কোনও মনোযোগ নেই।
জগলুল উদ্দিন বাপকে ফেলে পালিয়ে গেলো।
রমিজ উদ্দিন মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে মারা গেলেন।
পরদিন তার মৃতদেহ পুলিশ এসে নিয়ে গেলো। ছেলেগুলো সব কদিন গা ঢাকা দিলো। কদিন মানুষ খুনের ভয়াবহতায় আতঙ্কে কাটালো। তারপর ভুলে গেলো। কিন্তু কেউই রমিজ উদ্দিনের মৃত্যুতে দুঃখ পেলো না। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক, রমিজ উদ্দিন মজার মানুষ হলেও প্রয়োজনীয় কোনও মানুষ ছিলেন না।
শাপলা বাণুকে আবারও ভাইয়েদের ঘরে যেয়ে উঠতে হলো ।
*
আমাদের গল্প শুরু হয়েছিলো জৈষ্ঠ্যের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে, যে রাতে রমিজ উদ্দিন নিজের প্রথম স্ত্রীকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলেন। সেই হত্যার কোনও বিচার হয় নি। বছর সাতেক পর চৈত্রের এক ভ্যাঁপসা গরম রাতে রমিজ উদ্দিন মার খেতে খেতে মারা গেলেন, এরও কোনও বিচার হলো না। সমস্ত জীবন মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাওয়া রমিজ সময়ের স্রোতে ভেসে ভেসে পশু হয়ে বেঁচে ছিলেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর দেখা গেলো, তার জীবনের মূল্য কোনও পশুর থেকেও কম। কীট পতঙ্গ কুচলে ফেলার মতোই সকলে তার অস্তিত্বকে কুচলে ফেলে এগিয়ে গেলো। ব্যতিক্রম হলো শুধু একজন, তার নিজেরই ছেলে জগলুল, যার সমস্ত ঘৃণা ফিকে হয়ে গিয়েছিলো বাপকে ফেলে পালিয়ে আসবার অহেতুক অপরাধবোধে।
রমিজ ছেলের ভেতর নিজের ছায়া দেখতে পাবেন ভেবে ভয় পেতেন। তার ভয় অমূলক প্রমাণিত হলো। দেখা গেলো জগলুল এখন নিজের ভেতর নিজের ছায়া দেখতে পেয়েই ভীত হয়।
বেশ্যাপুত্র রমিজ উদ্দিনের পুত্র সন্তান জগলুলের উদ্দিনের জীবনে কোনও জাদুকরী ঘটনা আর কখনও ঘটলো না। বাপের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সম্ভাবনাময়, উচ্ছ্বল জগলুল হারিয়ে গেলো। বাপের মতোই সমাজের কীটপতঙ্গদের ভীড়ে ওর ঠাই হলো।
(সমাপ্ত)
দ্বিপ্রহর
– রিফু
৫.অতিরিক্ত রোমান্টিক গল্প
আমাকে হা-ডু-ডু খেলার মাঝখান থেকে এনে বিয়ের আসরে বসানো হয়।
আমি খুব রেগে মাকে বকা দিচ্ছিলাম। মা আমার চুল টেনে কাল আমাদের বাসায় আসা দাদা টার পাশে বসিয়ে দিলো। আমি খেলা ফেলে এসেছি তাই আমাকে ডাকতে এসে আমার বন্ধুরা আমাকে এই অবস্তায় দেখে চলে যায়।
বাবা চা বাগানের সাধারণ লেভেলের অফিসার। এইটা আমাদের কলোনী। আট পরিবারের এই পাড়া। এক পাশে উচ্চ লেভেলের অফিসার দের পাড়া অন্য পাশে শ্রমিকদের। তাই এই পাড়ার বাইরে যাওয়া হয় না। আর এই আট পরিবারে দশ ছেলে মধ্যে আমি একটা মেয়ে। ওদের সাথেই বড় হই আমি। কে ছেলে কে মেয়ে অত কিছু বুঝার মতো জ্ঞান আমাদের ছিলো না। এক সাথে খেলি, হেরে গেলে মারামারি করি, আবার একজন অন্যজনকে ছাড়া চলে না।
আমরা চার জন এক ক্লাসে অন্যরা ছোট। তবে খেলায় সবাই সমান। এইখানের স্কুলে মাত্র পনের বছর বয়সে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ফেলি। এখন কোন পড়ালেখা নেই তাই সারাদিন ওদের সাথে ঘুরি। বিশাল বিশাল সবুজ গাছের ডালে সবুজের গালিচায় মাঝে মধ্যে কোথাও কৃষ্ণচূড়া ছড়ানো পাহাড়ের খাদে কাটে আমাদের ছুটি।
মা আমাকে ঘরে রাখতে চায়। আমি শুনি না। সাথে ছোট ভাই অনুপকেও সাথে নিয়ে যাই।
একদিন ঘুরতে ঘুরতে বড় সাহেবদের পাড়ায় পেয়ারা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ি। ওখানের এক স্যার আমাকে ডেকে বাবার নাম আর পাড়া কোনটা জিজ্ঞেস করে আমাদের যেতে বলে। ওনার একটা মাত্র ছেলে সে নাকি প্রতিবন্ধী তাই তার সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে পছন্দ হয়েছে। বাবা চিন্তায় পড়ে যায়। বাবার আপন বলতে শুধু এক বোন। মায়ের দিক থেকে কেউ নেই কারণ মা ওদের অমতে বাবাকে বিয়ে করেছিলো।পিসি টা ঢাকায় থাকে, বাবা ওনাকে সব খুলে বললে ওনি ওনার ছেলেকে নিয়ে আসে কাল রাতে। আজ তার সাথে আমার বিয়ে। আজ রাতেই চলে যাবে ঢাকায়। আমি তখনো বুঝি নি বিয়ে কি, কোথায় যাবো? এইসব আমি পরে জেনেছি।
আমার কাছে এই কলোনী বাইরে যা কিছু তা বাইরের দুনিয়া বলেই জানি। দেখা হই নি কখনো। পিসি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আমি নাকি একদম ওনার মেয়ে রিয়ার মতো। রিয়াকে আমি একবার দেখেছি। সব সময় অসুস্থ থাকতো। ক্যান্সারে শেষমেষ নিয়ে গেলো তাকে অন্য দুনিয়া।
মা আমাকে বলেছিলো আমার পরীক্ষা শেষ। আবার পড়া শুরু হতে হতে আমাকে বেড়াতে পাঠাচ্ছে। কাপড় নিতে চাইলে আন্টি বলে রিয়ার অনেক কাপড় পড়ে আছে নতুন। কিছু নিতে হবে না। তাও আমি দুইটা প্যান্ট নিয়েছিলাম কারণ সবে সেলোয়ার পড়া শুরু করেছিলাম দড়িতে গিট লেগে যেতো তাই মা রাবার দিয়ে সেলোয়ার বানিয়ে দেয়।
আমি পুরো রাস্তা ঘুম ছিলাম। সকালে ডেকে তুলে আমাকে বাসায় ঢুকানো হয়।
আমাদের সেমি-পাকা ঘর, স্যাতস্যাতে বাথরুম, ৬০ ওয়ার্ডের বাতি আর ইট ভেঙে ঘাস উঠা ঘরের থেকে এই বাড়ি যেন রাজ বাড়ি।
আমাকে পিসির সাথেই রাখা হয় সারাদিন এই ঘর ও ঘর ঘুরে বেড়ায় টিভি দেখি আর খেয়ে দেয়ে ঘুমাই।
মায়ের সাথে কথা হলে মা বলতো পিসির সাথে হাতে হাতে কাজ করতে। আমি রান্নাঘরে গেলেই পিসি বকা দিতো বলতো যখন সময় হবে সব তোকে করতে হবে।
আমি বলতাম কিছুদিন পর তো চলে যাবো। উনি তখন হাসতেন। আর বলে
-যা, ঘর গুছিয়ে ফেল তাহলে।
আমি ভুল করে উনার রুমে চলে যাই। বিছানায় কম্বল গায়ে ঘুমাচ্ছিলেন। উনি আমার সাথে কথা বলেন না তেমন। তার নাকি পরীক্ষা চলছে। আমি কম্বল টান দিতে উনি ধরফরিয়ে উঠে বসেন। আমি ভয় পাই। উনি বলে,
-এই মেয়ে, এইখানে কি করো? কিছু লাগবে?
আমি মাথা নেড়ে চলে আসি। আর কখনো যাই না সে রুমে।
মা বাবাকে আমাকে নিতে আসে না। রেজাল্ট দেওয়ার পর কাগজ পত্র নিয়ে আসে। এইখানের কলেজে ভর্তি করানোর জন্য। আমি বলি,
-আমি আর বাড়ি যাবো না?
মা বলে,
– মায়া এইটাই তোর বাড়ি। তোর বিয়ে গেছে। আর যাওয়া হবে না তোর সেখানে। এরা তোর মা-বাবা আর এই দাদা টা তোর স্বামী। এরা তোকে অনেক ভালো রাখবে। অনেক ভালোবাসবে। এতো ভালোবাসবে যে আমাদের ভুলে যাবি। আমাদের চেয়ে বেশি ভালোবাসবে।
আমি অবাক হয়ে বলি,
-এরচেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসে নাকি?
মা হেসে বলে, বোকা মেয়ে।
মা বাবার সাথে ওটা আমার শেষ দেখা। মাস খানিক পর পাহাড় ধসে আমাদের পুরো কলোনী চাপা পড়ে কেউ বেঁচে থাকে না। অতটুকু বয়সেই বুঝে গিয়েছিলাম আমি খুব একা। এরা ছাড়া কেউ নেই।
আমাকে এইখানের কলেজে ভর্তি করানো হয়। প্রতিদিন এক প্যান্ট পড়তাম তা পিসি খেয়াল করে। আমি চুপ থাকি। পরে বলি,
-আমি দড়ি প্যান্ট পড়তে পারি না।
পিসি এত জোরে হাসে। আর বলে,
-বোকা মেয়ে, আগে বলবি তো।
কলেজে গিয়ে আমি যেন কুয়ো থেকে সাগরে এসে পড়েছি। এইখানের মেয়েদের চালচলা, কথাবার্তা আমার কাছে টিভিতে দেখা মেয়েদের মতো লাগে। এইটা মেয়েদের কলেজ ছেলে ছিলো না তাও মেয়েদের মুখে শুধু ছেলেদের কথা ছিলো। আর একটা শব্দ বয়ফ্রেন্ড-গার্লফেন্ড।
আমার কোন বান্ধবী ছিলো না। তাও মাঝেমধ্যে ওদের মাঝে গিয়ে বসতাম। একজন বললো-
-কি রে মায়া, তোর কয়টা বয়ফেন্ড ছিলো?
আমি চুপ থাকায় আবার বলে,
-আরে ছেলে বন্ধু!
– ওহ! দশজন।
– ও গড, কি বলিস? কেমনে সামলাতি?
আমি আবার বোকা হয়ে যাই, তখন সেঁজুতি নামে একটা মেয়ে আমাকে বাঁচায়।
-আরে ও তো গ্রামে ছিলো, মে বি স্কুল ফ্রেন্ডদের কথা বলছে। তাই না মায়া?
-হ্যাঁ, আমরা এক পাড়ায় ছিলাম সবাই এক সাথেই খেলতাম। তবে এখন কেউ নেই, সবাই যে-
সবাই এত জোরে হেসে উঠে আমি বাকি কথা বলতেই পারি না।
সেঁজুতি ওদের মতো হলেও কেমন যেন কোমল ছিলো। আমার সাথে বেশ ভাব হয়ে গেলো। ও ক্লাস না করে বয়ফ্রেন্ডে সাথে ঘুরতে গেলে আমি ওর জন্য নোট করে রাখি।
ও বললো- চল তোর বাসায় যাই, কে কে আছে রে?
– পিসি, পিসো আর এক দাদা। মা বলেছিলো আমার নাকি দাদাটার সাথে বিয়ে হয়ে গেছে।
সেঁজুতি হাটতে হাটতে দাঁড়িয়ে যায়।
-এমা, তোর বিয়ে হয়ে গেছে?
তার ঠোঁটে চিমটি কেটে বলে,
-ফার্স্ট নাইট কেমন ছিলো রে, ব্যথা পেয়েছিলি বেশি? আমি তো কত স্বপ্ন দেখি এই দিনটা নিয়ে।
আমি ওর কথার আগামাথা কিছু বুঝি না।
-কি বলিস এইসব? আমি তো পিসির সাথে ঘুমাই।
আমি ওকে সব বলি। তখন ও বলে,
-তার মানে তোদের এখনো সেক্স হয় নি?
আমি ওর মুখে প্রথম এই শব্দটা শুনি। তখন ও আমাকে অনেক কিছু বুঝায় যা আমি হা করে শুনি। মোবাইলে কিছু ভিডিও দেখায় আমি প্রথমে ভয় পেয়ে যাই। আমার ভয় পাওয়া দেখে ও আরো জোরে হাসে।
ও বুঝায় সবাই করে এইগুলো। আমি অবাক হয়। যেটা আমার কাছে হাত পা চোখের মতো প্রস্রাবের জায়গা সেটার জন্য পুরো আলাদা একটা দুনিয়া। এত পাগলামী মানুষের।
যতই বাজে লাগুক না কেন ব্যাপার গুলো আমাকে চম্বুকের মতো টানতে থাকে। মাঝে মধ্যেই পিসিকে রুমে পেতাম না। পিসো রিয়ার রুমে থাকতো হয়ত ওখানে যায়। আগে ব্যাপারটা কিছু না লাগলেও যখন থেকে বুঝতে পারি আমার ভীষণ লজ্জা লাগতো। পরের দিন আমি পিসির দিকে তাকাতে পারতাম না লজ্জায় কিন্তু পিসির কোন চেঞ্জ থাকতো না। আমি সেজুতিকে বললে ও বলে,
-দুর বোকা মেয়ে, ওনারা তো জামাই বউ।
একদিন সবাই খেতে বসি। আমি এখনো কোন কাজ করি না। রান্নাবান্না সব পিসি করে। আমি বলি,
-পিসি আরেকটু ভাত দাও না।
তখন পিসি ভাত দিতে দিতে বলে,
-তুই আমাদের মা-বাবা ডাকতে পারিস না?
আমি মুখ ফসকে বলে ফেলি,
-তো উনাকে কি দাদা ডাকতে হবে?
সবাই এত জোরে হেসে উঠে আমি লজ্জায় পড়ে যাই। এই লোকটাকে আমি খেয়ালই করি নি কখনো। কি সুন্দর করে হাসে। চশমা পড়া ছোট খাট ফর্সা মুখে এত মায়া। আমি যে উনার দিকে তাকিয়ে আছি আমি নিজেই জানি না। উনার চোখ পড়তেই ভ্রু কুচকে ইশারা করলেন, কি?
আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেলি লজ্জায়। সে দিনের পর থেকে আমি ওনার আশেপাশে ঘুরতে থাকি। গিয়ে রুম গুছিয়ে রাখি। সে টিভি দেখলে তখন সোফায় গিয়ে বসি। সে কোন দিন কথা বললো তো কোন দিন বললো না। কিন্তু যখন সে বাসায় থাকে না আমার ভীষণ বিরক্ত লাগে। সেজুতিকে বলি, ও বলে, আমি নাকি প্রেমে পড়ছি।
-তাহলে তার ও কি এমন লাগে?
– তা তো জানি না। লাগলে তো সেও তোর দিকে তাকিয়ে থাকতো তোদের মধ্যে এখনো তেমন কোন সর্ম্পক নেই তার ও ইচ্ছে নেই। মে বি তার কোন গার্লফ্রেন্ড আছে।
একদিন পিসিরা এক আত্নীয়কে দেখতে যাচ্ছে। খুব অসুস্থ নাকি। একটু দুরে। আমার কলেজ নেই। উনি ভার্সিটি যাচ্ছিলো। তখন পিসি বললো আমাকেও নিয়ে যেতে। আমি তো ভীষণ খুশি। তারাতারি রেডি হয়ে আসি। খুব সুন্দর করি সাজি, সবুজ জামা পড়ি, কাজল দিয়ে চুড়ি পড়ি।
উনি কিছুক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে।
তার সাথে এই প্রথম রিকসায় উঠেছি অদ্ভুত ভালো লাগছিলো। রিকসায় একটু একটু হাত লাগছিলো। আমি চুপ ছিলাম। সে বলল,
-কি নিয়ে পড়ায় ইচ্ছে আছে তোমার ভার্সিটিতে?
-আমার রসায়ন খুব ভালো লাগে।
-বাহ, বেশ তো। আমিও তো রসায়ন নিয়েই পড়ছি।
আরো কিছু টুকটাক কথা বললেন। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে আছি। ভার্সিটিতে যাওয়ার পর সবাই শুধু জিজ্ঞেস করছিলো আমি কে?
উনি বলছেন, ওর নাম মায়া।
মনে হচ্ছিলো সবাই আমার কথা জানে। আমার ভালোই লাগছিলো। কিন্তু একটা মেয়েকে দেখলাম এসে ধুম করে পিঠে কিল বসিয়ে দিলো। আবার গায়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখে বলল, আদিত্য এইটা কে?
-ও মায়া।
– আচ্ছা তোর পুতুল বউ। বলে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। তখন উনি ওর মুখটা চেপে ধরেছে। মেয়েটা হেসেই যাচ্ছে। আবার কাছে গিয়ে কানে কানে কি যেন বলছে।
কেন জানি না আমার বুকের ভিতর খুব জ্বলছে আমি নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। এমনটা আমার কখনো লাগে নি।
-এই মায়া কিছু মনে করো না, ওর নাম অবন্তি, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বেশি ফাজিল আর কি।
আমি কিছু না বলে একটু হাসলাম। আসার সময় রিকশায় বললাম,
-মেয়েটা কি আপনার গার্লফ্রেন্ড?
-আরে না। ফ্রেন্ড। কেন?
– না আমার বান্ধবীদের দেখি বয়ফ্রেন্ডের সাথে এইভাবে কথা বলে। আর ছেলে মেয়ে বন্ধু হয় নাকি এই শহরে?
– হাহা৷ বোকা মেয়ে। তুমি যখন ভার্সিটি উঠবে তখন তোমারো বন্ধু হবে। তো তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?
আমি খুব রেগে ছিলাম। তখন রাগ দেখিয়ে বললাম,
-আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার বয়ফ্রেন্ড কেন থাকবে?
-তো আমারও তো বিয়ে হয়ে গেছে। আমার কেন থাকবে?
এতক্ষনের রাগ সব পানি হয়ে গেলো। মনে মনে কি যে খুশি লাগছিল৷ সেদিন পিসিরা আসল না। বৃষ্টি তাই। আমার একা ভীষণ ভয় লাগছে। তাই ওনার রুমের ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
– তোমার ভয় লাগলে তুমি এইখানে থাকতে পারো।
আমিও কথা না বাড়িয়ে খাটের এক কোণে শুয়ে গেলাম মাঝে বালিস দিয়ে। কিন্তু ভয় লাগছিল। যদি,
ঘুমের ঘোরে ওনার হাত একবার গায়ে এসে পড়ে আমি আঁতকে উঠে বসে থাকি। সারারাত ঘুম হয় না। সকালের দিকে ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে ঘুম ভাঙ্গে ওনার ডাকে,
-মায়া তুমি এইভাবে বসে আছো কেন?
-আপনি গায়ে হাত দিয়েছিলেন তাই,
-সরি, একা থাকার অভ্যাস তাই। যাও
মা-বাবা এসে গেছে।
আমি রুম থেকে বের হতেই পিসি হাসে।
-কি রে ঘুম কেমন হলো?
-সারারাত তো ঘুমাতেই পারি নি উনার জন্য।
পিসি আর পিসো চোখাচোখি হাসছে।
আমি কিছু না বুঝে আবার বললাম-
-তোমার ছেলে এত হাত পা ছুড়ে উঠে বসে ছিলাম।
তখন পিসি এত জোরে হেসে উঠে আমি লজ্জা পেয়ে যাই। তখন উনি পিছন থেকে আলতো করে মাথায় বারি দিয়ে বলে
-বোকা কোথাকার।
এরপর পিসি আর আমাকে তার সাথে থাকতে দেয় না। এইটা নাকি আমার রুম৷ একদিন সে রুমে ঘুমাতে পারলে প্রতিদিন পারবো। আমি অনিচ্ছা শর্তেই যাই। মাঝেমধ্যে বালিস টপকে হাত এসে গায়ে পড়ে। প্রথম প্রথম বিরক্ত লাগলে। আমি খেয়াল করলাম কিছুদিন পর আমি অপেক্ষা করতাম কখন একটু আঙ্গুলের ছোয়া লাগবে। দুইদিন হাত আর এইদিকে আসে না। আমার ভাল লাগে না। অস্থির লাগে। ইচ্ছে করে গিয়ে হাত টা টেনে এইদিকে নিয়ে আসি। কিছুদিন পর ইচ্ছে করে আমি যাই বালিশ টপকে। একদিন পর খুব বৃষ্টি হচ্ছিল আমি জেগে ছিলাম সেও, আমি বালিশ সরিয়ে নিলে সে পাশ ফিরে। দুইজনের চোখেই সে রাতে হয়ত কিছু ছিলো যা কোন কথায় থাকে না। ভারী নিঃশ্বাস যেন মায়ারজাল।
এরপর শুধু তার স্বার্থপরতার গল্প। তার রোজ আমাকে বুকে নিয়ে ঘুমাতে হয়। একটু নড়াচড়া করা যায় না। নড়লে আরো জোরে চেপে ধরে। আমিও খেয়াল করলাম এরচেয়ে শান্তির ঘুম আমার কোথাও হয় না।
মাঝেমধ্যে রাগ করলে বালিশে শুয়ে পড়তাম তাই বিছানায় শুধু একটা বালিশ।
আমি কোথাও গেলে কি পড়ব আজ অবধি আমি ঠিক করতে পারি না। সে পছন্দ করে দিবে।
আর একটা আপদ, প্রতিদিন সে ফুল নিয়ে আসবে আমার মাথায় লাগাতে হবে। পিসি হাসে। আমার লজ্জা লাগে।
তার কি লাগবে না লাগবে আমাকে দেখতে হবে। মুখে কিছু বলে না। বললে সে বলে,
-আমি যদি বলে দিই, তোমার তো জানা হবে। এখন নিজে বুঝে নাও তাহলে আমায় তুমি আমার চেয়ে বেশি জানবে।
আমি মুখ ভেংছিয়ে বলি,- কত শখ!
– শখ নয় রে বোকা মেয়ে, এইটা ভালোবাসা।
তার ভালোবাসা যেন অত্যাচারে ভরপুর। গভীর ঘুম থেকে টেনে তুলে বলে,
-যাও তো খয়েরী শাড়ি টা পড়ো, আমি চুলে ফুল লাগাবো।
আমি ভয়ানক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি কিন্তু করতে হয়। এরপরে যে সে মুগ্ধ চোখে শুধু চেয়ে রবে তার চোখের সে হাসির জন্য করি।
বৃষ্টির দিনে ব্যলকনিতে নাকি রাত কাটাতে হবে, সে আরেক জ্বালা। যেতে না চাইলে কোলে তুলে নিয়ে যায় চেয়ারে বসে থাকে। আমিও তার বুকে মুখ গুজে শুনতে থাকি, ভালোবাসি ভালোবাসি সে সুরে কাছে দূরে…….
এই যে কেমন ভালোবাসার জ্বালা আমি বুঝি না। সে চোখের ভাষায় নাকি শব্দ বলবে আমাকে বুঝতে হবে। প্রথম প্রথম না বুঝলেও পরে সব বুঝতে পারি।
এখন সব বুঝি পাকা গিন্নি আমি। ছেলেকে শাসন করা কঠিন মা আমি। মা বাবার খেয়াল রাখা বউ আমি। শুধু তার কাছেই রয়ে গেলাম বোকা মেয়ে হয়ে।
তার কাছে গেলে যেন আমি আসলেই বোকা হয়ে যাই। বুদ্ধি সব তার পায়ের কাছে রেখে শুধু ছেড়ে দি নিজেকে তার বুকে যেন নদীর পানিতে চুল খোলা রেখে শুধু গা ভাসিয়ে রাখা।
বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলো ভীষণ খারাপ লাগতো মায়ের জন্য। কেমন যেন একা আর চুপ হয়ে যায়। আমার ভয় হয় ভীষণ ভয় হয়। আমি তো পারবো না এইভাবে একা থাকতে। তার অত্যাচার গুলো ছাড়া তো জীবন ভাবা যায় না।
তাকে ভীষণ ভাবে চেপে ধরি মাঝেমধ্যে, তখন সে আবার হাসে।
-বোকা মেয়ে, কোথায় যাবো? গেলে তোমাকে কে সামলাবে? তোমার শাড়ি কে বেছে দিবে?
এখন বয়স হয়ে গেছে তাও সে আমায় লাল শাড়ি পড়াবে। এখনো কাজল দিতে হয়। লাগাতে হয় ফুল। মানুষে হাসে, কারণ কোথাও গেলে এখনো হাত ধরে থাকে আমি নাকি পড়ে যাবো।
প্রতি পূর্ণিমা এখনো নির্ঘুম চায়ের কাপ হাতে কাটে। এখন ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করতে থাকি এই অত্যাচার যেন শেষ না হয়। থাক না এই অত্যাচারী মানুষটা এমন নতুন নতুন অত্যাচার নিয়ে৷
তার হলো মরণ রোগ। যেতে দেওয়া হয় না তার কাছে আমায়। এই রোগ নাকি ছোঁয়াছে। আমি বলি হোক না আমারো। কি দরকার তাকে ছাড়া আমার একার ভালো থাকা।ছেলে আমায় যেতে দেয় না তার কাছে। আমি ছুটে যাই। নিতে চাই সে রোগ। ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করতেই থাকি রাখো না বাঁচিয়ে আর কিছুদিন এই অত্যাচারী ভালবাসাটাকে।
ভগবান আমার কথা শুনে নি। তাকে নিয়ে গেলো সাথে সব অত্যাচার। আমাকে রেখে গেলো সুস্থ। এই যেন আরো বড় অত্যাচার।সত্যিই এখন আরো বোকা হয়ে গেলাম। শাড়ি বেছে দেওয়ার ঝামেলা নেই, সব লাল নীল শাড়ির রং ধুয়ে এখন সাদা।
তবে অত্যাচার গুলো যে এখনো ভীষণ জ্বালায়। বৃষ্টি রাতে এখনো ঘুম হয় না। বারান্দায় বসে থাকি। তবে এখন যে ভীষণ শীত করে আমার।
#অত্যাচারী_ভালোবাসা
দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা